May 1, 2024
ঈদ কাদের মতো করে উদযাপন করবো? প্রশ্নটি তৈরি হওয়ার একাধিক উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছে। ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব, তাই স্বাভাবিকভাবেই উদযাপন হওয়ার কথা ইসলামিক রীতি অনুসারে। রীতি অবশ্য রোজা, যাকাত, ফিতরা এবং ঈদের দিনের নামাজ আদায়কে অনুসরণ করে। তবে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশের আবার ঈদ উদযাপনের সঙ্গে যুক্ত হয় নিজস্ব অভ্যাস বা যাপন। বাংলাদেশেও তেমনি ঈদ যাপন হয়ে আসছে।
ঈদের দিন কয়েক আগে থেকেই গ্রাম-মফস্বল শহরে উৎসবের আলো জ্বলে ওঠে। এই আলো মানুষের হৃদয়ের। সেই হৃদয়ে বাজে উৎসব সঙ্গীত। গ্রাম-শহরের বাইরে কাজের জন্য যারা বাইরে থাকেন, তারা ঘরে ফেরেন। বাড়িতে বাড়িতে চলে হাত সেমাই, চালের রুটি, পিঠে তৈরির আয়োজন। গ্রামের বাজার-হাটও সরগরম হয়ে ওঠে। চাঁদরাতে মেহেওদী বাটা এবং হাতে আকাঁর ধুম। ঈদের দিন ঈদগাহতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সেই আনন্দ এক প্রকার পূর্ণতা পায়। সেই পূর্ণতার আনন্দ ঘুরে বেড়ায় বাড়িতে বাড়িতে। নতুন কাপড়ে ধবধবে দিন। যাদের গায়ে নতুন কাপড় ওঠে না তাদের মুখেও থাকে খুশির ঝিলিক। অন্যের আনন্দ উপভোগ করেন তারাও। ঈদ উদযাপনের এই দৃশ্য গ্রামে-মফস্বল শহরে এখনো আছে।
তবে সমাজের একটি শ্রেণি এই উদযাপনের অভ্যাস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তাদের এখন আর ঘরে ফেরা হয় না। তারা আর ঘরে ফিরতে চান না। ঘরে ফিরলেই যে শ্রেণিতে লম্ফ দিয়ে উঠতে চান, সেখান থেকে লম্ফনে তাদের পতন হতে পারে। উৎসবে উড়াল দেওয়া ছাড়া তাদের জাত রক্ষা অসম্ভব প্রায়।
এই শ্রেণিটিরই আবার জাত রক্ষা বা বিশেষ জাতে ওঠোর জন্য দেশীয় পণ্যে অরুচি। উৎসবের ছুঁতোতে লন্ডন, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারতের বাজারে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। রমজানের চাঁদ দেখা দেওয়ার আগেই বিদেশের বাজার তাদের দখলে। উড়োজাহাজ ভর্তি থান কাপড়, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, গাউন,পাঞ্জাবি, জুতো এবং অলঙ্কার নিয়ে দেশে ফেরেন তারা। আজকাল কেউ কেউ নিজের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আত্মীয়-প্রতিবেশির কাছে বেচা-বিক্রির জন্য কিছু বাড়তিও নিয়ে আসেন। গত এক-দুই বছরে আমরা অনলাইনে সেই বাণিজ্য দেখতে পাচ্ছি। যারা বিদেশ উড়ে যেতে পারেননি, সেই ক্রেতাদেরও একটি বড় অংশ বিদেশি ট্যাগ দেখে পণ্য কেনেন। দাম এবং গুন যাই হোক না কেন। বিশেষ করে পাকিস্তানি ও ভারতীয় কাপড়ের ভোক্তা বেশি। এখন শুনছি আতর, টুপি, জায়নামাজের বিদেশি ট্যাগেরই বেশি কদর।
গণমাধ্যমে শোনা যাচ্ছে দেশের লাখ তিনেক ক্রেতা বিদেশ থেকে বাজার করে নিয়ে আসায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-রাজশাহী এবং সিলেটের অভিজাত দোকান প্রায় ক্রেতা শূন্য। ক্রেতাদের সাফাই- দেশীয় বিপণী বিতানে কয়েক গুণ বেশি দাম নেওয়া হয়।ওই টাকায় বিদেশ ঘুরে দেখা এবং কেনাকাটা দুটোই নাকি হয়ে যায়। ক্রেতাদের এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। আমাদের ব্যবসায়ী শ্রেণি দুই ঈদ এবং পূঁজোকে পুঁজি করে সারা বছরের লাভ সিন্দুকে ভরে ফেলতে চান। ব্যবসায়ীদের এই মানসিকতা যেমন সত্য, তেমনি সত্য দেশে এখন অনেক উন্নতমানের পোশাক, জুতা তৈরি হচ্ছে। যা বিদেশি পণ্যের সমতুল্য। কিন্তু একটি শ্রেণির দেশীয় পণ্যের প্রতি উন্নাসিকতা এবং বিদেশি পণ্য ব্যবহারই উঁচুতলায় উত্তরণের টিকেট, এই ভ্রান্ত ধারণটিই আমাদের উৎসবের বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের উৎসবের টাকা চলে যাচ্ছে ভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীর ক্যাশবাক্সে।
উৎসবের খাবারেও ফিউশন এসে গেছে। মা-খালাদের তৈরি সেমাই ‘জদ্দার’ সঙ্গে মোঘল, পশ্চিম এবং পূবের রান্না পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটেছে। অন্যান্য পদের বেলাতেও তাই। গ্রামে এখনও এই মিশ্রণ প্রবেশ করেনি। নিম্নবিত্ত তার খাবারের অভ্যাস পাল্টাতে পারেনি। তবে তার কাছে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের একই রুচির বিনোদন সহজগম্য হয়েছে। সকল শ্রেণি টিভিতে ইচ্ছে করলেই একই ধরনের অনুষ্ঠান দেখতে পাচ্ছে। ঈদ উৎসবে দেশের চ্যানেলগুলো নানা প্রকারের অনুষ্ঠান তৈরি করছে প্রতিবার এবারও করছে। অনুষ্ঠানের গুণগতমান গড়পড়তা হলেও, ভালো মান এবং যত্নে তৈরি অনুষ্ঠানও রয়েছে বেশকিছু। তারপরও নির্মাতাদের বুক দুরু দুরু। দর্শকরা থাকবেন তো তাদের সঙ্গে। কারণ কোনও দেশীয় চ্যানেলের কোনও অনুষ্ঠানের সময়ে ভারতের কোন চ্যানেলে কী সিরিয়াল বা রিয়েলিটি শো পড়ে যায় বলা মুশকিল। তখন ভারতের চ্যানেলই দর্শক টেনে নিবে। বড় পদা’য় কোন ছবি মুক্তি পাবে? সেখানেও ভারতীয় নায়ক- নায়িকাদের মজবুত খুঁটি। দেশের নায়ক-নায়িকা সেখানে ‘ভাত’ নাই।
ঈদের ঘুরাঘুরিতেও বদল এসেছে। আগে আত্মিয় পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোটাই ছিল মূল আকর্ষণ। এখন সময় কাটে কফি শপে। সিনেপ্লেক্স-ফুডকোর্টে। কেউ কেউ চলে যান শহরের আশপাশের রিসোর্টে। পশ্চিমে নাকি লোকে এভাবেই উৎসবে সময় কাটায়। এমন করে সময় না কাটালে করপোরেট রাজ্যের প্রজা বা উজির হওয়া যায় না। তাই গত কয়েক বছর উৎসব উদযাপনের এই চর্চা চলছে। তবে সুখের কখা, আনন্দের কথা হলো কতিপয় সংশয়ে নিমজ্জিত মানুষই পূর্ব-পশ্চিমের অনুকরনে উৎসবের নতুন অভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টায়। বাকিরা কিন্তু গ্রাম-শহর, নগরে আগের মতোই মেতে উঠছে উৎসবে। প্রিয়জন, প্রিয়বন্ধুকে জড়িয়ে কাটে তাদের আনন্দ সময়। এবারের ঈদ আনন্দে যারা সেই সনাতন অভ্যাসের সঙ্গে আছেন তাদের অভিনন্দন। বাকিদের পুরাতনে ফিরে আসার অপেক্ষায় স্বাগতম।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি
শাখাওয়াত লিটন : করতেন শিক্ষকতা। সেটা ছেড়ে আসলেন রাজনীতিতে। শুরুতে মাঠের বক্তৃতা করতেও অতি ভদ্র ও শালীন ভাষা ব্যাবহার করতেন বলে নিজ দলের অনেকেই তাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করত। এখনো রাজনীতিতে প্রচলিত অনেক উগ্র ভাষা আয়ত্ত করতে পারেননি। ধীরে ধীরে কলেজের সেই শিক্ষক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হয়ে উঠলেন পুলিশের রেকর্ডে এক ‘ভয়ংকর’ রাজনীতিবিদ; রাজপথের মাস্তান।
বিশ্বাস করুন বা না করুন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী ফখরুল রাস্তায় লাঠি হাতে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পুলিশের কর্তব্য পালনে বাধা দিয়েছেন। লোহার রড, লাথি, ইট, পাথর, হকি স্টিক নিয়ে দলবলে সজ্জিত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালিয়েছেন পুলিশের উপর। কখনো রাস্তায় ভাংচুর করেছেন জনসাধারণের যানবাহন। ভাঙচুর থেকে রেহাই পায়নি সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী ট্রাকও। ময়লার গাড়ির ড্রাইভারকেও মারধর করেছেন, হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।শুধু তাই নয়, দলের অন্য সিনিয়র নেতাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাদের সাথে গিয়ে রাতের অন্ধকারে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন মীর্জা ফখরুল। পুলিশের খাতায় এমন আরও কত যে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন গত কয়েক বছরে সেসবের বিস্তারিত তিনি হয়ত নিজেই জানেন না। কমপক্ষে ৮৩ টি মামলার আসামি হয়েছেন। হুলিয়া মাথায় ঘুরেছেন। কয়েক দফা জেলে যেতে হয়েছে। অনেক ধকল সয়ে জামিন মিলেছে। এখনো যাপন করছেন জামিনে থাকা জীবন, মুক্ত জীবন নয়।
ফখরুলের সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য সেটা সময়ই বলবে। তবে মামলার রেকর্ড খতিয়ে দেখা যায় অন্য অনেকের চেয়ে তিনি আলাদা। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মামুলি ব্যাপার। সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন দুর্নীতির মামলা হয়নি এমন সিনিয়র রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার দলের নেত্রী অথবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী–তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা হয়েছে। তবে ফখরুল তাদের কাতারে নাম লেখাতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে একটাও দুর্নীতির মামলা হয়নি। সবগুলো মামলাই হয়েছে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করাকে কেন্দ্র করে রাজপথের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলায় জড়িত থাকার অভিযোগে। তার মামলার রেকর্ড পড়লে যে কারো মনে হতে পারে, ফখরুল রাজপথে অরাজকতা সৃষ্টিতে দক্ষ; মারামারি হানাহানিতে ভীত নন মোটেও।
কিন্তু রাঙ্গুনিয়াতে গাড়িবহরে হামলার শিকার যে ফখরুলের চেহারা পত্রিকার পাতায় আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে তার সাথে পুলিশের মামলার রেকর্ডের ফখরুলকে মেলানো যায় না। হামলার পরপর এক অসহায় ফখরুলকে দেখা গেছে। তার গাড়িতে আক্রমণের সময়েও তিনি হামলাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করেছেন, কেন তারা এমন করছে? যখন হামলাকারীরা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ফখরুল তখন গাড়ির গ্লাস লাগিয়ে ভিতরে ভয়ে জবুথুবু হয়ে থেকেছেন। হামলার পর মুহূর্তে ফোনে যারা কথা বলেছেন তারা ফখরুলের আতঙ্ক ভরা কণ্ঠ শুনেছেন। ৬৫ বছর বয়স্ক ফখরুল কখনো এমন দিন দেখেননি বলে নিজেই বলেছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করা ফখরুল হামলাকারী যুবকদেরকে কি তার ছাত্রের মত ভেবে ভুল করেছিলেন? ওরা কোনওদিন কি কারো ছাত্র হয়ে শিক্ষা নিয়েছে?
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হওয়ার পর গত প্রায় তিন দশকের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অন্য কোনও দলের মহাসচিবকে ফখরুলের মত এতোটা নিগৃহীত হতে হয়নি। বিএনপির রাজনীতির সমর্থক নন এমন অনেকে আছেন যারা ফখরুলের ভদ্রতা ও শালীনতা বোধের প্রশংসা করেন। যারা সংঘাত-সহিংসতা মুক্ত রাজনীতি চান ফখরুল তাদের একজন। তার উপর এমন হামলা যে কাউকে রাজনীতির আগামী দিনগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন করবে। খোদ সরকারি দলের অনেক নেতাও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন; দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কেউ কেউ ফখরুলের উপর হামলাকে সুস্থ রাজনীতির প্রত্যাশার উপর হামলা বলেও অভিহিত করেছেন। কেননা যখন তার উপর হামলা হয় তিনি কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন না। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কেউ কেউ এই হামলাকে সুস্থ রাজনীতির অভিশাপ, এবং রাজনীতিতে অশনি সংকেত হিসাবে অভিহিত করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই হামলার নিন্দা না করে বরং বিগত বিএনপি সরকার আমলে রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর পুলিশের হামলার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন; সে সবের কিছু আলোকচিত্রও প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গ টেনেছেন। এ সব তুলনা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বিএনপি সরকার আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর হামলা করেছে পুলিশ বাহিনী। আবার আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল সরকারি দলের কয়েক জন সিনিয়র নেতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদূর পরিকল্পনা এবং যোগসাজশে চালানো হামলা; যে হামলার লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা নিজে।
অন্যদিকে, ফখরুলের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের কোনও সায় ছিল বলে এখনো তেমন কিছু প্রকাশ পায়নি। এ হামলা প্রমাণ করে সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের উশৃঙ্খলতা, আইনের প্রতি আনুগত্বহীনতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। হামলাকারীরা জানত ফখরুলের গাড়িবহরে আক্রমণ করে তারা পার পেয়ে যাবে, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিবে না। তাদের ধারণাই ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। যেমনটা আরও অনেক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার করতে করতে মাঠ পর্যায়ে সরকারি দলের অনেক নেতা কর্মীর বেপরোয়া আচরণ বেড়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল বাড়ছে। গত আড়াই বছরে আওয়ামী লীগের নিজেদের ভেতর কোন্দলে নিহত হয়েছে ৬০ জন নেতা কর্মী। এমন বেপরোয়া আচরণ সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না; যা সরকারি দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
বিএনপি তার ভুল রাজনীতির খেসারত দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় দলের নেতা কর্মীদের উশৃঙ্খল আচরণ, অনিয়ম দুর্নীতির জবাব পেয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটি একাই প্রায় ২০০টি আসন লাভ করলেও ২০০৮ সালে এসে দলটির আসন ৩০ এর নিচে নেমে যায়। তাই বিএনপির আমলের কোনও ঘটনাকে টেনে ফখরুলের উপর হামলাকে খাটো করে না দেখাই ভালো।
ফখরুলের উপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্দে ব্যবস্থা নেওয়া হলে একটা বার্তা স্পষ্ট হবে যে, রাজনীতিতে এখনো ভদ্র লোকের জায়গা আছে। আর তা না হলে মনে করতে হবে, ফখরুলদের মতো ভদ্র ও শালীন রাজনীতিবিদ যে দলেই থাকুন না কেন বর্তমান রাজনীতিতে তারা অচল এবং অযোগ্য।
ডেইলী স্টার
কথায় বলে, মাছে ভাতে বাঙালি। আমরা বাঙালি জাতি দুবেলা পেট পুরে খেতে পারলেই হলো। এর বেশি কিছু সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চায় না। সরকার সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিল আমাদের। দাম বেশি হলেও এতদিন সেই মতই চলছিল। মানুষের খুব একটা অভাবে পড়তে হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি চিত্রটা একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে বৈকি!
গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে চালের দাম। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সহসাই যে কমছে না সেই বিষয়টাও অনেকটা নিশ্চিত। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা এবং সরু চালের কেজি ৫৬ টাকায় উঠেছিল। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জসহ দেশের ছয় জেলায় বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে হাওরের ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ইস্যুকে পুঁজি করে বাড়তে থাকে চালের দাম। এরপর থেকে আর স্থিতিশীল হয়নি চালের বাজার। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনও মোটা চাল নেই। ৬৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না ভালো মানের চিকন চাল। আমি বেশ কয়েকবার মুদি দোকানে গিয়ে ফিরে এসেছি। আশা দাম একটু কমলে কিনবো। কিন্তু দিনদিন সেটা বাড়তির দিকে। চালের দাম বেশি বেড়েছে গত পাঁচ মাসে। প্রতিমাসেই সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা করে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো চালের দাম বাড়ার কারণ জানেন না কেউ। সরকার স্বীকারই করতে চায় না যে চালের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। চালের দামকে কেন্দ্র করে অন্য সব নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে। তারা হিমশিম খাচ্ছেন সংসার চালাতে। বিপাকে পড়েছে আমার মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণিও। তবে লোকলজ্জার ভয়ে এ বিষয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না।
চালের দাম বাড়া নিয়ে কোনও স্পষ্ট বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, ‘মোটা চাল উৎপাদনের কৃষক আগ্রহ হারাচ্ছেন। চালের দাম রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয় তাই এ বিষয়ে ঝুঁকি নিয়ে এগুতে হচ্ছে।’ আমাদের দেশে সমস্য গভীর হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ধরা হয়, জনগণকে সঠিক তথ্য না দেওয়া এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সবকিছুতে সরকারের সমালোচক বা বিরোধী পক্ষকে দোষারোপ করা। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বারবার তার বক্তব্যে বলছেন, ‘চালের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্র রয়েছে।’ অন্যদিকে, বিশ্বে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চালের দাম উল্লেখ করে বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীনদের বাণিজ্যিক সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম বেড়েছে।’ কোনটা যে সত্য আমজনতা জানে না।
রাজধানীর বাজারে নতুন বোরো চাল আসতে শুরু করলেও দাম পুরনো চালের মতো চড়া। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘এ বছর ধানের দাম বেশি, তাই চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমার সম্ভাবনা কম।’ বেসরকারি খাতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি শুরু হয়েছে। স্থলবন্দর দিয়েও ভারত থেকে চাল আমদানি হচ্ছে। তবে নানা কারণে চাল আমদানির পরিমাণ খুবই কম। কয়েকমাস ধরে সরকারি ভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির কথা শোনা গেলেও এখনও এক কেজিও চালও দেশে এসে পৌঁছেনি। কবে নাগাদ ওই চাল দেশে আসবে দায়িত্বশীল কারো কাছে সেই প্রশ্নের জবাব নেই। অনেকে উল্টো কথাও বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে যোগাযোগ করেও নাকি চাল পাওয়া যায়নি। বিষয় যাই হোক না কেন সেটা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। কতদিন তাদের এই বাড়তি টাকার বোঝা বইতে হবে সেটাও জানা দরকার। এছাড়া কেউ সিন্ডিকেট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইলেও সেটার সমাধান হওয়া জরুরি। সমস্যা নিয়ে বসে থাকলে হবে না, সেটা যতো দ্রুত সমাধান করা যায় ততোই জনগণের মঙ্গল। কারণ নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না আয়। অনেকে ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। চাল এখনও আমাদের খাদ্যতালিকার প্রধান খাদ্য। এর দাম বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষেরা দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ ঠিক রাখতে গিয়ে অন্যান্য খরচ কমিয়ে ফেলেন। অথবা অনেক সময় দেনাও করতে হয়। ফলে চালের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে যে প্রভাব পড়ে তাতে বেঁচে থাকাটাই কঠিন সংগ্রামের। আর্থিক অনটনের কারণে নিজের সন্তানকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে তুরাগে। যদিও এটা পুলিশের ধারণা। এদিকে, দেশীয় বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলেও শুল্ক আগের মতোই রয়েছে। যেহেতু বাজারে কিছু সঙ্কট, পাশাপাশি কিছু প্যানিক রয়েছে, চাল আমদানিতে বর্তমান ট্যারিফ তুলে দিলে আর ভারত থেকে পর্যাপ্ত চাল এলে দাম আবার কমতে শুরু করবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদও সেই অনুরোধ জানিয়েছেন।
খাদ্যমন্ত্রী সবশেষ আবারো বলেছেন, দাম বাড়বে না, কমে আসবে। খাবারের অভাব হবে না। আমরা এই কথায় আস্থা রাখতে চাই। তাহলে দাম বাড়ার পেছনে নিশ্চয় কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। পরস্পরকে দোষারোপ না করে সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। নইলে হয়তো সরকারকে নিয়ে বিরোধীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে ছাড়বে না। যেমনটি করেছিল ২০০৭-০৮ সালে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
প্রযুক্তি ডেস্ক : আইফোন ৮-এ যোগ হতে যাচ্ছে ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তি, এমনটা জানিয়েছেন মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপল-এর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এক মুখপাত্র।
এই প্রযুক্তিতে গ্রাহক একটি ইন্ডাক্টিভ সারফেইস-এ আইফোন রেখে চার্জ করতে পারেবন, বলা হয়েছে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড মিরর-এর প্রতিবেদনে।
স্যামসাংসহ অন্যান্য স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ডিভাইসে ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তি যোগ করেছে। কিন্তু অ্যাপলের কোনো আইফোনে এযাবৎ এই প্রযুক্তি দেখা যায়নি।
অ্যাপলের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান উইস্ট্রোন-এর প্রধান নির্বাহী রবার্ট হং বলেন, এ বছর নতুন আইফোন ৮-এ বিল্ট ইন থাকবে ওয়্যারলেস চার্জিং।
“পানি নিরোধী এবং ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের মতো নতুন ফিচারগুলোতে এখন ভিন্নতা দরকার এবং পানি নীরোধী ফিচার আইফোন অ্যাসেম্বল প্রক্রিয়াও কিছুটা পরিবর্তন করবে,” বলেন হং।
চলতি বছরের শুরুতে ওয়্যারলেস পাওয়ার কনসোর্টিয়াম-এর সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে অ্যাপল। আর ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের পেটেন্টও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই নতুন আইফোনে ওয়্যারলেস চার্জিং আনা হচ্ছে তা একরকম নিশ্চিতই বলা যায়।
নতুন আইফোন নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু গুজব শোনা গেছে। সম্প্রতি ডিভাইসটি নিয়ে কিছু তথ্য ও ছবি ফাঁস করেছে চীনা সাইট আইফোনার্স।
সাইটটিতে বলা হয় নতুন আইফোন ৮ নিয়ে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৮ ও এলজি জি৬-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে অ্যাপল। পুরো বেজেলহীন এই আইফোনটির পর্দার অনুপাত উল্লেখ করা হয় ১৮.৫:৯।
ধারণা করা হচ্ছে আইফোন ৮-এ বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে অ্যাপল। চলতি বছরের শেষ দিকে ডিভাইসটি উন্মোচনের কথা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এর আগে আইফোন ৭এস উন্মোচন করবে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বরাবরের ‘এস’ সিরিজের মতো আইফোন ৭এস-এও বাহ্যিক পরিবর্তন আনা হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে আইফোন ৬-এর পর নকশায় খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায়নি আইফোনের। কিন্তু আইফোনে ৮-এ অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে বলে গুজব রয়েছে।
নতুন ফাঁস হওয়া ছবিতে দেখা গেছে সামনের পুরোটা অংশ জুড়ে পর্দা রাখা হয়েছে। ওপরের দিকে পর্দার কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে সেখানে ক্যামেরা ও অন্যান্য সেন্সর বসানো হয়েছে। যেহেতু সামনে থেকে হোম বাটন বাদ দেওয়া হয়েছে তাই ধারণা করা হচ্ছে ওপরের ওই অংশেই নেভিগেশন বাটন রাখা হবে।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল পর্দার মধ্যেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর ব্যবহার করা হবে আইফোন ৮-এর। কিন্তু ফাঁস হওয়া ছবিতে দেখা গেছে ডিভাইসের পেছেন অ্যাপল লোগো-এর নিচে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর রাখা হয়েছে।
এছাড়া আইফোন ৭-এর মতো ডুয়াল ক্যামেরা দেখা গেছে আইফোন ৮-এ। তবে, আড়াআড়ি না রেখে এবার লম্বালম্বিভাবে ডুয়াল ক্যামেরা বসানো হয়েছে এতে।
কবিতা হরদম লেখা হয়। কিন্তু মহাকাব্য রচিত হয় এক বা দুটি। শুক্রবার কার্ডিফে বাংলাদেশ কবিতা লেখেনি, লিখেছে মহাকাব্য। রচনাকার দুই কবি সাকিব এবং মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশ দলের সংগ্রহ একসময় ৩৩/৪, এ অবস্থায় যারা কার্ডিফ থেকে মন সরিয়ে নিয়েছিলেন তারা এখন আফসোসের অনলে পুড়ছেন। এই অনলের দগ্ধতা বড় তীব্র। কারণ বাংলাদেশ খুব শিগগিরই হয়তো আরেকটি ম্যাচ জিতবে, কিন্তু সেই ম্যাচটি কি এমন মহাকাব্যিক হয়ে উঠবে? তামিম, সৌম্য, সাব্বির এবং মুশফিক বিদায় নেওয়ার পর বাংলাদেশ রেকর্ডের এমন প্রাচীর গড়বে এমন স্বপ্ন সত্যি কেউ দেখেনি। বেতার, টিভি, অনলাইন থেকে সরে গেছেন অনেকে। যারা ছিলেন তারা দেখতে চেয়েছিলেন কত অঙ্কে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। জয়ের তীরে গিয়ে কতবারইতো বাংলাদেশ তরী ডুবিয়ে দিয়েছে, আর কার্ডিফে অতল গহ্বর থেকে ভেসে উঠলো বাংলাদেশ। সাকিব – মাহমুদউল্লাহর জুটি মুহূর্তে ইতিহাস গড়ে যাচ্ছিল। দুজনার চোখ এবং শারীরিক ভাষা দেখে মনে হচ্ছিল বাঘের মতো কেউ নয়, দুই বাঘই সুন্দরবনের মান বাঁচাতে লড়ে যাচ্ছে। আর সুন্দরবন মানেইতো বাংলাদেশ। আজ অস্ট্রেলিয়া – ইংল্যান্ডের মধ্যে কে জিতবে কে হারবে সেদিকে আমার নজর থাকছে না। কারণ এবারের আইসিসি চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনাল ম্যাচটি আমি গতকাল দেখে ফেলেছি, দেখেছে বিশ্ব। কথাটা আবেগের নয়, কার্ডিফে রচিত মহাকাব্যের প্রতি পঙতিতে বাংলাদেশ এর প্রমাণ রেখে দিয়েছে ।
বরাবরই আমি ব্যক্তি জীবন এবং রাষ্ট্রকে ক্রিকেট থেকে প্রণোদনা ও মন চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেই। কারণ ক্রিকেটের ইনিংসে যেমন জোয়ার -ভাটা আছে, ব্যক্তি জীবন, রাষ্ট্র জীবনও একই নিয়মে আবর্তিত। হাল ছেড়ে দেওয়া কোনও সমাধান নয়। লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়। খাদের কিনার থেকেও জীবনের কাছে ফিরে আসা যায়। বিধ্বস্ত জনপদকে মাতানো যায় জয়ের উল্লাসে। কার্ডিফে সেই উদাহরণ রচনা করে দেখিয়েছেন সাকিব- মাহমুদুল্লাহ। আমরা অনেকটা সময় ধরে সংকটের মধ্যে আছি। রাষ্ট্র এবং সমাজে বিভক্তি বাড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় আধা শতাব্দী পড়ে এসে সংশয় দেখা দিয়েছে- মুক্তিযুদ্ধে যে আদর্শের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের লড়াইটা, আজ ভোটের জন্য বুঝি তাদের সঙ্গেই আপসের করমদন! রাজনীতির ক্ষমতানীতিতে রূপান্তর ঘটেছে যেমন, তেমনি সমাজ জীবন, ব্যক্তি জীবন এখন সমুদ্রে ভাসমান। ষোল কোটি মানুষ বিবেচনায় সম্পদ গুটিকয়েক মানুষের মুঠোতে। বাড়ছে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির দূরত্ব। শিক্ষার কাঠামো ভেঙে তছনছ।
অসাম্প্রদায়িক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক সাজাতে ব্যস্ত একটি পক্ষ। ধর্মকে ভোট কেনার মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গণমাধ্যম হয়ে পড়েছে পুঁজির পাহারাদার। সবকিছুর যোগফল হলো অবিশ্বাস এবং অনিশ্চয়তার বাংলাদেশ। প্রশ্ন কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ হেরে যায়নি। তার গন্তব্য বিজয়ে পথে। বিশ্বাস – অবিশ্বাসে বিভক্ত, ক্ষমতা- ভোগের বিস্কুট দৌড়ে ক্লান্ত প্রতিটি বাঙালির সবশেষ গন্তব্য বাংলাদেশ। এই একটি নাম, একটি উচ্চারণে একাট্টা বাঙালি। যোগ নেতৃত্ব যেকোনও অচলায়তন থেকে বাংলাদেশেকে তুলে আনতে পারে, যে কোনও শক্তির কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে, একাত্তর তা দেখিয়েছে। ২০১৭ তে দেখানো সাকিব- মাহমুদউল্লাহ। হারবে না বাংলাদেশ। এ শুধু কোনও আবেগী উচ্চারণ নয়, প্রায়োগিক বিশ্বাস ।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি
রবিবার রাতে এক বন্ধু ফেসবুক মেসেঞ্জারে ইনবক্সে জানতে চাইলেন, সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণের দাম কত?
আমি বললাম, শুনেছিলাম, ভুলে গেছি।
আসলে আমাদের মধ্যবিত্তের ভাবনার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ১০০ হাজারে এক লাখ, এটুকু মনে রাখতে পারি। লাখ লাখ, কোটি কোটি, হাজার কোটি শুনলেই প্যাচ লেগে যায়; পেছন থেকে গুনতে থাকি- একক, দশক, শতক…। মনে রাখতে পারি না।
সারাজীবন স্বর্ণের ওজন শুনে এসেছি ভরিতে। এখন এক ভরি স্বর্ণের দাম কত? কয় ভরিতে এক কেজি হয়? দুইটা গুণ দিলে এক কেজির দাম বের হবে। তাকে ৪০ দিয়ে গুণ দিলে এক মণের দাম পাবেন। তাকে ১৩.৫ দিয়ে গুণ দিলেই পেয়ে যাবেন সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণের দাম। আমার সমস্যা হলো, এক ভরি স্বর্ণের এখনকার দাম কত তাও জানি না, আর কয় ভরিতে এক কেজি হয় তাও জানি না। আপনারা কেউ বের করতে পারলে জানাতে পারেন। খালি অনুরোধ, হিসাব করার সময় বড় ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হবে। ছোট খাটো ক্যালকুলেটরে অত টাকার হিসাব নাও আসতে পারে।
সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণের দাম নয়, আমার মাথায় খালি ভাবনা, সাফাতের মতো একটা ছেলে থাকলে, আর কিছু লাগে না। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম সারাজীবন ব্যবসা করে মণ কে মণ স্বর্ণ কামালেন, এক ছেলের জন্য একলহমায় তার সব তামা হয়ে গেলো। সারাজীবনের সব কামাই এখন বাংলাদেশে ব্যাংকের ভল্টে। এই ঘটনায় দায় যতটা সাফাতের, তারচেয়ে বেশি তার বাবা দিলদারের। ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আসার পরও দিলদার তার পক্ষে সাফাই গাইছিলেন। আমার আসলে দিলদারের জন্য করুণা হচ্ছে। তার হয়তো শত কোটি বা হাজার কোটি টাকা আছে। কিন্তু দিলদার তার আসল সম্পদ চিনতে পারেননি। আসল সম্পদ আপনার সন্তান। দিলদার যদি স্বর্ণে বিনিয়োগ না করে, সন্তানে বিনিয়োগ করতেন, তাহলে আজ তাকে এমন পথে বসতে হতো না। পথে বসাটা হয়তো আক্ষরিক অর্থে নয়। সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণ জব্দ করার পরও হয়তো দিলদারের আরো অনেক সম্পত্তি আছে। কিন্তু ভাবুন একবার, যার সন্তান ধর্ষণের অভিযোগে কারাগারে থাকে, তারচেয়ে নিঃস্ব আর কে আছে? অনেকেই বলছেন, দিলদারের ছেলে সাফাত আহমেদের বিরুদ্ধে না হয় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কিন্তু যে অভিযোগে তার সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণ জব্দ করা হলো, একই অপরাধ তো বাংলাদেশের সব স্বর্ণ ব্যবসায়ীই করেন এবং করছেন। কারণ বিমানবন্দর ছাড়া বাংলাদেশে কোনও স্বর্ণের খনি নেই। কিছুদিন পরপরই বিমানবন্দরে মণে মণে স্বর্ণ ধরা পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হয় না বললেই চলে। তাহলে এত এত স্বর্ণের দোকান স্বর্ণ পায় কই। আসলে বাংলাদেশে স্বর্ণের ব্যবসার পুরোটাই চলে চোরাচালানে আসা স্বর্ণ দিয়ে। আপন জুয়েলার্সের মতো কোনও জুয়েলার্সই তার স্বর্ণের বৈধ কাগজ দেখাতে পারবে না। এটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে। কিন্তু সরকার দেখেও না দেখার ভাব করছে। তাহলে আপন জুয়েলার্সকে ধরা হলো কেন? ওই যে কথায় বলে না, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
তবে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপন জুয়েলার্সের জব্দ করা সব স্বর্ণ ফেরত না দিলে রোববার থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছে। হুমকি শুনে আমার মনে হয়েছে, চোরের সাক্ষী মাতাল। আপন জুয়েলার্সের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের পাশে কিভাবে দাঁড়ায় সমিতি। আমার ধারণা ব্যবসায়ীরা আসলে তাদের নিজেদের স্বর্ণ বাঁচাতেই এই দাবি জানিয়েছেন। ধর্মঘটের আড়ালে তাদের মূল দাবি আসলে আর কোনও জুয়েলার্সে যেন এ ধরনের অভিযান চালানো না হয়।
দিলদার আহমেদ সেলিমের ঘটনা থেকে আমাদের কিছু শেখার আছে? আমরা কি বুঝবো আমাদের আসল সম্পদ কোনটা, সন্তান না স্বর্ণ? টাকা থাকলেই কি আমরা সন্তানকে প্রতিদিন দুই লাখ টাকা পকেট খরচ দেবো লুচ্চামি করার জন্য? দিলদার আহমেদ সেলিমের অনেক টাকা। কিন্তু বিল গেটসের চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই নয়। বিল গেটস প্রতিদিন তার সন্তানদের কোটি টাকা পকেট খরচ দিলেও তার অর্থ ফুরাবে না। বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস অনেক অর্থ কামিয়েছেন, তাই জানেন অর্থই অনর্থের মূল। বিল গেটসের সন্তানরা একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগও পান না। অঢেল ও বেহিসেবী অর্থ সাফাতকে যেমন অমানুষ বানিয়েছে, এর আগে ঐশীকেও খুনি বানিয়েছিল।
একজন মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। আর সেই কর্ম ধারণ করে বাবা-মাকে বাঁচিয়ে রাখে তার সন্তান। তাই বুদ্ধিমানরা মূল বিনিয়োগটা করেন সন্তানে। অনেকে সন্তানের জন্য গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যেতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। আর বাপের টাকা ধ্বংস করে অপোগন্ড সন্তান। তারচেয়ে ভালো আপনি যদি আপনার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করেন, সে নিজেই তার জীবনধারনের মতো অর্থ উপার্জন করতে পারবে, আপনার রেখে যাওয়া সম্পদের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনটা ধ্বংস করবে না। ভেবে দেখুন, আপনি যে কঠোর পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, সেটা ভালো, নাকি আপনার বাবার টাকায় ফুটানি করলে ভালো লাগতো? অবশ্যই সন্তানের পেছনেই আপনি আপনার সমস্ত আয় ব্যয় করবেন। তাকে ভালো স্কুলে পড়াবেন, ভালো পোশাক পড়তে দেবেন, ভালো ডাক্তার দেখাবেন, সন্তানের সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, আপনার সন্তান যেন অপচয় না করে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ যেন সে হাতে না পায়। কিপটেমি করবেন না, সন্তানের হাতে দেওয়া প্রতিটি পয়সার হিসাব যেন আপনার জানা থাকে। আপনার সন্তান যেন আপনার অর্থেই মাদক নিতে না পারে, নারীদের পেছনে ব্যয় করতে না পারে। সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব আপনারই। আপনার সন্তান যেন নারীদের শ্রদ্ধা করে, আপনার সন্তান যেন জীবনকে ভালোবাসে, আপনার সন্তান যেন মানবিক মানুষ হয়; সেটুকু নিশ্চিত করতে পারলেই আপনি সফল। নইলে আপনার সারাজীবনের সব অর্জন ধুলোয় মিশে যাবে দিলদারের মতো।
বনানীকাণ্ড থেকে আমাদের আরও অনেককিছু শেখার আছে। একটা হলো, কার সাথে ছবি তুলবেন, কার সাথে তুলবেন না। বনানীকাণ্ডের পর সেলফি মানেই আতঙ্ক। কার সাথে ছবি তুলবেন, কার সাথে তুলবেন না; এটা অবশ্য পুরোপুরি আপনার ওপর নির্ভর করে না। মোবাইলের যুগে এখন বাংলাদেশে ১৬ কোটি ফটোগ্রাফার। সবার হাতেই ডুয়েল ক্যামেরা। যখন তখন ছবি তোলা এখন ডালভাত। বিশেষ করে সেলিব্রেটিদের জন্য এই ক্যামেরা হলো শাখের করাত। আপনি যদি সেলফি তুলতে রাজি না হন, সবাই বলবে ভাব বেড়ে গেছে। আর যদি নির্বিচারে ছবি তোলেন, তাহলে কী হতে পারে, বনানীকাণ্ডের পর সবাই এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
ঢাকায় এসে নাঈম আশরাফ বনে যাওয়া সিরাজগঞ্জের হালিম একজন পেশাদার টাউট। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা তার সাইনবোর্ড, আসল ব্যবসা প্রভাবশালীদের সাথে সেলফি তুলে তা ফেসবুকে দিয়ে বোঝানো সেও কতটা ক্ষমতাশালী। তারপর সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা সুবিধা আদায়ই হলো তার মূল ব্যবসা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টও এই প্রক্রিয়ার অংশ। অবশ্য এই প্রবণতা নতুন নয়। যখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না, তখনও এ ধরনের কিছু মানুষ প্রভাবশালীদের সাথে ছবি তুলে বাসার ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখতো। মোবাইল, ফেসবুক আসার পর এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তাদের সুযোগ নেওয়ার সুবিধাও বেড়েছে। টেলিভিশনে কোনও নেতা বক্তব্য রাখার সময় পেছনে ক্যামেরার ফ্রেমে থাকার জন্য কিছু মানুষের ধাক্কাধাক্কি দেখি। আমরাও মাঝে মাঝেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রীর পেছনে দাঁড়ানো মানুষদের কাউকে চিহ্নিত করে নিউজ করি, দাগী আসামীর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বা অন্য কোনও মন্ত্রীর কোনও দোষ দেখি না আমি। মন্ত্রীরা তো আর সারাদেশের লাখ লাখ দাগী আসামীর নামের তালিকা পকেটে নিয়ে ঘোরেন না বা সবাইকে তারা চেনেনও না। কে, কখন, কোথায় ছবি তুললো; সেই ছবি দিয়ে সে কোথায় কোন ফায়দা আদায় করলো, তা তো আর তাদের মনিটর করা সম্ভব নয়। বনানীর ঘটনার পরও বিশেষ করে নাঈম আশরাফের সাথে মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, গায়িকা, নায়িকা, ক্রিকেটার, পুলিশ, সাংবাদিকদের ছবি বা সেলফি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই ছবি দিয়ে অনেককে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। নাঈম আশরাফের সাথে সেলফি আতঙ্কে ভুগছেন অনেকে। নাঈম হয়তো মন্ত্রীর সাথে তার সেলফি দেখিয়ে এমপির কাছ থেকে, এমপির ছবি দেখিয়ে পুলিশের কাছ থেকে সুবিধা নেয়। কিন্তু আমরা অযথাই যাদের সাথে ছবি, তাদের হেয় করছি। নাঈম যখন সুযোগ পেয়ে ছবি তুলেছে, তখন তো সে ধর্ষণ মামলার আসামী ছিল না। যারা ছবি তুলেছেন, তারাও জানতেন না, নাঈম পরে ধর্ষণ করবে। তবে তারপরও সেলিব্রেটিদের ছবি তোলার ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত। ভুবন জোড়া কত ফাঁদ পাতা থাকে, কে যে কখন, কোথায় সেই ফাঁদে পড়ে যায় কে জানে?
বিশ্ব জোড়া পাঠাশালা। আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। সাফাতের ঘটনায় তরুণদের, দিলদারের ঘটনায় অভিভাবকদের, নাঈমের ঘটনায় সেলিব্রেটিদের। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো, আমরা কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। তাই বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
ফাহমিদা হক: ঈদ সমাগত। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নতুন পোশাক। প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। আর এর একটা অন্যতম অংশজুড়ে থাকে পোশাক বাণিজ্য। মানুষের মৌলিক চাহিদার দ্বিতীয় স্থানে থাকা পোশাক, একসময় নিতান্তই চাহিদা পূরণে ব্যবহার হলেও এখন পোশাক মানে ফ্যাশনের অন্যতম অংশ। দেশীয় সমৃদ্ধশালী কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে দেশীয় কাপড়, দেশীয় বুননে রং ও নকশার বৈচিত্র্যে এসব পোশাকই বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণের উৎসবকে করে তুলে আরও রঙিন। কারণ এইসব পোশাকের ডিজাইনে রয়েছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অপূর্ব সব ছোঁয়া। সমাজের সৌখিন ও ফ্যাশন সচেতন লোকদের কেনাকাটার জায়গা হিসাবে পরিচিত দোকানই হচ্ছে বুটিক হাউজ। বুটিক ফরাসি শব্দ হলেও এর সযতœ ব্যবহার আর নান্দনিকতায় তা এখন আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বুটিকের পণ্য তৈরিতে যে সমস্ত সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছেÑ বøক, বাটিক, এমব্রয়ডারি, কারচুপি এবং হ্যান্ডিক্রাফট।
বাংলাদেশে দুই যুগের ব্যবধানে বুটিকের সঙ্গে জড়িত নারীদের একটি প্লাটফর্ম হয়েছে। বর্তমানে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ১৩০টি রেজিস্টার্ড বুটিক হাউজ রয়েছে। এর বাইরেও সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে আরও প্রায় ৫ হাজার বুটিক হাউজ। এ শিল্পের নিজস্ব বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এর বাজার চাহিদা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বুটিক শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রায় ১০০ ভাগ নারী। বুটিক হচ্ছে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং চামড়া শিল্পের সহায়কশিল্প। এই শিল্পের উন্নতি হলে আলাদা রুচি ও বৈশিষ্ট্যের বাজার সৃষ্টি হবে। বুটিকের তৈরি পোশাকের দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগও রয়েছে। বিশেষ করে ইউএসএ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ এবং ইউকে সবচেয়ে বড় বাজার হতে পারে আমাদের জন্য। কারণ সেখানে প্রচুর বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাই রপ্তানির মাধ্যমে এ শিল্পকে আরও লাভজনক করার সুযোগ রয়েছে।
এক সময়ের ঘরোয়া বা সৌখিন বুটিক হাউজগুলোই এখন বাজার বিকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, নান্দনিকতায় এবং দেশীয় ভাবধারার এসব পোশাক বর্তমানে সব বয়সের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। কিছু উদ্যমী এবং স্বাপ্নিক তরুণের স্বপ্নই দেশে তৈরি করা কাপড় দিয়ে ফ্যাশনেবল পোশাক তৈরি ও তা জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তার প্রমাণ, একসময় পাশ্চাত্য ফ্যাশনের উপর অনুরক্তদের একটি বড় অংশই এখন দেশীয় পোশাকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের নিজস্বতা তথা শিল্পের স্বাক্ষর রেখে ফ্যাশনের উজ্জ্বল দিগন্তকে আরও দ্যুতিময় করে তুলেছে তাদের নানান সুচারু কর্মদ্বারা। আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙের মতো ফ্যাশন হাউজগুলো দেশীয় সকল শ্রেণির ক্রেতাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিদেশেও কিছু পরিমাণে রপ্তানি করছে।
ফ্যাশন হাউজগুলো এদেশের মানুষের মধ্যে কেনাকাটায় এই সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আগে যেখানে মানুষ শুধু ঈদ বা পূজার সময় নতুন পোশাক কেনার চিন্তা করত এখন সব উৎসবে মানুষ নতুন পোশাকে নানান সংস্কৃতির রুচিশীলতায় যুক্ত থাকতে পারছে স্বাচ্ছন্দ্যে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সকল সেরা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক নির্মাণ করে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সেই বাংলাদেশেরই কিছু সংখ্যক উদ্যোক্তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় সৃষ্ট দেশীয় পোশাকের এই বুটিক শিল্প যখন নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষমতা অর্জন করছে এবং দিন দিন তা বিস্তার লাভ করছে। সেক্ষেত্রে এই শিল্পকে ছোট করে দেখা, অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, ব্যাংক ঋণ, বৈদেশিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মর্যাদা ও সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে এই শিল্পও দেশ সমৃদ্ধির সহায়ক শক্তি হয়ে কাজ করতে পারে।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : ১.
গত সপ্তাহে আমি কয়েক দিন কোনও পত্রিকা পড়িনি। বাসায় পত্রিকা এসেছে কিন্তু আমি ভাঁজ না খুলে পত্রিকাটি রেখে দিয়েছি এটি আগে কখনও ঘটেনি। গত শুক্র, শনিবার আমার জীবনে এটা ঘটেছে—আমার পত্রিকাটা খুলতে ইচ্ছা করেনি। কারণ আমি জানতাম পত্রিকাটি খুললেই আমি দেখতে পাব, সেখানে লেখা থাকবে হেফাজতে ইসলামের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য হাইকোর্টের সামনে বসানো একটা ভাস্কর্যকে রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি এটাও জানতাম, সেখানে সরকারের বড় বড় মন্ত্রীর আরও বড় বড় বক্তব্য থাকবে, যেখানে এই কাজটিকে সমর্থন করে অনেক কিছু বলা হবে, শুধু মুখ ফুটে কেউ সত্যি কথাটি বলবে না মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এখন ভাস্কর্য বসানো যায় না। শুধু তা-ই নয়, বসানো হলেও হেফাজতে ইসলামকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য সেটাকে রাতের অন্ধকারে সরিয়ে নিতে হয়।
আমার অবস্থা উট পাখির মতো, উট পাখি বালুর ভেতর মাথা ঢুকিয়ে রেখে যখন চারপাশের কিছু দেখে না তখন নাকি তার ধারণা হয় তাকেও কেউ দেখছে না। আমিও পত্রিকা পড়া বন্ধ করে দিয়ে যখন কোনও খবরই রাখছি না, তখন মনে মনে ভাবছি দেশেও বুঝি কিছু ঘটছে না, কিন্তু আসলে যা ঘটার সেটি ঘটে গেছে। জানতে পেরেছি আমাদের কিছু তরুণ ঘটনাটি ঘটতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা এই দেশের ত্রিশ লাখ শহীদের পক্ষ থেকে এই ঘটনাটির প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছিল।
আজকাল আমার মাঝে মাঝেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসটির কথা মনে পড়ে। ১৬ তারিখ বিকেল বেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, আমি পরদিন ভোরবেলা যাত্রাবাড়ী থেকে হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহরে আসছি। চারপাশে নানা কিছু ঘটছে তার মাঝে আমি একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছি, একবার ডানে এবং বামে তাকাচ্ছি। মনে মনে ভাবছি, এই যে আমার স্বাধীন বাংলাদেশ, এটি আমার দেশ। আমাদের আর কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, কোনও কিছু নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না। আমরা যা যা স্বপ্ন দেখেছি তার সবকিছু এখন সত্যি হয়ে যাবে। আর কিছু নিয়ে কোনও দিন আন্দোলন বা সংগ্রাম করতে হবে না।
এখন আমি ভাবি এবং মনে হয় আমি কতই না ছেলেমানুষ ছিলাম! কখনও কি ভেবেছিলাম মাত্র চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এভাবে হত্যা করা হবে? চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হবে? এক যুগ থেকে বেশি সময় দেশকে মিলিটারিরা শাসন করবে, দেশকে পুরো উল্টো পথে ঠেলে দেবে? সব মানবতাবিরোধী অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাবে, শুধু তা-ই নয়, তারা একদিন মন্ত্রী হয়ে সরকারের অংশ হয়ে যাবে? শুধু এখানেই শেষ হয়ে গেলে ইতিহাসটি হতো দীর্ঘশ্বাসের, কিন্তু আমাদের খুব সৌভাগ্য এখানেই শেষ হয়নি। আবার মুক্তিযুদ্ধের সরকার এসে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার বিচার করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করেছে।
কিন্তু তারপর যখন দেখি সেই একই সরকার হেফাজতে ইসলামের সামনে প্রায় নতজানু হয়ে তাদের সব দাবি মেনে নিচ্ছে, পাঠ্যবইকে পরিবর্তন করেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, এই দেশ থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি হিসাব মেলাতে পারি না।
২.
ভাস্কর্য একটি অপূর্ব শিল্প মাধ্যম। মনে আছে পোস্টডকের অল্প কিছু বেতন থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের ছয় মাসের ছেলেকে নিয়ে ফ্লোরেন্স গিয়েছিলাম মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড দেখতে। কতবার ছবিতে ডেভিডের ছবি দেখেছি কিন্তু প্রথমবার যখন সেই দীর্ঘ ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভ্যাটিকানে গিয়েছিলাম পিয়েতা দেখতে, এটি যখন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তৈরি করছিলেন তখন তার পরিচিতি ছিল না, তাই পিয়েতার বুকে তিনি তার নামটি খোদাই করে রেখেছিলেন। আমি লিখে দিতে পারি পৃথিবীতে একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, এই ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্যে অভিভূত হবে না।
যখন বয়স কম ছিল তখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতে ক্লান্তি হতো না, আমার কাছে নতুন একটি দেশ মানেই সেই দেশের মিউজিয়াম, সেই দেশের শিল্পকর্ম, সেই দেশের ভাস্কর্য। যাদের প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, শুধু তারাই বলতে পারবেন ভাস্কর্য কত সুন্দর। আমি যখন এই অপূর্ব ভাস্কর্যগুলোর সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকি, তখন মনে মনে ভাবি আমরা কতই না সৌভাগ্যবান যে, মানুষ হয়ে জন্মেছি তাই এই অপূর্ব সৌন্দর্যটি উপভোগ করতে পারছি।
শুধু ভাস্কর্য নয়, মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে কত শিল্পীর কত পেইন্টিং। সাধারণ দর্শকরা বিখ্যাত পেইন্টিংয়ের সামনে ভিড় করে দাঁড়ায় আমি ঘুরে ঘুরে সুন্দর পেইন্টিং খুঁজে বেড়াই। প্রায় অপরিচিত একজন শিল্পী কিন্তু তার অসাধারণ শিল্পকর্মের সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিই আমাকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য। সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতাটি দেওয়ার জন্য। আমাদের দেশে প্রতিবছর ক্লাসিক্যাল মিউজিকের বিশাল আয়োজন হয়। আমরা সেখানে রাত জেগে পৃথিবীর সেরা সঙ্গীতশিল্পী, বাদক, গায়কদের শিল্পকর্ম শুনি, উপভোগ করি, মুগ্ধ হই। কিভাবে রাত কেটে যায়, আমরা টের পাই না।
কবিরা কবিতা লেখেন, সেই কবিতার আবৃত্তি শুনে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। মঞ্চে অভিনেতারা নাটক মঞ্চায়ন করেন, নাটকের পুরোটুকু অভিনয় জানার পরও আমরা চরিত্রগুলোর আনন্দে হাসি, দুঃখে কাঁদি, অবিচার দেখে মুগ্ধ হই। মঞ্চে শুধু নাটক দেখি না নৃত্যানুষ্ঠান দেখি, সেখানে নৃত্যশিল্পীরা তাদের নাচের মুদ্রা দিয়ে আমাদের মোহিত করেন।
আমরা পৃথিবীর অসংখ্য বৈচিত্র্যময় শিল্পমাধ্যম উপভোগ করে এক ধরনের পূর্ণতা লাভ করি। যে মানুষটি শিল্পকে যত বেশি অনুভব করতে পারবে সেই মানুষটি তত পূর্ণ মানবসন্তান। মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে আমরা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে পারি। একজন শিশুকে কখনও শেখাতে হয় না, তার বোঝার ক্ষমতা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার নিজের মতো করে সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে শিখে যায়। মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে পৃথিবীর বাতাস যে রকম আমার বুকে টেনে নেওয়ার অধিকার ঠিক একই রকম অধিকার একটি কবিতা লেখার, একটি কবিতা আবৃত্তি করার, একটি গান শোনার, একটি বাঁশি উপভোগ করার, একটি ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার। পৃথিবীর কেউ আমাকে বলতে পারবে না তুমি এই শিল্পটি দেখে মুগ্ধ হতে পারবে না।
অথচ হেফাজতে ইসলাম বলছে আমরা কবিতা পড়তে পারব না, আমরা ভাস্কর্য দেখতে পারব না, তাদের কে এ কথা বলার অধিকার দিয়েছে? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ প্রাণ দিয়ে আমরা এই বাংলাদেশটি পেয়েছি, লটারিতে জিতে এই দেশটি আসেনি। যে মুক্তিযোদ্ধারা নিজের প্রাণ দিয়ে এই দেশটিকে আমাদের উপহার দিয়েছেন, তারা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, সেটিই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের সেই বাংলাদেশের কাঠামোর বাইরে যাওয়ার কোনও অধিকার নেই। কোনও দল, কোনও গোষ্ঠী এসে ধর্মের দোহাই দিয়ে বলতে পারবে না বাংলাদেশকে পাল্টে দিতে হবে, দেশটিকে এখন সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করে ফেলতে হবে।
আজকাল কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দেওয়া হয়। হাইকোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি যখন দৃষ্টিসীমার বাইরে কোথাও নিয়ে স্থাপন করা হলো, তখন হেফাজতে ইসলাম যথেষ্ট বিরক্ত হলো, তারা সেটিকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভাস্কর্য সরানোর ব্যাপারে তারা ধর্মের কোনও এক ধরনের ব্যাখ্যা দেয়। মেয়েরা হচ্ছে তেঁতুলের মতো, তাদের দেখলেই মুখে পানি চলে আসে। নারী জাতি সম্পর্কে এ রকম একটি অপমানকর বক্তব্য আমি তাদের কাছেই শুনেছি। তাদের এই বক্তব্য ইসলাম ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা সেটি আমরা কেমন করে জানি?
আমরা আমাদের দেশের কিছু তরুণকে হলি আর্টিজানে শুধু বিদেশি হওয়ার কারণে অন্য অনেকের সঙ্গে সন্তানসম্ভবা একজন মহিলাকে হত্যা করতে দেখেছি। শুধু তা-ই নয়, হিজাব না পরার কারণে তারা মেয়েদের হত্যা করেছে, সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিকারভাবে তারা রাতের খাবার উপভোগ করেছে। তারা এই কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে তাদের নিজস্ব এক ধরনের ধর্মবিশ্বাস থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের আইএস ইয়াজিদি মেয়েদের যৌনদাসী করে রাখার ব্যাপারে ধর্মের এক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছে। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম গোষ্ঠী শত শত স্কুলের মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে, এই ভয়ঙ্কর অমানবিক কাজটি করেছে ধর্মের এক ধরনের দোহাই দিয়ে। আজকাল প্রায় প্রতিদিনই দেখছি ইউরোপের কোনও না কোনও শহরে আত্মঘাতী তরুণরা শত শত নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে অকাতরে হত্যা করছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে এ ধরনের কাজগুলোর ব্যাপারে তাদের নিজস্ব এক ধরনের ধর্মের ব্যাখ্যা আছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর জামায়াত শিবির চাঁদে সাঈদীর চেহারা দেখেছিল এবং সারাদেশে যে ভয়াবহ তাণ্ডব করেছিল তার পেছনেও তাদের নিজস্ব এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে। শুধু তা-ই নয়, একজন ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করার জন্য ঘাড়ের কোন জায়গায় কীভাবে কোপ দিতে হবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে এবং সেটিও করা হয়েছে ধর্মের নামে।
কাজেই ধর্মের নামে কিছু একটা দাবি করলেই সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে কে বলেছে?
১৯৭১ সালে পাকিস্তান মিলিটারি এই দেশের তিরিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং এই ভয়ঙ্কর গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। আমার বাবাকে পাকিস্তান মিলিটারি একটা নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল, যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাদের কাছে শুনেছি, মৃত্যুর আগমুহূর্তে তিনি হাত তুলে খোদার কাছে তার সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। (খোদা তার প্রার্থনাটি শুনেছিলেন বলে এই দেশ একটি হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছিল) আমার বাবা অসম্ভব ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ ছিলেন। এই ধর্মপ্রাণ মানুষটির কাছে আমি সংগীত শিল্প সাহিত্যকে ভালোবাসতে শিখেছি। আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষ এক, সবাই সৃষ্টিকর্তার কাছে পরিত্রাণ চাইছে, শুধু একেক ধর্মের পদ্ধতিটি একেক রকম, আর কোনও পার্থক্য নেই।
স্বাধীনতার পর আমার অসহায় মা তার সন্তানদের নিয়ে একটি অকূল পাথারে পড়েছিলেন, কিন্তু তাকে আমি এতটুকু বিচলিত হতে দেখিনি। আমাদের ধরে রাখার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু তার শক্তিটুকু এসেছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল একটি বিশ্বাস থেকে। অসম্ভব ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ যে পুরোপুরি সেক্যুলার হতে পারে সেগুলো আমি আমার মা-বাবার কাছ থেকে জেনেছি। শুধু আমি যে আমার আপনজনের কাছে ধর্মের এই মানবিক রূপটি দেখেছি তা নয়, আমার পরিচিত প্রায় সবাই এ রকম উদাহরণ দিতে পারবে। বহুকাল থেকে এই দেশের মানুষ ধর্মকর্ম করে এসেছে, কিন্তু ধর্মের এই বর্তমান অসহিষ্ণু রুদ্র রূপ আগে ছিল না।
কাজেই কোনও একটি দল ধর্মের একটি ব্যাখ্যা দিয়ে পুরোপুরি অযৌক্তিক, অমানবিক কিছু একটা দাবি করলেই সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে কে বলেছে? পৃথিবীর অন্য যেকোনও দেশে যাই ঘটুক না কেন বাংলাদেশে সেটা ঘটতে পারবে না। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দিয়ে, যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার আমাদের কোনও অধিকার নেই। কাজেই যখনই কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে ভুলুণ্ঠিত করে, তারা সরাসরি ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
সামনে নির্বাচন। আমরা অনুমান করি নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার হেফাজতে ইসলামের কাছে নতজানু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জেতার জন্য আওয়ামী লীগ নিজেই যদি সাম্প্রদায়িক একটা দলে পাল্টে যায় তাহলে আমরা কার দিকে মুখ তুলে তাকাব?
আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে তাদের মূল শক্তি হতে হবে এই দেশের প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক আধুনিক তরুণ গোষ্ঠী। তাদের মনে আঘাত দেওয়া যাবে না, তারা দেশকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছে আওয়ামী লীগকেও সেই স্বপ্নের অংশীদার হতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়