পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

বাবা যখন ধর্ষক

Posted on July 16, 2017 | in নির্বাচিত কলাম | by

তসলিমা নাসরিন : যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদের খুব অবাক করে না। আমরা মেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি  ঘরে বাইরে ধর্ষণের শিকার হতে। আমাদের ধর্ষণ করে অচেনা লোক, চেনা লোক, আত্মীয় লোক, স্বজন লোক– কে নয়? অনেকে এখনও ভাবে অশিক্ষিত অসভ্য লোকরাই ধর্ষণ করে। ভাবে ধর্ষকরা মানসিকভাবে অসুস্থ। আর কতবার প্রমাণ দেখাতে হবে যে ধর্ষকরা অন্য কোনও জগতের লোক নয়, তারা আমাদেরই বাবা ভাই, আমাদেরই মামা কাকা, আমাদেরই প্রতিবেশি, আমাদেরই বন্ধু? ধর্ষকরা মানসিক হাসপাতালের দরজা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আমাদের ধর্ষণ করছে না। তারা আমাদের ঘর বাড়ির মতই ঘর বাড়িতে বাস করে। তারা আমাদের মতই চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য করে। তারা আমাদের মতই বিয়ে থা করে, সংসার করে, বাচ্চা কাচ্চা করে। তারা আমাদের মতই সকালে দৈনিক পত্রিকা পড়ে। ধর্ষণের খবর পড়ে।

এ সপ্তাহে আমাদের আরও একবার কিন্তু প্রমাণ মিললো ধর্ষকরা শিক্ষিত হতে পারে, সভ্য জগতে তাদের বসবাস হতে পারে। মানসিকভাবে তারা সুস্থ হতে পারে। আরমান হোসেন শব্দ প্রকৌশলী। বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে চাকরি করেন। না, তিনি বেকার নন, দরিদ্র নন। প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করে দিব্যি টিকে আছেন। এই আরমানও বাড়ি ফিরে গিয়ে ধর্ষণ করেন। তার কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণ করেন। কন্যার যখন ১২ বছর বয়স, তখন থেকেই ধর্ষণ শুরু। আজ সেই কন্যার বয়স কুড়ি। কুড়িতে এসে সে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করেছে, আরমানের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে, সে কারণে আমরা জেনেছি ঘটনা। এরকম কত ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। প্রতিদিন মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিবারবেষ্টিত মেয়েদেরও মুহূর্তে অনাথ বানিয়ে দিতে পারে ধর্ষণ। একবার ধর্ষিতা হলে এই পুরুষের পৃথিবীতে মুখরা মেয়েও বোবা হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ধর্ষণ মেয়েদের অবলা আর অসহায় বানিয়ে দেয়।

আরমান হোসেন তার স্ত্রীর কন্যাকে ধর্ষণ করছিল গত আট বছর। স্ত্রী যেহেতু তার কন্যা নিয়েই বাস করছিলেন আরমানের সঙ্গে, খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় আরমানও কথা দিয়েছিলেন স্ত্রীর কন্যাটিকে তিনি নিজের কন্যা হিসেবেই বড় করবেন। জানি না কন্যাকে দত্তক নিয়েছিলেন কিনা আরমান। নিলেও বা না নিলেও কন্যাটির আরমানকে বাবা বলে ডাকার সম্ভাবনা বেশি। ২০০৬ সাল থেকে,  ৯/১০ বছর বয়স থেকে, কন্যাটি আরমানের সংসারে বাস করছে। ২০০৮ সালে আরমান তাকে প্রথম ধর্ষণ করেন, তখন সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী, বয়স সবে ১২।  ১২ বছর বয়সী মেয়ে ধর্ষিতা হলে চমকে ওঠার কিছু নেই। বাংলার গ্রামে গঞ্জে ওই বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। তাদের স্বামী তাদের ধর্ষণ করে প্রতিদিন। আরমান এবং কন্যাটির বয়সী স্বামী- স্ত্রী প্রচুর পাওয়া যাবে খুঁজলে। অসম বয়সীদের যৌন সম্পর্ক নিয়ে কাউকে অবাক হতে দেখিনা। তবে কেন মানুষ আরমানের কীর্তি শুনে চোখ কপালে তুলছে, কেন মানুষ বিস্ময়ে বিমূঢ়! অবিবাহিত মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বলে? নাকি একই পুরুষ মা আর মেয়েতে উপগত হচ্ছে বলে?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে শিশুদের ধর্ষণ করার ইচ্ছে পোষণ করে শতকরা কতভাগ পুরুষ, মনে মনে শিশুদের ধর্ষণ করে কতভাগ পুরুষ, এবং কতভাগ পুরুষ শিশুদের সত্যি সত্যি ধর্ষণ করে। এই সংখ্যা, আমার আশঙ্কা, মানুষ যতটা আশঙ্কা করে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এ কথা স্বীকার করতে দোষ কী যে আমরা মেয়েরা বাস করি ধর্ষকদের সঙ্গে, যে ধর্ষক শিশু থেকে প্রৌঢ় – কাউকে ধর্ষণ করতে দ্বিধা করে না। পুরুষ কি তবে ধর্ষকের জাত? পুরুষ সম্ভবত ধর্ষকেরই জাত। পুরুষের ধর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য আমরা পুরুষকে এই শিক্ষা দিতে চাইছি যে, কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে বা কারও ওপর জোর খাটিয়ে যৌন সঙ্গম করা উচিত নয়। এও বলছি, শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত বয়স্কদের। এই নীতি বা নিয়ম বার বার ভাঙছে পুরুষেরা। তারা আমাদের শিশুপুত্র আর শিশুকন্যাদের শরীর এবং মনকে চরম আঘাত দিয়ে চিরকালের জন্য অসুস্থ করে তুলছে। তাদের যৌনসুখের জন্য আজ মেয়েদের পতিতা হতে হচ্ছে। পতিতালয়ে শিশুরা পাচার হয়ে আসছে, যেন শিশুদের ধর্ষণ করে পুরুষের অঙ্গে সুখ জোটে।  অন্তর্জাল ভরে গেছে শিশুপর্নে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা শিশুদের সুরক্ষা করার বদলে, নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে শিশুদের অপ্রস্তুত শরীরকে লালসার শিকার করে। এই পুরুষের সঙ্গে এক সমাজে বাস করতে আমরা বাধ্য হই। আমরা এত যে তাদের শিক্ষিত করতে চাই, কিন্তু তারা কিছুতেই শিক্ষিত হতে চায় না।  

পত্রিকায় খবর এসেছে, কন্যাকে ধর্ষণ করেছে বলে আরমানের কোনও অনুশোচনা নেই। প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলীরও যদি অনুশোচনা না হয়, হবে কার? এই প্রকৌশলীটি, বলতে পারি, সত্যিকার শিক্ষিত নন। শিক্ষিত হলে নিজের যৌন-আনন্দের জন্য কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ককে তিনি বেছে নিতেন না, বা কোনও প্রাপ্তবয়স্কদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি যেতেন না।

প্রকাশ্যে বা গোপনে আরমানের পক্ষ নেওয়ার লোকের অভাব সমাজে নেই। তারা বলে বেড়াচ্ছে, মেয়ে কেন আট বছর পর প্রতিবাদ করলো, কেন আগে করেনি? বলছে, মেয়ের মা সব জানতো, তার সায় ছিল। মেয়ে আর তার মা’কে দোষী হিসেবে দেখাতে পারলে আরমানকে দোষী বলে চেনা তো যাবেই না, বরং তাকে নির্দোষ নিরীহ পুরুষ হিসেবেই মনে করবে মানুষ। আরমানকে যারা রিমান্ডে নিয়েছে, তাদের একবারও কি মনে হয়নি, ‘আরমান আর এমনকী খারাপ কাজ করেছে, কন্যাটি তো তার নিজের কন্যা নয়! রক্তের সম্পর্ক তো আর নেই?’ মনে মনে জানি না ক’জন আরমানের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে। বিচারকদের মধ্যেও হয়তো কেউ কেউ করবে।
ভালো পুরুষ, শিক্ষিত পুরুষ, সমব্যাথী পুরুষ, যৌন সংযমী পুরুষ কি জগতে নেই? নিশ্চয়ই আছে। আছে বলেই আশা জাগে, ধর্ষক, নির্যাতক, নিষ্ঠুর, অবিবেচক, লোভী, স্বার্থান্ধ পুরুষও হয়তো একদিন মানুষ হবে। শুধু কী আশায় বসতি! পুরুষই জানে তারা আদৌ এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য হতে দেবে কিনা।

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud