May 1, 2024
ধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : ঈদ আরবি শব্দ, যার অর্থ আনন্দ। তবে ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দটা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতাম। কিন্তু তারপরে যতই বয়স বেড়েছে, জীবন বাস্তবতার মুখোমুখি যত হয়েছি ততই যেন ক্রমেই ঈদের আনন্দ উবে গেছে, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উভয় কারণেই বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আনন্দের কথাই বলি, আমার ছেলেবেলার ঈদ আনন্দ। শৈশবের ঈদ মানেই হচ্ছে নতুন জামা-কাপড় কেনা, নতুন জুতো পাওয়া এবং ভাল ভাল খাবার খাওয়া। সেদিন যেন অন্য দিনগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন রকম হতো। সেদিন অন্তত পড়াশোনার চাপ থাকত না বা মুরুব্বিদের চোখ রাঙানিও দেখতে হতো না পড়াশোনায় গাফিলতির জন্য। কেমন যেন একটি মুক্ত বিহঙ্গের মতো দিনটা কাটাতে পারতাম।
মনে আছে, আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল, বগুড়ায়। আমাদের চাচাত ভাই-বোনেরা মিলে ঈদের দু’সপ্তাহ আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা করতাম যে, আমাদের বাড়িটাকে কিভাবে সাজানো যায়। এই ধারণা আমাদের মাঝে একটু ব্যতিক্রমই ছিল। কারণ অন্য কোনো বাড়ি সাজানোর উদ্যোগ নিতে দেখিনি কিন্তু আমরা আমাদের বাড়ি নানা রকমভাবে সাজাতাম। বিভিন্ন রঙিন কাগজ কেটে নানান আকার দিয়ে দড়িতে বেঁধে বাড়ি সাজাতাম এবং বাড়িটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতাম। চাচাতো ভাই-বোনেরা মিলে বাড়িটা পরিষ্কার করে রাখতাম।
ঈদের দিনের সকাল বেলায় নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি বা প্যান্ট, জুতো পরে বাবা-চাচাদের হাত ধরে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ পড়ে ঈদের মাঠেই বাবা-চাচাদেরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হতো। ওখানে সালামি পেতাম না, বাড়ি এসে পেতাম। বাড়ি ফিরে এসে সেমাই, জর্দ্দা যা আছে খেয়ে শুরু করতাম এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরা। চাচাত ভাই-বোনেরা এবং বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়াতাম। প্রত্যেক বাড়িতেই কিছু না কিছু খাওয়া হতো। দুপুর গড়িয়ে গেলেই বাড়ি ফিরে আসতাম। তখন অনেকটা কান্ত, পরিশ্রান্ত থাকতাম।
বিকেল হলে আবার বেরিয়ে পড়তাম। যেসব বাড়িতে যাওয়া শেষ হয়নি সেখানে যেতাম এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। রাত হলে আবার বাড়ির যে সমস্ত ভাল ভাল খাবার থাকত সেটা খেতাম এবং এটা একটা আকর্ষণ ছিল। রাতে যখন ঘুমোতে যেতাম তখন মনে হতো এত আনন্দের দিনটি চলে গেল! এই একটা ব্যথা যেন মনের মধ্যে থেকে যেত। কিন্তু বাস্তবাতটা তো এরকমই, ঈদটা তো একদিনেরই হয়। এইভাবে আনন্দ-বেদনার মধ্যদিয়ে ঈদ পার হয়ে যেত।
ঈদ মানেই তো আনন্দ বলেছিলাম কিন্তু বাংলাদেশের কজন মানুষ ঈদের আনন্দটা উপভোগ করতে পারে? এখনো বাংলাদেশের অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়, গায়ে কাপড় নেই, পেটে খাবার নেই। তারা তো ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। তাদের তো নতুন কাপড়ও নেই, খাবারও নেই, মাথার উপর কোনো আচ্ছাদনও নেই। সামাজিক বাস্তবতায় ঈদের এই আনন্দ সেদিনই পূর্ণ হবে যেদিন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মাথার উপর ছাদ থাকবে, গায়ে কাপড় থাকবে, পেটে খাবার থাকবে নইলে আমাদের সমাজে উঁচু স্তরের ঈদের আনন্দ-উল্লাসের যে আয়োজন এটা আমার কাছে অনেকটাই দায়িত্বহীনতা বলে মনে হয়। এসব কারণেই এখন ঈদের আনন্দটা আর ছেলেবেলার মতো উপভোগ করি না।
পরিচিতি: ইতিহাসবিদ
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
সম্পাদনা: আশিক রহমান