April 26, 2024
যতীন সরকার : বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নিজেদেরকে সংহত করতে পেরেছে। সেটা এখনো আমরা অতীতকালে পরিণত করতে পারিনি। যে অপশক্তি এ রকম একটা অন্যায় ও জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আমরা যারা নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে মনে করি, তারা সত্যি সত্যিই সেক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটি করতে পারিনি। এই আগস্ট মাসে আমাদের সেই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে যেÑ এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়েছিলেন, আমরা তা বাংলা গড়ে তুলব। তিনি যে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই স্বাধীনতার সংগ্রামকে যথার্থ সফল করতে হবে।
মুক্তির সংগ্রামে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। এভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথার্থ সম্মান জানাতে পারি। আমরা যে তার শূন্যতা পূরণ করতে পারিনি। তবে বঙ্গবন্ধু যদি নিহত না হতেন, তার তো স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারত? বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, এটা পূরণের দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের সেই দায়িত্ব পূরণ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারি মনে করি, তার আদর্শ ফিরিয়ে আনার জন্য তাদেরকে যথার্থ অর্থে মুক্ত মনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
পরিচিতি: শিক্ষাবিদ
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল :
১.
এই বছর আমরা গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান এবং ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে সব মিলিয়ে এক ডজন মেডেল পেয়েছি। খবরটি সবাই জানে কিনা আমি নিশ্চিত নই। আমাদের দেশের সংবাদপত্র খুবই বিচিত্র। তাদের কাছে সব খবর সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোনো কোনো অলিম্পিয়াডের খবর তারা খুবই গুরুত্ব নিয়ে ছাপাবে। আবার কোনো কোনোটির খবর তারা ছাপাবেই না। কাজেই আমি ভাবলাম আমি নিজেই সবাইকে খবরটি দিই। একটা দেশের জন্যে আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে এক ডজন মেডেল সোজা কথা নয়।
আমরা গণিতে চারটি মেডেল পেয়েছি, দুটি সিলভার এবং দুটি ব্রোঞ্জ। এক নম্বরের জন্যে আবার গোল্ড মেডেল হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু আমি ঠিক করেছি সেটি নিয়ে আমি মোটেই হা-হুতাশ করব না। দেখতে দেখতে একটা সময় চলে আসবে যখন আমরা গোল্ড মেডেল রাখার জায়গা পাব না! গণিতে গোল্ড মেডেল না পেলেও অন্য একটি ‘মেডেল’ আমরা পেয়েছি– সেটি হচ্ছে এই অঞ্চলের সব দেশকে হারিয়ে দেওয়ার ‘মেডেল’। আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষ বিশাল একটি দেশ। লেখাপড়া, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তারা অনেক এগিয়ে আছে। হলিউডের একটা সিনেমা তৈরি করতে যত ডলার খরচ হয় তার থেকে কম খরচে মঙ্গলগ্রহে তারা মহাকাশযান পাঠাতে পারে। কাজেই আমরা যদি গণিত অলিম্পিয়াডে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের হারিয়ে দিতে পারি তাহলে একটু অহংকার তো হতেই পারে।
পদার্থ বিজ্ঞানেও আমরা এবারে চারটি মেডেল পেয়েছি। তার মাঝে একটি সিলভার এবং তিনটি ব্রোঞ্জ। পদার্থ বিজ্ঞানে মেডেল পাওয়া তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন। কারণ সেখানে খাতা-কলমে সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে প্র্যাকটিক্যাল করতে হয়। আমাদের দেশের লেখাপড়াটা এতই দায়সারা যে, এই দেশের ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠানিকভাবে ল্যাবরেটরিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা একেবারেই পায় না। পদার্থ বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের কমিটি নিজেদের উদ্যোগে ল্যাবরেটরির কাজকর্ম একটুখানি শিখিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ম্যাজিকের মতো ফল এসেছে। চার চারটি মেডেল!
আমার আনন্দ একটু বেশি। কারণ এই চারজনের ভেতর একজন মেয়ে। আমরা কখনোই মেয়েদের ছেলেদের সমান সুযোগ দিই না। শুধু তাই না, পারিবারিক বা সামাজিকভাবেও তাদের ধরে বেঁধে রাখি। তাই এই প্রতিযোগিতাগুলোতে সমান সমান ছেলে এবং মেয়ে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত, একটুখানি পরিকল্পনা করে অগ্রসর হলেই ছেলেদের সাথে সাথে মেয়েদের দলটিকেও পেতে শুরু করব। পদার্থ বিজ্ঞানের মেডেল বিজয়ী এই মেয়েটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সহকর্মী শিক্ষকের মেয়ে। তাকে আমি ছোট থেকে দেখে আসছি। তাই আমার আনন্দটুকুই অন্য অনেকের থেকে বেশি।
ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে আমরা চারজনকে পাঠিয়েছি, চারজনই মেডেল পেয়েছে। তিনটি ব্রোঞ্জ এবং একটি সিলভার। ইনফরমেটিক্স শব্দটা যাদের কাছে অপরিচিত মনে হচ্ছে তাদেরকে সহজভাবে বলা যায়, এটি হচ্ছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের অলিম্পিয়াড। ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের কথা বললেই আমাকে একবার প্রফেসর কায়কোবাদের কথা বলতে হবে। এই মানুষটি না থাকলে আমাদের ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডকে কোনোভাবেই এতদূর নিয়ে আসতে পারতাম না। অনেকেই হয়তো জানে না যে, প্রতিযোগীরা যেন নিশ্চিন্তে প্র্যাকটিস করতে পারে সেজন্যে তিনি তাদের নিজের বাসায় দিনের পর দিন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আমাদের ধারণা, ঢাকা শহরে চিকুনগুনিয়ার আক্রমণ না হলে আমাদের প্রতিযোগীরা ঢাকা শহরে এসে আরও একটু বেশি প্রস্তুতি নিতে পারত।
গণিত অলিম্পিয়াডের মতোই ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডেও আমাদের আরও একটি ‘মেডেল’ আছে, সেটি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষকে হারিয়ে দেওয়ার ‘মেডেল’। এত বড় একটি দেশ, তথ্যপ্রযুক্তিতে সারা পৃথিবীতে তাদের হাঁকডাক। কাজেই সেই দেশটিকে যদি আমাদের স্কুল-কলেজের বাচ্চারা হারিয়ে দেয়, একটুখানি আনন্দ তো আমি পেতেই পারি!
আমাদের দেশের এই এক ডজন ছেলেমেয়ে তাদের এক ডজন মেডেল দিয়ে আমাকে যা আনন্দ দিয়েছে সেটি আমি কাউকে বোঝাতে পারব না।
২.
ঠিক এই একই সময়ে আমাদের দেশের প্রায় এক ডজন ছেলেমেয়ে আমার বুকটা ভেঙে দিয়েছে। মোটামুটি এই সময়টাতেই এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। পরীক্ষার ফল মনের মতো হয়নি, তাই সারা দেশে প্রায় ডজন খানেক ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে। শুনেছি, শুধু কুমিল্লা বোর্ডেই নাকি এগার জন ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
খবরটি জানার পর থেকে আমি শান্তি পাচ্ছি না। কোনো কারণ নেই, কিন্তু নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে, “আহা, আমি যদি আশাভঙ্গ এই ছেলেমেয়েগুলোর সাথে একবার কথা বলতে পারতাম– একবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারতাম, জীবনটা অনেক বিশাল, তার তুলনায় একটা এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষা একেবারে গুরুত্বহীন একটা ব্যাপার। যার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তার জীবনের কিছুই আটকে থাকবে না, কোনো না কোনোভাবে সে সামনে এগিয়ে যাবে।”
আমি শিক্ষক মানুষ, আমার সব কাজ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। আমি তাদের অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারতাম, এই একটি পরীক্ষার ফলাফল মনমতো না হলে তাতে জীবনের বিশাল প্রেক্ষাপটে কিছুই উনিশ-বিশ হয় না। আমি তাদের বোঝাতে পারতাম জীবনটা কত মূল্যবান। একটা জীবন দিয়ে পৃথিবীর কত বড় বড় কাজ করা যায়। কিন্তু সেটা করা যায়নি। এই দেশের দশ-বার জন ছেলেমেয়ে (কিংবা কে জানে হয়তো আরও বেশি) বুকভরা হতাশা আর সারা পৃথিবীর প্রতি এক ধরনের অভিমান নিয়ে চলে গেছে। আমি তাদের আপনজনের কথা ভেবে কোনোভাবে নিজেকে সান্তনা দিতে পারি না।
আমি যেটুকু জানি তাতে মনে হয় সারাদেশের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সব অভিভাবকই কেন জানি ভাবতে শুরু করেছেন তাদের ছেলেমেয়েদের জিপিএ ফাইভ কিংবা তার থেকেও বড় কিছু গোল্ডেন ফাইভ পেতেই হবে। তারা বুঝতে চান না সেটা সব সময় সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, তার প্রয়োজনও নেই। মানুষের নানা ধরনের বুদ্ধিমত্তার মাঝে লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তা শুধু একটা বুদ্ধিমত্তা। তাই তারা শুধু লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তাটাকেই গুরত্ব দেবেন, অন্য সব ধরনের বুদ্ধিমত্তাকে অস্বীকার করবেন বা সেটাকে দমিয়ে রাখবেন, সেটা তো হতে পারে না। বাবা-মা যখন তার সন্তানকে পৃথিবীতে এনেছেন তাকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে হবে। লেখাপড়ার চাপ দিয়ে জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুললে কোনোভাবেই তাদের ক্ষমা করা যাবে না।
পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে লেখাপড়া আছে, কিন্তু পরীক্ষা নেই। সেই দেশের ছেলেমেয়েরা সবচাইতে ভালো লেখাপড়া করে। আমাদের দেশ সেরকম দেশ নয়। এখানে লেখাপড়ার চাইতে বেশি আছে পরীক্ষা। আমরা শিক্ষানীতিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলেছিলাম। সেই শিক্ষানীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চারটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। যার অর্থ, আমরা একটি ছেলে কিংবা মেয়েকে তার শৈশব আর কৈশোরে চার চারবার একটা ভয়ংকর অমানুষিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিই।
তা-ও যদি সেই পরীক্ষাগুলো আমরা ঠিকভাবে নিতে পারতাম, একটা কথা ছিল। প্রতিবার পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে স্বীকার করে নেওয়া হলে আবার নূতন করে পরীক্ষা নিতে হবে। তাই সবাই মিলে দেখেও না দেখার ভান করে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক ছাত্রছাত্রী এবং তাদের বাবা মায়েদের অপরাধী হওয়ার ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছি এবং অল্প কিছু সোনার টুকরো সৎ ছেলেমেয়ে, যারা পণ করেছে তারা কখনো ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখবে না, মরে গেলেও অন্যায় করবে না তাদের বুকের ভেতর দেশের বিরুদ্ধে এবং চক্ষুলজ্জাহীন কিছু দেশের মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ এবং হতাশার জন্ম দিয়ে পাচ্ছি। যে দেশ তাদের সৎ ছেলেমেয়েদের ভেতরে হতাশার জন্ম দেয় সেই দেশকে নিয়ে স্বপ্ন কেমন করে দেখব ?
অথচ খুব সহজেই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একবার ঘোষণা দিতে হবে, যা হবার হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কখনো প্রশ্ন ফাঁস হবে না। তারপর প্রশ্ন যেন ফাঁস না হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে দেশের অসংখ্য আধুনিক প্রযুক্তিবিদ প্রস্তুত হযে আছে। কেউ তাদের কাছে একবারও পরামর্শ নেওয়ার জন্যে যায়নি!
কাজেই যা হবার তাই হচ্ছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমার কাছে প্রমাণ আছে যেখানে একটি ছেলে কিংবা মেয়ে চিঠি লিখে বলেছে তার বাবা-মা তাকে বলেছে যে, তাকে জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে– যদি না পায় তার সুইসাইড করা ছাড়া আর কোনো উপায নেই।
কী ভয়ংকর একটি কথা! এটি কত জনের কথা?
অসংখ্য ছেলেমেয়ে আছে যাদের পরীক্ষার ফলাফল মনের মতো হয় না। তখন তাদের সান্তনা দেওয়া, সাহস দেওয়া কিংবা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্বটি পড়ে তার বাবা-মা কিংবা অন্য আপনজনের উপর। কিন্তু তারা অনেক সময়েই সেটি পালন তো করেন না, বরং পুরোপুরি উল্টো কাজটা করেন, তাদেরকে অপমান করেন, তিরস্কার করেন, লাঞ্ছনা করেন। অসহায় ছেলেমেয়েগুলো সান্তনার জন্যে কার কাছে যাবে বুঝতে পারে না। (কান পেতে রই (০১৭৭৯৫৫৪৩৯২) নামে একটা সংগঠন হতাশাগ্রস্ত এবং আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের সাহায্য করে। আমি এই সংগঠনের ভলান্টিয়ারদের কাছে শুনেছি প্রত্যেকবার পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর তাদের আলাদাভাবে সতর্ক থাকতে হয়।)
৩.
বছরের এই সময়টা আসলে আমার সবচেয়ে মন খারাপ হওয়ার সময়। কারণ এই সময়ে ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময়। কারণ এই সময় ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরীক্ষাগুলো হয়। শুধুমাত্র অল্পকিছু বাড়তি টাকা উপার্জন করার লোভে প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদাভাবে ভর্তিপরীক্ষা নেয়। দেশে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় যে প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদা দিনে পর্যন্ত পরীক্ষা নিতে পারে না। একদিন দেশের এক কোণায় পরীক্ষা, তার পরের দিন দেশের অন্যপ্রান্তে পরীক্ষা। ছেলেমেয়েরা এক জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে রাতের বাসে উঠে সারারাত জার্নি করে ভোরবেলা দেশের অন্য প্রান্তে পৌঁছায়। অজানা অচেনা জায়গা, তাদের হাত-মুখ ধুয়ে বাথরুমে যাবার পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। সেইভাবে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লোভের টাকা সংস্থান করার জন্যে ভর্তিপরীক্ষা দেয়।
সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মান কেউ দেখেছে? হাই কোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়ার কারণে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্ন আমাকে দেখতে হয়েছিল, যেখানে প্রত্যেকটা প্রশ্ন নেওয়া হয়েছিল কোনো না কোনো গাইড বই থেকে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সক্ষম বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এরকম অবস্থা হয় তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী অবস্থা হতে পারে কেউ কি অনুমান করতে পারে? সে জন্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে রমরমা ব্যবসার নাম ইউনিভার্সিটি ভর্তি কোচিং!
আমি জানি আমার এই লেখাটি যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চোখে পড়ে তাহলে তারা আমার উপর খুবই রেগে যাবেন এবং বোঝানোর চেষ্টা করবেন তারা মোটেই বাড়তি টাকার জন্যে ভর্তিপরীক্ষা নিচ্ছেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বজায় রাখার দায়বদ্ধতা থেকে করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি হতেও পারে, কিন্তু মোটেও সামগ্রিকভাবে সত্যি নয়। ভর্তিপরীক্ষা প্রক্রিয়া থেকে একটি টাকাও না নিয়ে যদি কোনো শিক্ষক আমাকে চ্যালেঞ্জ করেন আমি অবশ্যই আমার বক্তব্যের জন্যে তার কাছে ক্ষমা চাইব! আছেন সেরকম শিক্ষক?
এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চোখে এখনও ভর্তিপরীক্ষা নামে এই ভয়ংকর অমানবিক প্রক্রিয়াটি চোখে পড়েনি। কিন্তু এই দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির চোখে পড়েছে। তিনি কিন্তু দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের একটি সম্মেলনে একটি সম্মিলিত ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে এই দেশের ছেলেমেয়েদের এই অমানুষিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করার অনুরোধ করেছিলেন। আমি খুব আশা করেছিলাম যে, তাঁর অনুরোধটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রক্ষা করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি সেরকম কোনো লক্ষ্মণ দেখতে পাচ্ছি না! মনে হচ্ছে, এই দেশের ছেলেমেয়েদের উপর নির্যাতনের এই স্টিম রোলার বন্ধ করার কারও আগ্রহ নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় আগ বাড়িয়ে কখনোই এই উদ্যোগ নেবে না।
আমরা একবার যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্মিলিত ভর্তিপরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। দেশের ‘মেহনতি’ মানুষের রাজনৈতিক সংগঠন বামপন্থী দলগুলো এবং কমিউনিস্ট পার্টি মিলে সেটি বন্ধ করেছিল! (বিশ্বাস হয়?) কাজেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধটি রক্ষা করার জন্যে যদি কোনো উদ্যোগ নিতে হয় সেটি নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে। তারা কি সেই উদ্যোগটি নিয়েছে?
এই দেশের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের পতাকা বুকে ধারণ করে যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডের মেডেল নিয়ে আসে তখন আনন্দে আমাদের বুক ভরে যায়। তার প্রতিদানে আমরা এই দেশের ছেলেমেয়েদের প্রতি যে অবিচারটুকু করি সেটি চিন্তা করে বুকটি আবার বেদনায় ভরে যায়।
কেন আনন্দের পাশাপাশি বেদনা পেতে হবে? কেন শুধু আনন্দ পেতে পারি না?
তুষার আবদুল্লাহ : অভিভাবকের অবস্থান থেকে আমরা সন্তানদের হুকুম দিতে অভ্যস্ত। নিজেদের রুচি ও ভাবনা চাপিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তারা সেই হুকুম গ্রহণে বা ভাবনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে কিনা, বিষয়গুলো পছন্দ করছে কিনা, সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেইনা। বই পাঠের রুচি তৈরির বেলাতেও সেই অভিজ্ঞতা থেকে বেরোতে পারিনি। আমরা আমাদের সন্তানদের হাতে যে বই তুলে দিচ্ছি, সেই বইটি আমাদের রুচির। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের রুচির পরিবর্তন অনিবার্য। এই সত্য আমরা স্বীকার করি না। আবার একথাও বিবেচনায় রাখা দরকার, অভিভাবকদের সন্তানদের রুচি তৈরি করে দেওয়ারও দায়িত্ব নিতে হয়। অভিভাবক হিসেবে আমরা দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। এই বোধে পৌঁছেছি সন্তানদের কাছ থেকে পাওয়া অভিব্যক্তি, অনুযোগ থেকে। বছর পেরিয়ে গেলো বিদ্যায়তনে শ্রেণিকক্ষের পাশে বইমেলা আয়োজনের। এই উদ্যোগে আমরা কথা বলি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তারা বই নিয়ে যে মূল্যায়ন এবং পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছে, তা আমাদের বিস্মিত করেছে যেমন, তেমনি আত্মসমালোচনার মুখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলছে প্রতিবছর তাদের সামনে প্রকাশকরা যে বই নিয়ে আসেন, তাতে বৈচিত্র্য নেই। তাদের শিশু-কিশোর প্রকাশনা গুটিকয় লেখক কেন্দ্রিক। বাণিজ্যিক কারণে এই ক’জনা লেখকদের নিয়েই প্রকাশকদের মাতামাতি। নতুন লেখক উপস্থাপনে তাদের আগ্রহ কম।
এই লেখকরাও প্রতিবছর একই বিষয় নিয়ে লিখে যাচ্ছেন। বিষয় বৈচিত্র্যের ঘাটতিতে ভুগছেন তারা। কোনও কোনও প্রকাশক নতুন লেখক নিয়ে যে আসছেন না তা নয়, পরিমাণে সেটা মন্দ নয়। তবে বই বিপণনের বাজার জনপ্রিয়মুখী। এই জনপ্রিয়তার ছকটি আবার গণমাধ্যমের তৈরি করে দেওয়া। গণমাধ্যমের লেখক গোষ্ঠীতে যারা অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পান বা সুযোগ করে নেন, তারাই জনপ্রিয়তার বিজ্ঞাপনের মডেল লেখক হয়ে ওঠেন। এই বিজ্ঞাপন সমাজে এমন একটি ধারণা করে তৈরি করে দেয় যে, এই লেখকরাই সেরা লেখক এবং তাদের লেখাই শ্রেষ্ঠ লেখা। তারা যে বিষয় নিয়ে লিখছেন, সেটিই পৃথিবীর এসময়কার প্রতিপাদ্য। শিক্ষার্থীরাতো বটেই, অভিভাবকরাও সেই বিজ্ঞাপনের কারেন্টজালে আটকা পড়ে যান। তারা ভাবেন এই জনপ্রিয় ধারার বইগুলো সন্তানের হাতে তুলে দিতে পারলেই তারা সৃজনশীলতা এবং শুভ চিন্তার মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলবে।
বাস্তবতা হলো প্রকাশক, গণমাধ্যম এবং অভিভাবকদের এই যৌথ উদ্যোগ আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন এবং চিন্তার ঘেরাটোপে বন্দি করে রেখেছে। আমাদের প্রকাশক, লেখক এবং অভিভাবকদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ইন্টারনেট পৃথিবী যে আমাদের সন্তানদের বিশ্বসাহিত্যের সীমানার নিয়ে যে গেছে, এটা তাদের ধারণার বাইরে। আমাদের সন্তানরা এখন বিশ্ব সাহিত্যের একেবারে আনকোরা লেখকের নাম এবং তাদের কাজের সঙ্গে পরিচিত। তারা এখন তুলনা করতে পারছে দেশের লেখকদের সঙ্গে বিদেশি লেখকদের। ফলে আমাদের সন্তানদের ফাঁকি দেওয়ার আর এখন সুযোগ নেই।
অভিভাবক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ছিল বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখক এবং তাদের লেখার সঙ্গে সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। এর মাধ্যমে আমরা সন্তানদের রুচি তৈরি করে দিতে পারি। সন্তানকে যদি শৈশব থেকেই আমরা বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখাগুলোর সঙ্গে পরিচিয় করিয়ে দেই, তাহলে তাদের ভালো বই বেছে নেওয়ার অভ্যেস তৈরি হবে। এতে তারা জনপ্রিয় ধারার বইয়ের বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবে না।
সন্তানরা বই বিমুখ হচ্ছে, এই ধারণাটি পুরোপুরি আমাদের মনগড়া। তারা বইয়ের সঙ্গেই আছে, আমরা তাদের কাছে চাহিদা মতো বই তুলে দিতে পারছি না। তাদের কাছে তাদের প্রয়োজন ও রুচির বইটি তুলে দিয়ে পাঠ্যাভ্যাসে আটকে রাখতে হবে। যদি তাদের রুচি নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকে, তবে তার দায় কিন্তু আমাদেরই। অভয়বাণী হচ্ছে- আমাদের সন্তানরা বইয়ের সঙ্গে আছে। বই নিয়ে তাদের উত্সাহে কমতি নেই। সতর্কবাণী হলো- আমরা যদি ধারণার বলয় ভেঙে না বের হই, তবে সন্তানদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়বেই। এই দূরত্ব আমাদের প্রকাশনা, সাহিত্য ও চিন্তার দুনিয়াকে পুষ্টিহীন করে তুলবে। এই পুষ্টিহীনতা নিয়ে সুষম চিন্তার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা আকাশকুসুমই বটে!
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি। বাংলাট্রিবিউন
ইকরাম কবীর : ধর্ষণ চলছেই। বিকৃত যৌনতা নিয়ে এ দেশের মেয়েদের অত্যাচার করেই চলেছে ছেলেরা। অনেকে আবার মানসিক বিকলাঙ্গতার প্রমাণ রেখে যাচ্ছে। এই বিকলাঙ্গতা পুরুষ হিসেবে মনের ভেতর প্রদাহের জন্ম দেয়, আক্রোশের জন্ম দেয়।
পত্রিকায় বেরিয়েছে যে একজন রাজনৈতিক কর্মী একজন ছাত্রীকে বাড়ি থেকে ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছেন। শুধু ধর্ষণই করেননি, ব্যাপারটি ধামাচাপা দিতে মেয়েটিকে ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে দু’জনেরই মাথা ন্যাড়া করে দেন। পুলিশ বলছে, মেয়েটি ও তার মায়ের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।
খাবারের লোভ দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে ঢাকার বাড্ডায় তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে এক পুরুষ। এরপর সে শিশুটির মৃতদেহটি বাড়ির শৌচাগারে ফেলে যায়।
এর কিছুদিন আগে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে একটি ছেলের বিরুদ্ধে। তারও কিছুদিন আগে আরও কয়েকজন ছেলে একই ভাবে দাওয়াত দিয়ে দু’জন মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল। উঠতি সমাজের উঠতি ছেলেরা যখন ধর্ষণে লিপ্ত হয়, তখন সংবাদ মাধ্যমে খবর হয়। কিছুদিন এ বিষয়ে খবরের তাণ্ডবও চলে। তারপর আবার বরাবরের মতো ঝিমিয়ে যায়। সংবাদ মাধ্যম অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। বিষয়টিই হারিয়ে যায়। ঢাকার বাইরে থেকে কয়েকটি ধর্ষণের খবর আসে, তবে অন্য কোনও কিছু না ঘটলে তা খবর হিসেবে পাঠানো হয় পত্রিকার ছাপা হওয়ার জন্য। কয়েক মাস আগে পত্রিকায় সারা দেশে কত ধর্ষণ হয় তা ছাপা হয়েছিল।
এ বছর মে মাসের সাত তারিখে কয়েকটি কাগজে একটি খবর বেরিয়েছিল। এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত, তিন মাসে ১৪৪ জন মেয়ে-শিশু আমাদের দেশের নানা স্থানে ধর্ষিত হয়েছে। গত বছর ২০১৬ সালে এই একই সময়ে ৪৪৬ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৩ সালে ১৭০ জন এবং ২০১২ সালে ৮৬ জন মেয়ে-শিশু ধর্ষিত হয়েছিল।
চিন্তা করতে পারেন? প্রতি মাসে আটচল্লিশজন মেয়ে-শিশু! আমরা কেমন সাহসী জাতি!
এই হিসেব কিন্তু শুধু মেয়ে-শিশুদের। মেয়ে-শিশু যাদের বলা হয় তার বাইরের ধর্ষণের সংখ্যা এই খবরগুলোতে আসেনি। তাহলে! সেই সংখ্যা যোগ করলে কত হবে? যারা শিশুদের ধর্ষণ করতে পারে, তারা শুধু মেয়ে নয়, ছেলেদেরও ধর্ষণ করতে পারে। কতজন ছেলে-শিশু ধর্ষিত হচ্ছে তার হিসেব আসেনি, আসবেও না। তবে আমরা সাহসী জাতি; ধর্ষণে পটু। শিশু নয় এমন নারীদের সংখ্যাও দেওয়া হয়নি।
এ অবস্থায় আমরা যদি ধর্ষণের হিসেব করতে বসি তাহলে ভিমড়ি খেতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল পাঁচ। যুদ্ধের পর-পরই জেনেছিলাম পাকিস্তানি ধর্ষকেরা আমাদের দু’লাখ মেয়েকে অত্যাচার করেছিল। আমার মনে হয় বন্দুকের গুলি বা বেয়োনেট দিয়ে মারলেও, এর চেয়ে ভালো ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও এ অত্যাচার থামেনি। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এদেশের ছেলেরা যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা হিসেব করলে বোধহয় আমার মাথায়ও গোটা চারেক ধর্ষণের দ্বায় পড়বে। এমন দ্বায় যখন আমার ওপরেও আসে, আমার নিজেকেও একজন ধর্ষক মনে হয়।
সম্প্রতি বনানীর একটি হোটেলে দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ দেশে জন্ম নেওয়া পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়া একটি অভিশাপ মনে হচ্ছে। পুরুষ হিসেবে লজ্জা হচ্ছে। কিছু পুরুষ এমন জঘন্য অপরাধ করে যাবে এবং দেশের সব পুরুষকে এর দ্বায়ভার বয়ে বেড়াতে হবে।
হোটেলের ওই ঘটনায় আমার কাছে প্রথম বিরক্তিকর বিষয়’টি হচ্ছে পুলিশের আচরণ। পুলিশ মানুষ বিপদে পড়লে বাঁচাতে আসবে। তারা হোটেলের ধর্ষণের ঘটনা মামলা হিসেবে নিতেই চাননি। অনেক কষ্টে দু’জন মেয়ে মামলা করতে পেরেছিলেন। কেন? ওই ছেলেগুলো প্রভাবশালী ধনী ব্যাবসায়ীদের সন্তান ছিল বলে? পুলিশের এই আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্য যখন কোনও ধর্ষিতার অভিযোগ অথবা মামলা গ্রহণ করতে চান না, তখন আমরা কি ভাববো? এরাও কি সমান অপরাধে অপরাধী নন? আমার তো মনে হয়, তাই। সমান অপরাধী।
তারপর কাগজে পড়লাম ধর্ষকেরা দেশে ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। তামাশা নাকি! এতো প্রযুক্তি, এতো মনিটরিং চলছে সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য; অথচ আমরা ধর্ষকদের ধরতে পারছি না! আমরা জানতে চাই এ ব্যপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য’রা নির্লপ্ততা দেখিয়েছিলেন কিনা। যা হোক; পরে জানা গেলো তারা দেশ ছেড়ে বেরুতে পারেনি এবং এ বিষয়ে মামলার বিচার কাজ চলছে।
দ্বিতীয় ভয়ের বিষয়টি হচ্ছে আমাদের গণমাধ্যম যেমন করে ধর্ষণের এই ঘটনাটি প্রচার করেছিল। টেলিভিশন সাংবাদিকদের কেউ-কেউ অত্যাচারিত একটি মেয়ের বাড়িতে গিয়ে জানতে চেয়েছিল যে ‘বাড়িটি ধর্ষিতার বাড়ি কিনা’। আমরা সবাই জানি একটি শিশু, একটি মেয়ে, একজন নারী অত্যাচারিত হওয়ার পর সমাজে তার অবস্থা কী দাঁড়ায়, তাকে কোন পর্যায়ে নামানো হয়। যে সাংবাদিক লাইভে আছেন, তিনি না বুঝে এ কথা বলে থাকতে পারেন। ঠিক আছে, মেনে নিলাম। তার হয়তো ধারণা ছিল না এ অবস্থায় কেমন আচরণ করতে হয়। তাদের অফিসে তাকে ধারণা দেওয়ার মতো কি কোনও সম্পাদক ছিলেন না? নিশ্চয়ই ছিলেন।
একটি ধর্ষণের ঘটনা প্রচার করার সময় আমরা সংবাদ মাধ্যমে ‘রা-রা’ করে ওঠি। ওই ৪৮ শিশু ধর্ষণ নিয়ে কথা বলছি না কেন? টক-শো সাজাচ্ছি না কেন? বেশির ভাগ সাংবাদিক পুরুষ বলে?
আমাদের পুরুষত্ব নিয়ে একটি উদাহরণ দেই।
কিছুদিন আগেকার কথা। আমার এক প্রাক্তন নারী সহকর্মী বাসে করে তার অফিসে যাচ্ছিলেন। বসার জায়গা না পাওয়ায় সে বাসের ভেতর দাঁড়িয়েই ছিলেন। আরো অনেক নারী-পুরুষও দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি তার নিতম্বে একটি শক্ত বস্তু চাপ অনুভব করলেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি। যখন বুঝলেন তখন সন্ত্রস্ত হয়ে দেখলেন যে এক পুরুষ তার উত্তেজিত অঙ্গটি তার শরীরে ঘষছে।
সাহসী নারী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন এবং পুরুষটিকে আক্রমণ করলেন। বাসের সবাইকে জানালেন ওই পুরুষটির অপরাধের কথা। বাসের ভেতর অনেক পুরুষ ছিলেন। তারা কেউ উচ্চবাচ্য করলেন না। সবাই চুপ। একজন যৌন অপরাধীর হাত থেকে এক নারীকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে এলেন না। বরং তারা এই নারীকে ঘটনাটি ভুলে যেতে পরামর্শ দিলেন।
অবাক হওয়ার মতো। আমরা পুরুষরা যখন দিনে-দুপুরে কোনও নারীর প্রতি অত্যাচার দেখি, তা নিয়ে কোনও কথা বলি না। প্রতিবাদ করি না। যৌন অপরাধীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আনি না। বরঞ্চ যিনি যৌন-বলি হলেন তাকে শান্ত থাকতে বলি। আর এ সুযোগে অত্যাচারী মুক্ত পাখির মতো উড়ে গিয়ে জনারণ্যে মিশে যায়। এই’তো আমরা! আমরা নাকি কোনও না কোনও নারীর বাবা, ভাই এবং সন্তান।
বনানীর ওই হোটেলের এক যৌন অপরাধীর বাবাও এমনই বলেছিলেন। তার কাছে তার ছেলের অপরাধ অপরাধ মনে হয়নি। ওই দু’জন মেয়ের অনুভুতি বোঝার মতো জ্ঞান তার নেই।
আমার কোনও ছেলে যদি এমন অপরাধ করে, তাহলে আমি কী করবো? এ সমাজের পুরুষ হিসেবে আমি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো। একজন যৌন অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা আমায় কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়? একজন যৌন অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা যে করে সেও কি একজন অপরাধী নয়? একজন ধর্ষককে বাঁচানোর চেষ্টা যে করে সেও কি একজন ধর্ষক নয়।
লেখক: গল্পকার।
উদিসা ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। হ্যাঁ, ভুল পড়েননি, শিক্ষার্থী- শিক্ষক সংঘর্ষ। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছেন, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের আঙুল ভেঙে দিয়েছেন। আঙুল ভেঙে ‘মজা’ও পেয়েছেন। কারণ তাদের ন্যায্য দাবির প্রেক্ষিতে ঘাড়ে ধাক্কা দেওয়ার প্রতিশোধ আকারেই আঙুল ভাঙার কথা ভাবছেন তারা। শিক্ষকদের এই অঙুলি নির্দেশ নিয়ে লেখার পরের অংশে কথা বলবো।
ঘটনাটি যেদিন ঘটলো সেদিন কল্পনায় এই দৃশ্য দেখতে বলেছিলাম শিক্ষকতা শেষ করে সদ্য অবসরে যাওয়া আমার মা-কে। ঘটনাটি যখন সংবাদ আকারে নিউজরুমে পেলাম তখন থেকে খোঁচাচ্ছিল, শিক্ষার্থীরা লাঞ্ছিত করতে গেলো শিক্ষককে? কিভাবে সম্ভব? রাতে ফিরে মাকে বললাম, কল্পনা করো, একজন শিক্ষক গলা ধাক্কা দিয়ে তোমার শিক্ষার্থী সন্তানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছে। আর তোমার সন্তান সেই শিক্ষকের আঙুল ভেঙে দিয়ে এলো। সদ্য শিক্ষকতা থেকে বিদায় নেওয়া আমার মা বললেন, এরা শিক্ষকও না, এরা শিক্ষার্থীও না। সব বদলে গেছে। যদি প্রকৃত শিক্ষকই হতেন তবে এমন ঘটনা আজ আমাকে কল্পনা করতে হতো না।
একজন ছোটবেলা থেকে পড়ালেখা করছে, পাস করছে, কেউ কেবল পড়া শেষে চাকরি করবে বলে পড়ে যাচ্ছে, কেউ একটু বেশি জানতে চায় বলে হয়তো পড়ছে এবং পাস দিচ্ছে। তারা সকলেই শিক্ষার্থী। কিন্তু শিক্ষক। এমনি হওয়া যায়? এমনি? না, শিক্ষক হয়ে ওঠার বিষয় আছে। একসময় যদি শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে পারতো শিক্ষার্থীরা, এখন কেন পারছে না? এটি একপাক্ষিক নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ভাবার সময় এসেছে, নিয়োগপত্র কাউকে শিক্ষকের মর্যাদা দেয় না।
এখনই প্রশ্ন উঠবে তবে কী করতে হবে শিক্ষকদের! সেটি আরেকটু পরের আলাপ। শঙ্কার জায়গাগুলো একটু বিবেচনায় নেই আগে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের নানা ঘটনা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, দেখা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি এক সহপাঠীর মরদেহ ক্যাম্পাসে নেওয়া ও জানাজা পড়তে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্ররা যে আশ্রয় হিসেবে উপাচার্যের মুখাপেক্ষী হন। উপাচার্য তখন নিরাপত্তা বেষ্টনী টেনে শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে সরে যান। একদিকে সহপাঠীর লাশ, আরেকদিকে টিয়ারসেলবিদ্ধ বন্ধু তারপরও প্রশাসনের কাছে থেকে নেই কোনও সদুত্তর। আপনি আশা করছেন সেই ছাত্রদের মাথা ঠাণ্ডা থাকবে, থাকা উচিত। কিন্তু সেসময় শিক্ষকরা কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন? এই ছাত্ররা যখন ‘গালিগালাজ’ করেছে বলে অভিযোগ করছেন, তখন শিক্ষকরা পাল্টা পুলিশে না দিয়ে কেন বলতে পারেননি, ‘এটি শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ না’। বলতে পারেননি কারণ, শিক্ষকসুলভ আচরণ তারাও করে দেখাতে পারেননি।
বন্ধু নির্ঝর মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সামনের ঘটনার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘কোন অজুহাতই শিক্ষকদের উপরে হাত তোলার জন্য যথেষ্ট না। কোন পরিস্থিতিতেই না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাংচুর করাটাও হয়ত বাস্তব পারস্পেকটিভ থেকে আন্দোলনের একটা অংশ হইতে পারে, পুলিশের দিকে ঢিল, বোতল, জুতা ছুঁড়ে মারার ব্যাপারটাও বৈধ বিবেচিত হতে পারে ছাত্র আন্দোলনে। কিন্তু শিক্ষকের শরীরে হাত দেয়াটা ক্ষমার অযোগ্য, খুনের সমতুল্য অপরাধ। যে বা যে সমস্ত ছাত্র সংগঠন এই ন্যক্কারজনক কাজটা ঘটালো, তারা তাদের নৈতিক বল চিরদিনের জন্যই হারালো। যে কোন দাবির বৈধতা বা ন্যায্যতা থাকলে, সেটি অর্জনের জন্য উল্টাপথে আন্দোলন করা লাগে না। শিক্ষক পিটানো লাগে না, বা উল্টাপাল্টা কাজ করা লাগে না। এই সমস্ত কাজ করলে যেটি হয়, সেটা হলো আন্দোলনের ন্যায্যতা বা বৈধতা নষ্ট করা।’
আমি হাজারো বার নির্ঝরের এই কামনা আকাঙ্ক্ষা পড়েছি গত দুইদিনে। শিক্ষকদের মারার কোনও বৈধতা আমিও দেই না। কিন্তু মূলেই আমার প্রশ্ন ‘তারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেনি’। এখানেই বারবারই আটকে গেছি, শিক্ষকরা শিক্ষকের মর্যাদায় আছেন কি? দিনের পর দিন দলীয় নিয়োগ, নিয়োগের আগে পরে নানা সুবিধা পেতে গবেষণা পড়ালেখার বাইরে কেবলই ‘জ্বি স্যার’ বলে প্রশাসনের কাছে থাকা মানুষদের কেন শিক্ষক বলবেন, ছাত্ররা কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন না? নাকি শিক্ষার্থীদের সেসব খুঁজতে নেই। যে শিক্ষক নিজের ক্ষমতা চর্চার জন্য একটি ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতাকে ‘সম্মান’ করে এবং তার শিক্ষার্থীরা সেটা দেখে সেই শিক্ষককে আসলে তারা সম্মান করবেন?
উত্তর হলো, শিক্ষক হওয়ার ‘রাজনৈতিক ধান্দাবাজি’র প্রক্রিয়া যেদিন থেকে ছাত্রদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষকরা যেদিন থেকে প্রশাসনের ও দলের লোক হয়েছেন সেদিন থেকে ছাত্ররাও শিক্ষার্থী না হয়ে ‘ক্যাডার’ মানসিকতার হতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিভাগের ‘মেধাবী শিক্ষার্থীরা’। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এর সাথে লাগে দলীয় পরিচয়, ভোট বাড়ানোর রাজনীতির কারণে লবিংকে গুরুত্ব দিয়েই নিয়োগে ব্যস্ত থাকে প্রশাসন। শিক্ষক হিসেবে তার ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য দেওয়ায় গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘প্রায়োরিটির’ জায়গা বদলে গেছে। একদল শিক্ষক রাজনীতি করে কিছু সুবিধাভোগের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছেন, আরেকদল এসব রাজনীতিতে না থেকে কিছু সুশীল ছায়ায় কনসালটেন্সি আর ‘দায়িত্ব পালনের ক্লাস’ নিচ্ছেন, কিছু শিক্ষক চেষ্টা করছেন আলাদা কিছু করতে (এই সংখ্যা চোখে পড়ে কম)। এই শেষপক্ষকে চিনতে কষ্ট হয় বলেই শিক্ষার্থীরা আঙুল ভেঙে মজা নেন। এ আঙুল নির্দেশ করে: সাবধান না হলে মর্যাদার দাবি থাকবে না, শিক্ষক হয়ে ওঠার ধাপগুলোর ধরন বদলাতে হবে নিশ্চিতভাবেই। এখন আপনারা ভুল পথে।
লেখক: সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন
হারুন উর রশীদ : লিঙ্গ বিষয়টি নিয়ে কোনও সংকীর্ণ ধারণা থেকে আমার এই কলাম নয়। তাই বলে রাখি, আমরা প্রচলিত অর্থে সাধারণভাবে লিঙ্গ বলতে যা বুঝি, তা যারা এই লেখায় খুঁজতে যাবেন তারা হতাশ হতে পারেন। পড়তে গিয়ে আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি পূরণ নাও হতে পারে। আমার ওপর নাখোশও হতে পারেন। তাই আমি শুরুতেই আপনাদের একটু জানিয়ে রাখলাম। যাতে কেউ চাইলে প্রথমেই আমার লেখা বাতিল করে দিয়ে অন্য কোনও কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
১. লিঙ্গ বিষয়টি ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। এই ক্ষমতা যে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হতে হবে তা কিন্তু নয়। এই ক্ষমতা অর্থের হতে পারে, পদের হতে পারে। হতে পারে অস্ত্র অথবা প্রচলিত অন্ধ আস্থার। তবে ক্ষমতা থাকতে হবে। আর তা না থাকলে লিঙ্গের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না। যদি ঘটেও যায় সেই লিঙ্গ কার্যকর লিঙ্গ হিসেবে প্রতিভাত হয় না।
২. ক্ষমতা থাকলে তার একটা বহিঃপ্রকাশও থাকে। এই বহিঃপ্রকাশ নানা ভাবে হতে পারে। কেউ দামি গাড়িতে চড়ে তার বিত্ত-ভৈববের প্রকাশ ঘটান। আবার কেউ প্রতিপক্ষকে দমন করে দেখাতে চান আমি কতটা ক্ষমতাবান। কেউ আবার ক্ষমতার জোরে যা খুশী তাই করেন। ক্ষমতার আরেকটি প্রকাশ ঘটে লিঙ্গের মাধ্যমে। লিঙ্গের প্রকাশ্য একটা দিক আছে। কিন্তু ফ্রয়েডের তত্ত্ব মানলে এর উৎপত্তি কিন্তু মাথায়। মাথায় যখন ক্ষমতার চাপ ভর করে তখন তার নানা প্রকাশ ঘটতে পারে। লিঙ্গেও তার একটা প্রকাশের সুযোগ আছে বা প্রকাশ হয়।
৩.ক্ষমতাবানদের গাড়ি-বাড়ি-বিদেশ ভ্রমণ বিলাসিতা এসব সব সময় যথেষ্ট নাও হতে পারে। তারা চান ক্ষমতার সব দিক বিকশিত হোক। সেই বিকাশ কেউ ঘটান পরিমিত ভাবে। আমরা তখন তাকে বলি সভ্য। আর কেউ সভ্য না হয়ে ক্ষমতাবান হলে তার প্রকাশ ঘটে উগ্র এবং অশ্লিলভাবে। তারা তখন লিঙ্গ গোপন না রেখে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যায়। শুরু হয় ক্ষমতাবানের লিঙ্গ সন্ত্রাস। আর যখন তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধিক ক্ষমতাবানদের রোষানলে পড়ে যায় তখন আমরা তাদের চিনতে পারি। জানতে পারি ধর্ষকের লিঙ্গ সম্পর্কে।
৪. সন্ত্রাস দুর্নীতিও ক্ষমতার আরেক প্রকাশ। যার হাতে ক্ষমতা নেই তার পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। আর সন্ত্রাসের নেপথ্যেও থাকে ক্ষমতা। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লিঙ্গ সন্ত্রাস এসব কিছুই ক্ষমতার অপর পিঠ।
৫. আমরা ক্ষমতার নানা ভরকেন্দ্র বা উৎসের কথা জানি। কারোর মনে হতে পারে বেশি ক্ষমতা পুলিশের। কেউ মনে করতে পারেন প্রশাসনের বড় কর্তার। পুঁজিপতির ক্ষমতাকেও কেউ বড় করে দেখতে পারেন। কিন্তু আসল ক্ষমতা রাজনীতির। রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীন রাজনীতি চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী।
কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা হলো। আমার এই তত্ত্ব যে সর্ব স্বীকৃত তাও নয়। এটা আমার এক ধরনের নিজস্ব বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণ একজন সাংবাদিক, একজন নাগরিক হিসেবে। এর মধ্যে আপত্তি থাকতে পারে। কারণ সমাজতত্ত্বের আদর্শ থিওরি মেনেও আমি এই বিশ্লেষণ করছি না। আর ক্ষমতাবান বলছি বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটা সব ক্ষমতাবানের জন্য প্রযোজ্য। যারা প্রকাশিত হয়েছেন। যাদের ত্যাজ্য করা হয়েছে। এটা তাদের জন্য।
এক. বগুড়ার তুফান এখন দেশজুড়েই তুফান তুলেছে। তুফান ২০১৫ সালে দুই বস্তা ফেনসিডিলসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। ছাড়া পেয়ে তুফান শ্রমিক লীগে যোগ দেয়। এপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে নাকি দুই বছরেই কোটিপতি হয়ে যায়। রাজনীতির ক্ষমতায় সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। আর ক্ষমতার চর্চার একটি দিক হলো লিঙ্গ চর্চা, যা আগেই বলেছি। সে শুধু সেটা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণের পর তরুণী ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া শহর ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু রাজনীতিতে তারচেয়েও ক্ষমতাবান আছে। তারা বিব্রত হয়েছেন। তুফানের লিঙ্গ সন্ত্রাস তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে। কারণ সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থেই তাকে দল থেকে ছুড়ে ফেলা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাই তুফান ও তার সহযোগিরা আটক হয়েছে। শ্রমিক লীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে।
দুই. সিলেটে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজা আক্তার নারগিসকে কুপিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু নারগিস প্রাণে বেঁচে গেছেন। বদরুল কারাগারে। যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। মনে হতে পারে অপরাধীতো ধরা পড়েছে। সাজা পেয়েছে। কিন্তু বদরুল যে বছরের পর বছর নারগিসকে যৌন হয়রানি করে আসছিল তখন কিন্তু বদরুল ধরা পড়েনি। ছাত্রলীগ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়নি। যখন প্রকাশ্যে কোপানোর দৃশ্য ভাইরাল হলো তখন তাকে আর নিতে পারলো না দল। দলের স্বার্থেই ত্যাজ্য করা হলো। শুধু তাই নয় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার সময় নারগিসের সঙ্গে সেলফি তুলে প্রমাণ করতে হলো আমরা নারগিসরই লোক বদরুল আমাদের কেউ নয়। কিন্তু ত্যাজ্য করলেই কি অতীত সম্পর্ক নাই হয়ে যায়?
৩. বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় সাফাত নাঈমরা কিন্তু প্রথমে ছাড়াই পেয়ে গিয়েছিল। তারা টাকার প্রভাবে লিঙ্গ সন্ত্রাস করতো আগে থেকেই। আর এই টাকায় তারা নিয়ন্ত্রণ করতো পুলিশসহ আরও অনেককে। সে কারণে সংবাদ মাধ্যমে খবর আসার আগে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে দুই তরুণী ছিল ‘নষ্ট চরিত্রের’। কিন্তু যখন খবর প্রকাশ হয়ে পড়ে সংবাদ মাধ্যমে তখন ক্ষমতার উপরিকাঠামো ক্ষমতাকে নিষ্কলুষ রাখতেই তাদের আটক করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখানে ক্ষমতার জন্য কোনটা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্ষমতা প্রকাশের লিঙ্গ সন্ত্রাসকে তাই ত্যাজ্য করা হয়েছে।
৪. কুমিল্লার তনু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনাও ক্ষমতার লৈঙ্গিক প্রকাশ। কিন্তু এখানে ওই লিঙ্গধর ক্ষমতাবানরা এখনও অপ্রকাশিত। ঘটনাটি ঘটেছিল ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে। এলাকা জানা গেলেও লিঙ্গ পরিচয় অজানা। ধারণা করি এখানে লিঙ্গ এবং রাজনীতি সমান ক্ষমতাধর। ওই লিঙ্গকে ঘায়েল করা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য হয়তো লাভ-লোকসানের হিসাবে পড়ে গেছে। তাই এখানে আমরা কাউকে গ্রেফতার বা ত্যাজ্য হতে এখনও দেখছি না।
চারটি ঘটনার চার ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু কোনও ঘটনাই ক্ষমতা প্রকাশের লিঙ্গ সন্ত্রাসের বাইরে না। তাহলে কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যাদের ক্ষমতা নাই তারা কি লিঙ্গ সন্ত্রাস বা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত হয় না? আমার জবাব জড়িত হয়। কিন্তু এখানে ক্ষমতার আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমরা তুলনা করলে দেখবো আপেক্ষিকভাবে একজন নিম্নবিত্ত মানুষও ক্ষমতাবান তার শ্রেণিতে অন্যের তুলনায়। এখানেও তুলনামূলভাবে যার সম্পদ কম, রাজনৈতিক যোগাযোগ কম সেই লিঙ্গ সন্ত্রাসের শিকার হয়। এই ক্ষমতার বিষয়টি শারীরিক শক্তির বিবেচনায়ও দেখা যেতে পারে। যার শিকার হয় শিশুরা।
ত্যাজ্য করার আগে কোনও ক্ষমতাধরের লিঙ্গের ক্ষমতাতো রাজনীতি বা সামাজিক কারণেই বাড়তে থাকে। বিকশিত হয় ক্ষমতা প্রকাশের লৈঙ্গিক দিক। তাহলে দল থেকে বহিষ্কার করলে বা ত্যাজ্য করলেই কি সব দায় এড়ানো যাবে? রাজনীতি বা সামাজিক শক্তি প্রকাশে লিঙ্গ চর্চার যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা কি দূর হবে?
আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজে ক্ষমতার অনৈতিক চর্চা যতদিন থাকবে ততদিন ক্ষমতাধরদের একাংশ ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে লিঙ্গ ব্যবহার করবেই। এর মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোর বিবেচনায় যেটা দুর্বল লিঙ্গ সেটা ধরা পড়বে। কিন্তু অনেক লিঙ্গই থেকে যাবে অধরা। অনেক লিঙ্গই আছে যাদের ত্যাজ্য করা যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক
শারমিন শামস্ : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জামায়াত নেতাদের সন্তানরা আওয়ামী লীগ করতে পারবেন। কিছুদিন আগে এই ওবায়দুল কাদেরই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগ নাকি ‘হাইব্রিড’ দিয়ে ভরে গেছে। এই ‘হাইব্রিড’ বলতে তিনি তাদের বুঝিয়েছেন, যারা দল ক্ষমতায় থাকার সুযোগে ভিড়েছেন কিন্তু আদতে তারা আওয়ামী লীগের আদর্শকে অন্তরে ধারণ করেন না।
তো আজ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মনে হচ্ছে, জামায়াত নেতাদের সন্তানরা হাইব্রিড হবেন না। তারা মনেপ্রাণে অন্তরে বাহিরে আওয়ামী লীগকে ধারণ বহন করতে পারবেন। ঠিক কী কারণে এত বড় একজন অভিজ্ঞ নেতার এ ধরনের চিন্তা মাথায় এসেছে আমরা তা বলতে পারি না। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, একাধিকবার জামায়াতের মনোনয়নে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা মুমিনুল হক চৌধুরীর মেয়ে রিজিয়া নদভী মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া প্রসঙ্গে নানা সমালোচনার সূত্র ধরে ওবায়দুল কাদের বিষয়টি নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বাবার সঙ্গে রিজিয়ার সম্পর্ক নেই। আর বাবা জামায়াত হলেও সন্তান আওয়ামী লীগ করতে পারবেন। এদিকে, রিজিয়া নিজেও এক সময় ইসলামী ছাত্রী সংস্থার নেত্রী ছিলেন।
রিজিয়াকে যেকোনোভাবে হোক পদে ধরে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছেন। এখন আওয়ামী লীগ তার দলে কাকে নেবে, কাকে নেবে না, সে স্বাধীনতা দলটার আছে। আমরা সাধারণ জনগণ তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু তাদের দল আমরা চালিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু দলটি যখন একের পর নানামুখী বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা করতে থাকে, তখন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেই হয়। কেননা, ভোটের রাজনীতিতে সাধারণ ভোটার রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
তো কয়েক বছর ধরেই আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অন্যায় অনাচারের কোনও সংবাদ বেরিয়ে পড়লেই দলটির নেতারা সমস্বরে একটি কথা মুখস্থ বুলির মতো আওড়াতে থাকেন। সেটি হলো, জামায়াত আর বিএনপি’র লোকেরা আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ে দলের সর্বনাশ করছেন। অর্থাৎ প্রকৃত আওয়ামী লীগ প্রত্যেকেই দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। আর যারা বজ্জাতি করে বেড়াচ্ছেন, তারা সবাই প্রকৃতপক্ষে বিএনপি বা জামায়াত। তারা আওয়ামী লীগে ঢুকেছেন দলের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে।
ভালো কথা। মানলাম। এ বছরের ২০ মে, গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঢুকে জামায়াত-শিবিরের লোকেরা সহজেই নেতা হয়ে যাচ্ছে তৃণমূলের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, দলীয় নেতা বানানোর আগে ভালো করে তাদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিন। কেননা এদের মুখে আওয়ামী লীগ আর ভেতরে জামায়াত-বিএনপি।
সম্ভবত তৃণমূল কর্মী-সমর্থক-নেতারা নেত্রীর এ বক্তব্যকে বিশ্বাস করছিলেন। তাই আওয়ামী লীগে জামায়াত-শিবিরের কেউ ঢুকে গেলে তাদের হতাশা ও আক্ষেপ চোখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তারা সেই মুখস্ত বাণীতেই আশ্রয় খুঁজে নেন, এ সব অপকর্ম প্রকৃত আওয়ামী লীগ করছে না, করছে ঢুকে পড়া বিএনপি আর জামায়াত।
এখন কথা হলো, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওই বক্তব্যের পরও দলে জামায়াত ঢুকছে। সর্বশেষ যা হলো, মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক ছাত্র সংস্থার নেত্রী রিজিয়া নদভীকে পদ দেওয়া নিয়ে এত ব্যাপক সমালোচনার পরও তাকে ওই পদে বহাল রাখা হয়েছে। এরপর পাওয়া গেলো ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য, ‘জামায়াত নেতাদের সন্তানেরাও আওয়ামী লীগ করতে পারবেন’। ওবায়দুল কাদের বার বার রিজিয়ার স্বামীর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নেওয়ার বিষয়টি সামনে টেনে আনছেন। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, রিজিয়ার স্বামী আবু রেজা নেজামুদ্দিন নদভীও একসময় জামায়াতের রাজনীতি করতেন এবং চার বছর আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাই স্বামীসূত্রে রিজিয়া এখন একজন খাঁটি আওয়ামী লীগকর্মী, যদিও তিনি একসময় মনেপ্রাণে জামায়াতের সদস্য ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার নিবেদিতপ্রাণ নেত্রী ছিলেন।
তো বিষয়টি আগেই মীমাংসিত। নেত্রীর আদেশ ও নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ করছেন সাধারণ সম্পাদক। এক্ষেত্রে তিনি হুট করে এমন বক্তব্য দিলেন, তা বলার কোনও সুযোগ নেই।
মনে পড়ছে, মাত্র কিছুদিন আগের কথা, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পর্ব যখন চলছিল, তখন জামায়াত ও বিএনপির তাণ্ডব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তার ওপর যা দেখেছি, তা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধী নেতাদের সন্তানদের আচরণ, তাদের উগ্রমূর্তি। বাপের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি কারও সন্তানকে। বরং বাবাকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং ও নানামুখী প্রচারণা চালিয়ে নানাভাবে বিচারকে তারা বাধাগ্রস্ত করেছে তারা। নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আছে এইসব নেতার ছেলেমেয়েদের বিরুদ্ধে।
এ রকম উদাহরণ ও অভিজ্ঞতার পরও আওয়ামী লীগ কিভাবে জামায়াতের নেতাদের সন্তানদের প্রতি আস্থা রাখে যে, তারা মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশ নেবে? কিসের ভিত্তিতে তারা মনে করছেন জামায়াতের সাবেক সক্রিয় নেত্রী রিজিয়া এবং আরও শত শত রিজিয়া অথবা নদভী বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে, একাত্তরের চেতনাকে সত্য জেনে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হতে পারবেন? নাকি এখন আর এসব আওয়ামী লীগে অতটা গুরুত্ব বহন করে না? তবে কি আওয়ামী লীগ একাত্তরের চেতনার যে কথা বলে আসছে যুগ যুগ ধরে, তা আজ বাস্তবতার চাপে মিইয়ে গেছে? যদি তা হয়ে থাকে, তবে কেন শেখ হাসিনা তৃণমূলকে সতর্ক করেন জামায়তের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে? তবে কেন ওবায়দুল কাদের হাইব্রিড নেতাকর্মী ঠেকাতে আদেশ দেন? একই মুখে কেন নানামুখী বক্তব্য? এই দ্বৈত অবস্থান শুধু জনগণকেই সংশয়ে ফেলছে না? এটা কি দলের সত্যিকার একনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের দ্বিধাগ্রস্ত ও দ্বিধাবিভক্ত করছে না? ভোটার হিসেবে আমাদের চিন্তাকে দিকভ্রান্ত করছে না?
কোনও এলাকায় আওয়ামী লীগ যদি সাবেক কোনও জামায়াতনেতাকে মনোনয়ন দেয়, তবে ভোটের ব্যালটে ছাপ মারার সময় আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং জামায়াতকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, এমন ব্যক্তির সিদ্ধান্ত আসলে কী হবে?
যে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেছে, বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করেছে, শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচাতে পেট্রোল বোমা মেরে শত শত মানুষ হত্যা করেছে, দেশজুড়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, ধর্মের নামে হাজার হাজার মানুষকে রগ কেটে, গলা কেটে হত্যা করেছে, সেই জামায়াতকে কোন পবিত্র জলে ধুয়ে আজ আলিঙ্গনে বাঁধতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ?
এসব ঘটনা আমাদের বেদনার্ত করে। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে এদেশের রাজনীতিবিদদের আদর্শ আর মূল্যবোধ আরো কত পচে গন্ধ ছড়াবে, জানা নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার কথা পইপই করে বলা আছে। যত বড় দল হোক, যত বড় নেতাই হোন, কেউ তার ঊর্ধ্বে নন। সেই জবাবদিহির পরোয়া কি আওয়ামী লীগ আদৌ করে?লেখক: প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।
দাউদ হায়দার : বাইশ গজের ক্রিকেট মাঠে কতজনকে বোল্ড আউট করেছেন- হিসেব জানা নেই। এও অজানা, কত সুন্দরী-তরুণী-যুবতি নারীর হৃদয় ভেঙেছেন ইমরান খান। অবশ্যই লড়াকু তিনি ক্রিকেটে, প্রেমে ও রাজনীতির খেলায়। হাল ছাড়লে চলবে না, লড়েই জিততে হয়। জিতেছেন নওয়াজ শরিফকে কাঠগড়ায় পাঠিয়ে। ইমরান খানের এই বাউন্ডারি ফাঁকা মাঠে নয়, প্রতিপক্ষও ছিল দক্ষ খেলোয়াড়। আম্পায়ার লক্ষ্য রেখেছেন দক্ষতা সত্ত্বেও খেলায় মূল গলদ কোথায়।
আম্পায়ারের সংখ্যা ছয়। অবশ্য, একজনই আসল। নাম আসিফ সাঈদ খান খোসা। তিনিই প্রধান বিচারপতি। পক্ষপাতহীন বিচারক হিসেবে বহুমান্য, সম্মানিত। বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত। ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকেও ছাড়েননি।
আসিফ সাঈদ খান খোসা একজন লেখকও। গোটা চারেক বই লিখেছেন। লাহোরের এক দৈনিকের সাংবাদিক রাবেয়া কুরেশি এখন বার্লিনে, দেখা করতে এসেছিলেন গতকাল বিকেলে। মানবাধিকার নিয়েও সরব, সংগঠনেও। খোসা-বিষয়ে মজার গল্প শোনান, ‘তিনি কেবল প্রধান বিচারক নন, ক্রাইম থ্রিলার-রগরগে উপন্যাসেরও পাঠক। নওয়াজ শরিফের বিচারের রায়ে মারিও পুজোর উপন্যাস ‘গডফাদার’ থেকে বিস্তর কোট করেছেন, হুবহু।’
তা হলে, একজন ক্রিমিনালকে সঠিক শনাক্ত করতে ক্রাইম-উপন্যাসও সহায়ক।
ফুটনোট: ওই যে বলেছিলাম, আম্পায়ারের সংখ্যা আরও ছয়, জানা দরকার কার কী অতীত ও বর্তমান। ওয়াজিদ জিয়া (ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির অতিরিক্ত মহাপরিচালক)। আমির আজিজ (এনআইবিএএফ- পাকিস্তানের ব্যাঙ্কার ও আর্থিক বিভাগের প্রশিক্ষণ বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। বিলাল রসুল (অর্থনৈতিক সংস্থা- সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক)। ইরফান নঈম মাহির (পাকিস্তানের শীর্ষ দমন বিভাগের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো- বেলুচিস্তান শাখার পরিচালক)। ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ নোমান সাঈদ (পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা- আইএসআই এর অভ্যন্তরীণ-শাখার প্রাক্তন পরিচালক, গত বছরই অবসর নিয়েছেন পরিচালকের পদ থেকে)। ব্রিগেডিয়ার কামরান খুরশিদ (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মিলিটারি ইনটেলিজেন্সে ‘স্পেশাল অফিসার’। বলা হয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে তার ক্ষমতা এতটাই, চিফ থেকে শুরু করে সব জেনারেলই তাকে সমীহ করেন, তার কথায় উঠবস করেন)।
বাকি চার আম্পায়ারের ডিসিশন বাহুল্য, দুই ব্রিগেডিয়ার আম্পায়ারকে উপেক্ষা করা কি সহজ খোসার? যতই বলা হোক, খোসার বিচার সিদ্ধান্তই পয়লা, নওয়াজকে গদিচ্যুৎ করার, ভিতরের ঘটনা ভিন্ন। ইমরান খান যতই আস্ফালন করুন, তিনি শিখণ্ডী। যদি মারতে হয় ভীষ্মকে, দরকার পাণ্ডববাহিনী, সর্বাগ্রে কৃষ্ণকে, মন্ত্রণাদাতা।
পাণ্ডব বাহিনীতে পাঁচজন নয়, গুনেগেঁথে ছয়জন, পঞ্চপাণ্ডবের বদলে ষষ্ঠপাণ্ডব, শিরে দুই ব্রিগেডিয়ার। মন্ত্রক পাক মিলিটারি। কৃষ্ণের ভূমিকায়-আমরা নিশ্চয় ভুলিনি, পাকিস্তানের কুরুক্ষেত্র রচনায় মিলিটারির কী ভূমিকা। নেপথ্যে কৃষ্ণ তথা আমেরিকা।
[ফুটনোট: ওবামার আমল থেকেই পাকিস্তান না-পসন্দ। কারণও বহুবিধ। পাকিস্তান একটি অবিশ্বাসী, বদমাইশ, দুষ্ট, হারামি খচ্চর দেশ। জন্ম থেকেই। খচ্চর পিটিয়ে গাধা করার দায় নিয়েছিল আমেরিকা। ওবামা বুঝতে পারেন, খচ্চর গাধা হয় না। তালিবানের সঙ্গ ছাড়বে না। লাদেনকে খতম করতেই হবে। খতম করার পরেও পাকিস্তানের তথা কৌরবের আক্কেল হয় না। নওয়াজ শরিফ চরিত্রে মূলত জাবালি। শায়েস্তা করার জন্য পানামা পেপারসই যথেষ্ট। লক্ষ করুন, পানামা পেপার্সের নথি-তালিকায় দুর্নীতি কত ফাইল ফাঁস হয়েছে! ১৫ মিলিয়ন। পৃথিবীজুড়ে এত মানুষের (ধনী) দুর্নীতি? ১৪৩ জন রাজনীতিক? ১২ জন রাষ্ট্রনেতা? প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী? কতজন সাজাপ্রাপ্ত? ইরাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট আয়াদ আলায়ি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরোসেঙ্কো, মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুবারক, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডর, এমনকি ব্রিটিনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বাবা-ও কী?]
– নওয়াজ শরিফ ভুল করেছেন ঘুঁটির চালে। আমেরিকার সঙ্গে বিটলেমি, সেনাবাহিনীর সঙ্গে কানামাছি খেলা সহ্য নয় ‘বিগ বসদের’। কাশ্মির নিয়ে যুদ্ধ চায় সেনাকর্তারা। নওয়াজ অরাজি। কাশ্মির সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে উদ্যোগী, কিন্তু সেনাকর্তাদের নিষেধ।
নওয়াজের ঘাড়ে কি দুটি মাথা?-অন্তত এতদিন তাই জেনেছেন। পাকিস্তানের কোনও প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী একবার কুর্সিচ্যুৎ হলে ফিরে পাননি। নওয়াজ পেয়েছেন, পরপর তিনবার। নেপথ্যে অবশ্য সেনাবাহিনী। এবার পাশা উল্টেছে। পানামা পেপার্স, দুর্নীতি উপলক্ষ। পাকিস্তানে সেনাকর্তারা নাখোশ হলে কী হয়, ঢাউস ইতিহাস।
ঠিক যে, পাকিস্তান আবার ইনস্ট্যাবিলিটি, আগামী বছরে, নির্বাচনে আরও ঘন হবে। নওয়াজের পাকিস্তান মুসলিম লিগ যদি জয়ী হয় নির্বাচনে, সংবিধান ওলোটপালোট করে নওয়াজকেই ফিরিয়ে আনবে, জনমত তোয়াক্কা না করে। পাকিস্তানে সবই সম্ভব। গণতন্ত্র উছিলা মাত্র। যেমন উছিলা পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির কেচ্ছা। কলকাঠি নাড়ার কর্তা সেনাবাহিনী। বিচারক নন।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
সূত্র : বাংলাট্রিবিউন।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : খবরের কাগজ খুলে যখনই আমি তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবরটি পড়ি, তখনই এক ধরনের অপরাধবোধ অনুভব করি। অনেকেই একটু অবাক হয়ে ভাবতে পারেন এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটতে দেখে আমি দুঃখ পেতে পারি, হতাশা কিংবা ক্ষোভ অনুভব করতে পারি কিন্তু অপরাধবোধ অনুভব করার কারণ কী? আসলে তার একটি কারণ আছে।
এই জুলাই মাসের ১২ তারিখ কবি নজরুল সরকারি কলেজের একজন ছাত্রীর কাছ থেকে আমি একটা ই-মেইল পেয়েছিলাম। ই-মেইলটির শুরুতেই সে লিখেছে,
‘গত ছয় মাস আগে ঢাকা বিভাগের সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন করা হয়। এরপর থেকে এই সাত কলেজের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা ক্লাস তো দূরের কথা আমরা কোনও নোটিশও পাইনি। সাত কলেজের প্রায় দুই লাখ ছাত্রছাত্রী অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভেতরে আছি।
আমাদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সবকিছু অচল হয়ে যাচ্ছে। পরিবার প্রশ্ন করছে, ক্লাস হচ্ছে না কেন? পরীক্ষা হচ্ছে না কেন? কিন্তু কোনও উত্তর কি আছে আমাদের কাছে? নেই স্যার, উত্তর নেই। প্লিজ স্যার, কোনও কিছু সাজেস্ট করুন। আমাদের এখন কী করা উচিত?’
এই ছাত্রীটি আরও দুই লাখ ছাত্রছাত্রীর পক্ষ থেকে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, তাদের এখন কী করা উচিত। আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি। আমি জানতাম না ঢাকার সাতটি গুরুত্বপূর্ণ কলেজের লেখাপড়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে আছে। আমি আরও অনেক কিছু জানতাম না, ছাত্রীটির ইমেইল থেকে সেগুলো জানতে পেরেছি।
যেমন অনেকেই হয়তো জানেন না, ঢাকার সাতটি বড় কলেজ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। কলেজগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়ন, সেশনজট নিরসন, পরীক্ষার ফলাফল তাড়াতাড়ি প্রকাশ করার জন্য মাস কয়েক আগে এই সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়েছে। এই সাত কলেজের প্রত্যেকটিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩০টি বিষয়ে পড়ানো হয়।
এ বছর ১৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই সাত কলেজের কোনও কাজকর্ম দেখছে না। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জুলাই মাস এই ৬ মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই উপকৃত হয়নি বরং তাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ অদ্ভুতভাবে ঝুলে রয়েছে।
ছাত্রীটি আরও অনেক গুরুতর সমস্যার কথা বলেছে। যেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে ৭ কলেজের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে, তাদের কোনও সিলেবাস নেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনও যোগসূত্র নেই, পরীক্ষার বা ফর্ম ফিলাপের কোনও নোটিশ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার কাছে সাহায্য চাওয়া এই লম্বা ইমেইলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি কিন্তু আমি তাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারব, কিছুতেই ভেবে বের করতে পারিনি। আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় হলে খোঁজখবর নিতে পারতাম কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যাপারে আমি কেমন করে আমার নাক গলাব?
আমি তখন নিজেকে বোঝালাম যে, এই সাতটি কলেজের কোনোটিই ছোটখাটো কলেজ নয়, সবগুলোই অনেক বড় কলেজ। বিশেষ করে ইডেন কলেজ হচ্ছে সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় মহিলাদের কলেজ। তাদের প্রিন্সিপাল মহোদয়রা নিশ্চয়ই ব্যাপারগুলো জানেন এবং তারা নিশ্চয়ই একটা সমাধান বের করে আনবেন। এছাড়া চিঠিতে লেখা ছিল ছাত্রছাত্রীরা এর মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের ছয় মাস কিংবা নয় মাসের সেশনজট একটি ব্যাপার কিন্তু দুই লাখ ছাত্রছাত্রীর সেশন জট রীতিমতো রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়। এত বড় একটা বিষয় কারও নজরে পড়বে না সেটা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা করা হবে। শুরু করার আগেই যদি ছয় মাসের সেশন জ্যাম থাকে তাহলে লেখাপড়া শেষ হতে হতে নিশ্চিতভাবেই সেটা কয়েক বছরের সেশন জ্যামে রূপ নেবে। দুই লাখ ছেলেমেয়ের জীবন থেকে দুই বছর সময় কেড়ে নেওয়া যদি রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় না হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় কী?
০২.
কাজেই ২০ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালবেলায় যখন এই সাতটি কলেজের ছেলেমেয়েরা শাহবাগে তাদের দাবি নিয়ে উপস্থিত হলো সেটি সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে এলো। কিছুক্ষণের মাঝে পুলিশের অ্যাকশনের খবর পেলাম এবং দুপুরবেলার মাঝে খবরে দেখতে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে।
যে ঘটনাটি গত ছয়মাসে হতে পারেনি ছাত্রছাত্রীরা পথে নামার সঙ্গে সঙ্গে সেটি ঘটে গেছে! (পরে আমি জানতে পেরেছি যে পরীক্ষার তারিখটি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের প্রিন্সিপালরা মিলে দু’দিন আগে ঠিক করে রেখেছিলেন কিন্তু তথ্যটি ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছানোর সৌজন্যতাটুকু দেখানোর কেউ প্রয়োজন মনে করেননি। ছাত্রছাত্রীরা যখন শাহবাগে জমা হয়েছিল তখন সেখানে সরাসরি সেই তথ্যটি পৌঁছে দিলে কী হতো? ভাইস চ্যান্সেলরের বাসা থেকে শাহবাগে দশ মিনিটের মাঝে পায়ে হেঁটে চলে আসা যায়)।
শাহবাগের এই ঘটনাটি দেশের জন্য একটা খুব খারাপ উদাহরণ হয়ে রইলো। দেশের সব মানুষ জানতে পারলো একটা খুবই ন্যায্য দাবিও সরাসরি আদায় করা যায় না। সে জন্যে পথে নামতে হয়, রাস্তাঘাট বন্ধ করতে হয়, যানবাহন থামিয়ে দিতে হয়। এবং সেটি করা হলে ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। যে কাজটি ছয় মাসেও হয়নি সেটি কয়েক ঘণ্টার মাঝে হয়ে যায়। কাজেই আমি নিশ্চিতভাবে অনুমান করতে পারি এই ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘটবে। শুধু শাহবাগে নয়, সারাদেশে।
০৩.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা পায়ে হেঁটে এসেও দশ মিনিটের মাঝে ছেলেমেয়েদের জানাতে পারতেন যে তাদের দাবি দু’দিন আগে পূরণ করা হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা প্রথম প্রথম একটু হম্বিতম্বি করতো তারপর খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারতো। এতগুলো ক্ষুব্ধ ছেলেমেয়ের মুখোমুখি হতে যদি তাদের সাহস না থাকে তাহলে পুলিশদের দিয়েও সেই তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাদের কাছে পৌঁছানো যেতো, কিন্তু সেটি করা হয়নি।
যেটি করা হয়েছে সেটি হচ্ছে পুলিশি অ্যাকশন। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হলে মানুষজনের দুর্ভোগ কমানোর জন্য পুলিশ নিরুপায় হয়ে এই ধরনের অ্যাকশনে যেতেই পারে। তবে যখন রাজনৈতিক নেতারা বিদেশ থেকে দেশে আসবেন এবং তার দলের সমর্থকরা তাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য এয়ারপোর্ট রোডের যানবাহন বন্ধ করে দেবেন তখনো পুলিশের একই ধরনের তৎপরতা দেখলে তাদের সদিচ্ছার ওপর বিশ্বাস আমার আরও বেড়ে যাবে।
যাই হোক, ক্ষুব্ধ ছেলেমেয়েদের ওপর লাঠিচার্জ করা হলো, তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস ছোড়া হলো। সেই টিয়ার গ্যাসের শেলের আঘাতে তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান পথে লুটিয়ে পড়লো। তাকে উদ্ধার করা দূরে থাকুক, সে বেঁচে আছে না মারা গেছে সেটা দেখার জন্যেও কোনও পুলিশ তার কাছে এলো না। শেষ পর্যন্ত একজন পথচারী তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো।
পুলিশের আচরণ যে মানবিক আচরণ ছিল না সেটা আমরা পরের কয়েকদিনের মাঝে টের পেলাম। একজন দুই জন নয় বারো শত ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দেওয়া হলো। (এর আইনগত প্যাঁচটুকু কী আমি জানি না, এই মামলার আসামি দেখিয়ে তারা যেকোনও সময়ে এই সাত কলেজের ছাত্রছাত্রীদের গ্রেপ্তার করতে পারবে?)
শুধু যে মামলা হয়েছে তা নয়, সংবাদমাধ্যমে দেখেছি এই মামলা হচ্ছে হত্যা মামলা! পরীক্ষার তারিখের দাবিতে একত্র হওয়া সাত কলেজের ছেলেমেয়েরা সেদিন শাহবাগে যে তাণ্ডবই করে থাকুক তারা যে কাউকে হত্যা করার জন্য একত্র হয়নি, সেটি বোঝার জন্য কি আইনস্টাইন হতে হয়?
সংবাদমাধ্যমে দেখেছি পুলিশ ছেলেমেয়েদের হাত থেকে তাদের ব্যানারটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। পুলিশকে নিশ্চয়ই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে একজন বিক্ষোভকারীকে ছাতু করে ফেলার অধিকার দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কারও হাত থেকে তাদের ব্যানার কেড়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি। কোনও ছাত্রছাত্রীকে যদি ছয় মাস সময়ের ভেতরেও পরীক্ষার তারিখ দেওয়া না হয় এবং সেই কথাটি যদি এক টুকরো কাপড়ে লিখে হাতে ধরে রাখে, সেটি কারও কেড়ে নেওয়ার অধিকার নেই।
ব্যানার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আমি অবশ্য আগেও দেখেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ভাইস চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় একটা ব্যানার ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন ছাত্রলীগের ছেলেরা এসে শিক্ষকদের হাত থেকে সেই ব্যানার কেড়ে নিয়েছিল। কাউকে অসম্মান করতে হলে, তাচ্ছিল্য করতে হলে, অপমান করতে হলে তার হাত থেকে ব্যানার কেড়ে নিতে হয়।
বলতে কোনও দ্বিধা নেই, আমি মনে মনে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, সাত কলেজের ছেলেমেয়েদের ওপর ছাত্রলীগের কর্মীরা না আবার হামলা করে বসে। পুলিশ কিছু করলে অনেক সময়েই জবাবদিহি করতে হয়, ছাত্রলীগের সেই ঝামেলা নেই। এই দেশে এই মুহূর্তে তারা যা ইচ্ছা করতে পারে কেউ তাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারবে না।
সিদ্দিকুর রহমান এখন হাসপাতালে, তার চোখের চিকিৎসার হচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা যায় কিনা, তার চেষ্টা করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখতে পেলাম ঠিক এই সময়ে পুলিশ নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে পুরো ঘটনায় তাদের কোনও দোষ নেই। তদন্ত কমিটি হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে এবং আমি মোটামুটি নিশ্চিত কোনও না কোনোভাবে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করে ফেলা হবে পুরো ঘটনাটিতে পুলিশের কোনও দোষ নেই এবং ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা নিজেদের ভেতর ঢিল ছোড়াছুড়ি করে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
তবে আমি শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি হাসপাতালে গিয়ে সিদ্দিকুর রহমানকে দেখে এসে এই ছেলেটি এবং তার আরও দুই লক্ষ সহপাঠীর দাবির প্রতি এক ধরনের সম্মান জানিয়েছেন। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা, সিদ্দিকুর রহমানের চোখের চিকিৎসার যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নিয়ে তাকে চেন্নাইয়ের চোখের হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। ছেলেটির মা অসহায়ভাবে তার সন্তানের মাথায় হাত দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এই দৃশ্যটি আমি ভুলতে পারছি না।
০৪.
আমাদের দেশে অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সৌভাগ্যবান ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকেরা খুব আন্তরিকভাবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করান সেটি বলা যাবে না, ভালো ছেলেমেয়েরা নিজের আগ্রহে লেখাপড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটুকু ধরে রেখেছে।
যে বিশ্ববিদ্যালয় যত ভালো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা তত দ্রুত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেবা করার জন্যে চলে যায়। কোনও জরিপ নেওয়া হয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু যদি নেওয়া হয় আমার ধারণা আমরা দেখব, এই দেশের মূল চালিকাশক্তি দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামিদামি ছাত্রছাত্রীরা নয়, দেশের মূল চালিকাশক্তি এই দেশের অসংখ্য কলেজের অসংখ্য ছেলেমেয়ে। ঢাকা শহরের সাতটি কলেজের যদি দুই লাখ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে তাহলে সারাদেশের এই ডিগ্রি কলেজগুলোতে কত ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে সেটি অনুমান করা যায়।
উচ্চশিক্ষার কথা বলা হলেই আমাদের চোখের সামনে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছবি ভেসে ওঠে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেবা করার জন্যে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঠিকভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আছে। কিন্তু আমার ধারণা, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সারাদেশের অসংখ্য কলেজ।
যদি তাদের লেখাপড়ার মান বাড়ানো হয়, তাহলে শুধু বিশাল সংখ্যার কারণেই তার প্রভাব হবে অনেক বিশাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে সাতটি কলেজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি সেই কলেজের ছেলেমেয়েদের নিজের মূল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের মতো বিবেচনা করে লেখাপড়ার মান বাড়িয়ে তুলতো, তাহলে কি একটা ম্যাজিক হয়ে যেতো না?
লেখাপড়া করার জন্য, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছেলেমেয়েরা পথে নেমেছে, পুলিশের মার খাচ্ছে সারা পৃথিবীর আর কোথাও কি এ রকম ঘটনা ঘটেছে? এর চাইতে বিস্ময়কর ঘটনা আর কী হতে পারে?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, শাবিপ্রবি
বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী : জাতিভ্রষ্ট লোকদের মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’। মানে ‘ভগবানের পুত্র’। তিনি একটা পত্রিকাও প্রকাশ করতেন তার নামও দিয়েছিলেন ‘হরিজন’। মহাত্মা গান্ধীর মতো একজন খ্যাতিসম্পন্ন মহান নেতা দিল্লির দাঙ্গর মহল্লায় এই জাতহীন লোকদের সঙ্গে সঙ্গে রাত্রিযাপন করে খাওয়া দাওয়া করা, তাদের মল পরিষ্কার করা- সহজ সরল কথা নয়। মেথর, চামার, মুচি, চন্ডাল, কর্মকার, জেলে- এরাই জাতহীন সম্প্রদায়।
ভারতের বর্তমান লোক সংখ্যা ১২০ কোটি। তার মাঝে জাতিভ্রষ্ট ও নিম্নজাতের হিন্দুর সংখ্যা ৩৪ কোটি। যে জাতির ৩৪ কোটি সন্তান অস্পৃশ্য থেকে যায় সমাজে যদি তাদের কোনও স্থান হয় না, তাহলে সে জাতির উন্নতি হয় কিভাবে- এই সত্যটা মহাত্মা গান্ধী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি তার জীবনের মূল্যবান সময় কাটিয়েছেন হরিজনদের মনে সাহস সঞ্চার করে ওপরে টেনে তোলার কাজে। এমন এক সময় ছিল জাতহীনরা নগরে প্রবেশ করলে কাঠের ডফ বাজিয়ে প্রবেশ করতে হতো। ইউরোপে এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল কুষ্ঠরোগীর ব্যাপারে। কাঠের করতাল বাজিয়ে এক সময় ইউরোপে কুষ্ঠরোগীকে নগরে পথ চলতে হতো।
জাতিভেদ প্রথা এতো নিকৃষ্টরূপ নিয়েছিলো যে জাতিভ্রষ্টদের মাঝেও উচু-নিচু প্রথা ছিল। পাঁচ কড়ি দাস আর তিন কড়ি দাস এক কথা নয়, যদিওবা তারা উভয়ে জাতিভ্রষ্ট তালিকার অন্তর্ভুক্ত। জাতিভ্রষ্টদের জাতিভেদ প্রথায় চন্ডাল ছিল সবার চেয়ে নিকৃষ্ট। চন্ডালের কাজ ছিল মৃতদেহ পোড়ানো। চন্ডালেরা বাজার থেকে কিনে কোনও কাপড় পরিধানের অধিকার ছিল না। মৃত্যু ব্যক্তি মরার সময় যে কাপড় পরে মরেছে সেই পরিত্যক্ত কাপড়ই তাকে পরতে হতো।
আবার বিখ্যাত ব্রিটিশ পণ্ডিত আর্থার লিওয়েলিন বাশামের বই ‘দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’য় পড়েছি মনুর ভাষ্য অনুসারে জাতিচ্যুতদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সম্প্রদায় হচ্ছে ‘অন্ত্যাবসায়ী’ সম্প্রদায়। তারা কোনও নগরে প্রবেশ করতে পারতো না। আর পরিপূর্ণ কাপড় পরারও তাদের কোনও অধিকার ছিল না। লেংটি ছিল তাদের ভূষণ।
এবার ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন রামনাথ কোবিন্দ। ২৫ জুলাই তিনি শপথ নিয়েছেন। তিনি উত্তর প্রদেশের লোক, জাতে চন্ডাল, পেশায় উকিল। তিনি ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী মীরা কুমারী। তিনিও জাতে মুচি, পেশায় উকিল। তারা উভয়ে জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের লোক। জাতিচ্যুতদের বর্ণ তালিকায় কে বড় কে ছোট জানি না। মীরা গত লোকসভায় স্পিকার ছিলেন। তিনি বিহারের সাসারাম থেকে পাঁচবার লোকসভার সদস্য হয়েছেন। তার পিতা জগজীবন রামও ছিলেন বিখ্যাত নেতা। ১৯৪৬ সাল থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সময় পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। জাতিচ্যুতদের মাঝে গত শতাব্দীতে অম্বেৎকর এবং জগজীবনই ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।
অম্বেৎকর ছিলেন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি অবশ্য কিছুদিন নেহরু মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের সন্তান। তিনি দু’ দু’বার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জাতিচ্যুতদের মাঝে মেথর সম্প্রদায়ের কন্যা। দিল্লির দাঙ্গর পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে পল্লীতে মহাত্মা গান্ধী বহু রজনী যাপন করেছিলেন। খুবই পরিতাপের বিষয় এই ভুঁইফোড় রাজনৈতিক নেতা মায়াবতী একবার মহাত্মাকে ‘শয়তানের সন্তান’ বলতে দ্বিধা করেননি। আসলে চিরকাল মাঝারিরা মহৎ মানুষদের নিজেদের মাপে ছোট ছোট করতে চায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাকে মহাত্মা বলেছেন, নেহরু তাকে সক্রেটিস বলে আখ্যায়িত করেছেন আর সুভাষ বসু তাকে জাতির পিতা বলেছিলেন।
আম্বেৎকরও মহাত্মার সঙ্গে কম গণ্ডগোল পাকাননি। অথচ মহাত্মার সযত্ন প্রয়াসের ফলেই জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের মাঝে লেখাপড়া শেখার উৎসাহ জেগে ছিল যে কারণে জগজীবন রাম, অম্বেৎকর, মায়াবতী, মীরা কুমারী, রামনাথ কোবিন্দ, কে আর নারায়ণ প্রমূখের উত্থান হয়েছিলো। গান্ধী সারা জীবন জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে কাজ করেছেন আর অম্বেৎকর তার সম্প্রদায়ের প্রতি নিজের কর্তব্যের কথা বিস্মৃত হয়ে হিন্দুদের প্রতি অভিমান করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। অম্বেৎকরের জীবনে এটা চূড়ান্ত পরাজয়। মহাত্মা সারা জীবন ভেদাভেদ রহিত করার কাজে কাজ করেছেন কারণ তিনি মনে করতেন মুক্তির পথ মানুষে ঐক্য সাধনায় ভেদাভেদে নয়।
গান্ধী নেহরু ও পেটেলকে বলেছিলেন- একজন দলিত সম্প্রদায়ের কন্যাকে ‘তোমারা ভারতের রাষ্ট্রপতি করিও’। গান্ধী জীবিত থাকলে কী হতো জানি না তবে ১৯৫০ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাজেন্দ্র প্রসাদই ভারতের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। দলিত সম্প্রদায়ের প্রতি যে মমত্মবোধ গান্ধী দেখিয়েছেন তা ভারতের ইতিহাসে চিরদিন স্মরণযোগ্য ঘটনা।
ভারতে প্রতিটি আশ্রমে ঠাকুরেরা পাচক হিসেবে কাজ করে। এমন কী হোটেলেও। কারণ এইসব স্থানে সব জাতের লোকের আনাগোনা হয়। যেন খেতে কারো অরুচি না হয়। কলকাতা থেকে মেটিয়াবুরুজ যাওয়ার রাস্তায় এক হোটেলে ভাত খেয়েছিলাম। হোটেলের সাইন বোর্ডে লেখাছিলো ‘ওকে পাইচ হোটেল-বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণের পাক’। কিন্তু গান্ধীর সমরমতি আশ্রমের রসাইখানার পাচক গোষ্ঠী ছিল দলিত সম্প্রদায়ের লোক। যে কারণে অনেক কংগ্রেস নেতাও তার আশ্রমে খেতে চাইতেন না। কথিত আছে মহাত্মা গান্ধীর বেয়াই রাজা গোপালাচারী নাকি সমরমতি আশ্রমে কখনও একগ্লাস জলও পান করেননি। কারণ তিনি ছিলেন দক্ষিণের উচ্চ জাতের ঠাকুর।
এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মীরা কুমারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্ন পূর্ণ হতো কারণ পূর্বেই বলেছি মীরা কুমারী দলিত কন্যা। এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ভারতের পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতির নির্বাচন। এর আগের রাষ্ট্রপতিরা হচ্ছেন, ১) রাজেন্দ্র প্রসাদ, ২) সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, ৩) ড. জাকির হোসেন, ৪) ভি ভি গিরি , ৫) ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ, ৬) নিলাম সজ্জীব রেড্ডী, ৭) জ্ঞানী জৈল সিং, ৮) আর. ভেনকটারামন, ৯) শংকর দয়াল শর্মা, ১০) কে. আর. নারায়ণ, ১১) এপিজে আব্দুল কালাম, ১২) প্রতিভা পাতিল, এবং ১৩) প্রবণ মূখার্জী।
ভারতের রাষ্ট্রপতিদের মাঝে রামনাথ কোবিন্দ প্রথম দলিত সম্প্রদায় থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নন। একাদশ রাষ্ট্রপতি কে.আর. নারায়ণও দলিত সম্প্রদায়ের সন্তান। কেরেলা রাজ্যে তার বাড়ি। তার পিতা নারিকেল গাছের মাথা পরিষ্কার করার কাজ করতেন। সমুদ্র উপকূলবর্তী কেরেলা রাজ্যে নারিকেলের বাগান বেশি। প্রাচীনকাল থেকে নারিকেল গাছের মাথা পরিষ্কার করার কিছু পেশাদার লোক ছিল। এ ছোট সম্প্রদায়টাও জাতিভ্রষ্ঠ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
কে আর নারায়ণ লন্ডনে লেখাপড়া করেছিলেন। অধ্যাপক লাস্কি তার শিক্ষক ছিলেন। লেখাপড়া শেষে ভারতের ফিরে আসার সময় লাস্কি নেহরুকে নারায়ণ মারফত একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠি পৌঁছাতে গিয়ে কে.আর. নারায়ণের সঙ্গে নেহরুর পরিচয়। নেহরু তাকে একটা মামুলী আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগে যোগদানের অনুরোধ করেছিলেন। কে আর নারায়ণ নেহরুর অনুরোধ রক্ষা করে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। প্রতিভাবান লোক সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। অবসরে আসার পর কংগ্রেস তাকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদিকে বর্তমান ভারতের নব্য-চানক্য বলাই উত্তম হবে। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিনি খুবই কৌশলী লোক। উত্তর প্রদেশে জাতিভ্রষ্টদের নেতা হচ্ছেন মায়াবতী। আর নিম্নবর্ণের হিন্দু অর্থাৎ উত্তর প্রদেশের বিরাট গোয়ালা সম্প্রদায়ের নেতা হচ্ছেন অখিলেশ যাদব। যাদবেরা গোয়ালা। উত্তর প্রদেশে জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায় আর মুসলমান এর মাঝে সমঝোতা হলে মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী হন আর যাদব আর মুসলমানের মাঝে সম্মিলন হলে অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী হন। এবারে উত্তর প্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি খুব সফলতার সঙ্গে জাতিভ্রষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভোটারদের মাঝে ভাঙন ধরাতে পেরেছেন। রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে তিনি জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়কে তুষ্ট করলেন সম্ভবত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা চিন্তা করে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক