পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

নির্বাচন কমিশনের সংলাপ ও নির্বাচনী নিরাপত্তা

এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার অভিপ্রায় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের শরিক বলে পরিচিত সংগঠনগুলোর সঙ্গে কিছু বিষয়ে ধারণা এবং মতামত নেওয়ার জন্য আলোচনা শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই দেশের কিছু বরণ্য ব্যক্তি, যাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হয় তাদের সঙ্গে এবং গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এখন চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা। আলোচনার এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কারণ বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা তখনই পায় যখন জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে নির্বাচনের বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ না থাকে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচন কমিশনের একার কাজ নয়। সবার, বিশেষ করে শরিক বলে বিবেচিতদের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। যার প্রথমেই রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আইন ও বিধান মেনে চলা।

যাহোক আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের এবার একমাত্র চাওয়া ছিল যাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য হয়। নির্বাচন কমিশনও তেমনটাই ব্যক্ত করেছে। যেহেতু এ পর্যন্ত এসব আলোচনা মোটা দাগে হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো ছকে হয়নি তাই বহু ধরনের মতামত এসেছেÑ যার সারবত্তা বের করাই দুরূহ হবে। তবে দুটি বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তুলে ধরা হয়েছে, যা নির্বাচন কমিশনের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেই এ দুটি বিষয়ই সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র নিয়ামক নয়। এর একটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন এবং অপরটি ‘না ভোটের’ বিধান যুক্ত করা। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কী হবে না, হলে কীভাবে হবে এ বিষয়টি রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে পড়েছে। এর কারণ ২০১১ সালে সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে বাদ দেওয়া। আলোচনায় এ দুটি বিষয় উঠে আসায় পরবর্তীকালে যেভাবে আলোচিত হয়েছে তাতে মনে হতে পারে ভালো নির্বাচনের জন্য এ দুটি বিষয়ই অন্তরায়। তেমনটা মোটেই নয়, এ দুই বিষয় অনুষঙ্গ মাত্র। যারা এ দুটি বিষয়ের নির্বাচনে সামরিক বাহিনী না রাখা এবং না ভোটের বিধান ‘যা এখন’ আমাদের প্রক্রিয়ায় নেই, ভারতে গত নির্বাচন থেকে যুক্ত হয়েছে। না রাখার কথা জোর দিয়ে কেন বলেছেন তারা, কেন নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন তার কোনো জোরালো যৌক্তিক কারণ তুলে ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

যেমনটা আগেও বলেছি, সামরিক বাহিনীর সাহায্য এ পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনে প্রয়োজন হয়েছে, এ নির্বাচন এ সহযোগিতা ছাড়া অনুষ্ঠিত হবে বা হতে পারবে তা মনে হয় না এবং বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভরশীল। এখানে প্রশ্ন থাকতে পারে যে, ওই সময়ে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন এবং তাদের কার্যক্রম রিটার্নিং অফিসার তথা নির্বাচন আইনের আওতায় হবে, না সিআরপিসির আওতায় হবে? এখানেই প্রয়োজন মতামতের, যদিও আমি এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কারও মতামত খুব জরুরি তেমনটা মনে করি না।

এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে ভোটারদের নিরাপত্তা ও নির্বাচনের পরিবেশ আয়ত্তে রাখার জন্য। নির্বাচন কমিশন যদি শুধু অস্ত্রবিহীন আনসার-ভিডিপি দিয়েও অথবা কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাতে পারে সেটাই হবে কাম্য। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নির্বাচনী সংস্কৃতির পরিবেশে তা সুখ-স্বপ্নই মাত্র। আদৌ এ স্বপ্ন বাংলাদেশে কোনোদিন বাস্তব হবে কিনা জানি না। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেকের অনেক মত থাকলেও নির্বাচনের পরিবেশ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তেমন থাকেনি।

আগামী নির্বাচনের পরিবেশ বা নির্বাচন কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। কারণ বিগত দিনগুলোতে সাধারণ মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি, যার দায়-দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দলের। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সব সময়ই আশাবাদ প্রকাশ করেছে যে, তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারবে। হালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বর্তমান সংবিধানের আওতায় দলীয় সরকারের অধীনেও শুধু নির্বাচন সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব যদি সে পরিবেশ তৈরিতে সবার প্রচেষ্টা এবং সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তেমন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

আলোচনা শুরু করেছিলাম নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর কী ভূমিকা থাকবে তা নিয়ে। আমি মনে করি না এটি একটি বিতর্কের বিষয়। বিষয়টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তবে প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিয়োগ দিতে হলে তা নির্বাচনী আইন, আরপিও-১৯৭২ সংযোজন করতে হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি।

আমাদের দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অধিকাংশ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উদাহরণ রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত আধুনিক তাত্ত্বিক কাঠামোতে উদাহরণ বলে বিবেচিত হয়েছে। এ ব্যবস্থাপনায় একটি অত্যন্ত কার্যকরি শক্তিশালী নির্বাচনী আইন রয়েছে। রয়েছে সহজে আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের ব্যবস্থা। একটি স্বাধীন এবং আইন দ্বারা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে এবং মনোনয়ন নির্ধারণে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি ক্ষমতা ও নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইনের বিধান ও আদালতে আবেদন করার ও ত্বরিত মীমাংসার ব্যবস্থা। তদুপরি নির্বাচন কমিশনের বিশাল বহরের মাঠ পর্যায়ের এবং প্রয়োজনীয় সরবরাহের (খড়মরংঃরপং) ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। এতকিছুর পরও প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক যে, তা হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? তাত্ত্বিকভাবে হওয়ার কথা, তবে বাস্তবটা কি তেমন? এ প্রশ্নের উত্তরে অন্তর্নিহিত রয়েছে তাত্ত্বিক ব্যবহারিক বা বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে তফাৎ। আমাদের দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুখকর হয়নি, এর উদাহরণ টানার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায়ও হিমশিম খেতে হয়েছে। দু-চারটি ভালো স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সার্বিক বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। স্মরণ থাকার কথা যে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো কেমন হয়েছিল তা নিয়ে কথা বলারও তেমন কিছু নেই।

যেমনটা বলেছি, তাত্ত্বিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সব কাঠামোই বিদ্যমান তথাপি দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে এযাবৎ নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্কের কারণ প্রধানত তত্ত্বকে প্রয়োগে পরিণত করার মতো পরিবেশ তৈরি করা। বিদ্যমান পরিবেশে সম্ভব নয়। এ অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অন্তরায়, যেগুলো আমার গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লব্ধ, উল্লেখনীয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যা সুবিধাভোগী চধঃৎড়হ পষরহঃ রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। দুটি সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থা ব্যাপক দলীয়করণ যা ১৯৭৫-এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ নিয়ে ধোঁয়াশা, বিশেষ করে স্থায়ী গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় দলীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগ বিস্তারিত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনার সমস্যা।

এ পর্যায়ে আমি সংক্ষিপ্তভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় আমাদের মতো দেশে, যেখানে ভালো নির্বাচনের অন্তরায়গুলো দারুণভাবে নির্বাচনের মুখ্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় তার অন্যতম নির্বাচনী নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করছি। আমাদের মতো দেশে যে কোনো নির্বাচনে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে নির্বাচন কমিশনের মাথা ব্যথা এবং সবচেয়ে দুরূহ কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয় নিরাপত্তার বিষয়।

একটি নির্বাচন নিরাপত্তার পরিকল্পনা করতে হয় তিন ধাপে (১) প্রাক-নির্বাচন ভোট গ্রহণ; (২) নির্বাচনের দিন এবং (৩) নির্বাচনের পর। এই তিন ধাপের প্রতিটিতে চার স্তরের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো, এর প্রশিক্ষণ, বাহিনীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের মতো দেশে জনগণের আস্থার বিষয়টি বিবেচনায় এনে স্তরগুলো বিন্যাস করতে হয়। এই স্তরগুলো হলোÑ (১) কাঠামোগুলোর নিরাপত্তা; নির্বাচনী অফিস, রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস, ভোটকেন্দ্রসহ গণনাকেন্দ্র এবং অংশগ্রহণকারী দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অফিসগুলো; (২) নির্বাচনে ব্যবহার্য দ্রব্যাদির নিরাপত্তা; (৩) তথ্যের নিরাপত্তা, ভোটার তালিকা, বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও নির্বাচনের ফলাফল এবং সংশ্লিষ্ট আইনানুগ অন্যান্য তথ্যাদি এবং (৪) ভোটার, জনগণ ও নির্বাচনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা। চতুর্থ স্তরের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই স্তরের নিরাপত্তা নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি না হলে ভোটাররা, বিশেষ করে নারী ভোটার ও পক্ষান্তরে সংখ্যালঘু ভোটাররা নির্বাচন থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিরত থাকেন।

ওপরে আলোচিত ধাপ এবং স্তর বিবেচনা না করে নিরাপত্তার পরিকল্পনা কার্যকর হয় না। একই সঙ্গে প্রতি ধাপ এবং স্তরের জন্য কী ধরনের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের প্রশিক্ষণ এবং নির্ভরযোগ্য বাহিনীর প্রয়োজন সেটা বিবেচনা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। পরিকল্পনাকালে আরও মনে রাখতে হবে বর্তমান পরিবেশে জঙ্গি হামলার বিষয়টিকেও।

আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা বিষয়টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তার সামান্য উদাহরণ নির্বাচনী বাজেটে নিরাপত্তার খরচ। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে শুধু নিরাপত্তা বাবদই খরচ হয়েছে একশ নিরানব্বই কোটি বিরানব্বই লাখ নয় হাজার একষট্টি টাকা (১৯৯,৯২,৯০৬১) নির্বাচনী বাজেটের ৭০ শতাংশ (৭০%)। স্মরণযোগ্য যে, মাত্র ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অপরদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যয় ছিল চুরানব্বই কোটি আটষট্টি লাখ ষাট হাজার ছাপান্ন টাকা (৯৪,৬৮,৬০,০৫৬) মাত্র এবং ১৯৯১ সালে খরচ হয়েছিল আটাশ কোটি তেপান্ন লাখ বাহাত্তর হাজার একশ সাঁয়ত্রিশ টাকা মাত্র (২৮,৫৩,৭২,১৩৭)।

শুধু জাতীয় সংসদেই নিরাপত্তার এত বিশাল খরচ নয়, অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আরও বেশি মাত্রায় খরচ হয়েছে এবং হয়। উদাহরণস্বরূপ ২০১৬ সালের ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে ২৪৪,১৫,৩৬,৮৪১ টাকা মাত্র টাকা (দু’শ চৌচল্লিশ কোটি পনেরো লাখ ছত্রিশ হাজার আটশ একচল্লিশ টাকা মাত্র) নিরাপত্তার জন্য খরচ করেও একশর ওপর মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের ওই নির্বাচন ছিল এযাবৎ সবচেয়ে বেশি সহিংসপূর্ণ। একই নির্বাচনে ২০১১ সালে খরচ হয়েছিল ১৩৪,৮১,০০,০০০ টাকা (একশ চৌত্রিশ কোটি একাশি লাখ টাকা মাত্র) অবশ্য ওই নির্বাচনে সহিংসতার পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম। সূত্র : নির্বাচন কমিশন-নির্বাচনী পরিসংখ্যান।

ওপরের পরিসংখ্যান থেকেই প্রতীয়মান, আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় যজ্ঞ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা। এত ব্যাপক আয়োজন ইঙ্গিত দেয় যে, নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে নিরাপত্তা বিধানই নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। এত বড় যজ্ঞের পরও সুষ্ঠু নির্বাচন করা দুষ্কর যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে এবং জনমনে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গত কারণে ঘাটতি থাকে। তবে আমার মতে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সহায়ক প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। প্রশাসনের সংজ্ঞায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অন্তর্ভুক্ত, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমার বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভাজন এবং সংস্কৃতির কারণ নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কাজেই ওপরের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের আঙ্গিকে আগামী নির্বাচনের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় যা এখন থেকেই শুরু করা উচিত, কী ধরনের বাহিনী কোন ধাপ এবং স্তরের জন্য প্রযোজ্য হবে তা যেমন আইনি কাঠামো ও নিরাপত্তা পরিকল্পনায় রাখতে হবে, তেমনি রি-অ্যাকটিভ নয় প্রো-অ্যাকটিভ নিরাপত্তার পরিকল্পনায় সামরিক বাহিনী ব্যবহারের প্রশ্নটিরও উত্তর পাওয়া যাবে নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা ও সামর্থ্য থেকে। আমি মনে করি, প্রো-অ্যাকটিভ নিরাপত্তার জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে রাখতে নির্বাচনী আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করাই শ্রেয়। কাঠামোতে রাখা মানেই এই নয় যে, সামরিক বাহিনী অথবা আইনে উল্লেখিত সব বাহিনীকেই নিয়োগ দিতে হবে। কোন কোন বাহিনী কোন কোন স্তরের জন্য প্রয়োজন সে নির্ণয় নির্বাচন কমিশনের। কাজেই এ বিষয় নিয়ে বিতর্কও অবান্তর।

নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। এ কাজ করতে নির্বাচন কমিশনকে যা যা করা প্রয়োজন তেমন ক্ষমতাই সংবিধানের ১১৯ ধারার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখেই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যে পরিবর্তন ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা নির্বাচন কমিশনকে এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on নির্বাচন কমিশনের সংলাপ ও নির্বাচনী নিরাপত্তা

স্মৃতির পাতায় আইভি রহমান

দিল মনোয়ারা মনু : ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস। বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি দুস্থ শিশুদের মধ্যে দুধ বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে দুধ বিতরণ করছেন আইভি রহমান। আমার সুযোগ হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে থাকার। মাত্র সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। সবকিছু দেখার ও জানার প্রবল আগ্রহ তখন। চোখের সামনে সেই দৃশ্য আজও অমলিন। আইভি রহমান পরেছেন অফ হোয়াইট রঙের লাল-পাড় শাড়ি, চোখে সানগ্লাস। লাবণ্য-ঢলঢল স্নিগ্ধ চেহারা। অপূর্ব লাগছিল তাঁকে। বাচ্চারাও দুধ নিতে যেয়ে অবাক হয়ে যেন তাঁকেই দেখছিল।

আজ মনে পড়ছে কত স্মৃতি, কত টুকরো টুকরো কথা। রাজনীতি সবসময় পরিচ্ছন্ন নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু আইভি রহমান আমার সামনে এক অন্য রকম দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাঁর মতো নির্লোভ মানুষ এদেশের রাজনীতিতে মেয়েদের সচেতন করে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন বলেই আজ এ ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন তিনি একজন নির্ভীক সৈনিক। তাঁর এই মহান আত্মত্যাগ বাংলাদেশের নার আন্দোলনের মশাল হয়ে জ্বলবে চিরকাল।

আইভি রহমান সারাজীবন মাঠের রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক সভার মঞ্চে উঠে ভাষণ খুব কম দিয়েছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে মঞ্চের নিচে বসে শুনতে এবং শ্লোগান দিতেই পছন্দ করতেন বেশি। কিন্তু পোশাকে-আশাকে ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল, গোছানো। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজনীতি করতেন সক্রিয়ভাবে। কিন্তু আইভি আপার কারণে সেই সংসারও ছিল অত্যন্ত ছিমছাম এবং রুচিকরভাবে সাজানো।

নারী আসন নিয়ে যখন তুমুল বিতর্ক, পঁয়তাল্লিশ আসন নারীদের জন্য নির্ধারিত করা হল। প্রতিবাদে ফেটে পড়ল নারীসমাজ। জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করা হল। বক্তৃতা চলছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে এল মহিলা আওয়ামী লীগ, আইভি রহমানের নেতৃত্বে। মুহূর্তেই প্রকম্পিত হল জনপদ মুহুর্মূহু শ্লোগানে। তখন আমার পাশেই বসে থাকা জনৈক নেত্রী বললেন, “নাও, এখন সমস্ত ক্রেডিট যাবে আওয়ামী লীগের ঘরে।”

আমি মনে মনে ভাবলাম, ক্রেডিট নিতে জানতে হয়। আসর গরম করার কৌশলটি রপ্ত করাও একটি বড় শিল্প।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত তখন আইভি রহমান সেখানে যেয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, “তোমাদের এই আচরণের ফলে আমি যে ছাত্রলীগ করেছি সে কথা ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে।”

অকপটে সহজ সত্য বলতে তাঁর কখনও দ্বিধা ছিল না।

২০০০ সালে নারী-শিশুনির্যাতনবিরোধী আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন। এই আইন প্রণয়নের দীর্ঘসূত্রতাও তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত দশককে নারী দশক এবং ১৯৭৫ সালকে নারীবর্ষ ঘোষণা করা হলে আইভি রহমান এই ঘোষণায় স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দিক থেকে অবহেলিত, অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চনার শিকার এবং সামাজিক দিক থেকে প্রতিনিয়ত অমর্যাদাহীন নারীসমাজের জন্য এই ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ এই ঘোষণা এদেশের নারীআন্দোলনকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যুগিয়েছে অদম্য প্রেরণা।

তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা সেদিন আমাদের মুগ্ধ করেছিল। পাক্ষিক ‘অনন্যা’ র এক গোলটেবিল বৈঠকে নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। এসব ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, কণ্ঠ থাকত দৃঢ়।

এই আসর জমজমাট করে রাখা প্রাণবন্ত মানুষটি গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর তাঁর প্রিয় প্রাঙ্গন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের খোলা ট্রাকের পাশে পড়েছিলেন একা কিছুক্ষণ। ব্যাপক হতাহত ও আতংকের কারণে সবাই চারদিকে প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছিল। স্থির হয়ে ছিল তাঁর দুচোখ। কালো-পাড়ের সাদা শাড়িটির বেশিরভাগ অংশই ছিল রক্তে ভেজা। কাপড়ের নিচের অংশ পুড়ে ছাই। ডান পায়ের মাংসপিণ্ড দলা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের জন্য ৫২ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু কিছুতেই রক্তক্ষরণ ঠেকানো যায়নি। প্রায় তিনদিন অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ছাত্রজীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ছিলেন। প্রয়াত সভানেত্রী ড. নীলিমা ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর তিনি গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। নীলিমা ইব্রাহিমের সুযোগ্য অনুসারী হিসেবে এদেশের মঞ্চনাটককে গণমানুষের জন্য শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে যাদের নেপথ্যের অবদান উল্লেখযোগ্য, আইভি রহমান তাদেরই একজন। মহিলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি উনসত্তরের গণআন্দোলনের পর থেকেই দক্ষতার সঙ্গে পালন করে এসেছেন। দুই দফায় ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।

অন্ধ কল্যাণ সমিতিরও তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদিকা এবং গত আওয়ামী লীগ শাসনামলে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সংস্থার বিশাল কার্যালয় ও অত্যাধুনিক অডিটরিয়াম নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। উনসত্তরের গণআন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জননী। সবাই বিবাহিত। ছাত্রী হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেছেন।

ভৈরবের ‘বড় বাড়ি’ হিসেবে খ্যাত বাড়িটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তখনকার জাঁদরেল শিক্ষাবিদ প্রয়াত জালালউদ্দিন আহমেদ, মা হাসিনা বেগম এখনও বেঁচে আছেন। আইভি রহমানকে স্কুলের ফাংশনে নাচতে দেখে জিল্লুর রহমান তাঁকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করেন এবং একা যেয়ে আইভি রহমানের বাবার কাছে ভয়ে ভয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দুদিন পর তিনি সম্মতি দিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গাড়িতে মুজিব ও খান আতাউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিয়ে করতে যান। এই দুজনই ছিলেন আইভি রহমান ও জিল্লুর রহমানের বিয়ের সাক্ষী। আট বোনের মধ্যে আইভি রহমান চতুর্থ। বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিকী।

আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা জিল্লুর রহমান পত্নীবিয়োগে যখন হতবিহ্বল তখন বারবার তিনি বলেছিলেন, “একা আমি বাঁচব কীভাবে! তিনি বিনীতভাবে সকলকে অনুরোধ করেছেন, আপনারা এ দেশকে বাঁচান– মৌলবাদীদের হাতে এ দেশকে তুলে দেবেন না।”

আইভি রহমান একজন আলোকিত মানুষ। তিনি ভালোবাসতেন দেশ ও দেশের মানুষকে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্যতা। ঘাতকের গ্রেনেড সেই মাটিতেই তাঁকে লুটিয়ে দিল, মিশিয়ে দিল মাটির সঙ্গে। কিন্তু বেঁচে থাকবে তাঁর কর্ম ও প্রেরণা, যা এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সূর্যসম্ভাবনার দিকে। বিডিনিউজ২৪।

Posted in নির্বাচন কমিশন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি | Comments Off on স্মৃতির পাতায় আইভি রহমান

শেখ হাসিনার চোখে জল

অফিসে বসে রিপোর্ট লিখছি। হঠাৎ সংবাদ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। অনেক হতাহত হয়েছে। দ্রুত সেখানে যাওয়ার নির্দেশ। অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি গাড়ির সংখ্যা কম। মানুষ ছুটছে সব উত্তর দিকে। গুলিস্তানের দিকে কোনো গাড়ি যাচ্ছে না। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে। আমি দৌড়াতে লাগলাম। গুলিস্তানে গিয়ে দেখি মানুষের হাহাকার। ইতিমধ্যে অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। কান্নার রোল চারদিকে। শুনলাম আইভি রহমান মারা গেছেন। সরজমিন দেখে অফিসে এসে রিপোর্ট লিখলাম। ২১শে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার খবর। অফিসে এসে খবর পাই আইভি রহমানকে নেয়া হয়েছে সিএমএইচ-এ। তার অবস্থা গুরুতর। প্রতিদিনই আইভি রহমানের খবর নিতে গিয়ে জানতে পারি তার অবস্থার অবনতি। সংজ্ঞাহীন।

দু’টি পা কেটে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায়ই ২৪শে আগস্ট রাতে খবর পাই আইভি রহমান আর নেই। ২৫শে আগস্ট সকালে অফিস থেকে ফোন- গুলশানে আইভি টাওয়ারে যেতে হবে। আইভি রহমানের লাশ সেখানে নেয়া হবে। যথারীতি সেখানে পৌঁছলাম। আইভি কনকর্ড টাওয়ারের পঞ্চম তলা। পূর্ব-উত্তর কোণের রুমে শোকে মুহ্যমান জিল্লুর রহমান বিছানায় শোয়া। স্ত্রী বেগম আইভি রহমানের লাশের অপেক্ষায় তিনি। ছেলে পাপন আর ২ কন্যা তানিয়া ও ময়নার গগনবিদারী আহাজারি। এ বাড়ি ঘিরে শোকার্ত মানুষের ঢল। সবার চোখে পানি। কাঁদছে গোটা দেশ। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে লাশ আসবে। মিডিয়া কর্মীদের ভিড়। এ সময়ে জিল্লুর রহমান কি বলবেন? সাংবাদিকরা তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইছেন। লাশ তখনও আসেনি। সুযোগ হলো জিল্লুর রহমানের সামনে যাওয়ার। রুমে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম অঝোরে কাঁদছেন তিনি। দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। আনমনা হয়ে বিড়বিড় করছেন।

কখনও চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন। কিছুই বলতে পারছিলাম না। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ বুঝতে পারছিলেন তার জীবনসঙ্গী সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। তাই নিজ থেকেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বললেন, একা হয়ে গেলাম। বড় একা। যতদিন বেঁচে থাকবো আইভির স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফিরবে। ৪৬ বছরের সাংসারিক জীবনে আমাদের মাঝে কখনও ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। এ সময়ে কখনও একজন আরেকজন থেকে দূরে থাকিনি। ক্লাস নাইনে থাকতেই বিয়ে হয়। বিয়ের আগেই আইভিকে চিনতাম, তবে প্রেম ছিল না। সুদর্শনা আইভির সংগীত ও নৃত্যে মুগ্ধ হয়েই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে থাকেন, যে বিশ্বাস নিয়ে আইভিকে ঘরে এনেছিলাম সে বিশ্বাস দীর্ঘ ৪৬ বছরে একবারের জন্যও নষ্ট হতে দেয়নি। বরং তার অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার জন্যই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। বৃদ্ধ বয়সে এসেও রাজনীতি করতে পারছি। মাত্র তিনদিন আগে ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের জনসভায় একসঙ্গে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমান। কে জানতো এ যাওয়াই তাদের শেষ যাওয়া। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান মারাত্মক আহত হন। তার দু’টি পা-ই কেটে ফেলতে হয়। ভর্তি করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। ২৪শে আগস্ট রাত ৩টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আইভি রহমান। শোকাহত গোটা দেশ। গুলশান আইভি কনকর্ড টাওয়ারে শোকাহত মানুষের ভিড়। জিল্লুর রহমানের কথা- ২১শে আগস্ট জনসভায় যাওয়ার সময় আইভি নিজ হাতে পায়জামা-পাঞ্জাবি বের করে দেয়। পাঞ্জাবি পরার পর বলে, এটি খুলে ফেলো। লালচে লাগছে। ভালো সাদা পাঞ্জাবি পরে যাও। নিজ হাতেই অন্য একটি পাঞ্জাবি বের করে দেয়।

এটি পরার পর বলে, দেখ কত সুন্দর লাগছে। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন জিল্লুর রহমান। একটু পর আবার বলতে থাকেন, ও ছিল সুন্দরের পূজারী। সুন্দরকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতো। জিল্লুর রহমানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাইরে বেরুতেই খবর আসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আসছেন আইভিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। শেষবারের মতো দেখতে। জিল্লুর রহমানের শোকাহত পরিবারকে সহমর্মিতা জানাতে। এবার অপেক্ষা তাদের জন্য। হঠাৎ পিনপতন নীরবতা। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি এসে থেমেছে আইভি টাওয়ারের সামনে। নেমে এলেন শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। সোজা উপরে চলে গেলেন তারা। যেখানে একটু আগে আনা হয়েছে আইভি রহমানের লাশ। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যাওয়ার পর ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। কান্নার রোল সর্বত্র।

এরপর শেখ হাসিনা যান জিল্লুর রহমানের রুমে। মিডিয়া কর্মীদের বিষয়টি তদারকি করছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। তার কাছে সাংবাদিকদের দাবি শেখ হাসিনা আজ অন্তত কিছু বলুক। অপেক্ষার পর আসাদুজ্জামান নূর খবর নিয়ে এলেন এখনই শেখ হাসিনা কথা বলবেন মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে। জিল্লুর রহমানের রুমের ঠিক পশ্চিম পাশের রুমে প্রবেশ করলেন শেখ হাসিনা।

একটি সোফায় গিয়ে বসলেন। এরপর সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে দাঁড়ান। শেখ হাসিনার চোখে জল। কাঁদছেন তিনি। সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, কি বলবো আমি। কি বলার আছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমার নেতারা, কর্মীরা মানব ঢাল তৈরি করে, কেউ জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি দেশবাসীর কাছে এর বিচার চাই। কান্নায় বেশি কথা বলতে পারেননি শেখ হাসিনা। আইভি কনকর্ড টাওয়ারের ওইদিনের চিত্র আজো ভুলতে পারি না। জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমানের বিয়েও এক ইতিহাস। ১৯৫৮ সালের ২৭শে জুন জেবুন নাহার আইভি’র বিয়ে হয় জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তাদের এ বিয়ের এক নম্বর সাক্ষী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয় সাক্ষী ছিলেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। বিয়ের উকিল ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট গাড়িতে বসেই বর সেজে যান জিল্লুর রহমান। মানবজমিন

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on শেখ হাসিনার চোখে জল

নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও সেনা মোতায়েন

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো ১৬-১৭ মাস বাকি। নির্বাচনের অব্যবহিত প্রাক্কালে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেটা এত আগে বলার এবং মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণার পর বা তিন-চার মাস আগে একটা বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে যেমন আনন্দ, উল্লাস ও উৎসবের একটা অবস্থা বিরাজ করে, তেমনি এলাকাভেদে কম-বেশি নিরাপত্তার শঙ্কাও সৃষ্টি হয়। সবসময় যেমন, ঠিক তেমনি নির্বাচনের সময়েও শান্তি রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীসহ বেসামরিক প্রশাসনের। সময়মতো পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে যদি মনে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যথেষ্ট নয়, তাহলে অতিরিক্ত হিসেবে ওহ অরফ ড়ভ ঈরারষ ঢ়ড়বিৎ, এই বিধানের আওতায় সেনা মোতায়েন করা যেতে পারে। তখন পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বের কাঠমো ও পরিধি নির্ধারণ করলে সেটাই হবে যথার্থ। তার আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা এবং সঙ্গতকারণেই সেটা হবে বিপজ্জনক। সুতরাং সেনা মোতায়েন নিয়ে এখনই যারা শোরগোল করছেন, তাদের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ বোঝা কষ্ট হয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় ও রাজনীতিতে যে প্রলয়কা- ঘটে গেছে এবং যেভাবে ঘটেছে তাতে কার মনে কি আছে তা সহজে বুঝে ওঠা মুশকিল। প্রথম ও মৌলিক কথা হলোÑ দেড় বছর আগে পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি ব্যতিরেকে ফোর্সসমূহের দায়িত্বের পরিধি নিরূপণ করলে নির্ঘাত সেটি ভুল হবে এবং তা নিয়ে অবধারিতভাবে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ভেতরে অনাকাক্সিক্ষত রাজনীতি চলে আসবে। আর সেই রাজনীতির মাঝখানে পড়বে সেনাবাহিনী। তখন সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করার পূর্ব অভ্যাস যাদের আছে তারা ইচ্ছামতো একতরফা বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে পার্টিশন অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করবে, যেমনটি আগে আমরা দেখেছি। তাতে সেনাবাহিনীর পেশাগত বিশেষত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাহিনীর মনোবল ও শৃঙ্খলার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব দেশের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে ও ঊর্ধ্বে দেখতে চায়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের পরে পরপর দুজন সামরিক শাসক সেনাবাহিনীকে রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে অশেষ ক্ষতি করেছেন। ওই খারাপ দৃষ্টান্ত থেকে বের হওয়ার চেষ্টা সবাইকে অব্যাহত রাখতে হবে।

সময় পরিপক্ক হওয়ার আগে এখনই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে যারা অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তারা সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে টেনে আনার অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে আমার কাছে মনে হয়। সময়মতো পরিস্থিতির বিবেচনায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখনই কেন? একটি মৌলিক কথা আমাদের স্মরণে রাখা দরকার। আর তা হলোÑ যার যে কাজ সেটি তাকে দিয়ে না করিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী।

আর সে ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো কথাই নেই, সেনাবাহিনীদের পার্টিশন ব্লেইম গেমের মধ্যে ফেলা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় অন্তরায় হচ্ছে প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার এবং ভোট কেনাবেচায় টাকার ব্যবহার। অথচ এটা রোধ করার উপায় নিয়ে তেমন জোরালো ও বাস্তবসম্মত সুপারিশ কারও পক্ষ থেকে আসছে না। এটা নিয়ে বরং এখন সবচাইতে বেশি আলোচনার দরকার, যাতে সময় থাকতে প্রয়োজন হলে যেন বিধি-বিধান পরিবর্তন করা যায়। আগের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন প্রাক ও উত্তর সময়ে নিরাপত্তাজনিত সমস্যার বড় শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর মানুষ। তারপর সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এক রকম পরিবেশের সৃষ্টি হবে, আবার কোনো বড় দল অংশ না নিলে অন্য রকম হবে। অন্যদিকে বর্জনকারী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
একটি বিষয়ের ওপর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজে সেনাবাহিনীকে যেন জড়ানো না হয়। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জড়িয়ে গেলে নির্ঘাত ব্লেইম গেমের শিকার হবে, যেটি কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। দুই সামরিক শাসন রাজনীতিতে জড়িত করায় এক সময় সেনাবাহিনী ও জনগণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছিল এবং দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল যেটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য চরম ক্ষতিকর। সেনাবাহিনী সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস যতটা গৌরবোজ্জ্বল সে রকম উদাহরণ খুব কম দেশের সেনাবাহিনীর রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে। ফলে তার জন্ম বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হলো জনগণ এবং সেনাবাহিনী এক ও অভিন্ন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ ও সেনাবাহিনীর রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশের মাটিতে একসঙ্গে। জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য এ বন্ধনের মূল্য অপরিসীম। তাই সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে এবং সংবেদনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও কাজ বা রাজনৈতিক দলের সালিশি ও ঝগড়া মেটাতে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা ঠিক হবে না। তাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে পার্টিশন চিন্তা-চেতনা চলে আসতে পারে। পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনের পেশাই হলো জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। তারা জানে কিভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখতে হয়। সবাইকে এক করে ফেলা বা এক জায়গায় নিয়ে আসা দূরদর্শী কাজ হবে না। তাই নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতির বিবেচনায় সেনা মোতায়েন করতে হলে তা অবশ্যই হতে হবে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এবং নিয়োজিত থাকবে স্ট্রাইকিং ও স্ট্যান্ডবাই ফোর্স হিসেবে।
লেখক: কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Posted in নির্বাচন কমিশন, নির্বাচিত কলাম | Comments Off on নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও সেনা মোতায়েন

জঙ্গিবাদ রুখতে অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে

মে. জে. এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) : যে কোনো ধরনের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকা- রুখতে হলে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত জঙ্গিদের অর্থায়নের উৎস পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে কিছু লোককে এ পথে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংস্থা এসব অর্থ জোগান দিচ্ছে। এই কারণেই জঙ্গিরা আত্মগোপন করছে, বাড়ি ভাড়া করছে, অস্ত্র সরবরাহ করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই অর্থ আসে দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে। এ ধরনের অর্থের উৎস পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। এই অর্থের চ্যানেলটা বন্ধ করতে পারলে বহুলাংশে জঙ্গিবাদের তৎপরতা কমে যাবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।

সম্প্রতি সারাদেশে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে এবং তাদের কাছে সব ধরনের তথ্য রয়েছে। তবে এই কথাটি কখনোই এভাবে বলা সঠিক হবে না যে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আমরা খুব ভাল অবস্থান গ্রহণ করেছি। নিরাপত্তার বিষয়ে এভাবে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। সুতরাং আমাদের বলতে হবে যে, তারা যে অবস্থানটা নিয়েছে এটাতে মোটামুটি একটা সন্তোষজনক চেষ্টা। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি একটা সন্তোষজনক অবস্থানে পৌঁছেছে বলে আমার ধারণা। কিন্তু এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট কিনা সেটা বলা যাবে না। কারণ, যারা এই নিরাপত্তার বিপরীতে অবস্থান করে, যারা নাশকতা সৃষ্টিকারী তাদের নতুন নতুন কৌশল থাকে। সেই তথ্যও পুলিশের কাছে থাকে। এই দিক বিবেচনা করলে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থানটা যথেষ্ট, এটা বলা যাবে না। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। এ সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, কোনো ধরনের ভীত হওয়ার বা বড় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সার্বিক দিক বিবেচনায়Ñ বর্তমানে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা ভাল আছে।
জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। যে সচেতনতা এখন আছে, তা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম, মিডিয়ার মাধমে দেশের মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে। সামাজিক সংগঠন, কালচারাল প্রোগ্রাম, মিডিয়া সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিগত জঙ্গি অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে তৎপরতা ছিল, তা আরও জোরদার করতে হবে। এই বিষয়গুলোর উপর পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে, জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে। জঙ্গিদের সমূলে উৎখাত করা যাবে না। কারণ বাংলাদেশের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির ভেতরে জঙ্গিবাদের শিকড় আছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে, আঞ্চলিকভাবে যে ভূ-রাজনীতি। পাকিস্তান জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত, জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে। নানা রকম কর্মকা- তারা ঘটিয়ে থাকে। তার একটা প্রভাব সারা পৃথিবীতেই পড়ছে। এই সমস্ত কারণে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়।

পরিচিতি: নিরাপত্তা বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on জঙ্গিবাদ রুখতে অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে

নির্বাচনে সেনাবাহিনী নামাতে বলা কোন মতলবে : এ কে আজাদ

প্রতিবেদক : নির্বাচনে সেনাবাহিনী নামাতে হবে, এটি কোনো মতলব বা কুমতল বলে মন্তব্য করেছেন সরকার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দ্বিতীয় ও শেষ দিনের মতবিনিময সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।

এ সময় সিনয়র সাংবাদিক জ. ই. মামুন বলেন, নিবার্চন কমিশন আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তারা জনগণের জন্য কাজ করবেন। সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা জনগণের বিপক্ষে কোনো কাজ করবে না।

এসময় জ. ই. মামুন আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের আরো আশ্বস্ত করেছেন তারা সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টায় এ সভা শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনের সভায় গণমাধ্যমের ৩৪ জন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানায় কমিশন। সেখান থেকে ২০ জন প্রতিনিধি সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জনসংযোগ পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে ইসি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তা হচ্ছে- বিদ্যমান ইংরেজি আইন কাঠামো বিশেষ করে ‘দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার ১৯৭২’ এবং ‘দ্য ডিলিমিটেশন অব কনস্টিটিউশন অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬’ যুগোপযোগী করে বাংলা ভাষায় প্রণয়ন। বিগত নির্বাচন সমূহের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অবৈধ অর্থ এবং পেশী শক্তির ব্যবহার রোধ কল্পে আইনি কাঠামো সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবনা। সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ কল্পে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা, সংসদীয় এলাকার আয়তন, প্রশাসনিক অখণ্ডতা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ। নির্বাচন প্রক্রিয়া যুগোপযোগী ও সহজীকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ও প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন। প্রবাসী ভোটারদের ভোটদান নিশ্চিত করার বিষয়ে একটি আইন কাঠামোসহ প্রক্রিয়া প্রণয়নের জন্য প্রস্তাবনা।
এজেন্ডার মধ্যে আরো রয়েছে- কর্ম পরিকল্পনায় বর্ণিত অন্য কাঠামোকে যুগোপযোগী করার প্রস্তাবনা। নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও বিতরণ নিশ্চিত করার জন্য পরামর্শ। ভোট কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত কার্যক্রম যুগোপযোগী করার জন্য পরামর্শ। নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সক্ষমতা বাড়ানোর কর্ম পরিকল্পনার অতিরিক্ত কোনো প্রস্তাবনা।
এর আগে ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ সংলাপ শুরু হয়। সেদিন ৫৯ জন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখান থেকে অন্তত ৩৫ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এরপর বুধবার প্রথম দিনে গণমাধ্যমের ৩৭ জন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানালে সেখান থেকে ২৬ জন প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে ২০টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on নির্বাচনে সেনাবাহিনী নামাতে বলা কোন মতলবে : এ কে আজাদ

সাংবাদিকদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় ইসির বৈঠক

নিজস্ব প্রতিবেদক : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে মতামত নেয়ার জন্য আজ বৃহস্পতিবার আবারও সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বুধবার প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাকিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আজ টেলিভিশন, অনলাইন ও রেডিও’র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে বসলেন নির্বাচন কমিশনাররা।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে রাজধানীর আগারগাঁয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে এ বৈঠক শুরু হয়েছে।

বৈঠক শেষে ইসির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৈঠকের মতামত জানানো হবে।গতকাল বুধবার প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাকিদের সঙ্গে বেঠকের আগে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে করেছে ইসি। গতকালের বৈঠকে সাংবাদিকরা সেনা মোতায়েনের পক্ষে এবং বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ আবার ইসির সাংবিধানিক শক্তি কঠোরভাবে প্রতিপালনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন।সাংবাদিকের সঙ্গে বৈঠকের পর আগামী ২৪ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করবে ইসি।

ওইদিন সকালে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) এবং বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের (মুক্তিজোট) সঙ্গে বৈঠক করবে ইসি।২৮ আগস্ট সকাল ১১টায় বাংলাদেশ মুসলীম লীগ (বিএমএল) এবং বিকেল ৩টায় খেলাফত মজলিশের সঙ্গে বসবে ইসি। এ ছাড়া ৩০ আগস্ট সকাল ১১টায় বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির এবং বিকেল ৩টায় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি র (জাগপা) সঙ্গে বৈঠক করবে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি।

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on সাংবাদিকদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় ইসির বৈঠক

নির্বাচনি সংলাপ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ভাবনা

মঞ্জুরুল আহসান খান : আসন্ন আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা এবং সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল যেন সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে চলামন সংলাপ যেন নির্বাচন কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, সে অনুযায়ী তাদের কর্মকা- পরিচালিত করে সেটা আমরা প্রত্যাশা করি। কেবল সংলাপে বসলেই হলো না, এখানে যেন আন্তরিকতা থাকে। সবাইকে আন্তরিকভাবে সংলাপ করা উচিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যে সুপারিশগুলো করবেন সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

ইতোমধ্যে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে, সেখানে তারা অনেক কথা বলেছেন। সুপারিশ করেছেন। তাদের সুপারিশগুলো বিবেচনা করলেই তো অনেক দূর এগিয়ে যাবে নির্বাচনি ব্যবস্থা। আরও সংলাপ এখনো বাকি আছে। সংলাপ শেষে নির্বাচন কমিশনকে এমন একটি উদ্যোগ নিতে হবে, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on নির্বাচনি সংলাপ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ভাবনা

সুশীল সংলাপ কতটা কাজের?

আনিস আলমগীর : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কথাটা বলেছিলেন, একজন পাকা দার্শনিকের মতো। তখনকার বাস্তবতায় কথাটা নিয়ে যদিও অনেকে তখন ব্যঙ্গ করলেও এখনকার বাস্তবতায় খালেদা জিয়ার কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বহুদিন আগে দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যখন সারাদেশে আন্দোলন চলছিলো তখন মুন্সীগঞ্জের এক জনসভায় খালেদা জিয়া দাবি করেছিলেন, দেশে পাগল ও শিশু ছাড়া কোনও নিরপেক্ষ লোক নেই। অবশ্য তখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, শেখ হাসিনা ছিলেন ক্ষমতার বাইরে। বর্তমানে তারা দুইজন নিজেদের ক্ষমতা বদলের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে রাজনৈতিক অবস্থানও পরিবর্তন করেছেন।

নিরপেক্ষ ব্যক্তি কে, নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কী- এটা নিয়ে কি আমরা একমত! যিনি নিরপেক্ষতা বিচার করছেন তিনি নিজেই কি নিরপেক্ষ? আমাদের দেশে এখন বুদ্ধিজীবী, উকিল, ডাক্তার, আমলা- কে নিরপেক্ষ? সর্বস্তরে বিভক্তি। বিভক্তি এত চরম যে ডাক্তারদের সমিতিতে বিভক্তি, সাংবাদিকদের সংগঠনে বিভক্তি অর্থাৎ বিভক্তি সর্বত্র। ঘরনার বাইরে লোক পাওয়া মুশকিল।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যখন নিরপেক্ষতার প্রশ্ন এসেছিল তখন বহুবার বলেছিলাম, এই দেশে এখন নিরপেক্ষ লোক পাওয়া মুশকিল হবে। তাই অনুরোধ ছিল তল্লাসিতে না গিয়ে এমন লোককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হোক যিনি সুষ্ঠুভাবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। আমি সব সময় একজন ব্যক্তির দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির মেরুদণ্ডই প্রধান বিষয় হিসেবে দেখতে বলি। বলি, নিরপেক্ষ মত/লোক বিষয়টি একটা ভণ্ডামি। নিরপেক্ষতা নয়, খুঁজতে হবে ব্যক্তিটি যে পক্ষেই বলুক –যুক্তিনির্ভর ও সত্য কথা বলছেন কিনা, তার মেরুদণ্ড আছে কিনা। নতুবা যতই দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি চেয়ারে বসুক ফলাফল একই হবে।
আগেও একদিন লিখেছিলাম, বিএনপির চাপে পড়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তার সঙ্গীরা আওয়ামী ঘরানার অপবাদ পেয়ে যেন নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে গিয়ে ‘অতি নিরপেক্ষ’ না হয়ে যান। অতীতেও আমরা এমন চরিত্র দেখেছি আমলা শ্রেণির। ২০০১ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কথা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। আওয়ামী লীগের পছন্দের বলে অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান নিরপেক্ষতার ভাব নিতে গিয়ে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতার ১২টা বাজিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের ৩০ মিনিটের মধ্যে ১৩ সচিবকে বদলি/ওএসডি করেছিলেন। নুরুল হুদা সাহেবও যেন এমন ‘নিরপেক্ষ’ না হন।
নিরপেক্ষতার এই বিতর্ক ও সংকটকালে, গত ৩১ জুলাই ২০১৭ প্রধান নির্বাচন কমিশনার  কে এম নুরুল হুদা কতিপয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ডেকেছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে তার অফিসে এক দীর্ঘ বৈঠকে তিনি সুশীলদের পরামর্শ শুনেছেন। বৈঠকে নাকি ৫৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সবাই উপস্থিত হননি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বৈঠকে যারা যোগদান করেছেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। অবশ্য তাদেরকে চিনিও। শুধু আমি নই সাধারণ পত্রিকা পাঠক, টক শো দর্শক তাদেরকে চেনেন। জিজ্ঞেস করলে কে কোন ঘরনার লোক দ্বিধাহীনভাবে সাধারণ লোকরা তাও বলে দেবেন। কারণ বাংলাদেশে সুশীলরা নিজেদেরকে প্রায় ব্র্যাকেট বন্দী করে ফেলেছেন। তাই দেখা গেছে বৈঠকে প্রায় আলোচকেরা এক সুরে কথা বলেছেন। দাবি দাওয়ার রূপ-রং প্রায় এক রকমের। এক ঘরনার লোকের উপস্থিতিই ছিল বেশি। এইসব সুশীলরা অনেকে টক শোতে সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। এই বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও ব্যস্ত হয়ে যাবেন কারণ তিনি রাজনৈতিক দল, সম্পাদকদের সঙ্গেও নাকি পর্যায়ক্রমে কথা বলবেন।

নির্বাচনের আরও বহুদিন বাকি। এত দীর্ঘ সময় বাকি থাকতে নির্বাচন নিয়ে সর্বত্র এতো আলোচনা, এতো সক্রিয়তা আর কোনও নির্বাচনের পূর্বে দেখিনি। কোনও দেশে হয় বলেও মনে হয় না। আমার ধারণা এই সক্রিয়তা নির্বাচন করার জন্য সহায়ক হবে না। সর্বত্র গিট লেগে দুরাবস্থা সৃষ্টি হবে। যদিও চিত্রটা এখনও পরিষ্কার হয়নি তবে সব অবস্থা পর্যালোচনা করে ধারণা করা যায় যে অবস্থা সুখকর হওয়ার লক্ষণ খুবই ক্ষীণ।
নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করবো বির্তক সৃষ্টির সব দ্বার যেন উন্মুক্ত করে না দেন। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন কমিশনার এসেছেন সবাই তাদের নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিফল হয়েছেন। এদেশে যারা জিতেছেন বা যারা হেরে গেছেন কেউ ‘মেনে নেওয়ার’ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসি নন। সুক্ষ্ম কারচুপি, মোটাদাগে কারচুপি–নির্বাচনের পরে এমন সব দোষই নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়। এদেশে এই বিষয়টা ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন নিজের সততার কাছে নিজে দায়বদ্ধ থেকে কাজ করাই উত্তম। শত চেষ্টা করেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে যাওয়া যাবে না।

সুশীলদের আলোচনায় দেখা গেছে কোনও কোনও আলোচক ‘সহায়ক সরকার’-এর কথা বলেছেন। তত্ত্বাবধায়কের কথাও কেউ কেউ তুলেছেন। নির্বাচন কমিশনের কি এসব বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আছে? সহায়ক সরকারের কথা বলেছেন সত্য, আলোচকরা কেউ কিন্তু সহায়ক সরকারের কোনও রূপ রেখা দেননি। সুশীলরা এই সহায়ক সরকারের কথা বলতে পারেন কিনা সেটাও আরেক বিতর্ক কারণ সহায়ক সরকারের দাবিটা এখন বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা।

খালেদা জিয়া বর্তমানে লন্ডন আছেন। তিনি লন্ডনে তার ছেলে এবং দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি তারেক রহমানের সঙ্গে সহায়ক সরকারের রূপরেখাটা প্রণয়ন করার বিষয়ে আলোচনা করবেন। কোরবানির ঈদের পর ভারত হয়ে নাকি দেশে ফিরবেন তিনি। তারপর রূপরেখা ঘোষণা করবেন। তখন আমরা হয়তো পরিষ্কার হতে পারবো সহায়ক সরকারের রূপরেখা কী। বৈঠকে বিএনপি ঘরানার সুশীলেরা সহায়ক সরকারের কথা বলে সহায়ক সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে রেখে গেলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পোলারাইজেশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে মনে হয় শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার বাইরে এরশাদের জাতীয় পার্টি, বামপন্থীদের একটা মোর্চা এবং কওমিওয়ালাদের আরেকটা ফ্রন্ট রূপ নিতে যাচ্ছে। শুনেছি আসম রব-কাদের সিদ্দিকী এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার দল আরেকটা ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করছে। তারা নাকি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবে। নির্বাচনের পূর্বে সম্ভবতো এই হবে রাজনৈতিক দলগুলোর রূপ ও অবস্থান। এরাই হবে ক্ষুদ্র বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি।

আওয়ামী ফ্রন্ট, বাম ফ্রন্ট এবং এরশাদ বর্তমান শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে হয়তবা নির্বাচন করতে আপত্তি করবে না কিন্তু যত সব আপত্তি থাকবে বিএনপি-জামায়াত ফ্রন্টের। তাদের সঙ্গে রবরাও রব তুলতে পারেন। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিৎ হবে আওয়ামী ফ্রন্ট ও বিএনপি ফ্রন্টকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর উপায় উদ্ভাবনে সক্রিয় হওয়া এবং সহজভাবে, সততার সঙ্গে, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনটা সম্পন্ন করার চেষ্টা করা।

বেগম জিয়ার মামলার রায় হওয়ার সময় নিকটবর্তী। মামলার রায়ে বেগম জিয়ার অবস্থা পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফের মতো হলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সেটিও নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত এসে ধাক্কা লাগবে। উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন যেন নিজেদের গায়ে না লাগায়। তখন নির্বাচন কমিশনের উচিৎ হবে তার শাসনতন্ত্রে বর্ণিত দায়িত্বের মাঝে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখা।

আমরা আশা করি যে হাজার বির্তক থাকলেও বিএনপি নির্বাচনে থাকবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এ কথা সত্য। বিএনপি কিন্তু চেষ্টা করেও ‘অসুষ্ঠু’ নির্বাচনে গঠিত দশম সংসদকে বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি। সে জনজোয়ার সৃষ্টি করতে বিএনপি যেমন অপারগ হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সমর্থনও পায়নি। সুতরাং আগামী নির্বাচন বিএনপিকে নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে করতে হবে। জাপানিদের মতো হারিকিরির অভ্যাস অন্য কোনও জাতির নেই।   

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

Posted in নির্বাচন কমিশন | Comments Off on সুশীল সংলাপ কতটা কাজের?

পুনরায় ‘না ভোট’ চালুর দাবি নির্বাচন বিশ্লেষকদের

ডেস্ক রিপোর্ট : জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় না ভোটের সংযোজন প্রয়োজন বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। এর মাধ্যমে প্রার্থী পছন্দ না হলে ভোটাররা না ভোট দিতে পারবেন। অন্যদিকে দলগুলোর দেয়া প্রার্থী ভোটারদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য তাও স্পষ্ট হবে। বিশ্লেষকদের মতে তখন দলগুলো ভালো প্রার্থী নির্বাচনে আরো বেশি মনোযোগী হবে ।

কোন প্রার্থীকেই পছন্দ না হলে জনগনের জন্যে বিশেষ সুযোগ হচ্ছে ‘না ভোট’। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, যার ভোটার সংখ্যা প্রায় ৮২ কোটি। বিশ্বের ১৪তম দেশ হিসেবে সব শেষ ভারতের ব্যালটে না ভোটের যায়গা হয়েছে।

বাংলাদেশেও ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘না ভোট’ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ‘না ভোট’ বাতিল করে। ভারতে এ সুযোগ তৈরি হওয়ায় এখন বাংলাদেশে আবারও এ সুযোগ ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছে ।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতেই ‘না ভোট’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগনের মতামত না নিয়েই প্রার্থী চুড়ান্ত করে আসছে। যার ফলে অনেক কম যোগ্যতা সম্পন্ন লোকও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবার সুযোগ পাচ্ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আমি যদি ভোট দিতে গিয়ে দেখি কোন ক্যান্ডিডেট আমার পছন্দ না তখন আমার উপায়টা কি হবে? তাহলে আমাকে সেখানে ভোট না দিয়েই চলে আসতে হবে! অনেক ক্যান্ডিডেট আছে যারা সংসদে যাওয়ার উপযুক্ত না। তাদের কোন যোগ্যতা নাই, বা তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। তখন করণীয় কি হবে? এ জন্যেই না ভোট।
ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রাজিল, বেলজিয়াম, চিলি, ইউক্রেন, কলোম্বিয়া ও সুইডেনের নির্বাচনে না ভোট দেয়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশেই একমাত্র না ভোট চালুর পরেও তা বাতিল করা হয়।

সূত্র : নিউজ টোয়েন্টিফোর টিভি

Posted in জতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, সারা দেশ | Comments Off on পুনরায় ‘না ভোট’ চালুর দাবি নির্বাচন বিশ্লেষকদের

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud