পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

ইউএনও তারিক যদি সাংবাদিক হতেন

হারুন উর রশীদ : বরগুনা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমন, যিনি এর আগে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ছিলেন, তাকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি কার্ডে ছেপে মানহানি ও ক্ষতিপূরণের মামলায় দুই ঘণ্টার কোর্ট হাজতবাসের জেরে মামলার বাদী আইনজীবী সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ সাজু আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের পদ হারিয়েছেন। এ ঘটনায় বরিশাল আদালতের ছয় পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইউনও’র পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সর্বশেষ খবর হলো তার বিরুদ্ধে মামলাও প্রত্যাহার হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে ইউনও’র পাশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়েছেন বলে।
এখন তাকে প্রশাসনিকভাবে হেনস্তাকারী জেলা প্রশাসক ফেসবুকে ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বিভাগীয় কমিশনার রাজনৈতিক নেতাদের দোহাই দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে মনে হতে পারে, ন্যায় বিচারের ব্যত্যয় কোনোভাবে মেনে নিচ্ছে না প্রশাসন, পুলিশ থেকে দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। আর প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসার আগেই এই ইউএনও’র পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন করেছেন।
ইউএনও গাজী তারিক সালমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করে বিসিএস ২৮ ব্যাচে প্রশাসনে যোগ দেন। তার চাকরির বয়স একযুগের একটু বেশি হতে পারে। এবার একটু কল্পনার জগতে ঘুরে আসি। মনে করি, গাজী তারিক সালমন একজন সাংবাদিক। যদি তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দিতেন, তাহলে সিনিয়র রিপোর্টার হতেন।
তিনি যদি সাংবাদিক হতেন, তাহলে এই পরিস্থিতিতে কী ঘটতো, তা জানার আগে তিনি ইউএনও হিসেবে যা করেছেন, তার কিছু সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তা একবার দেখে নেই। ইউএনও হিসেবে আট মাস আগৈলঝাড়া থাকতে ওইসব কাজের কারণেই প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েন তিনি। আর সেগুলো হলো-
১. ঠিকাদার ও রাজনৈতিক নেতাদের কোনও অবৈধ সুযোগ দেননি। কাজ মানসম্পন্ন না হওয়ায় তিনি তাদের অনেকের বিল আটকে দেন। উন্নয়নকাজের প্রায় কোটি টাকা ফেরত পাঠান। যা প্রভাবশারীরা লুটেপুটে খেতে চেয়েছিলেন।

২. ডিগ্রি পরীক্ষায় নকল করার অপরাধে এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার পুত্রকে তিনি বহিষ্কার করেন। সেই প্রভাবশালী পুত্র ইউএনও’র সঙ্গে বেয়াদবি করলে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে ছয় মাসের জেল দেন।

৩. তিনি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। আর নতুন কোনও অবৈধ স্থাপনা বসতে দেননি।
তার এই কাজ থেকে বোঝা যায়, তিনি একজন সৎ কর্মকর্তা। আর সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও একজন সৎ ও নিরপেক্ষ পেশাদার সাংবাদিক হতেন; এটা ধরে নেওয়া যায়। তিনি আগৈঝাড়ায় ইউএনও হিসেবে যেসব কাজ করেছেন, একজন পেশাদার সাংবাদিকের জন্য ওই কাজগুলোও খুবই আকর্ষণীয় হতো। সাংবাদিক হিসেবে তার কাজগুলোর শিরোনাম যে রকম হতে পারতো-

১. রাস্তা নির্মাণের নামে সরকারি টাকার হরিলুট, নেপথ্যে শাসক দলের প্রভাবশালী নেতারা

২. সরকারি জায়গা দখল করে সরকার দলীয় নেতার মার্কেট নির্মাণ

৩. নেতার ছেলের পরীক্ষা তাই পুরো কেন্দ্রে নকলের স্বাধীনতা

এ রকম আরও অনকে প্রতিবেদন হতে পারতো। শিরোনাম আর না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। এই তিনটি প্রতিবেদনের জন্য সাধারণভাবে সাংবাদিক হিসেবে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে মোট ছয়টি মামলা হতে পারতো। প্রত্যেক প্রতিবেদনের জন্য একটি মানহানি কাম ক্ষতিপূরণের এবং প্রত্যেক প্রতিবেদনের জন্য একটি করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলা।

এখানেই শেষ নয়, যেহেতু তারা প্রভাবশারী রাজনৈতিক নেতা, তাই এরপর তারা ওসি এবং ইউএনওকে হাত করে আরও অনেক মামলা ঠুকে দিত। তার মধ্যে চাঁদাবাজি তো কমন, এমকি ধর্ষণ ও হত্যা মামলাও থাকতে পারতো। ওসি সাহেব পুরনো মামলায়ও ঢুকিয়ে দিতেন। তারপর কী হতো?

তারপর সাংবাদিক গ্রেফতার হতেন। অথবা আদালতে জামিনের জন্য হাজির হলে তাকে জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠান হতো। তাকে জোরে হাতধরে জেলে পাঠানো নয়, হাতকড়া পরিয়ে এমনকি কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পাঠানো হতো। আর এই মামলা হওয়ার আগে সাংবাদিককে কয়েক দফা পেটানো হতো। কিন্তু সাংবাদিকের কোনও মামলা নিতো না থানা। প্রশাসন বলতো ‘হলুদ সাংবাদিক’।

সাংবাদিকদের একাংশ প্রতিবাদ জানাতো আর আরেক অংশ নীরব থাকতো। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব বলতেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে।’ ওসি সাহেব বলতেন, ‘তদন্তের পর দেখা যাবে। তার আগ পর্যন্ত জেলেই থাকবে সাংবাদিক। আর আদালত তো আইনের বাইরে যায় না।’

এমনকি এই সাংবাদিক দেশের উন্নয়নকাজে বাধা দিচ্ছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে বাধা দিচ্ছেন, এমন অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামিও হতে পারতেন।

এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতো, তা আমি কিসের ভিত্তিতে বলছি? দু’একটি উদাহরণ না দিলে মনে হবে আমি গল্প লিখছি।

এক. ২০১৫ সালের মে মাসে মুন্সীগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম হাসান বাদল স্থানীয় আটটি পত্রিকার ডিক্লেয়ারেশন বাতিল করে দেন। আর ১১ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেন। বিষয়টি ছিল প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের অনুষ্ঠানে ডিসির আমন্ত্রণ রক্ষা করেননি সাংবাদিকদের একাংশ। এটাই তাদের অপরাধ।

দুই. ২০১৫ অক্টোবরে খুলনার বটিয়াঘাটার ইউএনও বিল্লাল হোসেন স্থানীয় সাংবাদিক শাহীন বিশ্বাসকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৩ মাস জেল দেন। জেল দেওয়ার পর ইউএনও নথিপত্রও নিজের কাছে রেখে দেন, যেন শাহীন বিশ্বাস জামিনের আবেদন না করতে পারেন। দুই মাস কারাগারে থাকার পর উচ্চআদালত নথি তলব করে তাকে জামিন দেন। বটিয়াখাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি শেখ আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে ইউএনও দু’টি মামলা করেন বলেও অভিযোগ আছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা দুর্নীতি-অনিয়মের খবর প্রকাশ করায় এই ব্যবস্থা নেন ইউএনও।

তিন. ২০১৩ সালের মে মাসে অনিয়ম আর দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় রাজশাহীর পুঠিয়া’র ইউএনও লুৎফর রহমান দৈনিক সমকালের স্থানীয় সাংবাদিক সৌরভ হাবিবের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করান এক সহকারী তহশিলদারকে দিয়ে। মামলায় সরকারি কাজে বাধা দান, চাঁদা দাবি, ভয়ভীতি দেখানো ও মানহানিকর সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়।

চার. ২০১৫ সালে পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ করায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বাংলা ট্রিবিউনের মৌলভীবাজারের প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম। ‘শ্রীমঙ্গল থানার ওসির বিরুদ্ধে হয়রানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ’ শিরোনামে সংবাদ করায় ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশের একটি দল তাকে আটক করে। পরদিন ২৪ এপ্রিল বিকালে গাড়িতে পেট্রোল হামলা ও পুলিশকে আক্রমণের দুই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ৩৮ দিন কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্ত হন।

পাঁচ. এই বছরের জুন মাসে খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সময়ের খবরের স্টাফ রিপোর্টার সোহাগ দেওয়ান ও পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী মোতাহার রহমানের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা তপন কুমার সাহা। যথাযথ তথ্য না নিয়ে মিথ্যা ও মনগড়া সংবাদ প্রকাশের অভিযোগের এই মামলা দায়ের করা হয়।

এই উদাহরণ আরও বাড়ানো যায়। কিন্তু তা না বাড়িয়ে উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে ডিসি, ইউএনও, ওসি, আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা; কেউই সাংবাদিকে রেহাই দেন না। আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের উদাহরণ দিয়ে আপনাদের আর সময় নষ্ট করতে চাই না।

ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে কিন্তু এত সহজে কিছু করতে পারেননি প্রভাবশালীরা। কারণ তিনিও প্রশাসনের লোক, তারও প্রভাব আছে। তাই কৌশলে ধরেছে। শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কার্ড ছাপানোয় ‘বিকৃতি ও অসম্মানকে’ ইস্যু করেছে। তবে এই ইস্যুতে টিএনওকে কিন্তু মামলার আগে শোকজ করা হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে জেলা প্রশাসক শোকজ করেন তারিককে। আর তারিক তার জবাবও দেন। কিন্তু কমিশনারের কাছে জবাব সন্তোষজনক মনে হয়নি। তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানোও হয়েছে। আমার মনে হয়, প্রভাবশালীরা প্রশাসন দিয়েই ইউএনওকে এক দফা ঘায়েল করেছে। তারপর মামলার দিকে এগিয়েছে। মানহানি ও ক্ষতিপূরণের মামলায় আদালত জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ওই দিনই পরে তার জামিন হয়। এরমধ্যে তাকে দু’ঘণ্টা কোর্ট হাজতে থাকতে হয়।

আর এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হয়। অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকরা প্রশ্ন তোলেন, ‘শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কার্ড বানানো কি অপরাধ?’

ফলাফল ইতিবাচক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। তারপর উল্টে যায় প্রভাবশালী নেতাদের ছক।

কিন্তু গাজী তারিক সালমান সাংবাদিক হলে কী এমন হতো? আমার তা মনে হয় না। কারণ প্রশাসন বলতো, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। পুলিশ বলতো, প্রভাবশালীরা বলতেন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সংবাদ মাধ্যম সোচ্চার হওয়ার আগে প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের এই ইউএনওকেই ছাড়েনি। তারা প্রভাবশালীদের কথায়ই কাজ করেছেন। আর এখন ইতিবাচক যা হচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া হয়নি। ঠেলার নাম বাবাজি!

গাজী তারিক সালমন আপনাকে বলছি, আপনি যদি সাংবাদিক হতেন, আর ওই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লিখতেন, তাহলে আপনাকে জেলেই যেতে হতো। আপনাকে হাতকড়াই পরানো হতো। আর এই সাধারণ মামলা নয়। আপনি আরও কঠিক কঠিন মামলার আসামি হতেন। মামলা প্রত্যাহার তো দূরের কথা, কবে জেল থেকে ছাড়া পেতেন, তার কোনও নিশ্চয়তা থাকতো না। এমনকি চাকরিও হারাতে পারতেন। কারণ ওই প্রভাবশালীরা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের ওপরও কখনও কখনও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন।

তারপরও আপনাকে বলি, আশা করি প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা হলেও আপনি নিজের হয়রানি দিয়ে সাংবাদিক হয়রানির বিষয়টি অনুধাবন করবেন প্লিজ।

লেখক: সাংবাদিক

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on ইউএনও তারিক যদি সাংবাদিক হতেন

কার দেয়াল, কার কথা?

তুষার আবদুল্লাহ : ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। সময় নেই চুপ করে বসে থাকার। বলছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাগরিকদের কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরে চা-কফি-ঝালমুড়ির আড্ডাতেও বেশ তাড়া। কোনও কথা নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে আবার কোনও বিষয় বাদ পড়ে যায়। বিষয়ের ফলন বেশ ভালো। বারোমাসি আবাদে নিত্য নতুন ফসল ফলে যাচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে ফরহাদ মজহার, চিকুনগুনিয়া, গৃহকর্মী নির্যাতন, ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের অপরাধে শিক্ষক বহিস্কার, জন্মদিনের নিমন্ত্রণে ডেকে তরুণী ধর্ষণ, বরিশাল সিটি করপোরেশন কাউন্সিলরের ইয়াবা ব্যবসা, সংসদ সদস্যদের মাটিকাটা-মেডিক্যালের মেঝে পরিষ্কার, সংসদ সদস্যের প্রতিপক্ষকে ক্রসফায়ারে দেওয়া, একই বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপর শিক্ষকের ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া। উল্টোপথে বাস চলায় বাধা দেওয়ায় ট্রাফিক সার্জেন্টের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের হামলা। স্কুল ছাত্রীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে আমন্ত্রণ পত্র বানানোর অভিযোগে ইউএনও’কে কারাগারে পাঠানো, টেলিভিশনের দুই তারকার বিবাহ বিচ্ছেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এক শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর আশঙ্কা। এতসব ঘটনার সঙ্গে ভোটের গন্ধ, মন্ত্রী পরিষদে রদবদলের গুঞ্জনতো আছেই।

শহরের রাস্তাগুলোতে এখন আর দেয়ালে লিখন বা ‘চিকা’ মারাতে চোখ আটকায় না। এক সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে উদ্দীপক লিখন চোখে পড়তো। দেয়াল লিখন পাঠ করেই অনেকে বিপ্লবে উদ্দীপিত হয়েছেন। এখন দেয়াল লিখন কমে এসেছে। যতোটুকু আছে সেটা দল ও নেতার প্রশস্তিতে তৈলাক্ত। এর বাইরে শহরের নানা প্রান্তে চলছে ‘সুবোধ’ সিরিজ। কেউ বলছে সুবোধ তুই পালিয়ে যা। এই শহর তোর না। আবার কেউ সুবোধকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য, সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার তাগাদা দিচ্ছে।এই দেয়াল লিখনের বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুকে’ প্রতিদিনই এখানকার নাগরিকেরা নিজ নিজ দেয়ালে ‘চিকা’ মেরে যাচ্ছেন। শহরের বাড়ির দেয়ালে পোস্টার-দেয়াল লিখন নিষিদ্ধ হলেও, ফেসবুকে লিখে যাচ্ছেন সবাই। যে প্রতিবাদ, ঘৃণা ছিল কংক্রিটের দেয়ালে, সেটাই এখন ব্যক্তির দেয়ালে প্রদর্শিত হচ্ছে। একে অপরের দেয়াল লিখনের বিষয়ের সঙ্গে যেমন সহমত পোষণ করছেন। পাশাপাশি ভিন্নমতও দিচ্ছেন। পারস্পরিক বিদ্বেষে যে কুলষিত হচ্ছে না দেয়াল তা কিন্তু নয়, বেশ ভালো ভাবেই হচ্ছে। কেউ কেউ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিব্রত বা হেয় করার জন্যই কেবল লিখে যাচ্ছে। যা দুষিত করছে সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমে ব্যক্তি বা সমষ্টির মতপ্রকাশের দেয়ালটিকে।

কংক্রিটের দেয়াল লিখন স্থায়ী হতো। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সয়ে যেতো কোনও কোনও লাল বা কাল লিখন। নিয়মিত যাতায়াতে পড়া হতো। ভাবনায় নতুন রূপে একেক দিন কথাগুলো ধরা দিতো। শুরুর দিকে মনকে হয়তো কোনও কোনও বাক্য আন্দোলিত করতে পারেনি। কিন্তু সময়ের বাস্তবতায় প্রায় ঝাপসা হতে যাওয়া বাক্যটি কোনও ব্যক্তি কিংবা সমাজকেই নাড়া দিয়ে বসেছিল। ফেসবুকের দেয়াল যে নাড়া দিতে পারে না, দেয় না সেই কথাও বলা যাবে না। শাহবাগের গণজাগরণ ফেসবুক দেয়ালের ফসল। তবে এরপর আর ফেসবুক দেয়ালের সামষ্টিক জাগরণ দেখা যায়নি। কারণ শাহবাগের ফসলে চিটে ধরে গেছিল বলে অনেকের ধারণা। সেই ধারণা থেকেই সামষ্টিক জাগরণের স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে ফেসবুকের নাগরিকেরা। আছে নানা রকম ও নীতিমালার জুজুর ভয়। আছে হুমকি-ধমক।

তাই যতোটা রক্ষণাত্বক ভঙ্গিতে দেয়ালে লিখন, চিকা মেরে যাওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে দেয়ালে লেখার বিষয়ের এতো সরবরাহ যে, কোনও লিখনই স্থায়ী হচ্ছে না। সকালের দেয়ালের লিখন সূর্য মধ্যগগণে আসার আগেই অন্য বিষয় এসে দখল নেয়। পরদিন ভোর হতে বিষয় বদলাতে থাকে। তাই মুহূর্তের লিখন হৃদয়কে বিপ্লবে প্লাবিত করার ফুরসত পায় না। ফেসবুক দেয়ালে লেখা স্লোগান গুলোর অপমৃত্যুর সঙ্গে মৃত্যু ঘটে আমাদের শুভ বুদ্ধিরও।

কিন্তু তারুণ্য বা এই সময় যখন সামাজিক যোগাযোগের নাগরিকত্বের পরিচয়কেই বড় করে দেখছে। গোলককে নিয়ে এসেছে এক উঠোনে। তখন শুভবুদ্ধি, সমাজ বা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিবেদিত জাগরণের উৎকৃষ্ট স্লোগান গুলোর ক্যানভাস হতে হবে ফেসবুক দেয়ালকেই। এই দেয়ালকে দুষিত হতে দেওয়া যাবে না। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং গোলকের স্বার্থে।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on কার দেয়াল, কার কথা?

শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য প্রস্তাবিত বাজেট সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : এ বছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট তথ্যগতভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অবাস্তব। আমরা দেখেছি, বিগত বছরগুলোতে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ ছিল তার সবটা খরচ করা হয়নি। গত বছরের বাজেটের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাস্তবায়িত করা হয়নি। সেখানে বরাদ্দভিত্তিক যে রূপরেখা দিয়েছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী সেটা আসলে খুব বাস্তবসম্মত নয়। বিশেষ করে শিক্ষাখাতে সব সময় বরাদ্দ কম দেওয়া হয়। ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষাখাতে অন্ততপক্ষে ২৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। সেখানে শিক্ষাখাতে এ বছর গত বছরের তুলনায় সামান্যই বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়লেও গড় হিসাবে এর আকার কমে আসছে। অন্যদিকে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই বাজেট হলো তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট এবং ত্রুটিহীন বাজেট। কিন্তু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কম, অন্যদিকে শিল্প-সংস্কৃতিক খাতেও যতসামান্য বাজেট। কাজেই শিক্ষা এবং সংস্কৃতিক খাতে বাজেট বরাদ্দ কম দিয়ে একটি দেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে বা উন্নত হবে এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়।

উন্নয়ন মানে কিছু রাস্তাঘাট নির্মাণ, ধর্মীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন সেটা এক অর্থে উন্নয়ন নয়। অর্থমন্ত্রী তা বোঝাতে চাইলেও আমরা তা বুঝব না। উন্নয়ন মানে হচ্ছে দেশের প্রতিটি মানুষকে পরিতৃপ্ত করার শক্তি যোগানো। অর্থমন্ত্রী শুরুতেই বলেছিলেন, এ বছরের বাজেটে তিনি চাপাচাপি করবেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ বাজেটটাই চাপাচাপিরই বাজেট হলো। কারণ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের পেট এবং পকেটে লাথি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে শিক্ষা এবং সংস্কৃতির জন্য প্রস্তাবিত বাজেট সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত এবং অবাস্তব বলে মনে করি আমি।

পরিচিতি: ইতিহাসবিদ
মতামত গ্রহণ : ফাতেমা-তুজ-জোহরা

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য প্রস্তাবিত বাজেট সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত

‘ বাবারা কি ধর্ষক হয়?’

বিথী হক :

প্রিয় বাবা,
তোমার খবর পড়ার অভ্যাসটা নিশ্চয়ই আছে। গতকালের পত্রিকায়, টেলিভিশনে খবরটা দেখেছো? ‘১২ বছরের কন্যা সন্তান ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, বাবার দ্বারা’! খবরটা শুনে তোমার কেমন লেগেছে তা আমি বুঝতে পারি। আমার তখন ভাবতে খুব ইচ্ছে করছিল, আমি জন্মাইনি। আমার খুব ভাবতে ইচ্ছে করছিল এই পৃথিবীতে আমার কোনও অস্তিত্ব নেই, আর তোমারও নেই। বাবা, তোমার ভালোবাসা-আদর যেমন করে শৈশব-কৈশোর রাঙিয়ে তুলেছিল, এখনও যেমন করে রাঙায় তার রং কি কখনও ওরা দেখেছে বাবা? ওরা জানে বাবারা পৃথিবীকে রঙিন করে রাখে?
সেইসব শীতের রাতে তোমার মনে পড়ে বাবা? উত্তরবঙ্গের হাঁড় কাপানো শীত, রাতের বেলা লেপের ওম ছেড়ে বেরুলে দাঁতে দাঁত লেগে যেত। আমি মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে বাথরুমে যাওয়ার জন্য চিৎকার জুড়ে দিতাম। মা যেন এই দুনিয়ায় নেই এমন করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকতো। আমি কিন্তু ঠিক জানতান, মা জেগে আছে। সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে এখন আমি মরে গেলেও শেষ ভরসা তুমিই। তুমি তখন আমাকে বাথরুমে বসিয়ে দিয়ে হিম বাতাসে একটা শাল পেঁচিয়ে কলতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে, কখনও কখনও আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়েই পড়তাম। আমার শরীর যেন আমার দায় নয়। কোনোদিন দেখিনি তুমি বিরক্ত হয়েছো, বকা দিয়েছো!
একবার তুমি আমাকে বলে গেলে কালোপুরের মেলায় যাচ্ছো। আমার জন্য গোলাপি রঙের মালা কিনে আনবে, আর একটা পুতুল। তারপর সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হলো, তোমার দেখা নেই। হঠাৎ শুনলাম কালোপুরের মেলা থেকে আসার সময় নদীতে একটা নৌকাডুবি হয়েছে। আমি আর মা জড়াজড়ি করে সারারাত বসে ছিলাম। তারপর রাত তিনটেয় খটখটে শুকনো তুমি আর তোমার হাতে গোলাপি মালা দেখে আমার যেন খুশী আর ধরে না। মালা ছুঁড়ে ফেলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমার তখন কী কান্না! মা আর তুমি তো থামাতেই পারলে না, অবশেষে চোখে জল নিয়েই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
বাবা জানো, গতকালের খবর বলছে মেয়েটাকে নাকি তার বাবা ধর্ষণ করেছে! তোমার বিশ্বাস হয় বাবা? ‘বাবা’ শব্দটির সঙ্গে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা যায়? তুমিই বলো! প্লিজ বলো বাবা, এসব যেন ওরা আর না বলে। আমার লজ্জা করে, আমার তোমাকে নিয়ে লজ্জা হয়। আমার লজ্জা হয় এই ভেবে যে মেয়েটি জানলো না, তোমার মতো অসংখ্য বাবা গায়ের রক্ত-চামড়া, স্বপ্ন বেচে বেচে আমাদের বড় করে তুলছে রোজ। আমার লজ্জা লাগে বাবা, মেয়েটি কোনদিন ‘বাবা’ শব্দের প্রেমের স্বরূপ জানবে না।
আমার জানতে ইচ্ছে করে, ওইসব বাবারাও কি তোমার মতো দেখতে হয়? তাদের মাথায়ও কি কালো মিশমিশে কোঁকড়া চুল থাকে, তেলের মতো কালো চামড়া আর ঝকঝকে দাঁত থাকে? আমার জানতে ইচ্ছে করে তারা কি আর সব বাবাদের মতোই? সন্তানের পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হাসতে পারে? ‘সাহারাতে ফুটলরে ফুল’ বলে টান দিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়? ফজরের আযান হলে গা থেকে আলতো করে পুতুলের মতো ছোট ছোট হাত-পা সরিয়ে পা টিপেটিপে মসজিদে যায়? ঈদের দিন ভোরবেলা সাইকেলের সামনে বসিয়ে নতুন জামা কিনতে যায়? এসব উত্তর আমায় কে দেবে? কে নিবৃত্ত করবে আমার হৃদয় পোড়া আগুন। কী দিয়ে কাটবে ভয়ানক এই অনুভূতি? সবাই যখন বলে ‘বাবারা ধর্ষকও হয়’, আমার তখন চোখ ফেটে জল আসে, মরে যেতে ইচ্ছে করে। ‘বাবা’ শব্দটা কানে বাজলেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তোমার চেহারা, সাদা রঙের চুল, ধীর-মিষ্টি কণ্ঠ, ঝকঝকে হাসি। অপমানে আমার মিশে যেতে ইচ্ছে করে।
ক’দিন আগে যখন সৎ বাবা কর্তৃক মেয়ের ধর্ষণের খবর পড়ছিলাম, তখনও নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছিলাম। প্রবোধ দিচ্ছিলাম এই ভেবে যে, সেটা সৎ বাবা। আপন বাবা নিশ্চয়ই এমন হবে না। ভাবছিলাম কন্যা সন্তান আছে এমন মায়েরা দ্বিতীয় বিয়েটা চিন্তা-ভাবনা করেই যেন করে! কিন্তু এখন তো আর নিজের কাছে কোনও যুক্তি অবশিষ্ট নেই। নিজেকে প্রবোধ দিতে আর কোনও অজুহাত এনে সামনে দাঁড় করাতে পারছি না। কী ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে জানো! নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারছি না সৎ বাবার কাছে মেয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে কয়েকবার ভাবা উচিত। মায়েদের কি ভাবনার চর্চা করতে হবে পৃথিবীর সকল বাবাও পুরুষ?
যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিলাম তখন কোথাও যাওয়ার সময় মা বারবার বলতো, বাবা আর আপন ভাই ছাড়া পৃথিবীতে কেউ আর নিরাপদ নয়। মায়ের মতো সব মায়েরাই এই ভাবনার ওপর কন্যাদের নিরাপত্তার ঘরবাড়ি বানায় কিনা তা জানি না, তবে অনেক মা বানায় সে ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। বাবা একবারও ভেবেছ, এখন থেকে পৃথিবীর মায়েরা তাদের সন্তানকে কিভাবে নিরাপত্তার শিক্ষা দেবে? পৃথিবীর সকল পুরুষই পুরুষ, কেউ বাবা নয় বা কেউ ভাই নয় এই বলে? কন্যারা জানবে তার জন্য পৃথিবীর কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই, নিজের ঘর নেই, বারান্দা নেই, চিলেকোঠা নেই? এর চেয়ে বড় ঘটনা, এর চেয়ে বড় লজ্জা, এর চেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন আর কি কিছু আছে?
এসব নষ্ট ঘটনা, সত্য আর নির্জলা বিষের ঠিকানা জানতে পেরে যদি পৃথিবীর কোনও মা আর কন্যা সন্তান জন্ম দিতে না চান, কোনও কন্যা যদি বাবা না চায়, বাবার পরিচয় জানতে না চায়, কোনও কন্যাই যদি জন্মাতে না চায় তখন কি হবে বাবা? তোমার মতো বাবাদের তখন একটা ছোট্ট পুতুল আর তার ছোটবেলার জন্য ঝরঝর করে কাঁদতে ইচ্ছে করবে না বাবা? তোমাকে বলেছিলাম না পরের সবজনমে আমি তোমার সন্তান হয়েই জন্মাতে চাই? আমি আর জন্মাব না বাবা। আমি শুধু চাই ওরা যেন তোমার সন্তান হয়ে জন্মায়। ওরা যেন জানতে পারে বাবা কেমন প্রেমের নাম। ওরা যেন জানতে পারে ‘বাবারা ঈশ্বর হন, ধর্ষক নন’।
লেখক: সাংবাদিক

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on ‘ বাবারা কি ধর্ষক হয়?’

বাবা যখন ধর্ষক

তসলিমা নাসরিন : যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদের খুব অবাক করে না। আমরা মেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি  ঘরে বাইরে ধর্ষণের শিকার হতে। আমাদের ধর্ষণ করে অচেনা লোক, চেনা লোক, আত্মীয় লোক, স্বজন লোক– কে নয়? অনেকে এখনও ভাবে অশিক্ষিত অসভ্য লোকরাই ধর্ষণ করে। ভাবে ধর্ষকরা মানসিকভাবে অসুস্থ। আর কতবার প্রমাণ দেখাতে হবে যে ধর্ষকরা অন্য কোনও জগতের লোক নয়, তারা আমাদেরই বাবা ভাই, আমাদেরই মামা কাকা, আমাদেরই প্রতিবেশি, আমাদেরই বন্ধু? ধর্ষকরা মানসিক হাসপাতালের দরজা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আমাদের ধর্ষণ করছে না। তারা আমাদের ঘর বাড়ির মতই ঘর বাড়িতে বাস করে। তারা আমাদের মতই চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য করে। তারা আমাদের মতই বিয়ে থা করে, সংসার করে, বাচ্চা কাচ্চা করে। তারা আমাদের মতই সকালে দৈনিক পত্রিকা পড়ে। ধর্ষণের খবর পড়ে।

এ সপ্তাহে আমাদের আরও একবার কিন্তু প্রমাণ মিললো ধর্ষকরা শিক্ষিত হতে পারে, সভ্য জগতে তাদের বসবাস হতে পারে। মানসিকভাবে তারা সুস্থ হতে পারে। আরমান হোসেন শব্দ প্রকৌশলী। বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে চাকরি করেন। না, তিনি বেকার নন, দরিদ্র নন। প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করে দিব্যি টিকে আছেন। এই আরমানও বাড়ি ফিরে গিয়ে ধর্ষণ করেন। তার কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণ করেন। কন্যার যখন ১২ বছর বয়স, তখন থেকেই ধর্ষণ শুরু। আজ সেই কন্যার বয়স কুড়ি। কুড়িতে এসে সে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করেছে, আরমানের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে, সে কারণে আমরা জেনেছি ঘটনা। এরকম কত ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। প্রতিদিন মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিবারবেষ্টিত মেয়েদেরও মুহূর্তে অনাথ বানিয়ে দিতে পারে ধর্ষণ। একবার ধর্ষিতা হলে এই পুরুষের পৃথিবীতে মুখরা মেয়েও বোবা হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ধর্ষণ মেয়েদের অবলা আর অসহায় বানিয়ে দেয়।

আরমান হোসেন তার স্ত্রীর কন্যাকে ধর্ষণ করছিল গত আট বছর। স্ত্রী যেহেতু তার কন্যা নিয়েই বাস করছিলেন আরমানের সঙ্গে, খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় আরমানও কথা দিয়েছিলেন স্ত্রীর কন্যাটিকে তিনি নিজের কন্যা হিসেবেই বড় করবেন। জানি না কন্যাকে দত্তক নিয়েছিলেন কিনা আরমান। নিলেও বা না নিলেও কন্যাটির আরমানকে বাবা বলে ডাকার সম্ভাবনা বেশি। ২০০৬ সাল থেকে,  ৯/১০ বছর বয়স থেকে, কন্যাটি আরমানের সংসারে বাস করছে। ২০০৮ সালে আরমান তাকে প্রথম ধর্ষণ করেন, তখন সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী, বয়স সবে ১২।  ১২ বছর বয়সী মেয়ে ধর্ষিতা হলে চমকে ওঠার কিছু নেই। বাংলার গ্রামে গঞ্জে ওই বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। তাদের স্বামী তাদের ধর্ষণ করে প্রতিদিন। আরমান এবং কন্যাটির বয়সী স্বামী- স্ত্রী প্রচুর পাওয়া যাবে খুঁজলে। অসম বয়সীদের যৌন সম্পর্ক নিয়ে কাউকে অবাক হতে দেখিনা। তবে কেন মানুষ আরমানের কীর্তি শুনে চোখ কপালে তুলছে, কেন মানুষ বিস্ময়ে বিমূঢ়! অবিবাহিত মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বলে? নাকি একই পুরুষ মা আর মেয়েতে উপগত হচ্ছে বলে?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে শিশুদের ধর্ষণ করার ইচ্ছে পোষণ করে শতকরা কতভাগ পুরুষ, মনে মনে শিশুদের ধর্ষণ করে কতভাগ পুরুষ, এবং কতভাগ পুরুষ শিশুদের সত্যি সত্যি ধর্ষণ করে। এই সংখ্যা, আমার আশঙ্কা, মানুষ যতটা আশঙ্কা করে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এ কথা স্বীকার করতে দোষ কী যে আমরা মেয়েরা বাস করি ধর্ষকদের সঙ্গে, যে ধর্ষক শিশু থেকে প্রৌঢ় – কাউকে ধর্ষণ করতে দ্বিধা করে না। পুরুষ কি তবে ধর্ষকের জাত? পুরুষ সম্ভবত ধর্ষকেরই জাত। পুরুষের ধর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য আমরা পুরুষকে এই শিক্ষা দিতে চাইছি যে, কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে বা কারও ওপর জোর খাটিয়ে যৌন সঙ্গম করা উচিত নয়। এও বলছি, শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত বয়স্কদের। এই নীতি বা নিয়ম বার বার ভাঙছে পুরুষেরা। তারা আমাদের শিশুপুত্র আর শিশুকন্যাদের শরীর এবং মনকে চরম আঘাত দিয়ে চিরকালের জন্য অসুস্থ করে তুলছে। তাদের যৌনসুখের জন্য আজ মেয়েদের পতিতা হতে হচ্ছে। পতিতালয়ে শিশুরা পাচার হয়ে আসছে, যেন শিশুদের ধর্ষণ করে পুরুষের অঙ্গে সুখ জোটে।  অন্তর্জাল ভরে গেছে শিশুপর্নে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা শিশুদের সুরক্ষা করার বদলে, নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে শিশুদের অপ্রস্তুত শরীরকে লালসার শিকার করে। এই পুরুষের সঙ্গে এক সমাজে বাস করতে আমরা বাধ্য হই। আমরা এত যে তাদের শিক্ষিত করতে চাই, কিন্তু তারা কিছুতেই শিক্ষিত হতে চায় না।  

পত্রিকায় খবর এসেছে, কন্যাকে ধর্ষণ করেছে বলে আরমানের কোনও অনুশোচনা নেই। প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলীরও যদি অনুশোচনা না হয়, হবে কার? এই প্রকৌশলীটি, বলতে পারি, সত্যিকার শিক্ষিত নন। শিক্ষিত হলে নিজের যৌন-আনন্দের জন্য কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ককে তিনি বেছে নিতেন না, বা কোনও প্রাপ্তবয়স্কদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি যেতেন না।

প্রকাশ্যে বা গোপনে আরমানের পক্ষ নেওয়ার লোকের অভাব সমাজে নেই। তারা বলে বেড়াচ্ছে, মেয়ে কেন আট বছর পর প্রতিবাদ করলো, কেন আগে করেনি? বলছে, মেয়ের মা সব জানতো, তার সায় ছিল। মেয়ে আর তার মা’কে দোষী হিসেবে দেখাতে পারলে আরমানকে দোষী বলে চেনা তো যাবেই না, বরং তাকে নির্দোষ নিরীহ পুরুষ হিসেবেই মনে করবে মানুষ। আরমানকে যারা রিমান্ডে নিয়েছে, তাদের একবারও কি মনে হয়নি, ‘আরমান আর এমনকী খারাপ কাজ করেছে, কন্যাটি তো তার নিজের কন্যা নয়! রক্তের সম্পর্ক তো আর নেই?’ মনে মনে জানি না ক’জন আরমানের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে। বিচারকদের মধ্যেও হয়তো কেউ কেউ করবে।
ভালো পুরুষ, শিক্ষিত পুরুষ, সমব্যাথী পুরুষ, যৌন সংযমী পুরুষ কি জগতে নেই? নিশ্চয়ই আছে। আছে বলেই আশা জাগে, ধর্ষক, নির্যাতক, নিষ্ঠুর, অবিবেচক, লোভী, স্বার্থান্ধ পুরুষও হয়তো একদিন মানুষ হবে। শুধু কী আশায় বসতি! পুরুষই জানে তারা আদৌ এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য হতে দেবে কিনা।

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on বাবা যখন ধর্ষক

ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ আ.লীগের

ডেস্ক রিপোর্ট : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সমনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। আাগামী ২৫ জুলাই থেকে শুরু হবে এ কার্যক্রম, চলবে আাগামী বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। ইসির এই ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম ও তাদের তথ্য সংগ্রহ কর্মসূচি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সারাদেশে দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সারাদেশে চিঠি পাঠিয়ে এ নির্দেশ দেন। চলতি সপ্তাহেই ওবায়দুল কাদেরের সই করা এ সংক্রান্ত নির্দেশনার চিঠি সারাদেশের সাংগঠনিক জেলা ও এর অন্তর্ভুক্ত সব কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদক বরাবর পাঠাতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশেই তার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে এ চিঠি পাঠানো শুরু হয়েছে।

ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা ও বেশ কয়েকটি জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সাংগঠনিক জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর সব স্তরের নেতাকর্মীকে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গৃহীত ভোটার তালিকা হালনাগাদের কর্মসূচি নিবিড়ভাবে ও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ এবং সমন্বয় ও তদারকি করার নির্দেশ পেয়েছেন তারা। কেন্দ্র থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি তারা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।

কেন্দ্রভিত্তিক সংসদীয় আসন অনুযায়ী দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয় চিঠিতে।
ওবায়দুল কাদেরের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়নও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দরের সব স্তরের নেতাকর্মীকে এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।

দলের এ নির্দেশনার খবরের সত্যতা বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান। এ নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক ও গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামসুল আলম হিরু।

উল্লেখ্য, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ আগামী ২৫ জুলাই থেকে শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। আগামী বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি ভোটার রয়েছে। প্রতিবছর মোট ভোটারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ নতুন মুখ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পায়।

সূত্র : বাংলাট্রিবিউন।

Posted in নির্বাচিত কলাম, রাজনীতি | Comments Off on ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ আ.লীগের

দুর্ভোগের দখিন দুয়ার

তুষার আবদুল্লাহ : দুর্ভোগের দখিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। সেবকেরা আমাদের এই দুয়ারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাসছি জলে। থমকে আছি জটে। শয্যা নিয়েছি মশকের দংশনে। ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতেই রাজধানীর রাজপথ-গলিপথে হাঁটুজল কোথাও কোথাও কোমরে গিয়ে ঠেকছে। ২৪ ঘণ্টা পরেও অনেক এলাকা থেকে পানি সরছে না। অতিবৃষ্টিতে দুই সিটি করপোরেশনের খুব কম সড়কই আছে, যেখানে খানা-খন্দ তৈরি হয়নি। যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে কোনও কোনও রাস্তা। আবর্জনায় ভরাট হয়ে নর্দমার জল ঢুকে পড়ছে বাসাবাড়িতে। আবর্জনা অপসারণ করা হচ্ছে না অনেক এলাকা থেকে। কোনও কোনও এলাকায় ব্যস্ত সড়কে আবর্জনা এনে জড়ো করাতে বৃষ্টিতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। সঙ্গে আছে যানজট। ঢাকা শহরকে নিয়ে পুলিশ বিভাগের নীরিক্ষা শেষ হয়নি। একেক দিন একেক ভাবে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। যানবাহন চলাচলের জন্য তৈরি সড়ক বা পথ বন্ধ রেখে যানজট নিয়ন্ত্রণের সূত্র আবিষ্কার করছে ট্রাফিক বিভাগ। সঙ্গে আছে ভিআইপির দৌরাত্ম। সবমিলিয়ে যানজট ও অবৈধ পার্কিংয়ে অচল শহর ঢাকা। বাড়তি হিসেবে আছে নানা উন্নয়ন কাজের জন্য ক্ষত-বিক্ষত সড়ক। আর পীড়ন? চিকনগুনিয়া মহামারীর মতোই ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়। এমন কোনও পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যে পরিবার চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়নি।

রাজধানী থেকে চট্টগ্রামের দিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয়। একটি বন্দর নগরী কিভাবে ভাসমান শহর হয়ে গেলো? সেই ভাসমান শহরে নর্দমার পানির তোড়ে হারিয়ে গেলেন একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। একটানা কয়েকঘণ্টা বৃষ্টি হলেই পুরো নগরবাসী পানি বন্দি। খাল-নর্দমা ভরাট হয়ে বৃষ্টির পানি নেমে যেতে পারছে না। পাহাড়ের বালু ও মাটিতে ভরাট হয়ে থাকা নর্দমা পরিষ্কার করা হয় না বলে পানি সরে যাওয়ার পথগুলো প্রায় বন্ধ। শহরের মাস্টারপ্ল্যানকে তোয়াক্কা করেনি নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সিটি করপোরেশন। নগরের কোন কাজ কে করবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চিরবিরাজমান। এই দ্বন্দ্বেই জল আটকে থাকে। আটকে থাকে যানবাহনও। সমন্বয় নেই বন্দরনগরীর উন্নয়ন ও পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কুড়িটির বেশি সেবা সংস্থার মধ্যে। সমন্বয়হীনতা সিলেট, খুলনা, গাজীপুর, রংপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ কোনও সিটি করপোরেশনেই নেই। রাজধানী ঢাকায় কাজ করছে যে পঞ্চাশটিরও বেশি সংস্থা তারাও বিক্ষিপ্ত ভাবে কাজ করছে। যখন একক সিটি করপোরেশন ছিল তখনও কারো সঙ্গে কারো যোগাযোগ বা মান্যগণ্য ছিল না, এখন দুই সিটি করপোরেশনে বিভক্ত হওয়ার পর সেই বিশৃঙ্খলা এখন আরও প্রকট হয়েছে। দেশের সকল নগরে সবাই উন্নয়নের একক নৈপুণ্য দেখাতে চায়। এই প্রবণতা যেমন সংস্থার রয়েছে, তেমনি ব্যক্তিরও। একক নৈপুণ্যে কোনএ সমাধান বা জয় আসে না। নগর সেবা দলবদ্ধ প্রয়াসের বিষয়। কিন্তু নগরপিতারাও মনে করেন তারা একক ভাবে নগরবাসীকে ‘ইউটোপিয়া’তে নিয়ে যাবেন। তাদের এই ভাবনায় যে ভেজাল আছে তার প্রমাণ একেকটি শহর কেমন দিনকে দিন দুর্ভোগের ভাগাড় হয়ে উঠছে।

রাজধানী, বন্দরনগরী, মহানগরের এই রূপ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নে সংক্রামিত হয়েছে। সেখানেও উন্নয়ন এবং উন্নয়নকাজের তদারকির মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই। ফলে বাঁধ তৈরি হচ্ছে অপরিকল্পিত ভাবে। কোন এলঅকা, কোন নদীর জন্য কত উচ্চতার বাঁধ হবে, তা বিবেচনায় থাকছে না। বাঁধ মেরামত ও রক্ষাতেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। ফলে বৃষ্টি হওয়া মাত্র বা নদীতে পানি বাড়লেই বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ফসলী জমি এবং বসত এলাকায় ঢুকে পড়ছে। হাওড়ের বাঁধ কেমন হবে, কিভাবে রক্ষা হবে তা নিয়েও পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। ঘাটতি আছে জেলা, উপজেলার রাস্তা মেরামত কাজেও। পার্বত্য এলাকার  পাহাড় কাটা বন্ধ করা, পাহাড়কে রক্ষার জন্যও কোন সমন্বিত উদ্যোগ নেই। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র অবধি উন্নয়ন কাজে বাজেট বরাদ্দে ঘাটতি কমে আসলেও, কমে আসেনি কাজ নিপুন ভাবে করার সক্ষমতা এবং তদারকির দায়িত্বশীলতা। এই ঘাটতি এবং দায়িত্বহীনতাই এখন রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সংকট। এই সংকট থেকে না বের হতে পারলে উন্নয়নের মহাসড়কে চলাচল সুখকর হবে না। বরং মহাসড়কে উঠতে না পেরে দুর্ভোগের দখিন দুয়ারেই দাঁড়িয়ে থাকবো।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on দুর্ভোগের দখিন দুয়ার

এভারেস্ট ও বাংলা চ্যানেল: কেনো আমি চুপ থাকি?

মুসা ইব্রাহীম : এভারেস্টে জয় আর বাংলা চ্যানেল পাড়ি নিয়ে ফের ধুন্দুমার পরিস্থিতি শুরু হয়েছে দেখলাম। যারা গালাগালি করছি, তাদের প্রোফাইলটা ঘুরে আসার চেষ্টা করেছি এই কয়েকদিনে। সবাই হাসিখুশি, উচ্ছ্বল। বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায় আছেন। সবাই একই ব্যাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন: মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে সবাই ছি ছি করছে। কিন্তু সে কেনো কথা বলে না? কেনো কথাবার্তার প্রতিবাদ করে না বা অভিযোগ খণ্ডায় না? এ প্রসঙ্গে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের একটা কথা মনে পড়ে গেল, ‘নষ্ট চোখে নীল আকাশে ওড়া পাখিটাকেও ময়লা মনে হয়।’

সুতরাং ফেসবুকে সবার মন্তব্য দেখে যেটা বুঝলাম, বক্তব্যগুলো এমন: আমি এভারেস্টে যাইনি, বাংলা চ্যানেলও পাড়ি দেইনি। কিংবা দিলেও পুরো পথ নৌকায় পাড়ি দিয়ে পাড়ের কাছাকাছি এসে ক্যামেরা দেখে সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে কিছুটা সাঁতরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছি, যাক বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়েছি(!)। বিষয়গুলো নিয়ে সবাই মন্তব্য করছেন। কেউ দুয়ো দিচ্ছেন। কেউ আবার বাপ-মা তুলে গালি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছেন। আমার চুপ করে থাকাটাকে যদি দুর্বলতা হিসাবে গণ্য করেন, এটা একান্তই আপনাদের বিবেচনা। তবে, মানুষ কতোখানি নিচে নামতে পারে, সেটা বলার মধ্যে আমি কোনো কৃতিত্ব খুঁজে পাই না। ফেসবুকে সবাই জাজমেন্টাল। গুড, ভেরি গুড। তাহলে আসুন, দেখে নেয়া যাক, কেন আমি চুপ করে থাকি? সবার দাবিতে কিছু কথা প্রকাশের গুরুত্ব বিবেচনা করছি।

১.
আপনাদের ঔৎসুক মনের জবাব দিতে গিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। তখন বিএমটিসির যুগ। আমি ছিলাম সেই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, আর ইনাম আল হক সভাপতি। আমার কাঁধ তখনো তেমন চওড়া নয়, কিন্তু দায়িত্ব বিশাল। সেই সঙ্গে পর্বতারোহণে আমাদের ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ যুগ চলছে। সবমিলিয়ে নতুনত্বের উদ্দীপনা ছিল, সবার উচ্ছ্বাস ছিল। কিন্তু এসব মিলিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। একবার ইনাম আল হক গেলেন নেপালের আইল্যান্ড পিক বেস ক্যাম্প ট্রেকিংয়ে, ২০০৫-০৬ সালের দিকে। ফিরে এসে তিনি লিখলেন, আইল্যান্ড পিক জয় করেছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো বলছেন আইল্যান্ড পিকের বেস ক্যাম্প পর্যন্ত গিয়েছেন। কিন্তু পিক জয়ের কথা লিখলেন কেনো? তার বক্তব্য ছিলো, বিএমটিসি নতুন। তার কিছু সাফল্য প্রয়োজন। তাই একে আইল্যান্ড পিক জয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। কিন্তু আমি দৃঢ় অবস্থান নিলাম এবং বললাম যে, আপনি যেহেতু পর্বত জয় করেননি, আপনার আদৌ তার প্রস্তুতি ছিল না, কাজেই আপনি এটা লিখতে পারেন না। সে যাত্রায় বিএমটিসির মুখপত্র ‘শিখর পেরিয়ে’তে তার আইল্যান্ড পিকের বেস ক্যাম্প অবদি ট্রেকিংয়ের গল্প ছাপা হয়েছিল।

সেবার ইনাম আল হকের নতুন এক চেহারার সঙ্গে পরিচিত হলাম। অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করার তার এই প্রবণতা সম্পর্কে আমাকে বহু মানুষই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ভেবেছিলাম, হয়তো নিছকই ভুল করে তারা সতর্ক করেছিলেন। পরে সজল খালেদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ইনাম আল হক যেভাবে কর্মসিদ্ধি করেছেন এবং যেভাবে সজল খালেদ বিএমটিসির পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়ে নিজে কষ্ট করে এভারেস্টে গেছে, সবমিলিয়ে সজলের জন্য খুব খারাপ লেগেছে। বিশেষ করে সজলের সন্তানের এমন পিতৃবিয়োগ একেবারেই মেনে নিতে পারিনি। সজল প্রথমবার ২০১১ সালে যখন এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন, সেবার এমএ মুহিতও গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা দুই জন একই ক্লাবের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যাওয়ার আগে আলাদা করে প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন। ব্যাপারটা শুধুমাত্র আর্থিক কারণে কি? অনেকেই বলেন, এটাও ইনাম আল হকের অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করার একটা ঘটনাক্রম। সেবার ব্যর্থ হয়ে ফিরলে ২০১৩ সালে সজল ফের এভারেস্ট যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এবার তাকে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়। যতোদূর শুনেছি, তিনি তার নবনির্মিত ছবি একটা চ্যানেলে জমা দিয়ে এবং আরও কিছু অর্থ সংগ্রহ করে তিনি এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন। মূলত আর্থিক সংকটের কারণে ২০১৩ সালে সজল এভারেস্ট জয় করে ফেরার সময় করুণ পরিণতির শিকার হয়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে সজলকে ২০১৩ সালে ইনাম আল হক তথা তার ক্লাব বিএমটিসি কোনো আর্থিক সহায়তা করেনি; কোনো ধরনের সহায়তা করেনি; এভারেস্টে যাওয়ার আগে ইনাম আল হকরা তাকে নিয়ে কোনো প্রেস কনফারেন্স করেনি। অথচ সজলের মৃত্যুর পর তার নামেই অর্থ সংগ্রহ করে এই ক্লাবের সদস্যরা নেপালে পর্বতারোহণে গেছেন, সজলের নামে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নেপালে স্থাপন করার নাম করে। এটাই মনে হয় বাংলা প্রবাদের সাক্ষাত উদাহরণ: সাপও মরলো, লাঠিও ভাংলো না। সজলকে মূল অভিযানে, এভারেস্টে সহায়তা করলেন না, অথচ তার নামে টাকা নিয়ে পর্বতারোহণ ঠিকই করলেন।

২০০৬ সালে বিএমটিসির পক্ষ থেকে ভারতের সিকিমের ফ্রে পিক অভিযানে গেলাম আমি আর সজল খালেদ (মোহাম্মদ খালেদ হোসেন)। ভারতের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট (এইচএমআই) এ অভিযানের আয়োজন করেছিল। সে সময়ে এইচএমআইয়ের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মেজর কেএস ধামি। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। তারই সঙ্গে যোগাযোগের প্রেক্ষিতে তিনি যখন এ অভিযানের প্রস্তাব দিলেন, তখন তা লুফে নিয়েছি। এ অভিযানের কিছু আগেই সজল খালেদ জার্মানি থেকে ফিরে বিএমটিসিতে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েই একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। মীর শামছুল আলম বাবুকে বিএমটিসি থেকে বের করে দিলেন। যদিও এ সময় ইনাম আল হক ফ্রে পর্বতের সঙ্গী হিসাবে হয় বাবু, নয়তো সজলকে বেছে নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় সজলকেই এই পর্বতাভিযানের সঙ্গী নির্বাচন করেছিলাম। দার্জিলিংয়ে গিয়ে শুনি যে, আয়োজনের সুবিধার্থে এইচএমআই এই অভিযান এক বিশেষ অ্যাডভান্স কোর্সের অংশ হিসাবে উপস্থাপন করছে। সঙ্গে থাকবে ভারতের সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের একটা গ্রুপ। এইচএমআইয়ের প্রশিক্ষক ‘নিডুপ ভুটিয়া’র নেতৃত্বে কমান্ডো দলের সব সদস্য এবং আমরা – সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ জন এই অত্যন্ত টেকনিক্যাল ক্লাইম্বিংপূর্ণ পর্বত জয় করেছিলাম। এতোজন এক সঙ্গে ফ্রে পর্বত জয় একটা রেকর্ড বলে জানিয়েছিলেন নিডুপ ভুটিয়া। তবে সামিটের দিনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল। অভিযানের সঙ্গী এইচএমআইয়ের তৎকালীন প্রশিক্ষক বাঙালি সঞ্জয় ভৌমিক শুরু থেকেই সামিটের দিকে যাত্রা বাদ দিয়ে নিচের দিকে নামার ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু অপর প্রশিক্ষক ঝুনা ঠাকুর বারবারই বলছিলেন, এতোদূর যেহেতু এসেছি, বাকিটুকুও আমরা আরোহণ করে চূড়া জয় করতে পারব। তার উৎসাহেই মূলত এদিন ফ্রে পর্বত জয় সম্ভব হয়েছিল। প্রায় ১৯ হাজার ফুট উঁচু ফ্রে পর্বত অভিযানের পুরো বর্ণনা সবই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘পাহাড় চূড়ার হাতছানি: কেওক্রাডং থেকে এভারেস্ট’ শীর্ষক বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

পরে অবশ্য মীর শামছুল আলম বাবু সঞ্জয় ভৌমিকের কথা রেকর্ড করেছেন, যার বরাত দিয়ে একাত্তর টিভি রিপোর্ট করেছে যে আমি নাকি ফ্রে পর্বত জয় করিনি। তাহলে বলতে হয় যে, বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এইচএমআইয়ের সে সময়ে ভীমরতি হয়েছিল দেখে আমাদের এমন ভুলভাল সনদ দিয়েছিল। আর যদি তাই হয়, তাহলে কেউ কেনো এইচএমআইয়ে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করলো না? কেনো শুধু সঞ্জয় ভৌমিকের কথা রেকর্ড করতে হলো? কেনো অভিযানের টিম লিডার নিডুপ ভুটিয়ার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনীয়তাবোধ করলো না? কেনোই বা এইচএমআইকে সংশয় জানিয়ে এই সনদ বাতিলের জন্য কেউ লিখলো না? সেটা কি এই এইচএমআই এমএ মুহিত, নিশাত, বাবুসহ অনেকেরই পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বলে? না কি কারো বুকের পাটা হয়ে উঠলো না? আপনাদের সাহস থাকে তো গিয়ে এইচএমআইকে চ্যালেঞ্জ করুন। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি: যদি এইচএমআই বলে যে, সেই বিশেষ অ্যাডভান্সড কোর্সের অংশ হিসাবে সেবার প্রশিক্ষণার্থীরা ফ্রে পর্বত জয় করেনি, তাহলে এই সনদ ত্যাগ করবো।

ইনাম আল হকদের নীচু মনমানসিকতায় অসহায় বোধ করি। তারা হয়তো নেপালের পর্বত জয় করেছেন, কিন্তু মনের পর্বত এখনো জয় করতে পারেননি। পারেননি দেখেই নিজেদের চুলু ওয়েস্ট অভিযানে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে দোষ চাপাচ্ছেন অন্যের ঘাড়ে। ২০০৭ সালে সেই অভিযানে দলনেতা সাব্যস্ত করে দিয়েছিলেন ইনাম আল হক, সজল খালেদকে। একটা পর্বত অভিযানকে কিভাবে লেজেগোবড়ে করতে হয়, তা এই অভিযানে না গেলে বুঝতে পারতাম না। অভিযান আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সঙ্গে কতোভাবে দুর্ব্যবহার করা যায়, কতোভাবে পোর্টারদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করা যায়, সবই করে দেখিয়েছেন অভিযানের দলনেতা সজল খালেদ। সবশেষে যখন এমএ মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে চূড়ায় না গিয়েই হাইক্যাম্পের পাশে একটি পাহাড়ে গিয়ে যেভাবে ‘সামিট সামিট’ বলে চিৎকার করছিলেন, তা দেখে হাইক্যাম্পে তাঁবুতে বসে বেশ পুলকিত অনুভব করছিলাম। ভেবেছিলাম, ইনাম আল হক যোগ্য শিষ্য তৈরি করেছেন তাহলে। চূড়ায় না গিয়েই সামিটের দাবি। পরে এমএ মুহিত আর সজল খালেদ নেপাল থেকে এর সনদও নিয়েছিলেন। পর্বত জয় না করেই সনদ! দেশে ফিরে যখন পুরো বিষয়টা অনুধাবন করে ইনাম আল হককে বলেছি, তখন তিনি কার্যত আমাকে নিষ্ক্রিয় থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টা আমার জন্য সম্মানহানিকর বিবেচনায় বিএমটিসি পরিত্যাগ করে সে বছরই নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এর পুরো আদ্যোপান্ত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘পাহাড় চূড়ার হাতছানি: কেওক্রাডং থেকে এভারেস্ট’ শীর্ষক বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চান, তাহলে অনুগ্রহ করে এমএ মুহিতকে সঙ্গে আনবেন। কারণ, চুলু ওয়েস্ট পর্বত জয় না করেই সনদ নেয়ার কৃতিত্ব যে দুই জনের, তার মধ্যে সজল খালেদ এখন প্রয়াত।

লাংসিসা রি পর্বতাভিযান নিয়ে ইনাম আল হক, বেনু আর মীর শামসুল আলম বাবুর মিথ্যাচারের জবাব ২০১৪ সালে এটিএন নিউজে এক অনুষ্ঠানেই দেয়া হয়েছিল। তারপরও সবার জ্ঞাতার্থে আবারও বলছি, বিএমটিসি ছেড়ে দেয়ার পর নিজেরা যখন নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশ (এনএসিবি) প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সে সময় বাংলাদেশ থেকে এভারেস্ট জয় এবং এভারেস্ট শীর্ষে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল এনএসিবিকে বাংলাদেশের সবার জন্য একটা সাধারণ প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তোলার এবং ২০১০ সালে যে এভারেস্ট অভিযানের পরিকল্পনা ছিল, সেটায় যেন এনএসিবিকে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে, সার্বজনীন হয়। সে উদ্দেশ্যে এর প্রাথমিক ধাপ লাংসিসা রি অভিযানে দলে নেয়া হয়েছিল এনএসিসির দুই সদস্য ছাড়াও এনএসিবির বাইরে মীর শামসুল আলম বাবু, রিমন ও তার বোনকে। আমাদের ছয় জনের জন্য তিন লাখ টাকা প্রয়োজন হলেও আমরা মাত্র অর্ধেক টাকা স্পন্সরদের কাছ থেকে নিয়ে নেপালে হাজির হয়েছিলাম। নেপালে যেখানে সব অভিযানই ‘প্রিপেইড’ সিস্টেমে হয়, সেখানে মাত্র অর্ধেক টাকা নিয়ে নেপালে হাজির হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। কিন্তু আমি মরিয়া ছিলাম এ অভিযানকে সফল করে তোলার জন্য। এনএসিবি থেকে এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার প্রথম ধাপেই আমি মুখ থুবড়ে পড়তে চাইনি। এ পরিস্থিতিতে আমার বিশেষ অনুরোধে নেপালের বন্ধু কোমল অরিয়াল এবং সারিন প্রকাশ প্রধান আমাকে বাকি টাকা ধার দিয়ে আমাদের সহায়তা করে। এজন্য তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অভিযান শেষে যখন দেশে ফিরেছি, তখন সময় ঘনিয়ে এলো লাংসিসা রি অভিযানের ধার করা অর্থ ফেরত পাঠানোর। কিন্তু ভিন ক্লাবের সদস্যরা ‘এটা নিয়ে আজ নয়, কাল বসব’ ধরনের কথা বলে এড়িয়ে যেতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে মীর শামসুল এই অর্থ পরিশোধে পুরোপুরি অপারগতা প্রকাশ করলেন।

এ অভিযানে মীর শামসুল আলমের একটা দায়িত্ব ছিল। তিনি পুরো অভিযানের ভিডিও ডকুমেন্টারি করে দিবেন। অভিযান শেষে দেশে ফিরে যখন তাকে ডকুমেন্টারিটা বানিয়ে দিতে অনুরোধ করলাম, তিনি ‘আজ দেবেন, কাল দেবেন’ করে মাস তিনেক সময় পার করলেন। এরপর যা বানালেন, তা অনেকেরই মনোপূত হলো না। তাকে ডকুমেন্টারিটা ‘রিটাচ’ করতে অনুরোধ করায় তিনি আর সেই অনুরোধ রাখলেন না।

এই অভিযান শেষে যখন আমরা অন্নপূর্ণা ফোর পর্বতারোহণে যাওয়ার দল গঠনের চেষ্টা করছিলাম, সে সময়ে মীর শামসুল আলম বাবুর একটা এসএমএস এলো: ‘আই ক্যান ডু দি ভিডিও’। এটা দেখে বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলাম। যাই হোক। তাকে যখন দলে নেয়া হলো না, তিনি গল্প ফাঁদলেন লাংসিসা রি আমরা জয় করিনি। এমনই তাদের আত্মসম্মানবোধ! এবার ভিডিওটা দেখুন এবং সিদ্ধান্ত নিন: https://youtu.be/qH1RVyIDlC4 এবং https://youtu.be/3M3kQuhY-kk। মীর শামসুল আলম বাবুর এমন বিরোধিতা দেখে মনে হয়, আমরা সবসময় পাহাড়ে পিকনিক আয়োজন করি, তিনি সেখানে অংশ নেয়ার ‘সামান্য’ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মাত্র।

অন্নপূর্ণা ফোর নিয়েও আপনাদের এন্তার অভিযোগ। সব অভিযোগের জবাব সেই ২০১১ সালেই দেয়া হয়েছিল। অনুগ্রহ করে দেখে নিবেন: http://fusionfactory.blogspot.com/2…। তারপরও যদি আর কোনো বক্তব্য থাকে, সোজা চলে যান নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনে। অভিযোগ দায়ের করুন সেখানে, যেমন করেছিলেন ইনাম আল হক, মীর শামসুল আলম বাবু এবং শাহজাহান মৃধা বেনু।

২.
বলটা নিজেদের মতো করে খেলতে না পারলে ইনাম আল হকরা সবসময়ই বেসুরে খেলেছেন। ইনাম আল হক, সজল খালেদ, তারেক অনুদের আরও নিচে নামাটা শুরু হয়েছিল, ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৫ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছানো আর ৫টা ১৬ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো’র পর। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ। তবে আমি এভারেস্ট চূড়া জয় করে বেস ক্যাম্পে নেমে আসার পরপরই এক সাংবাদিক ফোনে বললেন, মুসা আপনি কি সার্টিফিকেট পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেনো এই প্রশ্ন? উত্তরে সেই সাংবাদিক বলেছিলেন, ঢাকায় সজল খালেদসহ বেশ কয়েকজন একটা ‘চেইন ইমেইল’-এ আপনার এভারেস্ট জয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আর বলেছে, আপনি এভারেস্ট জয়ের সার্টিফিকেট না পেলে সেটাকে ‘অফিসিয়াল’ বলে মানা নাকি সম্ভব নয়। শুনে মনটা ছোটো হয়ে গিয়েছিল। কারণ, আমাদের গ্রুপে তিনজন মন্টেনেগ্রিয়ান ছিলেন, যারা প্রথমবারের মতো তাদের দেশ থেকে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বেস ক্যাম্পে স্বয়ং তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ফোন করেছিলেন। আর আমাদের দেশের কতিপয় ব্যক্তি তখন উঠে পড়ে লেগেছিলেন প্রমাণ করতে যে, ‘এভারেস্ট জয়টা মুসা ইব্রাহীমের দাবি। ব্যাটা আদৌ এভারেস্টে যায় নি, গিয়েছিল চট্টগ্রামের পাহাড়ে’। এই বলার চলটা শুরু করে গিয়েছিলেন প্রয়াত সজল খালেদ । ২০১০ সালে ২৩ মে আমি এভারেস্ট জয়ের পরপরই (২৪ মে ২০১০) তিনি সবাইকে ইমেইল করে জানিয়েছিলেন, মুসা ইব্রাহীম এভারেস্টে যায়নি। পরে আবার এক বিবৃতিতে (২৭ মে ২০১০) জানিয়েছিলেন যে, তার বক্তব্য ভুল ছিল।

কিন্তু যারা সংশয়বাদী, তারা কি এমন সহজে এসব মানবেন? তারা আসলে মানতে পারেননি। ফলে এই গোষ্ঠী – যার শিরোমনি ইনাম আল হক, সহযোগী সজল খালেদ, তারেক অনু, এমএ মুহিত, মীর শামছুল আলম বাবু, শাহজাহান মৃধা বেনু প্রমুখ – শুরু করেছিল প্রচারণা। আর সচলায়তনের কতিপয় ব্লগার শুরু করেছিলেন অনলাইনে ব্লগিং – নেভারেস্ট। সেই ঘৃণ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি তারা নিজেরাই করেছিলেন, যখন অনেকেই আমার এভারেস্টের ছবি সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপের ফটো ফরেনসিক ল্যাব থেকে ফরেনসিক টেস্ট করিয়ে আনলেন এবং বললেন যে, কোনো ছবিতে একটা পিক্সেলেরও হেরফের করা হয়নি, সব মেটাডেটা ঠিক আছে – তখন এই ন্যাক্কারজনক ব্লগিং থেমেছিল। আমার এভারেস্ট জয়ের ছবি নিয়ে জ্যামিতিক বিশ্লেষণ দেখুন এখানে: http://www.sachalayatan.com/arifjebtik/35602

এই ব্লগ এবং তার ২৫০টা কমেন্ট পড়ে এসে এরপর আলোচনা করুন। ফেসবুক যুগের আগে ব্লগ ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। সেখানেই তখন আলোচনা হয়েছিল। আমার ছবি মিথ্যা প্রমাণ করতে না পেরে অনেকেই পিছু হটেছিলেন। আমাকে নিয়ে আরও প্রোপাগান্ডার জবাব ১: http://fusionfactory.blogspot.com/…/07/blog-post_2489.html এসব নিয়ে সচলায়তনে হিমুর করা বিশ্লেষণের উপসংহার: http://www.sachalayatan.com/himu/35653 আচ্ছা যারা তখন আমার বিরু‌দ্ধে প্রচারণা চা‌লি‌য়েছি‌লেন তারা কী কেউ ক্ষমা চে‌য়ে‌ছি‌লেন?

৩.
২০১১ সালে ইনাম আল হক, সজল খালেদরা টাকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে লেখানোর লোক খুঁজছিলেন। একজন প্রকাশ করেছিলেন সেই ষড়যন্ত্রের কথা। আরো অনেকে যে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, তা অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখায় শুনুন সেই ষড়যন্ত্রের কথা। এটি দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ব্লগে প্রকাশ করেছিলেন ২ অক্টোবর ২০১১ সালে।

একটা অন্যায়ের ভয়

‘যারা পর্বতারোহন করে, তাদের মন হবে পর্বতের মতো বিশাল। কিন্তু আফসোস, আমাদের দেশের পর্বতারোহীরা ওপরে উঠতে থাকে, আর মনটা নিচে নামতে থাকে।’

: আমাদের এক শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, সাহিত্যিকের বলা কথা উদ্ধৃত করলাম।

কথাটির সত্যতা কিছুটাও হলে টের পাচ্ছি। সবাই হয়তো নন, তবে পর্বতারোহীদের কারো কারো চেহারা বড় নোংরা হয়ে ধরা দিল আমার কাছে।

এতো ভনিতা না করে আসল গল্পটাই বরং বলে ফেলি।

গত সোমবার গভীর রাতের ঘটনা। আমার ফেসবুক বন্ধু কাজী মামুন আমাকে ফেসবুকে একটি ম্যাসেজ পাঠালেন। ম্যাসেজটির ভাষ্য এরকম যে, আমি পর্বতারোহন বিষয়ে কিছু লেখালিখি করতে চাই কি না?

পর্বতারোহন বিষয়ক আমার সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবনের কিছু টিলায় জান হাতে নিয়ে হাচড়ে-পাচড়ে ওঠা। হাইট-ফোবিয়া, ক্লাস্ট্রো-ফোবিয়া দুটোই আছে বলে পর্বতারোহন বা বিমানে চড়ার কোনোটির প্রতিই কোনো টান অনুভব করি না। তারপরও লিখতে বাধা কোথায়?

বিশেষ করে নগদ-নারায়ন প্রাপ্তির যেহেতু সম্ভাবনা আছে, তাই রাজি না হয়ে উপায় কী? ছা-পোষা সাংবাদিক; বাড়তি দুই পয়সা আয় হলে মাস শেষে ধার-দেনার পরিমাণটা কমে। তাই বদর বদর বলে হ্যাঁ বলে দিলাম। এবং তারই ধারাবাহিকতায় সজল খালেদকে ফোন করে দিলাম।

সজল খালেদের নামটি পরিচিত। একজন অভিযানপ্রিয়, পর্বতারোহী হিসেবে তার পরিচিতি আছে। কৌতুহলী মানুষ হিসেবে তার নাম এবং কাজ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা ছিল। তাই অনুমান করলাম, হয়তো কোনো বই অনুবাদ-টনুবাদের কাজ দেবেন।

আমার মোবাইলের লগবুক সাক্ষ্য দিচ্ছে, রাত ১২টা ৮ মিনিটে আমি তাকে ফোন করলাম। আমার আগ্রহের কথা বলার পর তিনি বললেন, পরের দিন সকালে, মানে গতকাল, তিনি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করবেন। ফুটনোট হিসেবে জুড়ে দিলেন, কাজী মামুন যেহেতু আমাকে সুপারিশ করেছেন, তাই কাজ পাওয়া একরকম নিশ্চিত।

গতকাল সকালে নয়, দুপুর ১টা ২২ মিনিটে সজল খালেদের ফোন এল। তিনি প্রথমেই আমাকে বললেন, আগামী শুক্রবার আমি শাহবাগের দিকে আসতে পারবো কি না? সময় আটটা, সাড়ে আটটা।

সে সময় আমি অফিসে থাকি; শুক্রবার ছুটি নেই। তাই একটু ‘তো তো’ করতেই সজল খালেদ বললেন, আসাটা জরুরি এই জন্য যে, যে বিষয় নিয়ে আমাকে লিখতে হবে; সেটি সরাসরি আমাকে ব্রিফ করবেন ইনাম আল হক।

নামটা শুনে চমকে উঠলাম। পক্ষীবিশারদ, বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমী, অভিযানপ্রিয়; সবমিলিয়ে রোমাঞ্চকর সেই মানুষ ইনাম আল হক! আমার মতো নগণ্য মানুষের সঙ্গে তিনি কি কথা বলবেন?

শুধু কথা নয়, সজল খালেদ জানালেন, ইনাম আল হক আমার লেখা তৈরি করার স্বার্থে কিছু ডকুমেন্টসও আমাকে দিয়ে দেবেন। এরপর বললেন, বিষয়টা নিয়ে তারাও লেখালিখি করতে পারতেন; কিন্তু নৈতিকতায় বাধে বলে তারা নিজেরা এসব করবেন না। এ জন্য একজন সাংবাদিক খোজ করছিলেন। আর এসব কথার মাঝে মাঝে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে বলে দিলেন, আমাকে সম্মানীটা মন্দ দেওয়া হবে না।

কিন্তু একটু কেমন ভয় ভয় লাগল। ব্রিফ, ডকুমেন্টস, এথিকস; এগুলো শব্দ শুনলে কেমন যেন সিক্রেট-অপারেশন জাতীয় কিছু মনে হয়। তাই সজল ভাইকে প্রশ্ন করলাম, আসলে কি নিয়ে লিখতে হবে? একটু যদি ধারণা দিতেন….

উনি একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আসলে আমরা ওই ক্যাম্পেইনটা আবার শুরু করতে চাই।”

:কোন ক্যাম্পেইনটা!

:ওই যে হিমু যেটা করেছিল।

প্রথমটা মনে করতে পারলাম না। ইন্টারনেটে আমার বিচরণ বেশি নয় তো, তাই। পরে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সচলায়তন ব্লগে হিমু নামে একজন ব্লগার মুসা ইব্রাহিমকে নিয়ে টানা লেখালেখি করেছিলেন। লেখার প্রতিপাদ্য ছিল, মূসা এভারেস্টে ওঠেনি!

সেই লেখালিখির প্রতিবাদও হয়েছিল। প্রতিবাদটা বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা। এসব প্রতিবাদের মুখে হিমু একসময় স্বীকার করে নেন, মূসার এভারেস্টে ওঠার সত্যতা তিনি পেয়েছেন। সে ব্যাপার তো ওখানেই শেষ। তাহলে এখন আবার কী?

তার চেয়েও বড় প্রশ্ন মূসার এভারেস্টে ওঠা, না ওঠা বিষয়ক ক্যাম্পেইনের সঙ্গে সজল খালেদ বা ইনাম আল হকের সম্পর্ক কি? মূসাও পর্বত ওঠে, সজল খালেদও ওঠেন। মূসা, সজল খালেদ, মুহিত; সবার গুরুস্থানীয় ইনাম আল হক। তিনি কেন এদের কারো বিরুদ্ধে প্রচারণা করতে যাবেন?

আমি আর কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারি না। থতমত খেয়ে বলি,

: সজল ভাই, আমাকে ক্ষমা করে দিন। মূসাকে কাছ থেকে চিনি। ইনাম ভাইকে দূর থেকে শ্রদ্ধা করি। আমি কোনো নোংরামির মধ্যে যেতে চাই না।

সজল ভাই বুদ্ধিমান মানুষ। এক মুহূর্ত ভেবে বললেন,

: না, না। মূসার বিরুদ্ধে কিছু নয়…ঠিক আছে, আপনি রাজি না হলে তো কিছু করার নেই। তবে এই যা কথাবার্তা হল, সেটা ভুলে যান প্লিজ।

আমি অনেক চেষ্টা করেছি। সেই দুপুর থেকে আজ এই মাঝরাত অবদি; প্রায় পাঁচটি দিন ধরে চেষ্টা করেছি ভুলে যেতে।

পারলাম না সজল ভাই। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। নিজের বিবেকের তাড়নায় আমি এই ঘটনাটা ওয়েব দুনিয়ায় প্রকাশ করে দিতে বাধ্য হলাম। এই পুরো ঘটনার মর্মার্থ কি, তা সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারবেন; তারা হয়তো ব্যাখ্যাও দেবেন।

আমি শুধু আমার অভিজ্ঞতাটা বললাম। সেই অভিজ্ঞতা ফিরে দেখতে গিয়ে একটা ব্যাপারই মনে হয়েছে, আবার একটা অন্যায় হতে চলেছে। আবার একটা ছোট কাজ হতে চলেছে। তখনই মনে হল কথাটা: পর্বতারোহীরা ওপরে উঠছে আর মনটা নিচে নামছে!

৪.
ইনাম আল হকের মনমানসিকতা কতোটুকু নীচু, তার প্রমাণ পেয়েছি আরও একবার। খবর বের হলো এমএ মুহিত ২০১১ সালের ২১ মে তীব্বত দিক দিয়ে এভারেস্ট জয় করেছেন। তিনি ফেরার পর চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ভাই ফোন দিয়ে বললেন, মুসা একটু অফিসে এসো। তোমাকে আর মুহিতকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করি। সাগর ভাইয়ের আমন্ত্রণে যখন গেলাম চ্যানেল আইতে, দেখি মুহিতের সঙ্গে ইনাম আল হকও এসেছেন। সালাম দিয়ে যখন কুশল বিনিময় করতে গেছি, মনে হলো যেনো কোনো পাপ করে ফেলেছি। বাংলা সিনেমার দৃশ্য যেন। বাংলা সিনেমায় সৎ মা যেমন অপর পক্ষের সন্তানকে দেখতে পারেন না, তার চোখ জ্বালাপোড়া করে, তেমনি ইনাম আল হকও স্টুডিওতে ঢুকে আমার এভারেস্ট জয়ের ছবি দেখে বেশ চড়া গলায় এবং আমাকে শুনিয়ে বলছেন, এটা আবার কে?

যেন মাত্রই তিনি মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে এসেছেন এবং পৃথিবী নামক গ্রহের হালহকিকত যেনো জিজ্ঞেস করছেন! সে সময় থেকে চিন্তা করছিলাম, যেদিন আমি এভারেস্ট জয় করে দেশে ফিরেছিলাম, সেদিন এই ইনাম আল হক অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন। চ্যানেল আইয়ের স্টুডিওতে তখন মনে একরাশ ঘৃণা জন্মেছিল।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইনাম আল হক বা সজল খালেদ শুরুতে যে নাকে খত দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, সেখানে তারা থামলেও পারতেন। কিন্তু তারা সেটা করেননি। বরং, খোদ এলিজাবেথ হাউলিকে আমার এভারেস্ট জয়ের ছবি নিয়ে সংশয়মূলক ইমেইল করেছে তারা। এলিজাবেথ হাউলির মুখপত্র রিচার্ড সালিসবুরি কিন্তু ফিরতি ইমেইলেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আমার ছবিগুলো এভারেস্ট চূড়াতেই তোলা। খোঁজখবর করতে গিয়ে ইনাম আল হক, সজল খালেদ, বাবু, বেনু প্রমুখদের এই কুৎসিত কর্মকাণ্ড রিচার্ড সালিসবুরিই আমাদের জানিয়েছে।

আর কাঠমান্ডুভিত্তিক মার্কিন সাংবাদিক এলিজাবেথ হাওলি হিমালয়ান ডেটাবেস নামে একটি ডেটাবেস চালু করেছেন, যেখানে শুধু নেপাল হিমালয়ের সাত হাজার মিটারের চেয়ে উঁচু পর্বত জয়ের রেকর্ডগুলো সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে ১৯০৫ সাল থেকে। আমেরিকাভিত্তিক আমেরিকান আলপাইন ক্লাব এই ডেটাবেস প্রকাশ করে থাকে। সারা বিশ্বের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ এই তালিকাকে অবিসংবাদিতভাবে সামিটিয়ারদের চুড়ান্ত তালিকা হিসেবে গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাপী এই তালিকা পর্বতারোহীদের কাছে বাইবেল হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে। হিমালয়ান ডাটাবেজে আমার ও আমার সহযাত্রীদের নাম স্পষ্ট করে লেখা আছে। দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করেন: http://www.himalayandatabase.com/2010%20Season%20Lists/2010%20Spring%20A4.html

৫.
যাই হোক, বিতর্ক থামল। কিন্ত সেই গোষ্ঠীর ‌ক্ষোভ মিট‌ল না। ২০১২ সালে এভারেস্ট জয় করে দেশে ফিরে তারা কিছুটা শান্ত হ‌লেন। ত‌বে তখনো ক্ষোভ কেন মুসা প্রথম? মিডিয়াগুলো যখন দেশের সব এভারেস্টজয়ীকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে চেয়েছে, নতুন এভারেস্টজয়ী এবং তাদের পালের গোদা ইনাম আল হক তাতে বাগড়া দিয়ে বলেছেন – হয় এ বছর (২০১২ সালে) যারা এভারেস্ট জয় করেছেন, শুধু তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হবে, নয়ত এ বছর (২০১২ সালে) এভারেস্টজয়ীরা অনুষ্ঠানেই যাবেন না। তাদের বেঁকে বসায় কতো অনুষ্ঠান নির্মাতা যে আমাকে ফোন করে শেষ মুহূর্তে যেতে মানা করেছেন, তার হিসেব নেই। বেশি অসহায়বোধ করেছি নতুন এভারেস্টবিজয়ী গোষ্ঠীর মনমানসিকতা দেখে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সবাইকে ডেকে পাঠালেন, সবাইকে সংবর্ধনা দিলেন, তখন আবার তারা সেখানে ঠিকই গেছেন। সেখানেও যখন তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে গেছি, তারা নিজেদের অহম প্রকাশ করেছেন। মনকে বুঝ দিযেছি, তেলে জলে মিশবে না। আরেকটা বিষয় জানিয়ে রাখতে চাই। ব্যাপারটা খুবই ফানি। নিশাত মজুমদার যে বাসায় থাকে, সেই একই বিল্ডিংয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি। সেখানে গেলে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু দেখা হলেই যেন তিনি ভূত দেখেছেন, এমন একটা তটস্থ ভাব তার মধ্যে দেখি। দ্রুতই সরে পড়তে চেষ্টা করেন। কারো বিরুদ্ধে অন্যায় করলে তার মুখোমুখি হতে অসস্তি লাগে, নিশাতের হয়তো সেই বোধটা কাজ করে। এখন যদি কেউ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিশাত মজুমদারের ছবি ক্রপ করে আমি ছোটলোকি করেছি, সেক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, আমার ওয়ালে আমি ছবি ক্রপ করবো না এনলার্জ করবো, না কি সংকুচিত করবো – এটা একান্তই আমার ব্যাপার। আর যে আমাকে এড়াতে চায়, তার চেহারা আমি দেখতে চাইনা বলেই ক্রপ করেছি।

যাই হোক, এরপর এলো ২০১৪। ওই গোষ্ঠীর ২০১০ সালের ইচ্ছাপূরণ হ‌লো একাত্তর টিভি দি‌য়ে। সেখানে ইনাম আল হক, এমএ মুহিত, নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া, মীর শামছুল আলম বাবু, শাজাহান মৃধা বেনু প্রমুখ ঢালাও বলে গেলেন, মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ে তাদের সন্দেহ আছে। কিন্তু আমাকে কিছু বলতে হয়নি। তাদের প্রোপাগান্ডায় বহু মানুষ তাদের ছি ছি করেছেন। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন:

সাম্প্রতিককালে আবার যারা আমার এভারেস্ট জয়ের ছবি নিয়ে ফটো ফরেনসিক টেস্ট করার ইচ্ছা পোষণ করছেন, তাদের জন্য নিচের এই নোটটা শেয়ার করলাম। লিংক: goo.gl/k1m5sj

সত্যি বলতে, ইনাম আল হকদের এমন দাবিতে আমি মোটেও ভ্যাবাচেকা খাইনি। একটু বিরক্ত হয়েছি ঠিকই। তবে বুঝতে চেষ্টা করেছি যে, কেনো তারা লাইনে হাঁটলেন বা তারা কেনো ‘মুসা ইব্রাহীম যেভাবে ১৭ কোটি মানুষকে বোকা বানালেন’ প্রকল্প হাতে নিলেন? তারা কি নিজেদের কোনো দোষ লুকাতে চান? বলতে পারেন, এখানেই রহস্যের সমাধান পেয়ে গেছি।

আমার এভারেস্ট জয়ের ছবি নিয়ে যতো গবেষণা হয়েছে, নতুন যারা এভারেস্ট জয় করলেন, তাদের ছবি নিয়ে কি তা হয়েছে? হয়নি। তারা তো একেকটা পর্বত জয় করেন, আর মুহূর্তেই তা মিডিয়ায় চলে আসে, আর তা সবাই বিশ্বাস করে নেন। প্রমাণের দায়ভার তাহলে সব আমার? আপনারা শুধু আমাকেই প্রশ্ন করে যাবেন? কই, কাউকে তো দেখলাম না যে অন্যসব এভারেস্টজয়ীকে তাদের এভারেস্টসহ অন্য পর্বতারোহণের ছবি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে? তারা ‘জয় করেছেন’ বলতেই আপনারা বুঝে গেলেন? কেনো প্রশ্ন করলেন না? না কি ভাসুরের নাম মুখে আনা যায় না বলে? আমি বলতে চাই, সবার এভারেস্ট জয়ের ছবি নিরীক্ষা নিয়ে সমান দাবি উঠুক। কষ্ঠিপাথরে যাচাই হয়ে আসুক নির্ভেজাল সত্য।

কথাটা বলার কারণ আমার বন্ধু ও সহযোগী পর্বতারোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্তের এভারেস্টজয়ের ছবি জালিয়াত করে ভারতের এক পুলিশ দম্পতি গত বছর ধরা খেয়েছেন। এই ঘটনা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। এভারেস্ট নিয়ে জালিয়াতি যে কোন পর্যায়ে গেছে, তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি। https://www.nytimes.com/2016/09/01/…

ইন্টারনেট খুব অদ্ভুত জায়গা। এইখানে যেকোনো মানুষ কম্পিউটার স্ক্রিনের আড়ালে লুকায়ে নিজেরে যেইভাবে খুশি সেইভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। এখানেই যেহেতু আপনারা সত্যমিথ্যা প্রমাণের উদ্যোগ হাতে নিছেন, কাজেই, আপনাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলাম, যদি সম্ভব হয়, আমার এভারেস্ট জয়টা মিথ্যা ছিল প্রমাণ করুন। এটা প্রমাণ করার পরে এমএ মুহিতকে প্রথম এভারেস্টজয়ী হিসাবে দাবি করুন, আমি মেনে নেব। ইতরামির একটা সীমা থাকা উচিত।

বাংলা চ্যানেল সাঁতার

এ প্রসঙ্গটা সামনে এলে ভালোই লাগে। কারণ, যেমন দেশের মানুষ, তেমনি তাদের সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক। একাত্তর টিভি যা করে দেখালো দাদা! প্রায় সবাই লুফে নিয়েছেন। এখানে সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, আমি সেই অর্থে সাঁতারু নই। তবে যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারের কথা শুনলে যদি তা আমার সামর্থ্যের মধ্যে থাকে, তা আমি করতে চাই। তেমন একটা ব্যাপার ছিল বাংলা চ্যানেল সাঁতার। এই চ্যানেল যখন সাঁতরে পাড়ি দেয়ার আগ্রহের কথা এই চ্যানেলে আবিষ্কারক মরহুম কাজী হামিদুল হককে জানিয়েছিলাম, তিনি সোৎসাহে এগিয়ে এসে সাহস যুগিয়েছিলেন। তার কথাতেই নিজেকে প্রস্তুত করে বাংলা চ্যানেল জয় করতে নেমে পড়েছিলাম।

আমি সাঁতার কেটেছি ২০১১ সালে (প্রথমবার)। আর একাত্তর টিভি ভুলে ভরা মিথ্যা নিউজ করেছে ২০১৪ সালে। একাত্তর টিভি যা দেখিয়েছে, তাতে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে চাই, নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমি ৫ থেকে ১০ মিনিট নৌকায় ছিলাম। আর আপনারা যে মিথ্যা রিপোর্ট করলেন, আমি পুরো পথ নৌকায় পাড়ি দিয়েছি, সেই ফুটেজের মেটাডাটা জাতির সামনে প্রকাশ করুন। করে বলুন যে আমি পুরোটা পথ নৌকায় করে পার হয়েছি। আর যদি তা না পারেন, তাহলে জাতির কাছে আপনাদের ক্ষমা চাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।

বাংলা চ্যানেল নিয়ে কথা বলতে চাইলে লিপটন সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ২০১১ সালে ঘটনা কি ঘটেছিল? আমার দুর্ভাগ্য যে, বাংলা চ্যানেলের আবিষ্কারক মরহুম কাজী হামিদুল হক আর নেই। তিনি সেবার আমার মেন্টর হিসাবে ছিলেন।

২০১১ সালে বাংলা চ্যানেল সাঁতারের সময় দুর্ঘটনায় পড়ায় আমাকে নৌকায় ওঠানোর বিষয়টি আমি কখনই গোপন করিনি। বরং সেন্টমার্টিনে যে সাংবাদিকরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন, তারা নিজেরাই ওই প্রশ্ন করেছিলেন যে, দুর্ঘটনায় মুখে পড়ায় আমাকে উদ্ধার করার পর নৌকায় তোলা হলেও কীভাবে ফের বাকি পথ সাঁতরে পাড়ি দিলাম? উত্তরে বলেছিলাম, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস ছিল দেখেই নৌকা থেকে নেমে ফের সাঁতরে বাকি পথ পাড়ি দিয়েছি। এসবই ১৮ মার্চ ২০১১-তে বাংলা চ্যানেল অভিযান শেষে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যে প্রেস কনফারেন্স করা হয়েছিল সেখানে ভিডিওতে নৌকায় আমাকে উদ্ধার করার দৃশ্যও দেখানো হয়েছে। আর আমাকে এই ৫-৭ মিনিট নৌকায় তোলার পুরো ঘটনা ২০১২ সালে একুশে বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার লেখা ‘মিশন বঙ্গোপসাগর ও কিলিমানজারো’ বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। ১৫ মে ২০১৪ সালে আমার লেখা নোট পড়তে পারেন এখানে : goo.gl/bBSm54

আর এটাও যদি যথেষ্ট মনে না হয়, ভিডিও দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করেন -https://www.youtube.com/embed/wkjbDBQrDRY

এতেও যদি আপনাদের মন না ভরে, তাহলে সেদিন প্রোগ্রামের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের প্রশ্ন করুন। অন্যান্য টিভির ও সংবাদপত্রের রিপোর্ট দেখুন। এরপর আর আপনাদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করছি। দয়া করে ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’ শুনেই চিলের পেছনে দৌড়াবেন না।

সবার জ্ঞাতার্থে বলছি, এরপর ২০১২ সালে ডাচ সুইমার ভ্যান গুল মিলকোর সঙ্গে আরও একবার মরহুম কাজী হামিদুল হকের নেতৃত্বে বাংলা চ্যানেল সাঁতার আয়োজন করেছি। সেটা নিয়ে একাত্তর টিভির কোনো ‘রা’ নেই। আবার ২০১৬ সালে ভারতীয় ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী রিতু কেডিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে ফ্রি স্টাইলে বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়েছি। এসব নিয়ে একাত্তর টিভি একেবারে ‘স্পিকটি নট’।

কার্সটেঞ্জ পিরামিড অভিযান

কার্সটেঞ্জ পিরামিড অভিযানে আমাদের সহঅভিযাত্রী নন্দিতা চূড়া জয় করে বেস ক্যাম্পে ফেরার পথে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। দলের সিদ্ধান্তটা এমন ছিল: যেহেতু মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, কাজেই সেখান থেকে নিরাপদে ফেরাটা জরুরি। অভিযাত্রীদের জীবন বিপন্ন করে অভিযান সম্পন্ন করাটা আমাদের কাছে কাজের কোনো বিষয় মনে হয়নি। পুরো ট্রেইলের যে ভয়াবহতা, তা থেকে নন্দিতাকে রক্ষা করতেই আমরা হেলিকপ্টারে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এ নিয়ে পুরো ফেসবুকে যাচ্ছেতাই রকমের গালাগালি করতে দেখলাম। ব্যাপারটা কি এমন যে, আপনারা একটা লাশ চেয়েছিলেন? কারো মৃত্যু আপনারা কামনা করেছিলেন? ব্যাপারটা যদি সেটাই হয়ে থাকে, তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি, আমরা মনুষ্যত্ব বিবর্জিত জীবনসত্ত্বার একেবারে কিনারে এসে পৌঁছেছি। ভাগ্যিস নন্দিতা বাংলা পড়তে পারে না। নয়তো আমি মন্টেনিগ্রোর ব্লেকা (যিনি আমার এভারেস্ট জয়ের ব্যাপারে ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন) এবং অস্ট্রেলিয়ার ব্রেন্ডানের (যিনি আমাকে এভারেস্ট রিজে অক্সিজেন সরঞ্জাম ঠিকঠাক করে দিয়েছিলেন, পাওয়ার জেল খাইয়েছিলেন, এবং এভারেস্ট জয়ের ব্যাপারে ভিডিও সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন) মতো বন্ধুদেরকে আমি হারাতাম। তারা ভিডিও সাক্ষাতকার দেয়ার পর তাদের গালাগালি করে বাংলাদেশীরা বেশ কতক ই-মেইল, মেসেজ পাঠিয়ে বেশ নেকি হাসিল করেছিলেন।

সবশেষে দুটো গল্প বলি। এক নেতার প্রায় শ দুয়েক চ্যালাচামুণ্ডা। নেতার বাসার সামনে প্রতিদিন সকালে তারা হাজির হয়। নেতা তাদের হাতে একশটা করে টাকা তুলে দেয়। এ দিয়ে চ্যালারা বাজারসদাই করে বাড়িতে দিয়েই এলাকায় লাঠিবল্লম নিয়ে বের হয়ে পড়ে। নেতার কর্তৃত্ব জাহিরে তারা ‘নুন খেয়ে গুণ গায়’। লোকজন তাদের কথায় উঠে আর বসে। সমঝদারদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। তাই এই গল্প আর বাড়ালাম না।

দ্বিতীয় গল্পটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। কবিগুরু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরি’ অবস্থা। সবার বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথ যেহেতু জমিদার, তাই যেহেতু তার ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, তাই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাকে ব্যঙ্গ করে চল্লিশের দশকে কল্লোল নামে একটা সাপ্তাহিকে সেই পর্যায়ের লেখালেখি হতো। সেই যুগটা কল্লোল যুগ নামে পরিচিত। কবিগুরু কিন্তু সেসবের জবাব গায়ের জোরে নয়, বরং লেখার মাধ্যমে দিয়েছিলেন। কবিগুরুর সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে বলছি: কাজ, কাজ আর কাজ। এর মধ্য দিয়েই আমি সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমি চাই তরুণদের নিয়ে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। সেজন্য আপনাদের সবার বুদ্ধি-পরামর্শ-সহায়তা চাই।

লেখক : পর্বতারোহী ও সাংবাদিক

Posted in নির্বাচিত কলাম, সারা দেশ | Comments Off on এভারেস্ট ও বাংলা চ্যানেল: কেনো আমি চুপ থাকি?

অনলাইন মিডিয়ারও জবাবদিহিতা থাকা উচিত

কাজী সিরাজ : অনলাইন নিউজপোর্টাল মিডিয়ার একটি অংশ। এখন নিউজপ্রিন্ট ও টেলিভিশনের জন্য যদি রেজিস্ট্র্রেশন লাগে তাহলে অনলাইন পোর্টালগুলো তো একই কাজ করছে। সেদিক থেকে অনলাইন মিডিয়াকে জবাবদিহিতায় নিয়ে আসার জন্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি সঠিক মনে করি। এই অনলাইন নীতিমালাকে আমি সমর্থন করি। তবে রেজিস্ট্র্রেশনের নামে নিয়ন্ত্রণের যেন খড়গ চাপিয়ে না দেওয়া হয়। অর্থাৎ অনলাই মিডিয়ার স্বাধীনতা যেন হরণ করা না হয় সেদিকটি নিশ্চিত করতে হবে।

দেশে যে ব্যাঙের ছাতার মতো হাজারও অনলাইন নিউজ পোর্টাল হয়ে গেছে এগুলোকে একটু জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য হলেও নীতিমালাটি দরকার। অনেক নিউজপোর্টালের তো কোনো মান নেই। একদিকে যেমন মান নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, অন্যদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, কেউ যাতে সীমা লংঘন করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে। যেমন পত্রিকাগুলো একটা জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে, আপনি যা খুশি তাই কি লিখতে পারেন? যা খুশি তাই কি বলতে পারেন? টেলিভিশনগুলোতেও তো অনেক কিছু মেনে চলতে হয়।
কিন্তু অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোতে অনেক কিছু মানা হয় না। যখন যার ইচ্ছা হলো তখন সে কম্পিউটার কিনে অনলাইন পোর্টাল করে ফেলল। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে যদি কেউ বিরোধিতা করে আমার মনে হয় তা হবে অকারণ বিরোধিতা।

নীতিমালার ফলে সব অনলাইন নিউজপোর্টাল একটা
জবাবদিহিতার মধ্যে চলে আসবে। আমরা সংবাদপত্রকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে চাই, টেলিভিশনগুলোকেও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে চাই, তাহলে অনলাইন মিডিয়ার জবাবদিহিতা থাকবে না কেন? সবাকেই জবাবদিহিতার মধ্যে থাকা উচিত।

অনলাইন মিডিয়ার এই নীতিমালাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি আমি, যদি তা প্রপারলি করা হয়। কিন্তু যদি ওই কণ্ঠরোধ করার চিন্তা-ভাবনা থেকে করা হয়ে থাকে তাহলে সমস্যা থেকে যাবে। হোক না শত শত বা হাজারও নিউজপোর্টাল, কেউ যদি মেইনটেন করতে পারে তাহলে অনলাইন মিডিয়া চালাবে। কিন্তু জবাদিহিতার নামে যদি বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা থাকে তাহলে তো হবে না। আমার মনে হয়, যত খুশি তত অনলাইন হোক, কিন্তু জবাবদিহিতার মধ্যে থাকুক, যাতে এ বিষয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করতে না পারে।

পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on অনলাইন মিডিয়ারও জবাবদিহিতা থাকা উচিত

ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দটা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতাম

ধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : ঈদ আরবি শব্দ, যার অর্থ আনন্দ। তবে ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দটা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতাম। কিন্তু তারপরে যতই বয়স বেড়েছে, জীবন বাস্তবতার মুখোমুখি যত হয়েছি ততই যেন ক্রমেই ঈদের আনন্দ উবে গেছে, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উভয় কারণেই বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আনন্দের কথাই বলি, আমার ছেলেবেলার ঈদ আনন্দ। শৈশবের ঈদ মানেই হচ্ছে নতুন জামা-কাপড় কেনা, নতুন জুতো পাওয়া এবং ভাল ভাল খাবার খাওয়া। সেদিন যেন অন্য দিনগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন রকম হতো। সেদিন অন্তত পড়াশোনার চাপ থাকত না বা মুরুব্বিদের চোখ রাঙানিও দেখতে হতো না পড়াশোনায় গাফিলতির জন্য। কেমন যেন একটি মুক্ত বিহঙ্গের মতো দিনটা কাটাতে পারতাম।

মনে আছে, আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল, বগুড়ায়। আমাদের চাচাত ভাই-বোনেরা মিলে ঈদের দু’সপ্তাহ আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা করতাম যে, আমাদের বাড়িটাকে কিভাবে সাজানো যায়। এই ধারণা আমাদের মাঝে একটু ব্যতিক্রমই ছিল। কারণ অন্য কোনো বাড়ি সাজানোর উদ্যোগ নিতে দেখিনি কিন্তু আমরা আমাদের বাড়ি নানা রকমভাবে সাজাতাম। বিভিন্ন রঙিন কাগজ কেটে নানান আকার দিয়ে দড়িতে বেঁধে বাড়ি সাজাতাম এবং বাড়িটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতাম। চাচাতো ভাই-বোনেরা মিলে বাড়িটা পরিষ্কার করে রাখতাম।

ঈদের দিনের সকাল বেলায় নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি বা প্যান্ট, জুতো পরে বাবা-চাচাদের হাত ধরে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ পড়ে ঈদের মাঠেই বাবা-চাচাদেরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হতো। ওখানে সালামি পেতাম না, বাড়ি এসে পেতাম। বাড়ি ফিরে এসে সেমাই, জর্দ্দা যা আছে খেয়ে শুরু করতাম এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরা। চাচাত ভাই-বোনেরা এবং বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়াতাম। প্রত্যেক বাড়িতেই কিছু না কিছু খাওয়া হতো। দুপুর গড়িয়ে গেলেই বাড়ি ফিরে আসতাম। তখন অনেকটা কান্ত, পরিশ্রান্ত থাকতাম।

বিকেল হলে আবার বেরিয়ে পড়তাম। যেসব বাড়িতে যাওয়া শেষ হয়নি সেখানে যেতাম এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। রাত হলে আবার বাড়ির যে সমস্ত ভাল ভাল খাবার থাকত সেটা খেতাম এবং এটা একটা আকর্ষণ ছিল। রাতে যখন ঘুমোতে যেতাম তখন মনে হতো এত আনন্দের দিনটি চলে গেল! এই একটা ব্যথা যেন মনের মধ্যে থেকে যেত। কিন্তু বাস্তবাতটা তো এরকমই, ঈদটা তো একদিনেরই হয়। এইভাবে আনন্দ-বেদনার মধ্যদিয়ে ঈদ পার হয়ে যেত।

ঈদ মানেই তো আনন্দ বলেছিলাম কিন্তু বাংলাদেশের কজন মানুষ ঈদের আনন্দটা উপভোগ করতে পারে? এখনো বাংলাদেশের অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়, গায়ে কাপড় নেই, পেটে খাবার নেই। তারা তো ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। তাদের তো নতুন কাপড়ও নেই, খাবারও নেই, মাথার উপর কোনো আচ্ছাদনও নেই। সামাজিক বাস্তবতায় ঈদের এই আনন্দ সেদিনই পূর্ণ হবে যেদিন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মাথার উপর ছাদ থাকবে, গায়ে কাপড় থাকবে, পেটে খাবার থাকবে নইলে আমাদের সমাজে উঁচু স্তরের ঈদের আনন্দ-উল্লাসের যে আয়োজন এটা আমার কাছে অনেকটাই দায়িত্বহীনতা বলে মনে হয়। এসব কারণেই এখন ঈদের আনন্দটা আর ছেলেবেলার মতো উপভোগ করি না।

পরিচিতি: ইতিহাসবিদ
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
সম্পাদনা: আশিক রহমান

Posted in নির্বাচিত কলাম | Comments Off on ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দটা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতাম

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud