পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও সেনা মোতায়েন

Posted on August 24, 2017 | in নির্বাচন কমিশন, নির্বাচিত কলাম | by

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো ১৬-১৭ মাস বাকি। নির্বাচনের অব্যবহিত প্রাক্কালে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেটা এত আগে বলার এবং মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণার পর বা তিন-চার মাস আগে একটা বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে যেমন আনন্দ, উল্লাস ও উৎসবের একটা অবস্থা বিরাজ করে, তেমনি এলাকাভেদে কম-বেশি নিরাপত্তার শঙ্কাও সৃষ্টি হয়। সবসময় যেমন, ঠিক তেমনি নির্বাচনের সময়েও শান্তি রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীসহ বেসামরিক প্রশাসনের। সময়মতো পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে যদি মনে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যথেষ্ট নয়, তাহলে অতিরিক্ত হিসেবে ওহ অরফ ড়ভ ঈরারষ ঢ়ড়বিৎ, এই বিধানের আওতায় সেনা মোতায়েন করা যেতে পারে। তখন পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বের কাঠমো ও পরিধি নির্ধারণ করলে সেটাই হবে যথার্থ। তার আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা এবং সঙ্গতকারণেই সেটা হবে বিপজ্জনক। সুতরাং সেনা মোতায়েন নিয়ে এখনই যারা শোরগোল করছেন, তাদের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ বোঝা কষ্ট হয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনীতিতে যে প্রলয়কা- ঘটে গেছে এবং যেভাবে ঘটেছে তাতে কার মনে কি আছে তা সহজে বুঝে ওঠা মুশকিল। প্রথম ও মৌলিক কথা হলোÑ দেড় বছর আগে পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি ব্যতিরেকে ফোর্সসমূহের দায়িত্বের পরিধি নিরূপণ করলে নির্ঘাত সেটি ভুল হবে এবং তা নিয়ে অবধারিতভাবে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ভেতরে অনাকাক্সিক্ষত রাজনীতি চলে আসবে। আর সেই রাজনীতির মাঝখানে পড়বে সেনাবাহিনী। তখন সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করার পূর্ব অভ্যাস যাদের আছে তারা ইচ্ছামতো একতরফা বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে পার্টিশন অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করবে, যেমনটি আগে আমরা দেখেছি। তাতে সেনাবাহিনীর পেশাগত বিশেষত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাহিনীর মনোবল ও শৃঙ্খলার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব দেশের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে ও ঊর্ধ্বে দেখতে চায়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের পরে পরপর দুজন সামরিক শাসক সেনাবাহিনীকে রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে অশেষ ক্ষতি করেছেন। ওই খারাপ দৃষ্টান্ত থেকে বের হওয়ার চেষ্টা সবাইকে অব্যাহত রাখতে হবে।

সময় পরিপক্ক হওয়ার আগে এখনই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে যারা অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তারা সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে টেনে আনার অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে আমার কাছে মনে হয়। সময়মতো পরিস্থিতির বিবেচনায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখনই কেন? একটি মৌলিক কথা আমাদের স্মরণে রাখা দরকার। আর তা হলোÑ যার যে কাজ সেটি তাকে দিয়ে না করিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী।

আর সে ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো কথাই নেই, সেনাবাহিনীদের পার্টিশন ব্লেইম গেমের মধ্যে ফেলা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় অন্তরায় হচ্ছে প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার এবং ভোট কেনাবেচায় টাকার ব্যবহার। অথচ এটা রোধ করার উপায় নিয়ে তেমন জোরালো ও বাস্তবসম্মত সুপারিশ কারও পক্ষ থেকে আসছে না। এটা নিয়ে বরং এখন সবচাইতে বেশি আলোচনার দরকার, যাতে সময় থাকতে প্রয়োজন হলে যেন বিধি-বিধান পরিবর্তন করা যায়। আগের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন প্রাক ও উত্তর সময়ে নিরাপত্তাজনিত সমস্যার বড় শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর মানুষ। তারপর সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এক রকম পরিবেশের সৃষ্টি হবে, আবার কোনো বড় দল অংশ না নিলে অন্য রকম হবে। অন্যদিকে বর্জনকারী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
একটি বিষয়ের ওপর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজে সেনাবাহিনীকে যেন জড়ানো না হয়। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জড়িয়ে গেলে নির্ঘাত ব্লেইম গেমের শিকার হবে, যেটি কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। দুই সামরিক শাসন রাজনীতিতে জড়িত করায় এক সময় সেনাবাহিনী ও জনগণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছিল এবং দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল যেটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য চরম ক্ষতিকর। সেনাবাহিনী সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস যতটা গৌরবোজ্জ্বল সে রকম উদাহরণ খুব কম দেশের সেনাবাহিনীর রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে। ফলে তার জন্ম বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হলো জনগণ এবং সেনাবাহিনী এক ও অভিন্ন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ ও সেনাবাহিনীর রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশের মাটিতে একসঙ্গে। জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য এ বন্ধনের মূল্য অপরিসীম। তাই সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে এবং সংবেদনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও কাজ বা রাজনৈতিক দলের সালিশি ও ঝগড়া মেটাতে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা ঠিক হবে না। তাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে পার্টিশন চিন্তা-চেতনা চলে আসতে পারে। পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনের পেশাই হলো জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। তারা জানে কিভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখতে হয়। সবাইকে এক করে ফেলা বা এক জায়গায় নিয়ে আসা দূরদর্শী কাজ হবে না। তাই নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতির বিবেচনায় সেনা মোতায়েন করতে হলে তা অবশ্যই হতে হবে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এবং নিয়োজিত থাকবে স্ট্রাইকিং ও স্ট্যান্ডবাই ফোর্স হিসেবে।
লেখক: কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud