November 2, 2024
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন : অনেকে নানা জায়গায় দেখা হলে কায়দা করে প্রশ্ন করেনÑ আমার লেখায় কেন শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করি? ফেসবুক ইনবক্সেও কেউ আকার-ইঙ্গিতে, কেউ বা সরাসরি একই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কখনো হেসে এড়িয়ে যাই, কখনো বা বলি শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনা। তাই তাকে সমর্থন করে যাই। মাঝেমধ্যে গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি, কেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত সমর্থন করি! কেনই বা বিশ্বাস করি না যে, শেখ হাসিনার বিকল্প এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা ছাড়া কিছু নেই। পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান বলে? নাকি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুবাদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা নিয়ে তার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটায় এখনো পথ হারাতে পারিনি?
মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে। বয়স আর অভিজ্ঞতা আমাদেরও এখন অনেক হয়ে গেছে। জীবনকে বোঝার পাশাপাশি সমাজ, রাজনীতি, জগৎ-সংসার কম দেখা হয়নি। খারাপ মানুষ, ভালো মানুষ, খারাপ চিন্তা, ভালো চিন্তা, গণমুখী রাজনীতি, গণবিরোধী অপশক্তি, ভালো রাজনীতিবিদ, মন্দ রাজনীতিবিদ; এক কথায় গোটা সমাজচিত্রে বাস করা চরিত্রগুলো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো বা সমষ্টিগতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলেই মনের গভীর থেকে যার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য জন্মায়; তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
তার সরকারের প্রতি, তার অনেক মন্ত্রীর প্রতি কিংবা অনেক নেতাকর্মীর প্রতি অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি, শেখ হাসিনার প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন নিঃশর্ত। এই সমর্থন সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। মোটা দাগে, অল্প কথায় যদি চিত্রিত করি যুক্তির ওপর ভর করে, কেন আমি শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাকেই মনে করি। তাতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর ৪৬ বছরের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার একটি ছোটখাটো পোস্টমর্টেম হয়ে যায়। আমাদের রাজনীতি ৪৬ বছর ধরেই ব্যক্তিকে ঘিরে বা বলা যায় জনগণনির্ভর নেতৃত্বকে ঘিরে। সেখানে যৌথ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে ওঠেনি।
এমনি পরিস্থিতিতে যত শাসক এসেছেন, সেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাইরে রাখলে শেখ হাসিনাই শাসক হিসেবে উত্তম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আদর্শ, মূল্যবোধ ও গণমুখী আদর্শিক রাজনীতি চোরাবালিতেই ডুবে যায়নি, নির্লোভ রাজনীতির বিপরীতে গণবিরোধী, ক্ষমতালোভী, সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়েই ওঠেনি; স্বৈরশাসকদের ছায়ায় ভোগ-বিলাসের পথে রাজনীতিকে সহজলভ্য বিত্তবৈভব গড়ার সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষাক্ত বাতাসে সমাজ ও রাজনীতিকে আচ্ছন্নই করা হয়নি, উন্নয়নের সেøাগান তুলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করাই হয়নি, ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগণতান্ত্রিক শাসকরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতে একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদেরও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। প্রশাসনকেও শাসকের অঙ্গ হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে গণবিরোধী শক্তি হিসেবে তৈরি করেছিলেন।
স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে আসা শেখ হাসিনার সংগ্রাম ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। মৃত্যুভয়কে পায়ে পায়ে জয় করে জনগণকে পিতার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে সম্মোহনী শক্তিকে সংগঠিতই করেননি; আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে, নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন, ভাঙন ও হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে নিঃশেষ করার চেষ্টা হয়েছে, ২১ বছর পর তিনি সেই দলকে ব্যালট-বিপ্লবে ক্ষমতায় এনেছেন।
পৃথিবীর দেশে দেশে কি উন্নত, আধুনিক, কি অনুন্নত, পশ্চাৎপদ সব দেশেই রাষ্ট্রনায়োকচিত দক্ষ নেতৃত্বের গুণেই একেকটি রাষ্ট্র এগিয়েছে। তার ’৯৬ শাসনামল সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ শক্তিকে নিয়ে বিরোধী দলের জোট গঠনের পর শেখ হাসিনাই বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই করেননি, খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত করেছেন। অশান্ত উপমহাদেশের রাজনীতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে অভিভাবকত্বের জায়গায় শান্তির দূত হিসেবে বন্ধুত্বের হাতছানি ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে যুগের পর যুগ রক্তস্নাত পাহাড়িদের জীবনে শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে চরমপন্থিদের সুপথে ফিরিয়েছেন। সংসদে মন্ত্রীর বদলে এমপিদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালুর মধ্য দিয়ে সংসদকেই সব কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু করতে চেয়েছেন। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শেখ হাসিনা সুসংহতই করেননি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলের অভিজ্ঞ, বরেণ্য রাজনীতিবিদদের রেখে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচিত করেছেন। ১৯৯৮ সালের বন্যা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলাই করেননি, নারীর ক্ষমতায়নের দুয়ারই খুলে দেননি, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের দিগন্তও উন্মোচিত করেছিলেন।
তবুও ষড়যন্ত্র তার প্রতি সদয় হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে পরাস্ত করা হয়েছে। অনেক শক্তি নেপথ্যে একসঙ্গে কাজ করে ভোটযুদ্ধে তাকে পরাজিত করেছিল। তবুও তিনি দমে যাননি। তার নেতাকর্মীদের ওপর হত্যাযজ্ঞই চালানো হয়নি, জঙ্গিবাদের উত্থানই ঘটানো হয়নি, সন্ত্রাসবাদের কালো থাবা জনপ্রিয় নেতাদের জীবনই কেড়ে নেয়নি; তাকেও প্রকাশ্য দিবালোকে একুশের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। গোটা বাংলাদেশে অস্থির, অশান্ত, রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু যার ধমনিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত, সংগ্রাম যার বুকের ভেতর, দেশ ও মানুষ যার শক্তি তাকে দমায় কে? তিনি ফের ১৪ দল ও মহাজোট গঠন করে জনমত পক্ষে টেনে নিলেন।
একটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সব জনমত জরিপে তিনিই শীর্ষে থাকলেন। তবুও গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। কিন্তু আজকে যারা গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করছেন বা এদের সঙ্গে যারা গলা জড়াজড়ি করছেন তারা সবাই মিলে একটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইলেন। সেই পথ ধরে ওয়ান-ইলেভেন এসে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে ষড়যন্ত্রের পথে সরিয়ে দিতে চাইলেন। দলের অভ্যন্তরে একটি শক্তি সেই শক্তির সঙ্গে যুক্ত হলো। কিন্তু জনগণ ও কর্মী যার প্রতি আস্থাশীল সেই নেত্রী শেখ হাসিনাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরেছেন, সাহসিকতার সঙ্গে সেই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। কিন্তু নিজস্ব ক্যারিশমা, ইমেজ ও শক্তিতে পরাস্ত করে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
ব্যালট-বিপ্লবে গণরায় রায় নিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে দিনবদলের সনদ নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরেছেন। সাফাল্য তার হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। সমুদ্র বিজয়, সীমান্ত সমস্যার সমাধান, নিজস্ব অর্থনীতিকে বিশ্বমন্দার কবল থেকে রক্ষা করে জাতীয় প্রবৃদ্ধির সূচকই বাড়াননি, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ তার হাত ধরে আজকের এই বাংলাদেশ। তিনি গণতন্ত্রের পথে গেছেন। তার অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। একের পর এক সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচনে বিএনপির বিজয় প্রমাণ করেছে।
২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে ওয়াক ওভার দিয়েছে। শেখ হাসিনার সমঝোতা ও আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করেছে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে রক্ষার হটকারী পথ নিয়েছে। এক পাল্লায় উঠে সহিংস হরতাল, অবরোধ, ভোট বর্জন, প্রতিরোধসহ নানামুখী নাশকতার কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের পঙ্গু করেছে। যারা বলছেন সংসদ অকার্যকর, শক্তিশালী বিরোধী দল নেই, তাদের আঙুল প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্ত রাজনীতির অন্ধগলিতে পথহারা বিএনিপর দিকেই তোলা উচিত। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে ক্ষমতা নিশ্চিত নয়। ভোটযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণই বড় কথা।
শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতু করছেন। উন্নয়নের এক মহাকর্মযজ্ঞে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে। সুশাসন নিশ্চিত করা সামনে তার চ্যালেঞ্জ। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে দলে ও সংসদে যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতৃত্ব নির্বাচন, মনোনয়ন তার সমানে চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রের পথে যতটা না পরাস্ত করা গেছে, তার চেয়ে বেশি ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। বিশ্বমোড়লদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জীবন দিয়েছেন পরিবার-পরিজনসহ। কুড়িবারেরও বেশি শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে। তার রাজনীতি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও যে হবে তা অবলীলায় বলা যায়।
কারণ বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি ও মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। দেশপ্রেমই তার রাজনীতির মূল শক্তি, জনগণই তার ক্ষমতার উৎস। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের বাইরে তার রয়েছে আটপৌরে এক মানবিক কোমল হৃদয়। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় মানুষ, বিপদগ্রস্ত, নির্যাতিত কর্মী এক কথায় সাধারণের জন্য তার হৃদয় কেঁদে ওঠে। গভীর মমতায় কাছে টানে। অনাথের বিয়ে দেন, জীবনের নিরাপত্তা দেন। তিনি মানুষের কল্যাণে রাজনীতির পথে হাঁটেন। শেখ হাসিনাই আজকের দুনিয়ায় মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার হিসেবে আলোর বাতিঘর হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করেছেন। তাই শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। আর এ জন্যই বারবার তাকে সমর্থন দিতে হয়।
অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন : রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সহিংসতা এই যে আমরা আবার দেখলাম, তা তো নতুন কিছু নয়। সহিংসতাটা এর আগেও ছিল, বিশেষ করে গত বছরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বড় ধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। তখন মিয়ানমারের ৯জন পুলিশ সদস্য মারা গিয়েছিল এবং পাশাপাশি রোহিঙ্গা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের সীমান্তের উপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এটার পরে আবার এক বছরের কম সময়ের মধ্যে আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এর মাধ্যমে একদিকে আমরা দেখছি যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কতগুলো শান্তি উদ্যোগ ছিল, বিশেষ করে জাতিসংঘের তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করছিলাম, সেই তৎপরতার আরও গুরুত্ব বাড়তে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তার সীমান্তে যতই বাধারোপ করুক না কেন, যে ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন রোহিঙ্গাদের উপর চলছে, এর ফলে হয়তো পুরোপুরি সীমান্ত সুরক্ষা করা সম্ভব হবে না। ফলে বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের উপরে চাপ সৃষ্টি হবে এবং পাশাপাশি এই ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটা টানাপড়েন তৈরি হবে বা টানাপড়েনের এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে এমনিতেই অনেক ধরেই সম্পর্কটা চাপের মধ্যে আছে। অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। সেখানে এটি আবার নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। আবার বাংলাদেশ সরকারের উপরে বহির্বিশ্ব থেকে তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টিও আসবে। এবং বাস্তবতা হচ্ছে দেশের ভেতরে এমনিতেই একধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে।
এবারের আক্রমণটি ছিল সহিংস। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি তারা তাদের আক্রমণের বিষয়টি স্বীকার করেছে। ফলে ওই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলো তাদের যে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে যে তৎপরতা চালাচ্ছে, ফলে এ ধরনের সহিংস কার্যক্রমের ফলে তাদের কার্যক্রম বাড়বে। ফলে আমরা একটি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছি। বিশেষ করে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এবং রোহিঙ্গাদের ইতোমধ্যে ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশে অবস্থানের কারণে এটি এখন আমাদের জন্য বড় রকমের নিরাপত্তা ঝুঁকি সামনে চলে আসছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের যে ন্যায্য অধিকার মিয়ানমারের ভেতরে, সেটির প্রতি বিশ্ব জনমত সৃষ্টি দরকার। যদিও আমরা জানি যে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র তারা খুব একটা দায়িত্ব পালন করেনি। তবে এ ধরনের সহিংসতার ফলে হয়তো এ সমস্যার গুরুত্ব আরও অনুধাবন করতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ইতোমধ্যেই বলেছেন, যদি এ ধরনের সমস্যা সমাধান না করা হয় তাহলে সহিংসতা আরও বাড়তে পাড়ে। ঘটনাটি কিন্তু তাই ঘটছে। আমার মনে হয় মিয়ানমারের উপরে বহির্বিশ্বের চাপটা আরও বাড়ানো উচিত। এবং এ ধরনের সহিংসতার যে মূল কারণ সে কারণটি হচ্ছে যে মিয়ানমারের ১৯৮৩ সালের নাগরিত্ব আইন। এ আইনটি যদি তারা পরিবর্তন না করে এবং মিয়ানমারের জনগণ যদি তাদের নাগরিকত্ব স্বীকার না করে তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
আমরা হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার চেষ্টা করব। এখানে দ্বিপাক্ষিক এবং কূটনৈতিক বিষয়। তবে রোহিঙ্গা সমস্যাকে যদি একটা মানসিক সমস্যা হিসেবে দেখি তাহলে তা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের যা করার দরকার তার কিছুই করছে না তারা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের উপর বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর চাপ দেওয়া জরুরি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আরও বেশি তৎপর হওয়া দরকার। বাংলাদেশকে আরও কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো প্রয়োজন। তার কিছুটা হয়তো আমরা দেখছিও। কিন্তু এটি আরও বাড়াতে হবে। সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত বিপন্ন রোহিঙ্গারা হয়তো কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশে ঢুকে যাবে। কিন্তু এমন একটি ধারণা যেন অতীতের মতো না হয়, ওখানে সহিংসতা হলে এখানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসবে। তবে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মানবিক দিকটি মাথায় রাখতে হবে।
পরিচিতি: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ: বায়েজিদ হোসাইন
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম : দেশের তিন মহাসড়কে যানজট দিন দিন বাড়ছে। এর অনেকগুলো কারণ আছে। আমরা জানি, দুই ঈদের সময় অস্বাভাবিক রকমের বেশি যাত্রী চলাচল করে রাস্তাগুলোতে। সাধারণ যে যাত্রী পরিবহন বা যাত্রী সংখ্যা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি যাত্রী চলাচল করে এই সময়ে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বাস, ট্রাক ইত্যাদি চলাচল করে। সাধারণ সময়ে সড়কের যে ধারণ ক্ষমতা সেই তুলনায় অনেক বেশি চাপ লক্ষ্য করা যায়। শুধু যাত্রীবাহী পরিবহনই নয়, বিশেষভাবে কুরবানির ঈদে কুরবানির পশুবাহী যানবাহন বিপুল সংখ্যায় চলাচল করে। এটা যানজটে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এটা পৃথিবীর আর কোনো শহরে হয় বলে আমার জানা নেই। আমাদের মহাসড়কগুলো ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। সড়ক তো তৈরি করা হয় কিন্তু সেখানে উন্নতমানে তৈরি হয় না এটাও একটা কারণ। আবার এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার ফলে সমস্যাটা আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
আবহাওয়াজনিত কারণেও এই সমস্যাটা হয়ে থাকে। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিবৃষ্টি হলে সড়কগুলো দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দেশের সড়কগুলো পিচঢালা হওয়ার কারণে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কংক্রিটের হলে হয়তো এত দ্রুত নষ্ট হতো না। এবার বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মহাসড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিছু কিছু জায়গায় সড়ক ভেঙে গেছে, সেতু ভেঙে গেছে, কালভার্ট ভেঙে গেছে এসব কারণে যানজটটা আরও বেশি হচ্ছে। ব্যবস্থাপনার সমস্যার কারণে সাধারণ মানুষকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বহুবিধ সমস্যার কারণে এটা তীব্র আকার ধারণ করেছে। মহাসড়কের যানজট কমিয়ে আনা একেবারে সহজ হবে না। মানুষের চলাচল কিভাবে কমাবেন। এই সমস্যাগুলো দূর করতে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দ্বিকেন্দ্রিক করতে হবে। এটা তো আমি বলে ফেললাম দুটো শব্দের মাধ্যমে কিন্তু এটা করাটা খুব কঠিন। তবে এটাই হলো দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা। ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দ্বিকেন্দ্রিকরণ করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আগামী পাঁচ বছরে, দশ বছরে, বিশ বছরে একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতেই হবে। অর্থাৎ বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহরে যেন উন্নয়ন হয়। দেশের সব মানুষকে যেন ঢাকায় আসতে না হয়। সব মানুষকে আবার ঢাকা থেকে যেন বেরিয়ে না যেতে হয়।
পৃথিবীর আর কোনো শহরে এই মাত্রায় যানজট লক্ষ্য করা যায় না। কম বেশি হয়। যেমন পূজার সময় কলকাতা, দিল্লিতে যানজট হয় কিন্তু ঢাকার মাত্রায় হয় না। কাজেই এই সমস্যা সমাধানে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দ্বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মহাসড়কগুলোর লেন বাড়াতে হবে। এবং এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। মহাসড়কের উপর চাপ কমাতে নৌ ও রেলপথ সম্প্রসারণ করতে হবে। রেলওয়ের মান উন্নয়ন করতে হবে, তাহলে মহাসড়কের উপর চাপটা কমবে।
পরিচিতি: স্থপতি ও শিক্ষাবিদ
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
তুরিন আফরোজ : ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক বিশাল পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ের ২২৬ পৃষ্ঠা থেকে ২২৯ পৃষ্ঠায় তাঁর এই পর্যবেক্ষণ বিধৃত হয়েছে। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণে বেশ কয়েকটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যেমন, দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্নীতি পরিস্থিতি, অকার্যকর সংসদ, স্বাস্থ্যখাতের অবনতি, জনপ্রতিষ্ঠানসমূহকে মেধাশূন্যকরণ, প্রশাশনিক অব্যবস্থাপনা, অপরাধের পরিবর্তিত ধরন, নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ব্যর্থতা, নিয়ন্ত্রণবিহীন আমলাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগের ঔদ্ধত্য ও অদক্ষতা ইত্যাদি।
তাহলে মাননীয় প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, তাঁর মতে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোনো কিছুই আশাব্যঞ্জক নয়। তবে হ্যাঁ, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে ২২৯ পৃষ্ঠায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি লিখেছেন:
Even in this endless challenge , the judiciary is the only relatively independent organ of the State which is striving to keep its nose above the water through sinking.
অর্থাৎ তিনি লিখেছেন:
“সীমাহীন প্রতিকূলতার মাঝেও রাষ্ট্রের একমাত্র অপেক্ষাকৃত স্বাধীন অঙ্গ, বিচার বিভাগ, ডুবন্ত অবস্থায়ও নিজের নাক পানির ওপর ভাসিয়ে রাখবার লড়াই করে যাচ্ছে।”
এই যে পানির ওপর নাক ভাসিয়ে আমাদের বিচার বিভাগ নিরন্তর লড়াই করে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান সবার ওপরে রাখছেন, দুর্নীতি নিয়ে তার একটা সাম্প্রতিক প্রতিচ্ছবি দেখে আসা যাক।
মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে, ২০০৯ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে তিনি অবসরে যান। আলোচিত এই বিচারপতি ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত’ বলে তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে আমেরিকায় অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। যে কারও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার তাদের রয়েছে।দুদকের কাছে কোনো অভিযোগ এলে প্রথমে অভিযোগ অনুসন্ধান করা হয়। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এর জবাবে ২৮ এপ্রিল আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুদকে পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
এই চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেছেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেওয়া রায় সকলের উপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার দেওয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না মর্মে সুপ্রিম কোর্ট মনে করে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠি পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাই করেছে দুদক। চিঠিটি কমিশনের সভায় উপস্থাপন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এটির সঠিকতা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিঠির সঠিকতা যাচাই করে তা আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীরই বলে নিশ্চিত হয় দুদক। এ বিষয়ে দুদকের একটি নথিতে বলা হয়েছে:
“পত্রটি স্বাক্ষরকারী অরুণাভ চক্রবর্তী মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদন ও নির্দেশক্রমে প্রেরিত পত্রটিতে তার স্বাক্ষর সঠিক।”
ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের ২২৮ পৃষ্ঠায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে বর্তমানে ‘অবাধ দুর্নীতি’ চলছে। তাঁর এই দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতি আমরা অবশই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু মাননীয় প্রধান বিচারপতি যখন বিচার বিভাগের দুর্নীতির তদন্ত বন্ধের বিষয়ে চিঠি দিয়ে দ্বৈত অবস্থান গ্রহণ করেন তখন আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না।
বিচার বিভাগের দুর্নীতি কি তাহলে দুর্নীতি নয়? বিচারকগণ কি তাহলে আইনের ঊর্ধ্বে? আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তাহলে আমার প্রশ্ন, আমার দেশের বিচারপতিগণ কি ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো মহামানব যে, আমাদের জনগণ তাদেরকে দুর্নীতি করার অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে?
এম সাখাওয়াত হোসেন : প্রথমে সুশীল সমাজ ও পরে দুই পর্বে দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংলাপ সম্পন্ন করেছে। এরপরেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মোটাদাগে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম দুই আলোচনায় যা দেখলাম সেই একই কায়দায় আলোচনা করলে এটি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। তবে অতীতেও বলেছি এখনো বলেছি উদ্যোগটি যথেষ্ট প্রশংসনীয়, এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও অত্যন্ত জরুরি। এসব আলোচনার একটি লক্ষ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো না হয়। আগামী নির্বাচন হতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ে এই দেশের আপামর জনসাধারণও একমত পোষণ করেন। এটাই নির্বাচন কমিশনের প্রয়াস এবং এ বিষয়ই নির্বাচন কমিশনের করণীয় নির্ধারণে সহযোগীদের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন।
এ পর্যন্ত কয়েকটি আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরাও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে করা যায়, তা নিয়েই আলোচনা করতে গিয়ে কার্যত দুটি বিষয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন। বিষয় দুটি এর আগেও চর্চিত হয়েছে এবং এর ওপর সংক্ষিপ্তভাবে লিখেছিলামও। এর একটি নির্বাচনকালে সেনা নিয়োগ এবং অপরটি ‘না-ভোট’-এর বিধান রাখা। মনে হয় যেন এই দুটিই আগামী নির্বাচনের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র অন্তরায়! তেমনটা মোটেও নয়। এগুলো আনুষঙ্গিক মাত্র। যাঁরা এই দুটি ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন, তাঁরা কোনো জোরালো বা যৌক্তিক কারণ তুলে ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
যেমনটা আগেও বলেছি, সামরিক বাহিনীর সাহায্য এ পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনে প্রয়োজন হয়েছে। এ নির্বাচন সহযোগিতা ছাড়া অনুষ্ঠিত হবে বা হতে পারবে, তা মনে হয় না। এবং বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভরশীল। এখানে প্রশ্ন থাকতে পারে যে ওই সময়ে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন এবং তাদের কার্যক্রম রিটার্নিং অফিসার তথা নির্বাচন আইনের আওতায় হবে, নাকি সিআরপিসির আওতায় হবে? এখানে প্রয়োজন মতামতের। যদিও আমি এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কারও মতামত খুব জরুরি, তেমনটা মনে করি না।
এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে ভোটারদের নিরাপত্তা ও নির্বাচনের পরিবেশ আয়ত্তে রাখার জন্য। নির্বাচন কমিশন যদি শুধু অস্ত্রবিহীন আনসার-ভিডিপি দিয়েও অথবা কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাতে পারে, সেটাই হবে কাম্য। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতির পরিবেশে তা শুধু সুখস্বপ্নই মাত্র। আদৌ এ স্বপ্ন বাংলাদেশে কোনো দিন বাস্তব হবে কি না জানি না, তবে ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেকের অনেক মত থাকলেও নির্বাচনের পরিবেশ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তেমন থাকেনি।
আগামী নির্বাচনের পরিবেশ বা নির্বাচন কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। কারণ, বিগত দিনগুলোতে সাধারণ মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, যার দায়দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দলের। তবে বর্তমান কমিশন সব সময়েই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারবে বলে তাদের আশাবাদ জানিয়ে আসছে। হালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বর্তমান সংবিধানের আওতায় দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব যদি সে পরিবেশ তৈরিতে সবার প্রচেষ্টা এবং সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তেমন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আমাদের দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অধিকাংশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উদাহরণ রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত আধুনিক তাত্ত্বিক কাঠামোর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ ব্যবস্থাপনায় একটি অত্যন্ত কার্যকর শক্তিশালী নির্বাচনী আইন রয়েছে। রয়েছে সহজে আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের ব্যবস্থা, একটি স্বাধীন এবং আইন দ্বারা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী নিষ্পত্তি আইনের মাধ্যমে আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে এবং মনোনয়ন নির্ধারণে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি ক্ষমতা এবং নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইনের বিধান ও আদালতে আবেদন করার এবং ত্বরিত মীমাংসার ব্যবস্থা।
তদুপরি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের বিশাল বহরের মাঠপর্যায়ের এবং প্রয়োজনীয় সরবরাহের (লজিস্টিকস) ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। এত কিছুর পরও প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক যে, তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? তাত্ত্বিকভাবে হওয়ার কথা, তবে বাস্তবটা কি তেমন? এ প্রশ্নের উত্তরে অন্তর্নিহিত রয়েছে তাত্ত্বিক ব্যবহারিক বা বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে তফাত। আমাদের দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুখকর হয়নি, এর উদাহরণ টানার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। দু-চারটি ভালো স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সার্বিক বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। স্মরণ থাকার কথা যে ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো কেমন হয়েছিল, তা নিয়ে কথা বলারও তেমন কিছু নেই।
যেমনটা বলেছি তাত্ত্বিক দিক হতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সব কাঠামোই বিদ্যমান, তবু দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্কের কারণ প্রধানত তত্ত্বকে প্রয়োগে পরিণত করার মতো পরিবেশ তৈরি করা। বিদ্যমান পরিবেশে সম্ভব নয়। এ অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অন্তরায়;সেগুলো আমার গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লব্ধ, উল্লেখ্য১. রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যা সুবিধাভোগী (প্যাট্রন ক্লায়েন্ট) রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। দুটি সামরিক ও আধা সামরিক শাসনের সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে। ২. প্রশাসন–ব্যবস্থা ব্যাপক দলীয়করণ, যা ১৯৭৫-এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত। ৩. নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ নিয়ে ধোঁয়াশা, বিশেষ করে স্থায়ী গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় দলীয় সরকারকর্তৃক নিয়োগ; ৪. নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনার সমস্যা।
এ পর্যায়ে আমি সংক্ষিপ্তভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় আমাদের মতো দেশে, যেখানে ভালো নির্বাচনের অন্তরায়গুলো দারুণভাবে নির্বাচনের মুখ্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়, তার অন্যতম নির্বাচনী নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করছি। আমাদের মতো দেশে যেকোনো নির্বাচনে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে নিরাপত্তাই নির্বাচন কমিশনের প্রধান মাথাব্যথার কারণ এবং সবচেয়ে দুরূহ কাজ হিসেবে বিবেচিত।
একটি নির্বাচনে নিরাপত্তার পরিকল্পনা করতে হয় তিন ধাপে, ১. প্রাক্-নির্বাচন (ভোট গ্রহণ): ২. নির্বাচনের দিন এবং ৩. নির্বাচনের পর। এই তিন ধাপের প্রতিটিতে চার স্তরের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেবিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো এর প্রশিক্ষণ, বাহিনীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের মতো দেশে জনগণের আস্থার বিষয়টি বিবেচনায় এনে স্তরগুলো বিন্যাস করতে হয়। এই স্তরগুলো হলো ১. কাঠামোগুলোর নিরাপত্তা: নির্বাচনী অফিস, রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস, ভোটকেন্দ্রসহ গণনাকেন্দ্র এবং অংশগ্রহণকারী দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অফিসগুলো, ২. নির্বাচনে ব্যবহার্য দ্রব্যাদির নিরাপত্তা, ৩. তথ্যের নিরাপত্তা,ভোটার তালিকা, বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং নির্বাচনের ফলাফল এবং সংশ্লিষ্ট আইনানুগ তথ্যাদি এবং ৪. ভোটার, জনসাধারণ এবং নির্বাচনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা। চতুর্থ স্তরের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তরের নিরাপত্তা নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি না হলে ভোটাররা, বিশেষ করে নারী ভোটার ও পক্ষান্তরে সংখ্যালঘু ভোটাররা, নির্বাচন থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরত থাকেন।
ওপরে আলোচিত ধাপ এবং স্তর বিবেচনা না করে নিরাপত্তার পরিকল্পনা কার্যকর হয় না। একই সঙ্গে প্রতি ধাপ এবং স্তরের জন্য কী ধরনের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের, প্রশিক্ষণ এবং নির্ভরযোগ্য বাহিনীর প্রয়োজন, সেটা বিবেচনা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।
পরিকল্পনাকালে আরও মনে রাখতে হবে বর্তমান পরিবেশে জঙ্গি হামলার বিষয়টিকেও। আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তার বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ, তার সামান্য উদাহরণ নির্বাচনী বাজেটে নিরাপত্তার খরচ। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে, শুধু নিরাপত্তা বাবদই খরচ হয়েছে ১৯৯ কোটি ৯২ লাখ ৯ হাজার ৬১ টাকা। নির্বাচনী বাজেটের ৭০ শতাংশ। স্মরণযোগ্য যে মাত্র ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অপরদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ব্যয় ছিল ৯৪ কোটি ৬৮ লাখ ৬০ হাজার ৫৩ টাকা। ১৯৯১ সালে খরচ হয়েছিল ২৮ কোটি ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ১৭৩ টাকা। (সূত্র: নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী পরিসংখ্যান)।
ওপরের পরিসংখ্যান থেকেই প্রতীয়মান হয় যে আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় যজ্ঞ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা। এত ব্যাপক আয়োজন ইঙ্গিত দেয় যে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতেনিরাপত্তার বিধানই নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। এত বড় যজ্ঞের পরও সুষ্ঠু নির্বাচন করা দুষ্কর, যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে এবং জনমনে বিশ্বাসযোগ্যতা, সংগত কারণে ঘাটতি থাকে। তবে আমার মতে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সহায়ক প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। প্রশাসনের সংস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অন্তর্ভুক্ত, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভাজন এবং সংস্কৃতির কারণ নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কাজেই ওপরের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের আঙ্গিকে আগামী নির্বাচনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা, যা এখন থেকেই শুরু করা উচিত। কী ধরনের বাহিনী কোন ধাপ এবং স্তরের জন্য প্রযোজ্য হবে, তা যেমন আইনি কাঠামো ও নিরাপত্তা পরিকল্পনায় রাখতে হবে, তেমনি রি-অ্যাকটিভ নয় প্রো-অ্যাকটিভ নিরাপত্তার পরিকল্পনায় সামরিক বাহিনী ব্যবহারের প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যাবে নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা ও সামর্থ্য থেকে। আমি মনে করি, ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ নিরাপত্তার জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে রাখতে নির্বাচনী আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করাই শ্রেয়। কাঠামোতে রাখা মানেই এই নয় যে সামরিক বাহিনী অথবা আইনে উল্লেখিত সব বাহিনীকেই নিয়োগ দিতেই হবে। কোন কোন বাহিনী কোন কোন স্তরের জন্য প্রয়োজন, সে নির্ণয় নির্বাচন কমিশনের। কাজেই এ বিষয় নিয়ে বিতর্ক অবান্তর।
নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। এ কাজ করতেনির্বাচন কমিশনকে যা যা করার প্রয়োজন, তেমন ক্ষমতাই সংবিধানের ১১৯ ধারার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখেই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যে পরিবর্তন ও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন, তা নির্বাচন কমিশনকে এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো ১৬-১৭ মাস বাকি। নির্বাচনের অব্যবহিত প্রাক্কালে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেটা এত আগে বলার এবং মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণার পর বা তিন-চার মাস আগে একটা বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে যেমন আনন্দ, উল্লাস ও উৎসবের একটা অবস্থা বিরাজ করে, তেমনি এলাকাভেদে কম-বেশি নিরাপত্তার শঙ্কাও সৃষ্টি হয়। সবসময় যেমন, ঠিক তেমনি নির্বাচনের সময়েও শান্তি রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীসহ বেসামরিক প্রশাসনের। সময়মতো পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে যদি মনে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যথেষ্ট নয়, তাহলে অতিরিক্ত হিসেবে ওহ অরফ ড়ভ ঈরারষ ঢ়ড়বিৎ, এই বিধানের আওতায় সেনা মোতায়েন করা যেতে পারে। তখন পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বের কাঠমো ও পরিধি নির্ধারণ করলে সেটাই হবে যথার্থ। তার আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা এবং সঙ্গতকারণেই সেটা হবে বিপজ্জনক। সুতরাং সেনা মোতায়েন নিয়ে এখনই যারা শোরগোল করছেন, তাদের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ বোঝা কষ্ট হয়ে যায়।
১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনীতিতে যে প্রলয়কা- ঘটে গেছে এবং যেভাবে ঘটেছে তাতে কার মনে কি আছে তা সহজে বুঝে ওঠা মুশকিল। প্রথম ও মৌলিক কথা হলোÑ দেড় বছর আগে পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি ব্যতিরেকে ফোর্সসমূহের দায়িত্বের পরিধি নিরূপণ করলে নির্ঘাত সেটি ভুল হবে এবং তা নিয়ে অবধারিতভাবে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ভেতরে অনাকাক্সিক্ষত রাজনীতি চলে আসবে। আর সেই রাজনীতির মাঝখানে পড়বে সেনাবাহিনী। তখন সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করার পূর্ব অভ্যাস যাদের আছে তারা ইচ্ছামতো একতরফা বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে পার্টিশন অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করবে, যেমনটি আগে আমরা দেখেছি। তাতে সেনাবাহিনীর পেশাগত বিশেষত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাহিনীর মনোবল ও শৃঙ্খলার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব দেশের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে ও ঊর্ধ্বে দেখতে চায়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের পরে পরপর দুজন সামরিক শাসক সেনাবাহিনীকে রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে অশেষ ক্ষতি করেছেন। ওই খারাপ দৃষ্টান্ত থেকে বের হওয়ার চেষ্টা সবাইকে অব্যাহত রাখতে হবে।
সময় পরিপক্ক হওয়ার আগে এখনই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে যারা অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তারা সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে টেনে আনার অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে আমার কাছে মনে হয়। সময়মতো পরিস্থিতির বিবেচনায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখনই কেন? একটি মৌলিক কথা আমাদের স্মরণে রাখা দরকার। আর তা হলোÑ যার যে কাজ সেটি তাকে দিয়ে না করিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী।
আর সে ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো কথাই নেই, সেনাবাহিনীদের পার্টিশন ব্লেইম গেমের মধ্যে ফেলা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় অন্তরায় হচ্ছে প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার এবং ভোট কেনাবেচায় টাকার ব্যবহার। অথচ এটা রোধ করার উপায় নিয়ে তেমন জোরালো ও বাস্তবসম্মত সুপারিশ কারও পক্ষ থেকে আসছে না। এটা নিয়ে বরং এখন সবচাইতে বেশি আলোচনার দরকার, যাতে সময় থাকতে প্রয়োজন হলে যেন বিধি-বিধান পরিবর্তন করা যায়। আগের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন প্রাক ও উত্তর সময়ে নিরাপত্তাজনিত সমস্যার বড় শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর মানুষ। তারপর সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এক রকম পরিবেশের সৃষ্টি হবে, আবার কোনো বড় দল অংশ না নিলে অন্য রকম হবে। অন্যদিকে বর্জনকারী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
একটি বিষয়ের ওপর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজে সেনাবাহিনীকে যেন জড়ানো না হয়। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জড়িয়ে গেলে নির্ঘাত ব্লেইম গেমের শিকার হবে, যেটি কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। দুই সামরিক শাসন রাজনীতিতে জড়িত করায় এক সময় সেনাবাহিনী ও জনগণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছিল এবং দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল যেটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য চরম ক্ষতিকর। সেনাবাহিনী সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস যতটা গৌরবোজ্জ্বল সে রকম উদাহরণ খুব কম দেশের সেনাবাহিনীর রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে। ফলে তার জন্ম বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হলো জনগণ এবং সেনাবাহিনী এক ও অভিন্ন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ ও সেনাবাহিনীর রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশের মাটিতে একসঙ্গে। জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য এ বন্ধনের মূল্য অপরিসীম। তাই সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে এবং সংবেদনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও কাজ বা রাজনৈতিক দলের সালিশি ও ঝগড়া মেটাতে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা ঠিক হবে না। তাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে পার্টিশন চিন্তা-চেতনা চলে আসতে পারে। পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনের পেশাই হলো জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। তারা জানে কিভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখতে হয়। সবাইকে এক করে ফেলা বা এক জায়গায় নিয়ে আসা দূরদর্শী কাজ হবে না। তাই নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতির বিবেচনায় সেনা মোতায়েন করতে হলে তা অবশ্যই হতে হবে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এবং নিয়োজিত থাকবে স্ট্রাইকিং ও স্ট্যান্ডবাই ফোর্স হিসেবে।
লেখক: কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
তুষার আবদুল্লাহ : বন্যা এখন মধ্যাঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে প্লাবন মধ্যাঞ্চল হয়ে পশ্চিমমুখি হয়। বন্যার দাগ এখনও শুকোয়নি পূর্বাঞ্চলে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এই ব-দ্বীপ প্লাবিত হবে, এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। এই অঞ্চলের মানুষেরা সেই প্লাবনের সঙ্গে লড়াই করেই চলে। তবে কখনও কখনও সেই ঢল, অস্বাভাবিক এবং প্রলয়ঙ্করী রূপ নেয়। এবার বন্যা সেই রূপ নিয়েছে। বন্যার প্রলয়ঙ্করী রূপের বড় কারণ- এবার একাধিকবার প্লাবিত হয়েছে বাংলাদেশ। যদি পূর্বাঞ্চলের কথাই বলি, তাহলে মে মাসের আগাম বন্যায় প্রথমবারের মতো ভেসে যায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল। সেই প্লাবন নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জকেও আক্রান্ত করে। সুনামগঞ্জ নিকট অতীতে এমন প্লাবনের মুখোমুখি হয়নি। ধান, মাছ, বসত সবই হারাতে হয়েছিল তাদের। এই দুর্যোগ থেকে ওঠে না দাঁড়াতে আবারও ধেয়ে আসে বন্যা। পূর্বাঞ্চল দ্বিতীয় দফা আক্রান্ত হয়। উত্তরের অভিজ্ঞতা একই। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা বন্যার কবলে পড়ে দুই দফা। দ্বিতীয় দফায় তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র ভাসিয়ে নেয় লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং দিনাজপুরকেও। বন্যা নওগাঁ, রাজশাহী হয়ে বন্যা এখন টাঙ্গাইলে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র দাবি করছে, ১৯৮৮’র মতো ঢাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করবে না। তাদের দাবি সত্য হলেও, নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর সুযোগ নেই। কারণ রাজধানী এরই মধ্যে বন্যার কবলে। জলে প্লাবিত না হলেও, উত্তর, পূর্ব-পশ্চিম আক্রান্ত হওয়ার প্রভাব রাজধানীতে পড়তে শুরু করেছে। ফসল নষ্ট হয়েছে সত্য, কিন্তু যতোটা না নষ্ট হয়েছে তারচেয়ে বেশি পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে বন্যার অজুহাত তুলে।
রাজধানীর মানুষ না হয় একটু বেশি দামেই চাল-সবজি-মাছ কিনে খেলো। কিন্তু যার ঘর কেড়ে নিলো নদী, যার ফলন ভেসে গেলো বাঁধ ভাঙা জলে, যে খামারি হারালেন তার গরু-মুরগি-হাঁস, তার পেটে অন্ন জুটবে কী করে। এই বিপন্ন মানুষদের জন্য ত্রাণ প্রয়োজন। দরকার আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা। এই প্রকার দুর্যোগে সকল সরকারের বরাদ্দ থাকে। টাকা, খাবার, টিন সবই থাকে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বন্যার্ত মানুষের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সেই ত্রাণের খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। কোনও কোনও দ্বীপচরের মানুষের পক্ষে ইউনিয়ন, উপজেলা শহরে এসে সেই ত্রাণ নেওয়ার সাধ্যটুকুও থাকে না। কারণ ত্রাণ নিতে আসার মতো নৌকা বা বাহনের ভাড়া জোগাবেন তিনি কী করে। আবার কোনোভাবে দলবদ্ধ ভাবে যদি এসে পৌঁছানোও যায়, তাহলে বরাদ্দ থেকে খানিকটা কেটে রাখা হয়। তারচেয়েও বড় ঝক্কি, বন্যার যে বড় দুর্ভোগ রাজনৈতিক দলের তালিকায় নাম ওঠানো। এসব সাত পাঁচ ভেবে বিপন্ন-নিরন্ন মানুষেরা ত্রাণ শিবিরের দিকে ছুটে যান না। অপেক্ষায় থাকেন কেউ তাদের ঘর অবধি পৌঁছে যদি একটু সাহায্য তুলে দেয়। এই সাহায্য নিয়ে যাওয়ার দলে আছে যে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও, তাদের আবার ত্রাণ দেওয়ার চেয়ে আয়োজন বেশি। এক প্যাকেট বিস্কুট দেওয়ার জন্য খরচ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। ত্রাণের প্রচারের দিকেই তাদের নজর বেশি। বাস্তবে যে ত্রাণটি দুর্যোগ কবলিত মানুষের কাজে দেয়, সেটি ব্যক্তি মানুষের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের। তারাই আসলে বিপন্ন মানুষের কাছে অনাড়ম্বর ভাবে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারে, পেরেছে। অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। এখন যদিও ত্রাণ দেওয়ার সেলফি যুক্ত হয়েছে। তবুও আস্থা রাখি শিক্ষার্থী, সংগঠক এবং ব্যক্তির বিতরণ করা ত্রাণই সবচেয়ে কার্যকর। আজকাল বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানও ত্রাণ নিয়ে মাঠে নামে। তবে তাদেরও মূল লক্ষ্য মিডিয়া কভারেজ।
সুতরাং আসছে ঈদ ও পুজাতে আমরা যদি একটু সংযমী হই, তাহলে যার ঘর বিলীন হয়েছে নদীতে তার জন্য অন্তত একটি টিন, বিপন্ন পরিবারের শিশুদের খাবার, রোগীর পথ্যের জোগান আমরা দিতে পারবো। কোনও কোনও শিক্ষার্থীর হয়তো বই ভেসে গেছে বানের জলে। তার হাতে আবারও তুলে দিতে পারবো পাঠ্যবই। দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরিয়ে আনতে সাহসের জোগান দিতে, তারণ্যের শক্তির বিকল্প নেই। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লায় দেখছিলাম তরুণরা ঘুরে ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করছে। তাদের এই উদ্যোগ দেখেই ভরসাটা বাড়লো।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি
বিথী হক : পরিচিত প্রগতিশীল প্রাক-মধ্যবয়সীদের সঙ্গে এক ওয়েটিংরুমে বসে বসে টেলিভিশনে চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপনে পুরুষ সঙ্গী তার নারী সঙ্গীর মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া কাপড়টা খুব অসহ্য আর বিদঘুটে লাগল। ‘কী ধুয়েছো, পরিষ্কার হয় না’- বলে নারীর মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া কাপড় নিয়ে কারও কোনও সমস্যা নেই। না নারী, না পুরুষ, না স্বামীর, না স্ত্রীর! কিন্তু কারও না কারও সমস্যা থাকার কথা। বিশেষত ছুঁড়ে দেওয়া কাপড়ের জায়গাটি যদি ওয়াশিং মেশিন না হয়। ডাস্টবিন, ওয়াশিং মেশিন বা ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে কোনও জিনিস ছুঁড়ে ফেলাটাই যুক্তিযুক্ত, কারও মুখের ওপর নয়। এই মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত স্মার্ট ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘ভালোবেসে বউ যদি কাপড় ধুয়ে দেয়, তাহলে সমস্যাটা কোথায় আপনাদের? সবখানে পেঁচানোটা আপনাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।’ বিষয়টি শুধুমাত্র কাপড় পরিষ্কার-অপরিষ্কার ছাড়িয়ে পারিবারিক নির্যাতনকেও প্রমোট করবে কিনা এই প্রশ্নটি করার আগেই তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন।
আমার অনেক কথাই তখন আর বলা গেলো না। ভালোবাসাটা কি একপেশে? সব ভালোবাসা শুধু নারীই বাসবে? ভালোবেসে ভাত রাঁধবে, ঘর-দোর মুছবে, ছুঁড়ে দেওয়া কাপড় ধোবে, অসুস্থ হলে সেবা করবে, যত্ন করে সংসার গুছিয়ে রাখবে, বাচ্চা-কাচ্চা দেখভাল করবে; সবই ভালোবেসে করবে সমস্যা নেই। কিন্তু ভালোবাসা সব একজন বাসলে ঝামেলা। সঙ্গী যদি মনে করেন অবস্থানগতভাবে একজন সেবা করতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন, ‘ভালোবাসি’ বললেই যদি হাসিমুখে সব মেনে নেন তাহলে নিজেকেও যে ঠকানো হয়! ভালোবেসে শাসক-শ্রেণি কখনও শোষিতের কাপড় ধুয়ে দেন না কেন? নোংরা শোনায় নিশ্চয়ই, এসব তো নারীবাদ নয়।
আরেকজন নেতা মানুষ, সভা-টকশোতে নিয়মিত যান, সমানাধিকারের কথা বলেন, কিন্তু বিশ্বাস করেন সন্তান জন্মদান নারীর ইচ্ছে-অনিচ্ছের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। সন্তান জন্মদান প্রাকৃতিক, তাই সবাইকে এই নিয়মের মধ্যদিয়ে যেতেই হবে। এখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও স্থান নেই। এমনকি যে নারী বিয়ের পর পুরুষের নাম নেন, তার পক্ষেও সেই ব্যক্তির অবস্থান বেশ দৃঢ়। তার কাছে নারীর আইডেন্টিটি বদলানোর ঘটনা এমনকিছু নয়, স্বাভাবিক ঘটনা।
সেই তিনিই কিন্তু স্বাভাবিক হলেও অনেক কিছুই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে চান না। তার শার্ট-লুঙ্গি পরে বাইরে বেরোতে আপত্তি। ঔপনিবেশ হওয়ার আগে একপ্রস্থ কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকার স্বাভাবিক রীতিতে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। বলেন, তার ইচ্ছে এবং স্বাচ্ছন্দ্যটা গুরুত্বপূর্ণ, আর এখন সময় বদলেছে। সময় যে একদিনে বদলায় না, একে কারও না কারও বদলাতে হয়। এতেও তিনি স্বাভাবিকত্ব খুঁজে পান না। এবং তাই সন্তান জন্মদানে নারীর ইচ্ছে, স্বাচ্ছন্দ্যবোধের গুরুত্বটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কয়েকদিন আগে টিএসসিতে বসে এক মানবাধিকার কর্মীকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় একজন প্রো-প্রগতিশীল বললেন, ‘নারীরা নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করলে কী সমস্যা! নারী-পুরুষ সমানাধিকারের নামে এগুলো বাড়াবাড়ি।’ ‘তাহলে আত্মসম্মানবোধ আর নিজের পরিচয় তৈরির জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি বা স্বাধীনতা কোনও ফ্যাক্টরই নয়?’ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার মাও তো বিয়ের পর বাবার কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন, এমনকি দাদিও! তাতে কি তারা পরাধীন হয়ে গেছেন বা আত্মসম্মানহীন হয়ে গেছেন!’
এ বিষয়ে বললেই প্রাগৈতিহাসিক ঘটনার বিবৃতি একের পর এক আসতে থাকে। বাক্স-পেটরা টেনে ৪৪ হাজার বছরের রেফারেন্স, তন্ত্র আর চর্চা টেনে এনে যেকোনও কিছুর বৈধতা দেওয়া আমাদের অভ্যাস। আরও বেশি ঢুকেছে ‘মা-নানি-দাদিরা এতদিন যা করে এসেছেন তা ভুল হবে না’ যুক্তি। সবই তো পুরনো নিয়ম, পুরনো নিয়মে চললে কোনও সমস্যাই নেই।
ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার আপনার পাঁচ হাজার টাকা বেতন থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ খেয়ে আপনার বাবার পেনশনের ফাইল খুলে কাজ করবেন, এটাও পুরনো নিয়ম। আপনি এই নিয়ম ভাঙতে চাইলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। সেই ভদ্রলোক কতটাকা বেতন পান, তার স্ট্যাটাসের সঙ্গে তার বেতন কতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তার ঘুষ খাওয়াকে বৈধতা দেওয়া কোনও যৌক্তিক কাজ হতে পারে না নিশ্চয়ই। আপনি ঘুষ দেন, কারণ ওখানে ঘুষের সংস্কৃতি তৈরি আছে। না দিলে কাজ হয় না। ৫০০ বছর পর সেটাই নিয়ম বনে যাবে, তারপর সিভিল রাইটস। এখন হঠাৎ যদি মনে হয় এটা অন্যায়, আপনি আপনার টাকা অন্যায়ভাবে অন্যের কাছে দিতে চান না। যদি মনে হয় সিস্টেম যাই থাকুক, বদলাক বা না বদলাক বা নিজের মতো করে বদলাক, আপনি আপনার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করবেন তো তাতে দোষের কিছু নেই।
আপনার বা আমার মা-দাদির আত্মসম্মানের ঘটনাও এখানে এমনই। একটা চর্চা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে চলতে এখন এটাই সত্য আর স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এর বাইরে কেউ বের হতে চাইলেই তা আমাদের অদ্ভূত লাগে। অন্যের কাছ থেকে রোজ টাকা নিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে থাকলে, একটা মানুষের নিজের আত্মবিশ্বাস অনেকখানিই কমে যায়। তাছাড়া ভাবুন তো আপনি আপনার খুব ভালো একজন বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নেন, রোজ নেন। সে ছাড়া আপনার অন্যকোনও উপার্জনের উৎস নেই। সে একদিন অন্যায় আবদার করলে আপনি চাইলেই তাকে ‘না’ করতে পারবেন না। বা ধরুন অন্যায় নয় একেবারেই, কিন্তু তার সব কথা তার অধস্তন হিসেবে শোনাটাকে, তার বাধ্যগত হয়ে যাওয়াটা একসময় আপনার গা-সওয়া হবে না? বা ধরুন সে আর নাই। তার অনুপস্থিতিতে আপনি কোথায় যাবেন, কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজবেন, কী খাবেন?
আর কিছু না হোক, নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে হলেও সবারই নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা জরুরি। শুধু নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আর আত্মসম্মানের কথা বললে কেন সেটা অতিরঞ্জন হয়? বাড়াবাড়ি হয়? আপনার মানবতাবাদ কেন এই মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা বলে না?
যেকোনও সম্পর্কেই সমতা একটি বড় ফ্যাক্টর। বন্ধু বা সঙ্গী হওয়ার ক্ষেত্রে তো আরও জরুরি। সম্মানের সঙ্গে সমতার তেমন কোনও সম্পর্ক না থাকলেও যেখানে সমান অংশগ্রহণ দরকার, সেখানে সমতার বিকল্প কিছু আছে? সমতা না থাকলে তার জন্য আন্দোলন আর চর্চারও কোনও বিকল্প শর্টকাট পথ নেই। সবকিছু যদি ঠিকঠাকই চলে, তাহলে আন্দোলন কেন? ঠিকঠাকই যদি থাকে তবে পুরুষতন্ত্রের অপরাধই বা কোথায়? কেনই বা মানবতাবাদের কথা বলেন?
মানবতাবাদের কথা বলবেন আর ঘরের ভেতর অসমতার চর্চা করবেন, তবে রেনেসাঁর পথ চেয়ে কেন বসে থাকা? যেমনভাবে পৃথিবী চলেছে এত এত হাজার বছর, তেমনভাবেই তো পৃথিবী বাকি হাজার বছর চলে যেতে পারবে। এত মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কেন তবে? বিপ্লবেরই বা কী দরকার! আমরা সকলেই বেঁচে আছি, ভালোভাবে। প্রতিদিন রাতে তো আর আমাদের চামড়া ফুটে রক্ত বেরোয় না, বুকে গুলি লাগে না, তবে সিস্টেম চেইঞ্জ নিয়ে কেন এত মাথাব্যথা হয় আমাদের। আবার সমস্যা সিস্টেমে থাকলে শুধু সিস্টেম বদলে গেলেই কাল থেকে সবাই সিস্টেমমাফিক বোরকা বা বিকিনি পরে যেমন রাস্তায় বেরোনো শুরু করবে না, নিজে নিজে দৌড়ে বাসে উঠতে পারবে না, তেমন পরদিনই সকল অন্দরমহলের নারীরা অফিসে ছুটে যাবে না। তাই এমন আন্দোলন রোজ করতে হবে। ঘরে, বাইরে, টিএসসির মাঠে, অফিসে, টেলিভিশনের সামনে, নামে, পোশাকে সবখানে।
লেখক: সাংবাদিক
সাজ্জাদ সাকিব বাদশা : ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। এদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শুধু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গকে নয়, ‘শেখ’ বংশ থেকে সেসময় উদীয়মান যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আবির্ভাব হতে চলেছিল তাদেরও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, বোন জামাই আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি প্রমুখ তাদের অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নিকৃষ্টতম ও ভয়াবহ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডটি যেমন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রে বিরাট ও বিরূপ প্রতিফলন- পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তেমন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব-প্রভাব উল্লেখযোগ্য।
হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের সহযাত্রী ও হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত, পবিত্র দেহ ফেলে রেখে ১৬ আগস্ট সকালেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে (দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অতরিটি; ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে কলঙ্কিত করে। কিছু লোভী মানুষের পরিকল্পনা ও কতিপয় মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তার এই বিপথগামিতাকে দায়মুক্তি দেওয়া এই অধ্যাদেশটিকে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ ঘোষণা করে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে পরাজিত ও লজ্জিত করে, যা ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী নির্মম অত্যাচার চালানো পাকিস্তানি সেনা শাসকরাও করেনি। বলাই বাহুল্য, জিয়া ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের আরেক প্রধান মাস্টারমাইন্ড। এখানেই শেষ নয়। ৮ জুন ১৯৭৬ এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে নির্মম-নৃশংস এই ঘটনাটিকে তামাশায় পরিণত করা হয়। মামুলি হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরা হয়, যা প্রকারান্তরে মানব ইতিহাসের জন্য এক ন্যাক্কারজনক নজির সৃষ্টি করে। মানুষের জন্য পরিচালিত রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের এক মহান নেতার প্রতি কতোটা অমানবিক ও স্বৈরাচারী হতে পারে তা বিশ্ববাসী বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পায় পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে খন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়ার শাসনামলে।
পঁচাত্তরের পর অত্যাচার-নির্যাতন, দমন-পীড়ন সহ্য করে ফিনিক্স পাখির মতো জনতার দল আওয়ামী লীগ জনতার রায় নিয়ে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে (জেল হত্যা, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫) ধ্বংস করার মাধ্যমে কুচক্র মহল বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম মুছে ফেলার যে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল তা ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে; যিনি পঁচাত্তরে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন ঘাতকের বুলেট থেকে। সম্ভবত পিতা ও বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্মারক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্যটি সম্পন্ন করে দেশকে অগ্রযাত্রার কাঙ্ক্ষিত বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই শেখ হাসিনার এই আকস্মিক বেঁচে যাওয়া। ১৯৯৬ সালে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরপরই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সংসদে পাস করার মাধ্যমে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য পরিচালনা করার যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন না করে সাধারণ মানুষের প্রাণের স্পন্দন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সাধারণ আদালতে সম্পন্ন করার সিন্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। ২ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে নিম্ন আদালতে হত্যা মামলা দায়েরের পর দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যাকারিদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জনতার রায় ঘোষিত হয় ৮ নভেম্বর ১৯৯৮। এরপর মামলাটি গড়ায় হাইকোর্টে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও বিচারকদের নানামুখী অপতৎপরতায় মামলাটি আবারও পথ হারায় এবং ৩০ এপ্রিল ২০০১ হাইকোর্ট পর্যায়ে মামলাটির সমাপ্তি ঘটে। ২০০১-২০০৬ সময়ে বিদ্যমান বিএনপি-জামায়াত সরকার আপিল বিভাগে বিচারকদের একের পর এক বিব্রত হওয়ার নাটক উপস্থাপনের মাধ্যমে আবারও মামলাটিকে পথহারা করে। ২০০৮ সালে বিপুল গণরায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মামলাটি সচল হয়। যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৭ জানুয়ারি ২০১০ রায় কার্যকরের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর এবং মামলা দায়েরের ১৪ বছর পর এক সমুদ্র চোখের জল ও বুকভরা হাহাকারের পর বাংলাদেশ তার পিতা হত্যার প্রতাশিত বিচার পায়। বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্যটি যেন ছোট গল্পের পরিণতি লাভ করতে চলেছে; শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। দণ্ডপাপ্ত বেশ কয়কজন খুনি এখনও পলাতক। তারা বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে, দম্ভের সহিত। এছাড়া যারা কেবলমাত্র বন্দুকের গুলি চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে, তারাই কি একমাত্র অবরাধী? বা বিচারের সম্মুখীন হওয়ার, শান্তি পাওয়ার উপযোগী? যারা এ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তারা কি নিষ্পাপ? যারা সমর্থন-সহযোগিতা জুগিয়েছে? বিভিন্ন দফতর-ভবনে বসে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবদান রেখেছে? মন্ত্রী, এমপি, সংসদে বিরোধী দল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করেছে? তারা কি গণনার ভেতর আসবে না? তারা কি দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির পিতার সাথে অস্তিত্বের সাথে, প্রগতি ও অগ্রগতির ধারামুখের সাথে বেইমানি করেনি? অপরাধ করেনি? অবশ্যই করেছে। এবং এ কারণে এ নরপশুগুলোরও উপযুক্ত বিচার ও শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেবলমাত্র বন্দুক দিয়ে গুলি চালানো পাষণ্ডগুলোর বিচার করতেই যেখানে আমাদের ৩৪ বছর সময় লেগেছে, সেখানে বাকিগুলোর বিচার করতে কতোদিন সময় লাগবে? যতদিনই লাগুক না কেন, এদেশের সাধারণ মানুষ, মাটি-ফুল-ফল-বৃক্ষ-পাখি, সমুদ্র-পাহাড়, লাল-সবুজের পতাকা, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। নিষ্পাপ শিশু, স্বপ্নময় প্রতিটি প্রজন্ম শত-সহস্র বছর অপেক্ষা করবে তাদের পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত বিচার পাওয়ার আশায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্মম-নৃশংস, মানবতার বিরোধী দুইটি হত্যাকাণ্ড হলো- একাত্তরে বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। এই দুই হত্যাকাণ্ডে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করে, কলঙ্কিত করে। এই লজ্জা ও কলঙ্কের কালিমা জাতির ললাট থেকে দূর করেছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা তার অসীম সাহসিকতা দিয়ে। একাত্তরের মানবিধার বিরোধী অপরাধের বিচার এখনও চলমান। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করে দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবেন একমাত্র তিনিই। তার সাহসিকতা ও অসীম নিষ্ঠার প্রতি আমাদের সমর্থন অটুট থাকবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জাতীয় শোক দিবস এই শক্তিতেই আমাদের বলীয়ান করে প্রতি বছর।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও পরিচালক, সিআরআই।
ড. অজয় রায় : বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জনক। তাকে আমরা হারিয়েছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তাকে হারিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণীয় নয়। কোনোদিন পূরণ হবে বলেও মনে হয় না। তিনি বাংলাদেশকে, ‘সোনার বাংলা’ রূপে দেখতে চেয়েছিলেন। এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে জীবনভর লড়াই করে গেছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তাকে চলে যেতে হলো। এটা আমাদের জন্যই ছিল অনেক বড় ক্ষতি। যে ক্ষতি আমাদের পক্ষে পোষানো সম্ভব কিনা জানি না। তবে আমাদের উচিত হবেÑ তার আদর্শ অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়া। যেকোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রের তার আদর্শকে প্রাধান্য দেওয়া। তার আদর্শের ভিত্তিতে দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আমাদের যতটুকু সাধ্য আছে তার মধ্যে থেকে এগিয়ে যেতে হবে।
এখানে কেবল সরকারই নয়, সাধারণ মানুষকেও বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যেতে হবে। আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যেই চেষ্টা করে যেতে হবে। বুদ্ধিজীবীদেরও সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশটা উন্নতির দিকে যাচ্ছে কিনা মাঝেমধ্যে তা রিভিউ করার প্রয়োজন আছে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং জনগণের। দেশ এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা সঠিকভাবে বলা যাবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তারা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছে। আমাদের প্রত্যাশাÑ বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তার আর্দশ অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভিত্তি করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
পরিচিতি: শিক্ষাবিদ