পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

সুশীল সংলাপ কতটা কাজের?

Posted on August 3, 2017 | in নির্বাচন কমিশন | by

আনিস আলমগীর : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কথাটা বলেছিলেন, একজন পাকা দার্শনিকের মতো। তখনকার বাস্তবতায় কথাটা নিয়ে যদিও অনেকে তখন ব্যঙ্গ করলেও এখনকার বাস্তবতায় খালেদা জিয়ার কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বহুদিন আগে দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যখন সারাদেশে আন্দোলন চলছিলো তখন মুন্সীগঞ্জের এক জনসভায় খালেদা জিয়া দাবি করেছিলেন, দেশে পাগল ও শিশু ছাড়া কোনও নিরপেক্ষ লোক নেই। অবশ্য তখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, শেখ হাসিনা ছিলেন ক্ষমতার বাইরে। বর্তমানে তারা দুইজন নিজেদের ক্ষমতা বদলের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে রাজনৈতিক অবস্থানও পরিবর্তন করেছেন।

নিরপেক্ষ ব্যক্তি কে, নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কী- এটা নিয়ে কি আমরা একমত! যিনি নিরপেক্ষতা বিচার করছেন তিনি নিজেই কি নিরপেক্ষ? আমাদের দেশে এখন বুদ্ধিজীবী, উকিল, ডাক্তার, আমলা- কে নিরপেক্ষ? সর্বস্তরে বিভক্তি। বিভক্তি এত চরম যে ডাক্তারদের সমিতিতে বিভক্তি, সাংবাদিকদের সংগঠনে বিভক্তি অর্থাৎ বিভক্তি সর্বত্র। ঘরনার বাইরে লোক পাওয়া মুশকিল।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যখন নিরপেক্ষতার প্রশ্ন এসেছিল তখন বহুবার বলেছিলাম, এই দেশে এখন নিরপেক্ষ লোক পাওয়া মুশকিল হবে। তাই অনুরোধ ছিল তল্লাসিতে না গিয়ে এমন লোককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হোক যিনি সুষ্ঠুভাবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। আমি সব সময় একজন ব্যক্তির দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির মেরুদণ্ডই প্রধান বিষয় হিসেবে দেখতে বলি। বলি, নিরপেক্ষ মত/লোক বিষয়টি একটা ভণ্ডামি। নিরপেক্ষতা নয়, খুঁজতে হবে ব্যক্তিটি যে পক্ষেই বলুক –যুক্তিনির্ভর ও সত্য কথা বলছেন কিনা, তার মেরুদণ্ড আছে কিনা। নতুবা যতই দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি চেয়ারে বসুক ফলাফল একই হবে।
আগেও একদিন লিখেছিলাম, বিএনপির চাপে পড়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তার সঙ্গীরা আওয়ামী ঘরানার অপবাদ পেয়ে যেন নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে গিয়ে ‘অতি নিরপেক্ষ’ না হয়ে যান। অতীতেও আমরা এমন চরিত্র দেখেছি আমলা শ্রেণির। ২০০১ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কথা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। আওয়ামী লীগের পছন্দের বলে অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান নিরপেক্ষতার ভাব নিতে গিয়ে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতার ১২টা বাজিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের ৩০ মিনিটের মধ্যে ১৩ সচিবকে বদলি/ওএসডি করেছিলেন। নুরুল হুদা সাহেবও যেন এমন ‘নিরপেক্ষ’ না হন।
নিরপেক্ষতার এই বিতর্ক ও সংকটকালে, গত ৩১ জুলাই ২০১৭ প্রধান নির্বাচন কমিশনার  কে এম নুরুল হুদা কতিপয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ডেকেছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে তার অফিসে এক দীর্ঘ বৈঠকে তিনি সুশীলদের পরামর্শ শুনেছেন। বৈঠকে নাকি ৫৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সবাই উপস্থিত হননি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বৈঠকে যারা যোগদান করেছেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। অবশ্য তাদেরকে চিনিও। শুধু আমি নই সাধারণ পত্রিকা পাঠক, টক শো দর্শক তাদেরকে চেনেন। জিজ্ঞেস করলে কে কোন ঘরনার লোক দ্বিধাহীনভাবে সাধারণ লোকরা তাও বলে দেবেন। কারণ বাংলাদেশে সুশীলরা নিজেদেরকে প্রায় ব্র্যাকেট বন্দী করে ফেলেছেন। তাই দেখা গেছে বৈঠকে প্রায় আলোচকেরা এক সুরে কথা বলেছেন। দাবি দাওয়ার রূপ-রং প্রায় এক রকমের। এক ঘরনার লোকের উপস্থিতিই ছিল বেশি। এইসব সুশীলরা অনেকে টক শোতে সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। এই বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও ব্যস্ত হয়ে যাবেন কারণ তিনি রাজনৈতিক দল, সম্পাদকদের সঙ্গেও নাকি পর্যায়ক্রমে কথা বলবেন।

নির্বাচনের আরও বহুদিন বাকি। এত দীর্ঘ সময় বাকি থাকতে নির্বাচন নিয়ে সর্বত্র এতো আলোচনা, এতো সক্রিয়তা আর কোনও নির্বাচনের পূর্বে দেখিনি। কোনও দেশে হয় বলেও মনে হয় না। আমার ধারণা এই সক্রিয়তা নির্বাচন করার জন্য সহায়ক হবে না। সর্বত্র গিট লেগে দুরাবস্থা সৃষ্টি হবে। যদিও চিত্রটা এখনও পরিষ্কার হয়নি তবে সব অবস্থা পর্যালোচনা করে ধারণা করা যায় যে অবস্থা সুখকর হওয়ার লক্ষণ খুবই ক্ষীণ।
নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করবো বির্তক সৃষ্টির সব দ্বার যেন উন্মুক্ত করে না দেন। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন কমিশনার এসেছেন সবাই তাদের নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিফল হয়েছেন। এদেশে যারা জিতেছেন বা যারা হেরে গেছেন কেউ ‘মেনে নেওয়ার’ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসি নন। সুক্ষ্ম কারচুপি, মোটাদাগে কারচুপি–নির্বাচনের পরে এমন সব দোষই নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়। এদেশে এই বিষয়টা ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন নিজের সততার কাছে নিজে দায়বদ্ধ থেকে কাজ করাই উত্তম। শত চেষ্টা করেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে যাওয়া যাবে না।

সুশীলদের আলোচনায় দেখা গেছে কোনও কোনও আলোচক ‘সহায়ক সরকার’-এর কথা বলেছেন। তত্ত্বাবধায়কের কথাও কেউ কেউ তুলেছেন। নির্বাচন কমিশনের কি এসব বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আছে? সহায়ক সরকারের কথা বলেছেন সত্য, আলোচকরা কেউ কিন্তু সহায়ক সরকারের কোনও রূপ রেখা দেননি। সুশীলরা এই সহায়ক সরকারের কথা বলতে পারেন কিনা সেটাও আরেক বিতর্ক কারণ সহায়ক সরকারের দাবিটা এখন বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা।

খালেদা জিয়া বর্তমানে লন্ডন আছেন। তিনি লন্ডনে তার ছেলে এবং দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি তারেক রহমানের সঙ্গে সহায়ক সরকারের রূপরেখাটা প্রণয়ন করার বিষয়ে আলোচনা করবেন। কোরবানির ঈদের পর ভারত হয়ে নাকি দেশে ফিরবেন তিনি। তারপর রূপরেখা ঘোষণা করবেন। তখন আমরা হয়তো পরিষ্কার হতে পারবো সহায়ক সরকারের রূপরেখা কী। বৈঠকে বিএনপি ঘরানার সুশীলেরা সহায়ক সরকারের কথা বলে সহায়ক সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে রেখে গেলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পোলারাইজেশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে মনে হয় শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার বাইরে এরশাদের জাতীয় পার্টি, বামপন্থীদের একটা মোর্চা এবং কওমিওয়ালাদের আরেকটা ফ্রন্ট রূপ নিতে যাচ্ছে। শুনেছি আসম রব-কাদের সিদ্দিকী এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার দল আরেকটা ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করছে। তারা নাকি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবে। নির্বাচনের পূর্বে সম্ভবতো এই হবে রাজনৈতিক দলগুলোর রূপ ও অবস্থান। এরাই হবে ক্ষুদ্র বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি।

আওয়ামী ফ্রন্ট, বাম ফ্রন্ট এবং এরশাদ বর্তমান শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে হয়তবা নির্বাচন করতে আপত্তি করবে না কিন্তু যত সব আপত্তি থাকবে বিএনপি-জামায়াত ফ্রন্টের। তাদের সঙ্গে রবরাও রব তুলতে পারেন। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিৎ হবে আওয়ামী ফ্রন্ট ও বিএনপি ফ্রন্টকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর উপায় উদ্ভাবনে সক্রিয় হওয়া এবং সহজভাবে, সততার সঙ্গে, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনটা সম্পন্ন করার চেষ্টা করা।

বেগম জিয়ার মামলার রায় হওয়ার সময় নিকটবর্তী। মামলার রায়ে বেগম জিয়ার অবস্থা পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফের মতো হলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সেটিও নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত এসে ধাক্কা লাগবে। উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন যেন নিজেদের গায়ে না লাগায়। তখন নির্বাচন কমিশনের উচিৎ হবে তার শাসনতন্ত্রে বর্ণিত দায়িত্বের মাঝে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখা।

আমরা আশা করি যে হাজার বির্তক থাকলেও বিএনপি নির্বাচনে থাকবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এ কথা সত্য। বিএনপি কিন্তু চেষ্টা করেও ‘অসুষ্ঠু’ নির্বাচনে গঠিত দশম সংসদকে বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি। সে জনজোয়ার সৃষ্টি করতে বিএনপি যেমন অপারগ হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সমর্থনও পায়নি। সুতরাং আগামী নির্বাচন বিএনপিকে নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে করতে হবে। জাপানিদের মতো হারিকিরির অভ্যাস অন্য কোনও জাতির নেই।   

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud