পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

সুন্দরবন ধ্বংস মানে অরক্ষিত বাংলাদেশ

image37বিশেষজ্ঞ মত ও জাতীয় জাগরণ উপেক্ষা করে গত ৫ অক্টোবর, নির্ধারিত তারিখের ১৭ দিন আগে, ২৫০ কিলোমিটার দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ভিত্তিফলক উšে§াচন করেছেন। লংমার্চের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন রক্ষার জাতীয় জাগরণের মুখে এটা বেশ চাতুর্যপূর্ণ পদক্ষেপ সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব ‘চালাকি’ সরকারের শক্তির নিদর্শন নয়, বরং তাদের নৈতিক পরাজয়ের লক্ষণ। এটা প্রমাণ করে যে, বৈজ্ঞানিক তথ্য-যুক্তির সামনে দাঁড়ানোর কোনো তথ্য-যুক্তি সরকারের নেই; গণরায়ের সামনে দাঁড়ানোর নৈতিক সাহস তাদের নেই। সে জন্যই এই ফলক বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী সুন্দরবন ধ্বংসের তৎপরতার একটি চিহ্ন হয়ে থাকবে। ‘উন্নয়ন’ নামের এই ধ্বংসের প্রকল্পকে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এটি কার্যত ভারতের সঙ্গে বৈরিতা বৃদ্ধির একটি প্রকল্প। সরকার এ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের পথ আরও সংকুচিত করেছে। ভারতের আগ্রাসী নীতি এবং দুই দেশের কতিপয় গোষ্ঠীর মুনাফা আগ্রাসী তৎপরতার কাছে সরকার আত্মসমর্পণ করেছে। সুন্দরবনকে ধ্বংস করার এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ফলক উšে§াচনের দিনটি তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও একটি কলংক হয়ে থাকবে।

এর আগে গত ৩-৫ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি ঢাকায় প্রদত্ত বক্তব্যে সুন্দরবন রক্ষায় দুই দেশের যৌথ ভূমিকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেখতে পাচ্ছি, দুই দেশের সরকার যৌথভাবে রামপাল বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে বরং সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করছে। আশার কথা এই যে, দুই দেশের জনগণের পক্ষ থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগঠিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সুন্দরবন রক্ষার লক্ষ্যে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বানে লংমার্চ কর্মসূচিতে অসংখ্য মানুষ সাড়া দিয়েছেন।
দেশের শিল্প, কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবনযাপন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য যথাসম্ভব কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যাবশ্যক। এর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলীর সুপারিশ আমরা বিভিন্ন সময়ে করেছি। আমাদের এসব সুপারিশের মূল কথা হল, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সম্পদ শতভাগ জনগণের মালিকানায় রেখে তার পুরোটা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে দেশের কাজে লাগানো, খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধকরণ, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানির সংমিশ্রণে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। দেশ ও জনগণ এতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট থেকে খুব দ্রুত মুক্ত হতে পারত। কিন্তু এভাবে অগ্রসর হলে বহুজাতিক কোম্পানি, দেশী কতিপয় ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগী বিরাট লুটপাট থেকে বঞ্চিত হতোÑ সেটাই নীতিনির্ধারকদের জন্য সমস্যা।
সুন্দরবনের আঙিনায় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ সময় ধরে সমীক্ষা করে এ প্রকল্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে এর আগেই সতর্ক করেছেন। পরে এ নিয়ে অন্য বিশেষজ্ঞরাও প্রায় একই রকম বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ মত ও জনগণের বিরোধিতা উপেক্ষা করে, পরিবেশ অভিমত সমীক্ষা (ইআইএ) না করে সরকার এলাকার মানুষের জমি দখল করেছে এবং মানুষ উচ্ছেদ করেছে। প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশ ও সন্ত্রাসী দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে বহুবার। জমি অধিগ্রহণ ও প্রাথমিক চুক্তি সম্পন্ন করার পরেই ইআইএ রিপোর্ট সম্পন্ন করা হয়েছে।
গত ১২ এপ্রিল ইআইএ রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় একটি পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে। ওই সভায় বিশেষজ্ঞরা ইআইএ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে নতুন ইআইএ রিপোর্ট প্রণয়নের দাবি জানান। একই সভায় নতুন রিপোর্ট না হওয়া পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখারও দাবি জানানো হয়। ইআইএ রিপোর্ট এভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও গত ২০ এপ্রিল রামপাল বিদ্যুৎ প্লান্ট নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত যে চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে দুই দেশের সরকার যৌথভাবে আন্তর্জাতিক বিধি লংঘন করে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, প্রাণবৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম সুন্দরবন ধ্বংস করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে। উপরন্তু এ চুক্তিতে ভারতীয় কোম্পানির উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য কর মওকুফ, বিদ্যুতের দাম অনির্ধারিত রাখাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে সুন্দরবনের ৯-১৪ কিলোমিটারের মধ্যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। বাফার জোন বিবেচনা করলে এই দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। অথচ ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ গাইডলাইন ম্যানুয়াল ২০১০ অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা অনুমোদন করা হয় না। ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইডলাইন, ১৯৮৭’ অনুসারেও কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ স্থাপন করা যায় না। এ জন্য গত কয়েক বছরে ভারতের কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে তিনটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতে হলে সেখানকার আইন অনুযায়ী তা তারা করতে পারত না!
ভারতীয় কোম্পানির মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতে ও দেশী কিছু সুবিধাভোগীর স্বার্থে প্রণীত এই ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পে সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে, সে জন্য সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। আমাদের প্রশ্নÑ প্রথমত, এই প্রযুক্তিতে কিছু ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ ক্ষতি কম হয় ঠিক, কিন্তু তাতে সুন্দরবনের ধ্বংসের সামগ্রিক ক্ষতি কীভাবে কমবে? দ্বিতীয়ত, এই প্রযুক্তি যদি সুন্দরবনের ধ্বংস ঠেকানোর মতো এত নিশ্চিত প্রযুক্তি হয়, তাহলে ভারতীয় কোম্পানি কেন ভারতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব ক্ষতি দূরীভূত করে না? কেন গত তিন বছরে তাদের তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল হয়?
সরকার যখন একদিকে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানের কথা বলে সুন্দরবন ধ্বংসী তৎপরতায় লিপ্ত, ঠিক সে সময়ই বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্ভাব্য মজুদের ওপর বাংলাদেশের কর্তৃত্ব বিনাশ করে এ সম্পদের বিশাল সম্ভাবনা নষ্ট করছে। গ্যাস সংকট চলছে, কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে রফতানিমুখী চুক্তিও বলবৎ আছে। এর মধ্যে পুঁজির অভাবের কথা বলে অগভীর সমুদ্রের তিনটি ব্লক দুটি মার্কিন ও ভারতীয় কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে। অথচ তারা পাঁচ বছরে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে, তার সমপরিমাণ ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে’ অলস পড়ে আছে।
সম্প্রতি সরকার বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির দাবি অনুযায়ী পিএসসি-২০১২ সংশোধন করে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই সংশোধনীতে কোম্পানিগুলোর সুবিধা এত বেশি বাড়ানো হয়েছে, এরপর থেকে বাংলাদেশকে নিজের গ্যাস আমদানি করা আন্তর্জাতিক দামের বেশি খরচে কিনতে হবে। উপরন্তু সম্পূর্ণ জিম্মি থাকতে হবে এসব কোম্পানির হাতে। তাদের কাছ থেকে গ্যাস কেনার জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে শতকরা প্রায় ৫০ থেকে ৭০ ভাগ। তাছাড়া যে কোনো দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুবিধা দিয়ে পুরো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে অসম্ভব ব্যয়বহুল করে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরপরও বিদেশী কোম্পানির কর মওকুফ করা হচ্ছে। গ্যাসের ওপর তাদের কর্তৃত্বের অনুপাতও বাড়ানো হচ্ছে। কস্ট রিকভারি হিসেবে তাদের মালিকানা শতকরা ৫৫ ভাগের স্থলে করা হচ্ছে ৭০ ভাগ। জ্বালানি নিরাপত্তা ও জ্বালানি সংকট সমাধানের যে শক্তিশালী সম্ভাবনা বাংলাদেশে আছে, পিএসসি ২০১২ অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষর হতে থাকলে তা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হবে। সম্পদ পরিণত হবে অভিশাপে।
বিশেষজ্ঞরা তো বটেই, এমনকি পিডিবির মধ্য থেকেও বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্ট মেরামত করলে খুব কম খরচে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। সেটা না করে ৮ গুণ বেশি দামে তার থেকে কম বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ফাঁদে দেশকে ফেলে ভয়াবহ ঋণের বোঝা তৈরি করেছে সরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিশাল সম্ভাবনাও ক্ষুদ্র কিছু উদ্যোগের মধ্যে আটকে রেখে বিদেশী কোম্পানির ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে বিপজ্জনকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্লান্ট অনুমোদন করা হয়েছে। সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন চলছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনের নামে দেশী-বিদেশী এই লুটেরা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সরকার বারবার দেশের জন্য সর্বনাশা পথ গ্রহণ করছে। এ কাজে বৃহৎ দল ও তাদের সরকারগুলোর মধ্যে আমরা নীতিগত পার্থক্য দেখি না। জনস্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে কিছু দেশী-বিদেশী গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হওয়ায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নামে যেসব তৎপরতা চলছে, তা দেশের জন্য একের পর এক বিপদ তৈরি করছে। সুন্দরবন-কৃষিজমি-শহরধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাটি-পানি-মানুষ বিনাশী ফুলবাড়ী-বড়পুকুরিয়ার উš§ুক্ত খনির চক্রান্ত অব্যাহত রাখা, বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ব্লক একতরফা সুবিধা দিয়ে বিদেশী কোম্পানির কাছে ইজারা, কুইক রেন্টালের নামে ১৪ থেকে ১৭ টাকা কিংবা তারও বেশি দরে বিদ্যুৎ ক্রয়, কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি না করে, জনবল তৈরি না করে, প্রয়োজনীয় সমীক্ষা না করে বিদেশী কোম্পানিনির্ভর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ ইত্যাদি প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কিছু গোষ্ঠীর মুনাফা ও লুটপাটের আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়।
আমরা বারবার বলছি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুন্দরবন না থাকলে একেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ জীবন হারাবেন। সুন্দরবন ধ্বংস মানে অরক্ষিত বাংলাদেশ। এই পথ থেকে সরকারকে অবশ্যই সরে আসতে হবে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সুন্দরবন ধ্বংসী সব তৎপরতা বন্ধ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে জাতীয় কমিটির ৭ দফার ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে টেকসই বিদ্যুতের জোগানও সুলভ ও নিশ্চিত হবে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোনো সরকারই সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে পারবে না, কারণ সুন্দরবন রক্ষায় এখন জাতীয় জাগরণ তৈরি হয়েছে। ভারতের কোনো সরকার সুন্দরবন ধ্বংসের প্রকল্প গায়ের জোরে বাংলাদেশের ওপর চাপাতে পারবে না, কারণ ভারতের সজাগ মানুষরাও আমাদের এ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। সেখানে এই ধ্বংসাত্মক প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ইতিমধ্যে এনটিপিসিকে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে, স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে। কলকাতা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চেরও প্রস্তুতি চলছে। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সজাগ মানুষও সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানী, লেখক, শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মীরা উদ্বেগ নিয়ে যোগাযোগ করছেন। কারণ এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বেরও সম্পদ।
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

কিছু একটা হবে কেউ বিশ্বাস করে না

চারদিকে একটা হতাশা ও শঙ্কার আবহ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক সংকট এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না, রাজনীতিবিদরা এ সংকট থেকে দেশ ও জনগণকে মুক্তি দেবে। এ সংকটের জন্য দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদেরই দোষ দিচ্ছে, বিশেষ করে যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের। কারণ এ সংকট তাঁদেরই সৃষ্টি। রাস্তায় হাঁটা ১০ জন মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে তাদের আটজনই উত্তর দেবে, ভাই, আমাদের কপালে দুঃখ আছে, বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য কোনো রকমের সংলাপই হবে না। আর এ সংকট থেকে উত্তরণও ঘটবে না। অবস্থাটা হলো এমন যে তারা এটাকে তাদের নিয়তি বলে মেনে নিচ্ছে এবং সম্ভাব্য সংকটের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা-উত্তরকালে অনেক রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই ছিল, যার অধিকাংশই নির্বাচন কিভাবে হবে, কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রতিবারই রাজনৈতিক নেতারা একটা সমাধানে পৌঁছার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, শুধু বর্তমানের এ সংকট ছাড়া। এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটত যদি একটা অর্থবহ সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হতো। অবশ্য সে সংলাপের উদ্যোগটা নিতে হতো সরকারকেই। সরকারই এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এক ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক কদর্য রাজনীতি দেশের মানুষকে বর্তমানের অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। সরকার কেন সংলাপের বদলে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? জনমনে ভাবনা হলো, কোনো রকমের নির্বাচন হলেও সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে পুলিশ-র‌্যাবের সহায়তা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর সম্ভাব্য বিশৃঙ্খল অবস্থা দমন করে।

সরকারপ্রধান কয়েক মাস ধরেই তাঁর প্রতীক নৌকায় ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। অথচ বিরোধী দলের নির্বাচনে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতিই নেই। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে যেটা বোঝায়, বর্তমান অবস্থায় বিরোধী দল সেটা পাবে না বলে তারাও মনে করে এবং সুধীসমাজও তাই মনে করে। দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আগেও হয়নি, এখনো হবে বলে কেউ মনে করে না। বর্তমান সরকারের ভালো কাজগুলো এ সরকারের আমলে সংঘটিত কেলেঙ্কারির ঢেউয়ে ভেসে গেছে। সরকারের জনসমর্থন তলানিতে। বাংলাদেশে সব সময় যারা সরকারে থাকে, তাদের ভোটের মাধ্যমে জনগণ সরিয়ে দিতে চায়। এ ব্যাপারটা তো প্রমাণিত হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোতে। সেই হটে যাওয়ার মানসিকতা, ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের থাকতে হবে। এটাই গণতন্ত্রের দাবি। আজ তো দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। জনগণের এ আকাক্সক্ষাকে সরকার যতই অস্বীকার করছে, ততই মানুষের ক্ষোভ আর হতাশা বাড়ছে। ছয় মাস আগেও মানুষ মনে করেছিল, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে একটা কিছু হবে। এখন আর কেউ তা ভাবে না। বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধুরা সংলাপের কথা বলতে বলতে হয়রান হয়েছে। এখন তারাও বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সামনে কোনো সংকট থাকত না, তা যদি শাসনতন্ত্র থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটা সরকার বাতিল করে না দিত। অতি তাড়াহুড়া করে সরকার এ বিধান তুলে দিয়েছে। আর সেদিন থেকেই জনগণের মধ্যে হতাশা ও শঙ্কা তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোনো কিছুর ব্যাপারে আবার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে জনমত জরিপ করে নেয়। জনগণের মতের ভিত্তিতে মৌলিক বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্তে পৌঁছা হয়। আর বাংলাদেশের গণতন্ত্রে জনমত জরিপের কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারি উদ্যোগে কোনো জরিপ করা হলেও এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ এর ফল নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র টেকসই হতে দেয়নি এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদই। গণতন্ত্র বলতে তাঁরা বুঝিয়েছেন জোরজবরদস্তি করে ভোট আদায়। ভোট কেনাবেচাও হয়। কেনাবেচার দৌড়ে সৎ রাজনীতিবিদরা পেছনে পড়তে বাধ্য। আজকে রাজনীতিবিদরা যত পারেন দুর্নীতি করেন। দুর্নীতির অর্থের কিছু অংশ জনগণের জন্য ব্যয় করে তাদের খুশি রাখেন, শুধু তাদের কাছে ভোট চান। সেদিন বাংলাদেশে সোনার মানুষ পাওয়া নিয়ে রাজনীতিবিদদের এক সমাবেশে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে সোনার মানুষ পেতে হলে রাজনীতিবিদদের আগে সোনার মানুষ হতে হবে, তাঁদের দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের জনগণের ভাবনাই প্রতিফলিত করেছেন। রাজনীতিবিদরা যদি সৎ না হন, তাহলে পুলিশ অফিসার বা অন্য পেশার মানুষ সৎ হবে কেন? তাই আজ বাংলাদেশে অতি কদাচিৎ মেলে- এমন একটা গুণ সততা। সর্বত্র দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। এ সমাজে একটা দুদক গঠন করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ কমিশন কোনো রকমের একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্যই যেন তৈরি। কার বিরুদ্ধে কে নির্বাচন করবে? এমপিদের পদ খালি হলো না, অথচ সে পদে নির্বাচন হবে? আর নির্বাচন কমিশন কি একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সবার জন্য নিশ্চিত করতে পারবে? সরকার না চাইলে পারবে না। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন যতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে চাইবে, ততটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না। সুতরাং কোনো রকমে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এই কমিশনের আগ্রহ দেখানো ঠিক হবে না। অবস্থা হলো, নির্বাচন হলে জনগণ যেখানে খুশি হওয়ার কথা, সেখানে তারা শঙ্কিত। নির্বাচন কমিশন জনগণের অনুভূতিকে আমলে নেওয়ার চেষ্টা করছে? অনেকেই মনে করে, পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কথা বলছেন। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব অন্য দেশেও আছে। ওসব পদ্ধতিও বিবেচনার যোগ্যতা রাখে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

‘দুর্ঘটনায় কেন শুধু শ্রমিকই পোড়ে?’

picture-8233 (1)আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কথা হলো এডিনবরার নেপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর প্রফেসর রবার্ট ম্যাকক্লাউড রেসাইডের সঙ্গে। তিনি ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যখন ফোনে ধরতে পারলেন আমাকে, তখন, প্রথমে উত্তেজিত অথচ শেষে বিষণ্ন গলায় জানতে চাইলেন তাজরীন আর রানা প্লাজার এমন সব দুর্ঘটনার পরেও কীভাবে আসওয়াদের এই ‘হত্যাকাণ্ড’ সম্ভব হলো? তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘কিলিং’ শব্দটি ব্যবহার করলেন।

বাংলাদেশের অনেক বিষয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই স্কটিস প্রফেসরের সঙ্গে আমার বহুবার বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি সব সময়ই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্রমবর্ধমান সূচকটির ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের উন্নতির বিষয়ে তিনি বরাবরই আশাবাদী। তাঁর মতে, ৫০-৬০ বছর আগেও স্কটল্যান্ডের অবস্থা বাংলাদেশের মতোই ছিল। ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে যখন অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, মানবিক-নৈতিক-রাজনৈতিক সব ব্যাপারেই এই দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ। বিশেষ করে, তাঁর আস্থা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর। এমন মহৎ ইতিহাসের ওপর দাঁড়ানো জাতি উন্নতি না করে পারে না—এমনই অভিমত তাঁর।

কিন্তু তাজরীনের পরে রানা প্লাজা এবং মঙ্গলবারের দুর্ঘটনায় প্রফেসর রেসাইড বুঝি বা হতবিহ্বল হয়েছেন। আমার সঙ্গে কথা বলার আগেই তিনি ডেইলি স্টার আর অন্যান্য দেশি-বিদেশি ইংরেজি সংবাদসূত্রের বরাতে জেনে গেছেন যে ইতিমধ্যে ঘটনাটিকে কেবল যে ‘দুর্ঘটনা’ নামের লেবেলই দেওয়া হয়েছে এমন নয়, ‘নাশকতা’, ‘ষড়যন্ত্র’—এসবও খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। তিনি এত দ্রুত এত সব তথ্য জেনেছেন সম্ভবত এ কারণেও যে ব্রিটিশ ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন (আইটিভি) জানিয়েছে, আগুন লাগা ওই কারখানায় ছয়টি ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরির কাজ চলছিল। কোম্পানিগুলো হলো নেক্সট, প্রাইমার্ক, জর্জ, গ্যাপ, এইচ অ্যান্ড এম এবং মরিসন্স। এ ছাড়া রানা প্লাজায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কারখানার পরিবেশ এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তুমুল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। ফোনে কথোপকথন শেষ হওয়ার আগে প্রফেসর রেসাইড আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, যদি এসব কেবল দুর্ঘটনাই হবে, কেন শুধু শ্রমিকেরাই পুড়ে মরে? দুর্ঘটনা হলে তো কোনো না কোনো সময় মালিকপক্ষেরও দু-চারজনের এমন পুড়ে যাওয়ার কথা কোনো না কোনো কারখানায়। তাই তো, নিখাদ দুর্ঘটনার কি কোনো শ্রেণী পক্ষপাত থাকে?

দুই.
প্রথম আলোর অনলাইন আপডেটে দেখতে পাচ্ছি, ইতিমধ্যে বিজিএমইএর সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি আতিকুল ইসলাম দাবি করেছেন যে কারখানাটিতে দুই বছর আগে থেকেই অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ছিল। আসওয়াদ কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিস শিকদারের মতে, ‘অগ্নিনির্বাপণের সব ধরনের সরঞ্জাম থাকার পরও এক লাখ ১৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের তিনটি ইউনিটে আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটা আমাদের জন্য একটি নতুন বার্তা।’ বটে! বার্তাটি আমাদের জন্যও নতুন বৈকি! প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা কি দেওয়া হয়েছিল? ট্রেনিং কি দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে শ্রমিকদের যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁরা কীভাবে বের হয়ে আসবেন ভবন থেকে? তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে ‘প্রকৃত কারণ’ খুঁজে বের করার জন্য। তদন্ত কমিটি কোন প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবে? সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে এই সংবাদ সম্মেলনেই। তারা খুঁজে বের করবে কোনো নাশকতামূলক ‘ষড়যন্ত্র’ এই দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী কি না। তদন্ত কমিটি কি দেখবে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহারের মহড়া, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কীভাবে বের হবেন, সে বিষয়ে নিয়মিত মহড়া দেওয়া হয় কি না? যদি না দেওয়া হয়, তবে এই সাত শ্রমিকের মৃত্যু হত্যাকাণ্ড, বড়জোর শুনতে ভালো শব্দে বলা যায় ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’।

তিন.
প্রথম আলোরই (১০ অক্টোবর, ২০১৩) আরেকটি প্রতিবেদন থেকে দেখতে পাচ্ছি যে গত বছর তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মারা যাওয়ার পরে পোশাক কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণে যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল, সেখানে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল বিজিএমইএ। এই টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তিনজন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পাঁচজন এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে একজন সদস্যের সমন্বয়ে। শুরুতে উৎসাহ দিলেও পরে রীতিমতো অসহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে বিজিএমইএর বিরুদ্ধে। টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজিএমইএ ‘কমপ্লায়েন্ট’ ঘোষণা দিয়েছে, এমন ৩৪টি কারখানার অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব ‘কমপ্লায়েন্ট’ খেতাবধারী কারখানাগুলোই অগ্নিনির্বাপণের শর্ত মানছে না। অন্য কারখানাগুলোর অবস্থা অনুমান করাই যায়। এরপর যখন আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা, তখন কেন এসব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে পার পেয়ে যাবে বিজিএমইএ, সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিকেরা?

চার.
২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানার ‘কমপ্লায়েন্স’ নির্ধারণের জন্য অন্যতম চারটি বিষয় হলো, কারখানার প্রতি তলায় কতজন শ্রমিক কাজ করছেন, শ্রমিকদের সম্মিলিত ওজন ও শ্রমিকের কাজের জায়গা থেকে বের হওয়ার দরজার দূরত্ব, দরজার প্রস্থ যা আগুন লাগলে শ্রমিকের বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট কি না এবং দরজার ধরন। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে টাস্কফোর্স দেখেছে, অধিকাংশ কারখানাই ত্রুটিপূর্ণ। এমনকি কোনো কারখানার একটি তলা হয়তো ‘কমপ্লায়েন্ট’, অন্যগুলো নয় অথচ তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কারখানায় আগুন লেগে যখন শনাক্ত-অযোগ্য অবয়বে ছাই হয়ে যাচ্ছেন আমাদের শ্রমিকেরা, সেই সব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে আর কত দিন চালানো হবে?

পাঁচ.
বড় দুর্ভাগা আমরা। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছে, তাদের বিচার ও সাজা প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে-জীবনের দামে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পোশাকশিল্প, তাঁদের পুড়িয়ে মারার, ‘নন-কমপ্লায়েন্ট’ কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করে মেরে ফেলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দুর্ঘটনা’। নামকরণের রাজনীতিতে অনেক কিছুই আসে-যায়। এই উদ্দেশ্যমূলক নামকরণই অতঃপর সাধারণ হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমেও দেখি ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যাই দেওয়া হয়ে থাকে। মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল এবং দেশের মানুষ আমরা এসব ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যা দেওয়া হত্যাকাণ্ড রোধের ব্যাপারে কিছুতেই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছি না, প্রতিরোধ করা তো দূরে থাক। অথচ মানুষের সংঘবদ্ধ মানবিক শক্তি রুখে দাঁড়ালে এসব কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায় না, এমন পরাভবে আমার আস্থা কম। জাতিগতভাবে, ক্ষেত্রবিশেষে, উপেক্ষা করার, উদাসীন থাকার যে অসীম ক্ষমতা আমাদের, তারই ফাঁক গলে স্পেকট্রাম, তাজরীন, রানা, আসওয়াদের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটতে থাকে। শনাক্ত-অযোগ্য লাশগুলো শনাক্ত করার জন্য তাই প্রয়োজন হয় ডিএনএ পরীক্ষার, যাঁরা পোশাকের গায়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ফুটিয়ে তুলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পরিচিতি দেন। আর বলিহারি দারিদ্র্য আমাদের, এসব হত্যাকাণ্ডকে ৪০ হাজার, ৫০ হাজার, বড়জোর এক লাখ, দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে ফেলে রীতিমতো পুণ্যলাভের তৃপ্তি ভোগ করা যায়।

জানি যে প্রফেসর রেসাইডের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন ‘এসব যদি নেহাত দুর্ঘটনা, কেন শুধু শ্রমিকেরাই পুড়ে যায়?’ কয়েক দিন বাজতে থাকবে কানে, অস্বস্তি তৈরি হবে, ভুলে যাব সব ফের বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত। এসব মৃত্যু আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা পোশাক কারখানার শ্রমিক নই, আর যা-ই হোক, আমরা তো আর পুড়ে মরছি না! পুড়বে তো শুধু শ্রমিকেরাই। চিন্তা কি, যত দিন শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন রাখা যাবে, তত দিন বিদেশি ক্রেতার অভাব হবে না, যত দিন হা-ঘরে দারিদ্র্য থাকবে, তত দিন কারখানার আগুনে পুড়ে মরার জন্য শ্রমিক নামের লাকড়ির জোগান ফুরাবে না।

‘পৃথিবীর সবই ঠিক আছে, আর ঈশ্বরও রয়েছেন স্বর্গে’।— priyo

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনই কাম্য

image14সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনই কাম্যপূজা আর ঈদের ছুটির পর থেকে ১০ দিনের মাথায় সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় শুরু হবে। ৯০ দিন, ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারি। ২৫ অক্টোবরের আগেই পরিষ্কার হবে দুই বিবদমান রাজনৈতিক জোটের চূড়ান্ত অবস্থান। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে ২৫ অক্টোবরের পর থেকে। তবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী সময়সূচি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত জনমনে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থাপনা অপরিষ্কার থাকবে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন একবার নির্বাচনী সময়সূচি ঘোষণা করলে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। মনে হচ্ছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষও মনে করেন যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুধু ১৪-দলীয় জোটই একতফা নির্বাচনে প্রস্তুত।

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিকবার বলেছেন যে অন্যান্য দল অংশগ্রহণ না করলে তিনি ও তাঁর দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ‘জাতীয় বেইমান’ হতে চাইবে না। এই ঘোষণার পরও রাজনৈতিক বিশেøষকেরা এরশাদের কথার ওপরে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। তবে এ কথা ঠিক যে জাতীয় পার্টির ভেতরে তত্ত¡াবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকারের সপক্ষেই বেশির ভাগ নেতার অবস্থান। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিও যদি ১৪ দলের একলা চলো নীতির সঙ্গে যোগ না দেয়, তাহলে সে নির্বাচনকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অবশ্যই বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। বিশেষ করে সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল যদি অংশগ্রহণ না করে, সেই নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এমন নয় যে সরকারি দল এমন সরল পাঠ বোঝে না। কিন্তু খুব বিচলিত নয়। নির্বাচন হবেই এবং সেই নির্বাচন যে সরকারি দলের ছকে হবে, সেটাই এখন প্রধান বিরোধী দলের মাথাব্যথা। এ অবস্থায় বিরোধী দল ও জোট এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার প্রত্যয় খুব পরিষ্কারভাবে দেশবাসীকে জানিয়েছে। সর্বশেষ সিলেটের জনসভায় ১৮-দলীয় জোট ও বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন প্রতিহত করতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির নেত্রীর এই হুঁশিয়ারিকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। এমনটাই যদি হয়, তবে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী হবে, তার ফলাফল এবং ভোটার উপস্থিতি কী হবে—এ সবই অনুমেয়। এমন নির্বাচন দেশের ও গণতন্ত্রের জন্য যে মঙ্গলজনক হবে না, অন্তত ইতিহাস তা-ই বলে।

বিভিন্ন জরিপ, আলোচনা, সেমিনার এমনকি বহুল আলোচিত টক শোগুলোতে প্রশ্নকর্তারা যে ধরনের প্রশ্ন করেন, তাতে প্রতীয়মান হয় যে সংখ্যাতত্তে¡র দিকে না গেলেও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন যে অন্তত আগামী নির্বাচন নির্দলীয় অথবা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারব্যবস্থার তত্ত¡াবধানে না হলে তা শান্তিপূর্ণ হবে না। এমনকি সরকারি জোটের অনেক নেতা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে সংসদ রেখে নির্বাচন ভালো ব্যবস্থা নয়। তথাপি শাসক জোট সংবিধানের আওতায় বিদ্যমান পদ্ধতিতেই নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করতে যাচ্ছে।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, সরকারি দল আগামী নির্বাচনে বিরোধী গোষ্ঠীর অবর্তমানে মাঠকর্মীদের ৫১ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কাজ করতে বলেছে। এই সংবাদ যদি সত্য হয়, তাহলে বলতেই হবে যে বাস্তবতার নিরিখে তেমনটি হওয়ার নয়। এ অবস্থায় সরকারি দল ভোটার উপস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখালে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছ থেকে সেটি আশা করা যায় না। এ-ও সত্য, নির্বাচনে বিএনপি ও সমর্থক দল অংশগ্রহণ না করলে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি হবে না। এই সরল অঙ্ক কষতে বড় ধরনের পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
মহাজোটের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টির। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি নিজের পরিচয়ে নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচন করেছে। বাকিরা আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে জয়ী হয়েছেন। তবে নিজস্ব প্রতীকেও জাসদের ২৫ জন এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির তিনজন নির্বাচন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জাসদের তিনজন এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন সদস্য নির্বাচিত হন। এ দুই দলের মধ্যে জাসদ সমষ্টিগত প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ৭৪ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অপর দিকে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। কাজেই ১৪-দলীয় জোটের এই তিনটি দল, যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে, তাদের মোট ভোটের প্রাপ্ত শতাংশ ছিল ৪৯ দশমিক ২৫। অবশ্য জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ভোট। ১৪-দলীয় জোটের বাদ বাকি পার্টির কোনোটি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ভোটও পায়নি।
কাজেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী জোটবিবর্জিত এবং ঘোষিত বাধার মুখে ৫১ শতাংশ ভোটারের ভোট প্রদান বাস্তবিক পক্ষে কতখানি সম্ভব হবে, তা ভেবে দেখার বিষয়। স্মরণযোগ্য যে দশম জাতীয় সংসদে নিবন্ধিত দল হতে যাচ্ছে ৩৮টি আর বিএনএফ নামক সংগঠনটি যদি নিবন্ধিত হয়, তবে আরেকটি বাড়বে। সে ক্ষেত্রে নতুন দুটি দল কতখানি ভোট টানতে পারবে, তা সহজেই অনুমেয়।
মাত্র কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত হয় বরগুনা-২ আসনের উপনির্বাচন। ওই নির্বাচনে দুজন প্রার্থী প্রতিযোগিতা করেন। যার মধ্যে একজন ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের, অপরজন ছিলেন ইসলামী আন্দোলন পার্টির প্রার্থী। মোট প্রদত্ত ভোট ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ, যার মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সরওয়ার হিরু পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৯৯৩ এবং আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬৫ হাজার ৮১২ ভোট। ওই নির্বাচনের পর ইসলামী আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁদের অভিযোগ, তিনটি ইউনিয়নে ভোট প্রদানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ভোট গ্রহণের দুই দিন পর বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকেরা পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুর করেন বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হয়। যদিও বিজয়ী প্রার্থী এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন, তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবরের সত্যতা পাওয়া যায়। এর পরই ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা চরমোনাইয়ের পীর বলেন যে বর্তমান ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে তাঁরা ভবিষ্যতে নির্বাচন করবেন না।
উলেøখ্য, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১৬৬ জন প্রার্থী দিয়েছিল এবং প্রদত্ত মোট ভোটের ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কাজেই ১৪ দল এককভাবে নির্বাচন করলে ভোটের পরিসংখ্যান কেমন হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
ওপরের আলোচনা এবং নিরিখে প্রতীয়মান হয় যে শাসক জোট তাদের ঘোষিত উপায়ে আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের আওতায় নির্বাচন করে এবং জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করলে সে নির্বাচনে ভোটার সমাগম করানো দুরূহ কাজ হবে। তদুপরি বিরোধী জোটের ঘোষিত বিরোধিতার মুখে নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকবে, তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে।
স্মরণযোগ্য যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা, বজায় রাখা এবং ভোটারদের নিরাপত্তার বিধান করা নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে। ওই সময় নির্বাচন কমিশনই মুখ্য, সরকারের ভূমিকা শুধু সহযোগিতার হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী ধরনের পরিকল্পনা নেয় তা এ মাসেই হয়তো জানা যাবে, অবশ্য নির্বাচন কমিশন যদি কোনো পরিকল্পনা করে থাকে। তারা এখনো বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। সে কারণেও বিরোধী দল বিবর্জিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে নির্বাচন কমিশনকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।
যত দূর জানা যায়, নির্বাচন কমিশনও সংবিধানের আওতায় সংসদ রেখে নির্বাচন করাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখনো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সর্বশেষ সংশোধনীতে এ ধরনের নির্বাচনে কমিশনকে কতখানি শক্তিশালী করতে হবে তার বিধান রাখা হয়নি। এমনকি বিগত কমিশনের সুপারিশ করা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্তি হতে বাদ পড়েছে। এ অবস্থায় শুধু আচরণবিধি দ্বারা কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে—এমন কথা খোদ কমিশনাররাও বিশ্বাস করেন কি না সন্দেহ আছে।
নির্বাচন কমিশন নতুন আচরণবিধি যত দেশের বিধি দেখে তৈরি করুক না কেন, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একজন সংসদ সদস্য যেভাবে পাঁচ বছরে সর্ববিষয়ে শেষ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, সেখানে পদে বহাল থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিলে অন্যদের জন্য প্রতিদ্ব›িদ্বতা করা কঠিন হয়ে পড়বে বৈকি। স্মরণ করা যায় ক্ষমতাসীন দলের একজন ক্ষমতাধর নেতার সরকারি কর্মকর্তাদের প্রদেয় হুমকির বিষয়টি। নির্বাচন কমিশন কি এ ধরনের পরিস্থিতিতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারবে? চলমান সরকারি উদ্যোগে নির্বাচনী প্রচারণা কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সাহায্য করছে? নতুন বিধি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয় খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, তবে তার প্রয়োগ কতখানি করা যাবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়।
নির্বাচন কমিশন প্রতিবারই নিশ্চিত করতে চাইছে যে তারা সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সক্ষম হবে। প্রশ্ন থাকে যে যদি ওই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারে তাহলে কী হবে? নির্বাচন কমিশন ওই পরিস্থিতিতে সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন স্থগিত করতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উপাদান।
উপসংহারে বলতে চাই যে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দল একতরফা নির্বাচন করে কতখানি লাভবান হবে, তা নিশ্চয়ই বাস্তবতার নিরিখে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাই একতরফা নয়, সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই কাম্য। একই সঙ্গে সংশিøষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে নির্বাচনই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়, নির্বাচন গণতন্ত্রের ভিত মাত্র। ভিত নড়বড় হলে গণতন্ত্র ভেঙে পড়তে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের দায়িত্বও অপরিসীম।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

২৫ অক্টোবরের পর কী হতে যাচ্ছে

masud-majumder

ক’দিন যাবৎ সবার মনে জিজ্ঞাসা, ২৫ অক্টোবরের পর কী হবে? যারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অভিমত দেন, তারা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নানা ধরনের সঙ্ঘাত শঙ্কার আলামতের কথা বলছেন। রাজনীতির পক্ষগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বাগযুদ্ধে রয়েছেন। দু’টি প্রধান রাজনৈতিক স্রোতের বাইরে যারা রয়েছেন তারাও সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। সব শ্রেণীর নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, সবার জন্য সমতল নির্বাচনী মাঠ প্রস্তুত করা ও দলনিরপেক্ষ ধারণাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। মহাজোটের উল্লেখযোগ্য শরিক দলও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের মতো এক সুরে কথা বলছেন না। এর বাইরে যারা বেশি কথা বলছেন তারা নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কথা বলছেন, দেশপ্রেম ও নীতি-নৈতিকতা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবছেন না। অবশ্য তাদের সংখ্যা এখন হাতেগোনা। আমরা কতকটা নিশ্চিত, আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির কাছে মাথানত করতে বাধ্য হবে। বিরোধী দল আগেভাগে বড় ক্যানভাসে কথা বলেছে। তারা যা বলছে তার নাম তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে, তা বলেনি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকার নির্বাচনকালীন দেশ পরিচালনা করবেÑ এটাই তাদের চাওয়া। তাদের বক্তব্যের পরিসর বড়। আওয়ামী লীগ নিষ্ঠার সাথে সমঝোতা চাইলে বহু ধারণা এর মধ্যে একোমডেট করা সম্ভব। ফলে বিরোধী দলের পিছু হটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখন তাদের রাজনৈতিক ছাড় দেয়ারও তেমন কিছু নেই। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রতিকূলে রেখে সরকার পরিচালনা করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। ফলে মহাজোট সরকার সংবিধান ও কথার জট যতই লাগাক, লাভ হবে না। হয় সাপের মতো সোজা হয়ে গর্তে ঢুকতে হবে, নয়তো গর্তের বাইরে অনিরাপদ থাকতে হবে। এখন মহাজোট সরকার যেদিকেই হাঁটুক, সমাধান খুঁজে হাঁটতে হবে। নয়তো নিজেদের খোঁড়া গর্তে পড়তে হবে। বাংলা ভাষার প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনটা হচ্ছেÑ ‘যত গর্জায় তত বর্ষায় না’। প্রকৃতির এ নিয়মের একটা প্রভাব মানুষের স্বভাবের মধ্যেও দেখা যায়। তর্জন গর্জন যারা বেশি করেন তারা কাজের বেলায় ততটা সিরিয়াস হন না। এর প্রমাণও রয়েছে। যারা ঢোলবাদ্যি বেশি বাজান তারা অন্য কিছু করার সময় পান না। যারা আসলে কিছু করতে চান তারা কথার খই ফুটান না, ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যে ধনুক ভাঙা পণ করার মতো জেদনির্ভর কথা বলেন, কাজের বেলায় তারাই ঠনঠন। তা ছাড়া যারা বেশি কথা বলেন, তারা হয় বাড়িয়ে বলেন, নয়তো মিথ্যা বলেন। এই নীতিবাক্যটিও যে সত্য তারও অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। এমনিতেই প্রতিক্রিয়াশীলেরা সব সময় কাগুজে বাঘের মতোই হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ নেতারা যা বলছেন, তা যে বাড়িয়ে বলা এবং মিথ্যার নামান্তর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর বাইরে প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং বিরোধী মতভীতি তাদের তাড়িয়ে ফিরছে। যুক্তি বলে না শেষ পর্যন্ত সংসদ বহাল রেখে নতুন সংসদ নির্বাচনের দায় আওয়ামী লীগ নিতে যাবে, কিংবা নিতে পারবে। সংবিধান কি বলে-না-বলে সেটা না হয় তোলাই থাকল। তার ওপর সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করতে হলে বর্তমান সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে ধরনের প্রেক্ষাপটও নেই, সুযোগও নেই। অপর দিকে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নামেমাত্র হলেও এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার স্বাভাবিকভাবে বিদায়ের করুণ সুরই শুনতে পাবে। এর বাইরে একটা মাত্র পথ খোলা থাকবে, হুট করে আজগুবি কোনো ইস্যু তৈরি করে জরুরি অবস্থা জারি করে আরো কিছু সময় পার করার একটা অনৈতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা। জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য বশংবদ গোয়েন্দা এজেন্সিকে ঠিকাদারি দেয়া হয়। শক্তিধর পড়শির ওপর নির্ভর করা হয়। কল্পিত জঙ্গি উৎপাতের দোহাই দেয়া যায়।

স্পর্শকাতর পার্বত্য ইস্যু উসকে দেয়া সম্ভব। আশা করি জনগণকে বোকা ভেবে সরকার তেমন কোনো আগুন খেলায় নিজেদের পোড়াতে যাবে না। বিরোধী দল মহাজোট সরকারকে উপড়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে কি না, সেই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ একেবারেই অবান্তর। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধা নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উপড়ে ফেলার কথা কোনো দায়িত্বশীল বিরোধী দল ভাবে না। বর্তমান বিরোধী দলেরও ক্ষমতাচর্চার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারাও বিষয়টি জানে না তেমন নয়। চারদলীয় জোট সরকারকে অক্সিজেন বন্ধ করার হুমকি দিয়েও যে আগে পদত্যাগ করানো যায়নিÑ তাতো দু’পক্ষই জানে। এখন বিরোধী দলের যৌক্তিক অবস্থান হচ্ছে, রাজনৈতিক খেলা এতটা দক্ষতার সাথে জমিয়ে তোলাÑ যাতে সরকার একেবারে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তথ্য, যুক্তি ও নৈতিক শক্তির জোরে সরকারের নৈতিক শক্তি এতটা দুর্বল করে দেয়া যাতে তারা আর ছোবল মারার অবস্থায় না থাকে। ঊনসত্তরে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুব খান ছোবল মারতে পারেননি। একাত্তরে ইয়াহিয়া খান দন্তনখরহীন ব্যাঘ্র ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগ ও বাকশালী ধারার প্রবল প্রতিপত্তির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারীরা খড়কুটোর মতো স্রোতের অনুকূলে ভেসে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা মোশতাক সরকারের আনুকূল্য খুঁজতে ব্যস্ত ছিলেন। একাশিতে এরশাদের ঠাণ্ডা মাথায় ক্ষমতা দখলের সময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের ছত্রছায়ায় বিএনপি ছিল প্রতিরোধহীন অনেকটা অসহায় মেষ শাবকের মতো। আবার নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় এরশাদ সাহেব ঘুম থেকে ওঠেই দেখেন ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেছে। জনতা রাজপথে নেমে পড়েছে। এক-এগারোর সময় সব রাজনৈতিক নেতা চোখে অন্ধকার দেখলেন। এ কথাগুলো এজন্য বলা, আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেতারা হালুম হালুম করে বাঘ সাজতে চাচ্ছেনÑ এ বাঘ ছবির বাঘ। নয়তো কাগুজে বাঘ।
ক্ষমতার বরফ গলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতা উপভোগ করে যারা রগুড়ে বক্তব্য দিয়ে প্রতিপক্ষ শাসায় তারা নিজের পায়ের তলার মাটি সরায়। প্রধানমন্ত্রী যে কনফিডেন্স দেখাচ্ছেনÑ সেটা ওভার কনফিডেন্স। নিষ্ঠুর সত্য ও বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতা ধরে রাখার বাড়াবাড়ির একপর্যায়ে সময়টা হঠাৎ করে সরকারের প্রতিকূলে চলে যাবে। তখন নিজের ছায়া দেখলেও তারা ভয় পাবেন। ক্ষমতা না ছেড়ে একতরফা নির্বাচন ও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে পরিণতি এমনই হওয়ার কথা। দেখা যাবে, যাদের ওপর ভরসা করে এতটা চোখ-মুখ টাটিয়ে মুখ ভেংচিয়ে প্রতিপক্ষ শাসাচ্ছেন এবং শূন্যে গদা ঘুরাচ্ছেন তারা মাঝ দরিয়ায় নোঙর ফেলে বসে আছেন। অনেকেই জার্সি বদল করবেন। গাঢাকা দেবেন কেউ কেউ। বর্ণচোরা বামরা বলে বেড়াবেন আমরাতো ওদের লোকই নই। সুবিধাভোগী চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও ক্ষমতার সুযোগে যারা অবৈধপথে প্রচুর সম্পদ লুটেছেনÑ তারা সম্পদ রক্ষার জন্যই ব্যাকুল থাকবেন। অবশিষ্টরা চোখ উল্টিয়ে পথ চলবেন। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তখনো আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। সাময়িক নাই হয়ে যেতে বাধ্য হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে অদূরভবিষ্যতে বিলীন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দল হিসেবে অস্তিত্বহীন হলেও ধারা ও ধারণার দু’ধারায় নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে কংগ্রেসের মতো রাজনীতির ধারায় পৌঁছে যাবে। বিএনপি মুসলিম লীগের মতো ভাবধারার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। খালেদা জিয়া জানান দিয়েই রেখেছেন, তিনি ডানের বাম, বামের ডান। জাতীয়তাবাদী ভাবনার এমন চিন্তাই মধ্যপন্থী রাজনীতিকে বিকশিত করে। এর অন্য প্রধান কারণ বাংলাদেশে চরম বাম ও চরম ডান কোনো দিনই সুবিধা করতে পারবে নাÑ তাই বলে ডান-বাম ভাবনা বিলুপ্ত হবে না। তারা দু’দিকে ঝুঁকে থাকবে।
বাম ধারা আওয়ামী লীগের কাছাকাছি থাকবে। আর ডান ধারা বিএনপির পাশাপাশি অবস্থান নেবে। নির্বাচনী মেরুকরণ ও আদর্শিক অবস্থানের এই অবস্থার দ্রুত কোনো ব্যত্যয় খুব একটা ঘটবে না। রাজনৈতিক ধারা দীর্ঘ সময় টিকে থাকে কিন্তু নেতৃত্ব কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। আজ শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া যেভাবে দু’টি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটা অনেকের কাছে বিষবৎ মনে হলেও নানা কারণে বিএনপিতে প্রভাবক আছেন একজনই, তার নাম খালেদা জিয়া। আবার আওয়ামী লীগেও প্রভাবক আছেন একজন, তার নাম শেখ হাসিনা। উভয় দলে পারঙ্গম ও যোগ্য কম করে দু’ডজন নেতা আছেন, যারা দু’নেত্রীর তুলনায় কোনোভাবেই কম যোগ্য হয়তো নন। তারপরও দু’নেত্রীর অবস্থান এতটা দৃঢ় ও দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের দেশজ রাজনীতির বাস্তবতা, যে বাস্তবতা থেকে ভারত-পাকিস্তান তো বটেই বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও মুক্ত নয়। এর জন্য পরিবারতন্ত্র ও উত্তরাধিকার ধারার মুণ্ডুপাত করে লাভ নেই। যুগ যুগ ধরে এমন হয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও এমনই হতে থাকবে। আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবেই তারেক রহমানকে বিতর্কিত করতে চেয়েছে। তারা ব্যক্তি তারেক রহমানকে টার্গেট করেনি, করেছে বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিকে। এটা তাদের রাজনৈতিক রণকৌশলের অংশ। সজীব ওয়াজেদ জয়ও প্রতিপক্ষের কাছে সহজেই পার না পাওয়ার কারণও একই কৌশল।
এই প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই দু’ধারার ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে মাটি ধরতে হবে। টিকে থাকতে হবে। তাদের জন্য লালগালিচা থাকবে ক্ষমতার সুযোগে, বিরোধীদলীয় অবস্থানে থাকবে কাঁটা ছড়ানো। এর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইতিবাচক ধারায় পুষ্ট হবে। তাই ষোল আনা কাক্সিত মাত্রায় না হলেও হতাশার ঘন কুয়াশা ও ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাদর ভেদ করে আশার চেরাগও জ্বলবে। কারণ সরকারি দল ও বিরোধীদলের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য না থাকলেও হারজিতের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেছে। সরকারি দল এককভাবে পথ আগলে দাঁড়াবে, সেই নৈতিক শক্তি আর অবশিষ্ট নেই, রাজনৈতিক শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা নিজেদের ক্ষতি কমানো ও দায়ভাগ সহনীয় করতে মরিয়া। অতএব, ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। প্রকৃতির নিয়মেই অনিশ্চয়তার কালো মেঘ কাটবেই। অসমঝোতার ভেতরও একটা সমঝোতার পথ খুলে যেতে বাধ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, পরিস্থিতি অনুমান করে কিংবা উপলব্ধি করে কারা কতটা জনগণকে ভরসা জোগাতে পারবে। আস্থার জায়গায়টায় কারা বুকটান করে দাঁড়াবে সেটা সময়ই বলে দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য ভারত হয়তো তুরুপের তাসটি খেলে দিতে পারে। তবে দিল্লির সামনে বহু মুশকিল অপেক্ষমাণ। এটাও ঠিক, দিল্লিতে সরকার পাল্টালেও বাংলাদেশ পলিসি পাল্টায় না। তারপরও সর্বত্র জাল ফেলে দিল্লিতে বসে টানার সময় আগের মতো নেই। ভূকৌশলগত কারণে আন্তর্জাতিক শত্রু বন্ধু বুঝপড়ার স্বার্থে এখন অনেক খেলোয়াড়। কোনো শক্তির একক মর্জি ও ইচ্ছা চাপানো সহজ নয়। তবে রাজনীতিতে নেকড়ের মতো হিংস্রতা ও শিয়ালের মতো ধূর্ততা আছে। তারপরও জনগণকে সাথে পাওয়ার ও রাখার যোগ্যতা যাদের বেশি তারাই সাফল্যের পথ রচনা করবে।
রাজনীতির মাঠ যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো। এখানে ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর। বিজয় বীরের পদচুম্বন করেই সাফল্য ধরা দেয়। যুদ্ধের যেমন রণকৌশল ও দক্ষ সেনাপতির যোগ্যতার গুরুত্ব বেশি, রাজনীতির যুদ্ধেও কৌশল ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। জাতি মেরুবদ্ধ। ভোটার মন পরিবর্তনকামী হয়ে উঠেছে। এখন সামগ্রিক পরিস্থিতি বিরোধী জোটের অনুকূলে। মহাজোট ভাটার টানে হিমশিম খাচ্ছে। বিরোধী জোটের পক্ষে হয়তো জোয়ার সৃষ্টি হতে আরো সময় নেবেÑ তবে বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। অপর দিকে মহাজোটকে শনি তাড়া করছে। শনি এবং বৃহস্পতির ঠেলা ধাক্কায় বৃহস্পতি টিকে যায়Ñ এবারো যাবে। এই টিকে যাওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে জনগণ। বাংলাদেশের মানুষের শ্রেণী চরিত্রই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করবে। আমাদের এ মূল্যায়নের বাইরেও একটা আলাদা দৃশ্যপট থাকা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে একরোখা পথ চলতে চাইতে পারে। বিরোধী দল ও মত সহ্য না করার একটা চূড়ান্ত মরণকামড় বসাতে চাইতে পারে। সবকিছু উপেক্ষা করে পথচলা সহজ হলে আন্দোলনেরও ফাঁসি অনিবার্য। সেই ফাঁসি কার্যকর করতে রক্তস্রোত ডিঙ্গাবার একটা সুপ্ত বাসনাও কারো কারো থাকতে পারে। তবে বলে রাখা ভালো, সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে মহাজোট সরকারের জন্যও নিকষ কালো অন্ধকারের ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে।

২৫ অক্টোবরের পর কী হতে যাচ্ছে

ক’দিন যাবৎ সবার মনে জিজ্ঞাসা, ২৫ অক্টোবরের পর কী হবে? যারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অভিমত দেন, তারা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নানা ধরনের সঙ্ঘাত শঙ্কার আলামতের কথা বলছেন। রাজনীতির পক্ষগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বাগযুদ্ধে রয়েছেন। দু’টি প্রধান রাজনৈতিক স্রোতের বাইরে যারা রয়েছেন তারাও সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। সব শ্রেণীর নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, সবার জন্য সমতল নির্বাচনী মাঠ প্রস্তুত করা ও দলনিরপেক্ষ ধারণাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। মহাজোটের উল্লেখযোগ্য শরিক দলও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের মতো এক সুরে কথা বলছেন না। এর বাইরে যারা বেশি কথা বলছেন তারা নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কথা বলছেন, দেশপ্রেম ও নীতি-নৈতিকতা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবছেন না। অবশ্য তাদের সংখ্যা এখন হাতেগোনা। আমরা কতকটা নিশ্চিত, আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির কাছে মাথানত করতে বাধ্য হবে। বিরোধী দল আগেভাগে বড় ক্যানভাসে কথা বলেছে। তারা যা বলছে তার নাম তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে, তা বলেনি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকার নির্বাচনকালীন দেশ পরিচালনা করবেÑ এটাই তাদের চাওয়া। তাদের বক্তব্যের পরিসর বড়। আওয়ামী লীগ নিষ্ঠার সাথে সমঝোতা চাইলে বহু ধারণা এর মধ্যে একোমডেট করা সম্ভব। ফলে বিরোধী দলের পিছু হটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখন তাদের রাজনৈতিক ছাড় দেয়ারও তেমন কিছু নেই। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রতিকূলে রেখে সরকার পরিচালনা করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। ফলে মহাজোট সরকার সংবিধান ও কথার জট যতই লাগাক, লাভ হবে না। হয় সাপের মতো সোজা হয়ে গর্তে ঢুকতে হবে, নয়তো গর্তের বাইরে অনিরাপদ থাকতে হবে। এখন মহাজোট সরকার যেদিকেই হাঁটুক, সমাধান খুঁজে হাঁটতে হবে। নয়তো নিজেদের খোঁড়া গর্তে পড়তে হবে। বাংলা ভাষার প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনটা হচ্ছেÑ ‘যত গর্জায় তত বর্ষায় না’। প্রকৃতির এ নিয়মের একটা প্রভাব মানুষের স্বভাবের মধ্যেও দেখা যায়। তর্জন গর্জন যারা বেশি করেন তারা কাজের বেলায় ততটা সিরিয়াস হন না। এর প্রমাণও রয়েছে। যারা ঢোলবাদ্যি বেশি বাজান তারা অন্য কিছু করার সময় পান না। যারা আসলে কিছু করতে চান তারা কথার খই ফুটান না, ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যে ধনুক ভাঙা পণ করার মতো জেদনির্ভর কথা বলেন, কাজের বেলায় তারাই ঠনঠন। তা ছাড়া যারা বেশি কথা বলেন, তারা হয় বাড়িয়ে বলেন, নয়তো মিথ্যা বলেন। এই নীতিবাক্যটিও যে সত্য তারও অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। এমনিতেই প্রতিক্রিয়াশীলেরা সব সময় কাগুজে বাঘের মতোই হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ নেতারা যা বলছেন, তা যে বাড়িয়ে বলা এবং মিথ্যার নামান্তর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর বাইরে প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং বিরোধী মতভীতি তাদের তাড়িয়ে ফিরছে। যুক্তি বলে না শেষ পর্যন্ত সংসদ বহাল রেখে নতুন সংসদ নির্বাচনের দায় আওয়ামী লীগ নিতে যাবে, কিংবা নিতে পারবে। সংবিধান কি বলে-না-বলে সেটা না হয় তোলাই থাকল। তার ওপর সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করতে হলে বর্তমান সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে ধরনের প্রেক্ষাপটও নেই, সুযোগও নেই। অপর দিকে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নামেমাত্র হলেও এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার স্বাভাবিকভাবে বিদায়ের করুণ সুরই শুনতে পাবে। এর বাইরে একটা মাত্র পথ খোলা থাকবে, হুট করে আজগুবি কোনো ইস্যু তৈরি করে জরুরি অবস্থা জারি করে আরো কিছু সময় পার করার একটা অনৈতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা। জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য বশংবদ গোয়েন্দা এজেন্সিকে ঠিকাদারি দেয়া হয়। শক্তিধর পড়শির ওপর নির্ভর করা হয়। কল্পিত জঙ্গি উৎপাতের দোহাই দেয়া যায়।
স্পর্শকাতর পার্বত্য ইস্যু উসকে দেয়া সম্ভব। আশা করি জনগণকে বোকা ভেবে সরকার তেমন কোনো আগুন খেলায় নিজেদের পোড়াতে যাবে না। বিরোধী দল মহাজোট সরকারকে উপড়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে কি না, সেই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ একেবারেই অবান্তর। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধা নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উপড়ে ফেলার কথা কোনো দায়িত্বশীল বিরোধী দল ভাবে না। বর্তমান বিরোধী দলেরও ক্ষমতাচর্চার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারাও বিষয়টি জানে না তেমন নয়। চারদলীয় জোট সরকারকে অক্সিজেন বন্ধ করার হুমকি দিয়েও যে আগে পদত্যাগ করানো যায়নিÑ তাতো দু’পক্ষই জানে। এখন বিরোধী দলের যৌক্তিক অবস্থান হচ্ছে, রাজনৈতিক খেলা এতটা দক্ষতার সাথে জমিয়ে তোলাÑ যাতে সরকার একেবারে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তথ্য, যুক্তি ও নৈতিক শক্তির জোরে সরকারের নৈতিক শক্তি এতটা দুর্বল করে দেয়া যাতে তারা আর ছোবল মারার অবস্থায় না থাকে। ঊনসত্তরে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুব খান ছোবল মারতে পারেননি। একাত্তরে ইয়াহিয়া খান দন্তনখরহীন ব্যাঘ্র ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগ ও বাকশালী ধারার প্রবল প্রতিপত্তির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারীরা খড়কুটোর মতো স্রোতের অনুকূলে ভেসে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা মোশতাক সরকারের আনুকূল্য খুঁজতে ব্যস্ত ছিলেন। একাশিতে এরশাদের ঠাণ্ডা মাথায় ক্ষমতা দখলের সময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের ছত্রছায়ায় বিএনপি ছিল প্রতিরোধহীন অনেকটা অসহায় মেষ শাবকের মতো। আবার নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় এরশাদ সাহেব ঘুম থেকে ওঠেই দেখেন ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেছে। জনতা রাজপথে নেমে পড়েছে। এক-এগারোর সময় সব রাজনৈতিক নেতা চোখে অন্ধকার দেখলেন। এ কথাগুলো এজন্য বলা, আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেতারা হালুম হালুম করে বাঘ সাজতে চাচ্ছেনÑ এ বাঘ ছবির বাঘ। নয়তো কাগুজে বাঘ।
ক্ষমতার বরফ গলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতা উপভোগ করে যারা রগুড়ে বক্তব্য দিয়ে প্রতিপক্ষ শাসায় তারা নিজের পায়ের তলার মাটি সরায়। প্রধানমন্ত্রী যে কনফিডেন্স দেখাচ্ছেনÑ সেটা ওভার কনফিডেন্স। নিষ্ঠুর সত্য ও বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতা ধরে রাখার বাড়াবাড়ির একপর্যায়ে সময়টা হঠাৎ করে সরকারের প্রতিকূলে চলে যাবে। তখন নিজের ছায়া দেখলেও তারা ভয় পাবেন। ক্ষমতা না ছেড়ে একতরফা নির্বাচন ও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে পরিণতি এমনই হওয়ার কথা। দেখা যাবে, যাদের ওপর ভরসা করে এতটা চোখ-মুখ টাটিয়ে মুখ ভেংচিয়ে প্রতিপক্ষ শাসাচ্ছেন এবং শূন্যে গদা ঘুরাচ্ছেন তারা মাঝ দরিয়ায় নোঙর ফেলে বসে আছেন। অনেকেই জার্সি বদল করবেন। গাঢাকা দেবেন কেউ কেউ। বর্ণচোরা বামরা বলে বেড়াবেন আমরাতো ওদের লোকই নই। সুবিধাভোগী চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও ক্ষমতার সুযোগে যারা অবৈধপথে প্রচুর সম্পদ লুটেছেনÑ তারা সম্পদ রক্ষার জন্যই ব্যাকুল থাকবেন। অবশিষ্টরা চোখ উল্টিয়ে পথ চলবেন। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তখনো আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। সাময়িক নাই হয়ে যেতে বাধ্য হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে অদূরভবিষ্যতে বিলীন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দল হিসেবে অস্তিত্বহীন হলেও ধারা ও ধারণার দু’ধারায় নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে কংগ্রেসের মতো রাজনীতির ধারায় পৌঁছে যাবে। বিএনপি মুসলিম লীগের মতো ভাবধারার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। খালেদা জিয়া জানান দিয়েই রেখেছেন, তিনি ডানের বাম, বামের ডান। জাতীয়তাবাদী ভাবনার এমন চিন্তাই মধ্যপন্থী রাজনীতিকে বিকশিত করে। এর অন্য প্রধান কারণ বাংলাদেশে চরম বাম ও চরম ডান কোনো দিনই সুবিধা করতে পারবে নাÑ তাই বলে ডান-বাম ভাবনা বিলুপ্ত হবে না। তারা দু’দিকে ঝুঁকে থাকবে।
বাম ধারা আওয়ামী লীগের কাছাকাছি থাকবে। আর ডান ধারা বিএনপির পাশাপাশি অবস্থান নেবে। নির্বাচনী মেরুকরণ ও আদর্শিক অবস্থানের এই অবস্থার দ্রুত কোনো ব্যত্যয় খুব একটা ঘটবে না। রাজনৈতিক ধারা দীর্ঘ সময় টিকে থাকে কিন্তু নেতৃত্ব কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। আজ শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া যেভাবে দু’টি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটা অনেকের কাছে বিষবৎ মনে হলেও নানা কারণে বিএনপিতে প্রভাবক আছেন একজনই, তার নাম খালেদা জিয়া। আবার আওয়ামী লীগেও প্রভাবক আছেন একজন, তার নাম শেখ হাসিনা। উভয় দলে পারঙ্গম ও যোগ্য কম করে দু’ডজন নেতা আছেন, যারা দু’নেত্রীর তুলনায় কোনোভাবেই কম যোগ্য হয়তো নন। তারপরও দু’নেত্রীর অবস্থান এতটা দৃঢ় ও দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের দেশজ রাজনীতির বাস্তবতা, যে বাস্তবতা থেকে ভারত-পাকিস্তান তো বটেই বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও মুক্ত নয়। এর জন্য পরিবারতন্ত্র ও উত্তরাধিকার ধারার মুণ্ডুপাত করে লাভ নেই। যুগ যুগ ধরে এমন হয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও এমনই হতে থাকবে। আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবেই তারেক রহমানকে বিতর্কিত করতে চেয়েছে। তারা ব্যক্তি তারেক রহমানকে টার্গেট করেনি, করেছে বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিকে। এটা তাদের রাজনৈতিক রণকৌশলের অংশ। সজীব ওয়াজেদ জয়ও প্রতিপক্ষের কাছে সহজেই পার না পাওয়ার কারণও একই কৌশল।
এই প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই দু’ধারার ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে মাটি ধরতে হবে। টিকে থাকতে হবে। তাদের জন্য লালগালিচা থাকবে ক্ষমতার সুযোগে, বিরোধীদলীয় অবস্থানে থাকবে কাঁটা ছড়ানো। এর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইতিবাচক ধারায় পুষ্ট হবে। তাই ষোল আনা কাক্সিত মাত্রায় না হলেও হতাশার ঘন কুয়াশা ও ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাদর ভেদ করে আশার চেরাগও জ্বলবে। কারণ সরকারি দল ও বিরোধীদলের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য না থাকলেও হারজিতের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেছে। সরকারি দল এককভাবে পথ আগলে দাঁড়াবে, সেই নৈতিক শক্তি আর অবশিষ্ট নেই, রাজনৈতিক শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা নিজেদের ক্ষতি কমানো ও দায়ভাগ সহনীয় করতে মরিয়া। অতএব, ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। প্রকৃতির নিয়মেই অনিশ্চয়তার কালো মেঘ কাটবেই। অসমঝোতার ভেতরও একটা সমঝোতার পথ খুলে যেতে বাধ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, পরিস্থিতি অনুমান করে কিংবা উপলব্ধি করে কারা কতটা জনগণকে ভরসা জোগাতে পারবে। আস্থার জায়গায়টায় কারা বুকটান করে দাঁড়াবে সেটা সময়ই বলে দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য ভারত হয়তো তুরুপের তাসটি খেলে দিতে পারে। তবে দিল্লির সামনে বহু মুশকিল অপেক্ষমাণ। এটাও ঠিক, দিল্লিতে সরকার পাল্টালেও বাংলাদেশ পলিসি পাল্টায় না। তারপরও সর্বত্র জাল ফেলে দিল্লিতে বসে টানার সময় আগের মতো নেই। ভূকৌশলগত কারণে আন্তর্জাতিক শত্রু বন্ধু বুঝপড়ার স্বার্থে এখন অনেক খেলোয়াড়। কোনো শক্তির একক মর্জি ও ইচ্ছা চাপানো সহজ নয়। তবে রাজনীতিতে নেকড়ের মতো হিংস্রতা ও শিয়ালের মতো ধূর্ততা আছে। তারপরও জনগণকে সাথে পাওয়ার ও রাখার যোগ্যতা যাদের বেশি তারাই সাফল্যের পথ রচনা করবে।
রাজনীতির মাঠ যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো। এখানে ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর। বিজয় বীরের পদচুম্বন করেই সাফল্য ধরা দেয়। যুদ্ধের যেমন রণকৌশল ও দক্ষ সেনাপতির যোগ্যতার গুরুত্ব বেশি, রাজনীতির যুদ্ধেও কৌশল ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। জাতি মেরুবদ্ধ। ভোটার মন পরিবর্তনকামী হয়ে উঠেছে। এখন সামগ্রিক পরিস্থিতি বিরোধী জোটের অনুকূলে। মহাজোট ভাটার টানে হিমশিম খাচ্ছে। বিরোধী জোটের পক্ষে হয়তো জোয়ার সৃষ্টি হতে আরো সময় নেবেÑ তবে বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। অপর দিকে মহাজোটকে শনি তাড়া করছে। শনি এবং বৃহস্পতির ঠেলা ধাক্কায় বৃহস্পতি টিকে যায়Ñ এবারো যাবে। এই টিকে যাওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে জনগণ। বাংলাদেশের মানুষের শ্রেণী চরিত্রই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করবে। আমাদের এ মূল্যায়নের বাইরেও একটা আলাদা দৃশ্যপট থাকা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে একরোখা পথ চলতে চাইতে পারে। বিরোধী দল ও মত সহ্য না করার একটা চূড়ান্ত মরণকামড় বসাতে চাইতে পারে। সবকিছু উপেক্ষা করে পথচলা সহজ হলে আন্দোলনেরও ফাঁসি অনিবার্য। সেই ফাঁসি কার্যকর করতে রক্তস্রোত ডিঙ্গাবার একটা সুপ্ত বাসনাও কারো কারো থাকতে পারে। তবে বলে রাখা ভালো, সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে মহাজোট সরকারের জন্যও নিকষ কালো অন্ধকারের ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে।

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

মনে হয় মাতৃগর্ভ থেকে তাদের জন্ম হয়নি

image73

প্রত্যেক মানুষেরই জন্ম হয়েছে মাতৃগর্ভে; সে নারী কিংবা পুরুষ যেই হোক না কেন, এমনকি টেস্টটিউব বেবি বলতে যা আমরা বুঝি তাকেও কোনো-না-কোনো নারীর গর্ভে জন্ম নিতে হয়। ডিম্বটি শুধু নিষিক্ত হয় গর্ভের বাইরে। বাকি সব প্রাকৃতিক নিয়মেই। এই প্রক্রিয়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। প্রতিটি প্রাণী প্রজাতির ভেতরেই নারী-পুরুষ আছে। তা সে বিন্দুর আকারেই হোক আর তিমির আকারেই হোক। কয়েক দিন ধরে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের উসকানিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত গার্মেন্ট শিল্পে বিরাট অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আঁতাতের নির্বাচন করে যে চমকের মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে তখনই গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। এই চমকের মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই ছিল অনভিজ্ঞ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যাহীন। কেউ কেউ বিউটি পার্লারচর্চিত। সন্দেহ নেই, চমক তাতে সৃষ্টি হয়েছিল বটে। এমন বহু লোক মন্ত্রী হয়েছেন, যাদের নামও আগে কেউ শোনেনি। জাতীয় রাজনীতিতে যাদের কোনো অবদানই নেই। আওয়ামী লীগকে মানি বা না মানি, এটি একটি বড় রাজনৈতিক দল। আর এই দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা যদি কোনো কথা বলেন, তাহলে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে তার যে সমর্থক রয়েছেন, তারাও একই সুরে আওয়াজ তোলেন। এই দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে শিক্ষার বড় অভাব। যুক্তি এখানে পরাভূত। কিন্তু চিরদিন কি আর হুক্কাহুয়া ধ্বনি তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে? এই যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল নগরে, শহরে বিলবোর্ড দখল করে উন্নয়নের প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, তখন সে দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। আহা, কী সব মিষ্টিকথা শুনেছিলাম! ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা হয়তো সেই অবস্থায় আমাকে রাখেননি। শেখ হাসিনা যদি সত্যি সত্যিই ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াতে পারতেন, সেই চালের লাইনে আমি হয়তো দাঁড়াতাম না। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এ রকম মোটা চালের দীর্ঘ লাইনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সাবাস, শেখ হাসিনা। আমি ১০ টাকা কেজি দরের চাল খেতে চাইনি। কিন্তু এ রকম কোটি মানুষ আছে, যাদের আয় উপার্জন আমার থেকে অনেক কম। আর শেখ হাসিনা যদি সত্যি সত্যিই তাদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চালের ব্যবস্থা করতে পারতেন, তবে তারা শেখ হাসিনাকে ধন্য ধন্য করতেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই তিনি একেবারে ভোল পাল্টে ফেললেন। অস্বীকার করে বসলেন, তিনি এমন প্রতিশ্র“তি কখনো দেননি। বরং বলতে শুরু করলেন, চালের কেজি ১০ টাকা করলে কৃষক মাঠে মারা যাবে। তাদের উৎপাদন খরচ পোষাবে না। সুতরাং চালের দাম বাড়াতেই হবে।

আমরা তো এই ভেবে বিস্মিত হয়েছিলাম যে, শেখ হাসিনা কোন আক্কেলে এমন প্রতিশ্র“তি দিলেন। যখন তিনি ওই রকম ওয়াদা করেন, তখন সাধারণ বাজারে চালের কেজি ছিল ১৭ টাকা। সেখানে ভর্তুকি দিতে হয়নি। সেটাই ছিল সাধারণ বাজার দর। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে কৃষককে বিনামূল্যে সার দেবেন। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে। সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানিÑ কোনো কিছুরই অভাব হবে না কৃষকের। কিছু কিছু ঘোষণা শুনে তখন অবাক হয়েছি। ভেবেছি, এই যে প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন শেখ হাসিনা, সেটা রক্ষা করা কি তার পক্ষে সম্ভব হবে? ঢাকা কারওয়ানবাজারে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তাকে নির্বাচিত করলে, যা চান তাই তিনি দেবেন। কেউ যদি গান ধরত ‘তোরা যে যা বলিস ভাই/ আমার সোনার হরিণ চাই’, তাহলে কি শেখ হাসিনা তাকে সোনার হরিণ এনে দিতেন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, দেশ বিদ্যুতে ভাসিয়ে দেবেন। বিএনপি সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়নের নামে শুধু খাম্বা লাগিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। তিনি তখন শুধু খাম্বা দেখছিলেন। বিদ্যুৎ পাচ্ছিলেন না। এই ছিল তার অভিযোগ। খাম্বার অনেক দোষের কথা শুনেছিলাম। খাম্বা কিনে নাকি তারেক রহমান ও তার ‘বন্ধু’ একেবারে লালে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। এই খাম্বা নিয়ে হাসাহাসি কম হয়নি। এখন বিদ্যুৎ নেই। অথচ শেখ হাসিনা সরকারও হাজারে হাজারে খাম্বা কিনছেন। খাম্বা লাগাচ্ছেন। এই খাম্বা কাহিনীও পরে প্রকাশিত হয়েছিল। খাম্বার বেশির ভাগ শেয়ার ছিল এক আওয়ামী লীগারেরই। বিদ্যুৎব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।
বিদ্যুতের জন্য যখন সাধারণ মানুষ মিছিল করেছে, সড়ক অবরোধ করেছে, তখন পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে তিনি তাদের তক্তা বানিয়ে দিয়েছেন। আর তার সরকার এমনও ঘোষণা করেছিল, বিদ্যুৎ চাইÑ এ রকম দাবি নিয়ে কোনো এলাকার লোক যদি মিছিল, সমাবেশ অবরোধ করে; তবে যেটুকু বিদ্যুৎ তাদের দেয়া হয়েছে, তাও বন্ধ করে দেয়া হবে। সরকার বলে কথা। বাব্বাহ! আসলে কোথাও কিছুই হয়নি। এই সরকারের আমলে যা হয়েছে, তা কেবল দুর্নীতি আর দুর্নীতি। সে দুর্নীতি বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক শেখ হাসিনার যোগাযোগমন্ত্রীকে পদ্মা সেতু দুর্নীতির আসামি করেছে। ওরে, বাবা! বিশ্বব্যাংকের ওপর শেখ হাসিনা এমন খাপ্পা হয়ে উঠলেন যে, মনে হলো হাতে ক্ষমতা থাকলে গ্রামীণ ব্যাংকের মতোই তিনি বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নিয়ে কঠোর সাজা দিতেন। শ্রমিকদের জন্য তার যে কত প্রতিশ্র“তি ছিল! সেসব প্রতিশ্র“তি কোনোটাই কাজে আসেনি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় শ্রমিক আজ গার্মেন্ট শিল্পে। এখানে প্রধানত নারীশ্রমিকেরা কাজ করেন। এসব নারীশ্রমিকের বেশির ভাগই আগে গৃহকর্মী ছিলেন। তারা ন্যূনতম বেতনে গার্মেন্টশ্রমিক হয়েছেন। আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা বাজারের শত মন্দা সত্ত্বেও গার্মেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। শুধু টিকিয়ে রেখেছেন বললে ভুল হবে, এর পরিশীলিত বিকাশ ঘটিয়েছেন। এই শিল্প ধ্বংসের জন্য হেন কোনো ইতর কাজ নেই, যা দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা করেনি বা করছে না। সেসব চক্রান্ত প্রতিহত করেও আমাদের উদ্যোক্তারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সন্দেহ নেই, বেতন তারা কম দেন।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মালিকেরা শ্রমিকদের বেতন কম দিতে চান। এটি তো পুঁজিবাদী দুুনিয়ার নিয়মই। এরা সব সময় শ্রমিকদের ঠকাতে চান। আর সেই ঠকানো রোধ করার জন্য পৃথিবীতে মার্কসবাদের জন্ম হয়েছিল। এখন তার বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠেছে। পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ক্রমেই বাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তন্ত্র দিয়ে কিছু হয় না। কিছু করতে চাইলে, এমনকি জনগণের জীবনমানে উন্নয়ন চাইলেও বাজার অর্থনীতি ছাড়া গতি নেই। গার্মেন্ট আমাদের দেশের একটি প্রধান রফতানি খাত। আগে জনশক্তি রফতানি খাত ছিল সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন গার্মেন্ট ভরসা। কিন্তু তাজরীন ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ড, আর রানা প্লাজা ধসের পর এই শিল্পে এক বহুমুখী বিপর্যয় নেমে আসে। এক দিকে শিল্প টিকিয়ে রাখা, অপর দিকে বাজার ধরে রাখাÑ দুটোই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জেএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। অন্যান্য জায়গায়ও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। এর মধ্যে আবির্ভূত হলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হওয়ার আগে কেন জানি না, আমি শাজাহান খানের নাম শুনেছি আওয়ামী শ্রমিক নেতা ও বিরাট চাঁদাবাজ হিসেবে। তাকে মন্ত্রী করার পর টিআইবির সাবেক প্রধান মরহুম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেছিলেন, শাজাহান খানকে মন্ত্রী করার মানে চাঁদাবাজি জাতীয়করণ করা। তখন ভেবেছিলাম, তিনি নিশ্চয়ই শাজাহান খানকে ভালোভাবে চেনেন না। আর তাই এমন কথা বলেছেন। পরে তো দেখতেই পেলাম, শাজাহান খান কী! নৌমন্ত্রী বটে। কিন্তু বাস-ট্রাকের ড্রাইভারদের লাইসেন্স দেয়া নিয়ে কীর্তি তিনি কম করেননি। ভেবেছিলাম, এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে ধমক দেবেন। কিন্তু ধমক তো দেনইনি, বরং শাজাহান খান তার কর্তৃত্বের আওতা বাড়িয়েই চলেছেন। এবার তিনি গার্মেন্টশ্রমিকদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রথমে তিনি গার্মেন্টশ্রমিকদের মহাসমাবেশ ডেকে বসলেন হেফাজতে ইসলামের আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে। সেই সমাবেশে ঘোষণা করলেন, গার্মেন্টশ্রমিকদের বেতন-মজুরি কমপক্ষে আট হাজার টাকা করতে হবে।
সরকারের মন্ত্রী যখন এ রকম ঘোষণা দেন, তখন গার্মেন্টশ্রমিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এমন আশার সঞ্চার হয় যে, তাদের মজুরি মাসিক আট হাজার টাকা হতে আর বাকি নেই। সেভাবে তিনি এই সেক্টরে বক্তৃতা দিয়েই চললেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আশা বাড়তে থাকল। তা ছাড়া প্রায় ৪০ জন আওয়ামী এমপি আছেন, যাদের গার্মেন্ট ব্যবসায় আছে। শাজাহান খানের এত মুরোদ, তাহলে অন্তত তার দলের ৪০ জন এমপির কারখানায় ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা তিনি সবার আগে চালু করে দিলেন না কেন? তা যদি পারতেন, তাহলে অন্যরা ওই এমপিদের অনুসরণ করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু এখন দেখছি ভিন্ন চিত্র। শাজাহান খান উসকে দিলেন, শ্রমিকেরা ন্যূনতম আট হাজার টাকা বেতনের দাবিতে রাজপথে নেমে এলো। তারা গার্মেন্ট ভাঙচুর করল। গার্মেন্টে আগুন দিলো। পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হলো। পুলিশ লাঠিচার্জ করল। নির্বিচার গুলি চালাল। রাজপথে শ্রমিকের রক্ত ঝরল। তাতে সঙ্ঘাত আরো বাড়ল। আরো কারখানা জ্বলল। সঙ্ঘাত চলছে। খেলা চালু করে দিয়ে এখন খানিকটা আড়াল হয়েছেন। সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ, আগুন, রক্তপাত চলছেই। নিপুণ খেলোয়াড় বটে শাজাহান খান। বুর্জোয়া রাজনীতি তো এমনই নিপুণ, কুটিল দস্যুদেরই খেলা। সে ক্ষেত্রে আমরা সমস্বরে এই খেলাকে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাতে পারি। কিন্তু সেখানে আমি ব্যথিত হইনি। ক’দিনের পত্রিকায় দেখলাম, পুলিশ দুই হাতে শক্ত করে লাঠি ধরে নারীশ্রমিকদের সর্বশক্তি দিয়ে পেটাচ্ছে। আমি চমকে গিয়েছি ওইখানে। এদের কেউ চল্লিশোর্ধ্ব মাতা, কেউ বা আঠারোর কিশোরী। যেসব পুলিশ এদের আঘাত করছে, তাদের বয়স একই রকম। কারো বা ২০-২৫ বছর। কেউ বা পঞ্চাশের কাছাকাছি। বারবার মনে হতে থাকল, এরা কি কোনো মাতৃগর্ভে জন্ম নেননি। এদের ঘরে কি ওরকম কিশোরী সন্তান নেই। এরা তাহলে কারা? তবে কি এই আঘাতকারীরা পিশাচ? তবে কি এই সরকার পিশাচের সরকার? এ কথা মনে করতে করতে কেবলই মন ভারাক্রান্ত হয়েছে। মনে হয়েছে, যদি ওই মায়ের বদলে আমার পিঠ পেতে দিতে পারতাম! যদি ওই সন্তানের বদলে আমার পিঠ পেতে দিতে পারতাম! তাহলে হয়তো মানুষ হিসেবে খানিকটা দায়িত্ব পালন হতো। আমি তো তা পারিনি। আমরা সব সময় সব জায়গায় গিয়ে তা করতে পারি না। সেটাই মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের সবচেয়ে বড় বেদনা। আমি যেন আর সে বেদনার ভার বইতে পারছি না। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

আগামী নির্বাচন ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

image45

আগামী নির্বাচন সম্পর্কিত অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কোনো সুরাহা এখনও পর্যন্ত না হলেও নির্বাচনী দলগুলোর প্রত্যেকটি নিজের নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের শাস্তি নিয়ে হরতালের নামে রাস্তায় নেমে খুনখারাবি, অগ্নিসংযোগ, জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইত্যাদিতে বেশি ব্যস্ত থাকলেও অন্যরা আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই কাজ করছে। এদের মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগকেই সব থেকে বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে থেকে নিয়ে তার দলের লোকরা সরকারে থাকার সময় সরকারি খরচেই নিজেদের দলীয় নির্বাচনী প্রচারণা বেশ নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা থেকে তার পুত্রকে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য আমদানি করে দেশে এনেছেন। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি এমন এক খেলো ব্যাপারে পরিণত হয়েছে যাতে প্রধানমন্ত্রীর এ কাজ করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর পিতার বংশধররা কেউই দেশপ্রেমিক হিসেবে দেশে থাকেন না! প্রধানমন্ত্রীও এমনভাবে দেশে থাকেন যাতে মনে হয় তিনি তার পরিবারের রাজনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার জন্যই দায়ে পড়ে এখনও পর্যন্ত দেশে পড়ে আছেন। তার পুত্র, কন্যা, বোন ও তাদের ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে বাংলাদেশে ভ্রমণে আসেন এবং একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে, বিশেষত সরকারি রাজনৈতিক দলের লোক হিসেবে দেশের লোককে অনেক উপদেশ ও পরামর্শ খয়রাত করেন। এদেশ থেকে যা নেয়ার সেটা তারা ইংল্যান্ড-আমেরিকায় জমা করে নিজেদের ঘর গোছাতে ব্যস্ত থাকেন। অনেক দেশেই পারিবারিক শাসন কায়েম থাকলেও এভাবে জনবিচ্ছিন্ন ও দেশ বিচ্ছিন্ন কোনো পরিবারের শাসন দুনিয়াতে আর দেখা যায় না। অন্য যেসব দেশে কোনো না কোনো ধরনের পারিবারিক শাসন আছে তারা দেশেই থাকে, দেশেই বসবাস করে তারা সরাসরি দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রয়োজন হয় না। দিনরাত, প্রয়োজনে-নিষ্প্রয়োজনে মুখে দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার খৈ ফোটালেও দেশে থাকার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না। স্থূলভাবে কথাটি বলতে গেলে বলতে হয়, দেশপ্রেমের নামে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন থেকে নিয়ে হাজার রকম সুযোগ-সুবিধা আদায় করাই তাদের আসল কাজ। দেশে আসা-যাওয়া এবং দেশের রাজনীতিতে ঢিলেঢালা অংশগ্রহণ এ উদ্দেশ্যেই তারা করে থাকে।

নির্বাচনের মাঠে প্রকৃত অবস্থা যাই হোক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় তার দলের বিজয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই তার বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার কথা হল, গত পাঁচ বছরে তারা দেশের সব ক্ষেত্রে এত উন্নতি সাধন করেছেন, তার দিকে তাকিয়ে দেশের লোক তাদের ভোট না দিয়ে পারে না। বিরোধী দলের নেত্রীর উদ্দেশেও শেখ হাসিনা প্রায়ই বলছেন, তিনিও যে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বা দেখেন না তা নয়। কাজেই সবকিছু জেনেশুনেই তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে ভোটের বাক্স ভারি করার চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, এসব দেখার কোনো অসুবিধা হলে তার উচিত নিজের চোখের চিকিৎসা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ জোরের সঙ্গেই বলছেন, দেশের লোক তাদের সুকীর্তির দিকে তাকিয়ে বিএনপিকে কিছুতেই ভোট দিতে পারে না। অবাক হওয়ার ব্যাপার, তিনি একথা বলছেন সদ্য অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির বিরাট জয় এবং নিজেদের শোচনীয় পরাজয়ের পর! শুধু এ কথাই নয়, প্রধানমন্ত্রী, তার পুত্র, আজ্ঞাবাহী মন্ত্রীরা এমন আরও সব কথা নিজেদের নির্বাচনী প্রচারে বলছেন, যা শুনে সভাস্থলে উপস্থিত শ্রোতারা বেশ মজা পাচ্ছেন!!
প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ভোটারদের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তারা প্রথম বিপ্লব সফল করেছেন। এখন সময় এসেছে দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার। এই ‘মহৎ’ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আর একটি আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া অন্য উপায় নেই। আওয়ামী লীগই পারে বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করতে! ওই দ্বিতীয় বিপ্লবের মর্মার্থ বোঝা জনগণের পক্ষে মুশকিল। প্রায় অসম্ভব। কারণ আওয়ামী লীগের প্রথম বিপ্লবটি কী সেটা তারা জানেন না। তারা শুধু জানেন, আওয়ামী লীগ তাদের বিগত পাঁচ বছরের শাসন আমলে দেশে এক চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এটাই হল আজকের বাস্তবতা। এই বাস্তবতার কারণে বিগত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়েছে। এই বাস্তবতার দিক থেকে চোখ সম্পূর্ণ অন্যদিকে সরিয়ে রেখে এক কাল্পনিক ও ইচ্ছাপূরণের ভাবনার মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে প্রধানমন্ত্রী, তার সফরকারী পুত্র এবং আজ্ঞাবাহী মন্ত্রী ও দলীয় নেতা-নেত্রীরা নিজেদের নির্বাচনী জনসভাগুলোতে যেসব কথা বলছেন তার থেকে বোঝা যায় এ সরকার এবং এই দলটির ও এদের জোটের জনবিচ্ছিন্নতা। এই জনবিচ্ছিন্ন লোকদের বক্তৃতা শুনে যে শ্রোতারা বেশ মজা পাচ্ছেন এটা আগেই বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারি অর্থ ব্যয় করে যে সভাগুলোর আয়োজন করছে সেগুলোতে মানুষ আসছে মেলা দেখতে আসার মতো করে। এগুলোতে লোকের সমাগম সত্তে¡ও মনে করার কারণ নেই যে, এসব লোক নিজেদের ভোট আওয়ামী লীগের বাক্সে ফেলবে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ভোট দাও ভোট দাও বলে মানুষের কাছে অশøীল কায়দায় ভোট চাইছেন এবং কারা তাদের ভোট দেবেন তাদের হাত তুলতে বলছেন, এর একটা প্রতিক্রিয়া মানুষের মধ্যে হচ্ছে। এটা এমন এক ধরনের ছ্যাবলামি যা কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মানায় না। কিন্তু যে দেশে ছ্যাবলামি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নেই।
তবে আওয়ামী লীগের এ অবস্থা দেখে মনে করার কারণ নেই যে, আগামী নির্বাচন যেভাবে এবং যখনই অনুষ্ঠিত হোক, তাতে বিরোধী দল ক্ষমতায় এসে পরিস্থিতির কোনো উলেøখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাবে। এমন আশার কোনো শর্ত বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে নেই। মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও এর আগে দু’বার ক্ষমতায় এসেছে। তাদের ক্ষমতার ব্যবহারের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। ক্ষমতার ব্যবহারের স্টাইলের পার্থক্য ছাড়া। তাছাড়া বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর মতো এমন একটি রাজনৈতিক দলকে নিজের গাঁটছড়ায় শক্তভাবে বেঁধে রেখেছে, যে দলটি দ্রুতগতিতে ক্রিমিনালাইজড হয়ে ইতিমধ্যে ভয়াবহ চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত এবং বিএনপি বিরাট বিজয় অর্জন করবে। কিন্তু বিএনপির এ বিজয়কে জনগণের বিজয় মনে করা ভুল হবে। জনগণ আওয়ামী লীগকে তার গত পাঁচ বছরের কৃতকর্মের জন্য, তাদের চুরি, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটতরাজ, ঔদ্ধত্য, নির্যাতন ইত্যাদির জন্য শাস্তি দেয়ার আকাক্সক্ষার মধ্যেই আগামী নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য বিজয়ের কারণ নিহিত থাকবে।
বাংলাদেশে সবকিছু মিলিয়ে এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের জন্য সৃষ্টি করেছে এক অনিবার্য শর্ত এবং উর্বর ক্ষেত্র। এ কারণে বাংলাদেশ এখন সর্বপ্রকার দেশী-বিদেশী চক্রান্তের লীলাভূমি। দেশের এ অবস্থায় ‘দেশ কোন পথে?’- এ প্রশ্ন খুব বাস্তবসম্মত হলেও এর কোনো সঠিক জবাব দেয়া এখন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

দূষিত রাজনীতির দায় শিক্ষিত সমাজেরও

image39

বাংলাদেশের রাজনীতি বা রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। নব্বইয়ের পরে যে ‘গণতান্ত্রিক পর্বের’ যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন, এবার আমাদের রাজনীতি ক্রমশ গণতান্ত্রিক, সুস্থ ও ইতিবাচক হয়ে উঠবে। প্রথম কয়েক বছর মোটামুটি ভালো চললেও পরবর্তীকালে তা ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে। ক্রমে ক্রমে মূল ধারার রাজনীতি লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই রাজনীতিকে এখন ‘দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি’ বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।

তবে সত্যের খাতিরে বলা দরকার, সব রাজনৈতিক দল, নেতা বা কর্মীরা দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত নন। বড় দু-তিনটি দল, তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটি অংশ, সংসদ সদস্যদের একটি অংশ, অঙ্গসংগঠনের নেতাদের একটি অংশ এই দূষণ ও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত। মূল দলের তুলনায় সংখ্যায় তাঁরা কম হলেও দলে ও সরকারে তাঁরা খুব প্রভাবশালী। অনেক দুর্বৃত্ত দলের নীতিনির্ধারণেও জড়িত। তাঁদের দাপটে, সন্ত্রাসে, অর্থ-বিত্তের ক্ষমতায় ও আত্মীয়তার জোরে দলের নীতিবান, সৎ, সজ্জন ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীরা প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

আমার আজকের লেখা এই দুর্বৃত্ত রাজনীতিকদের নিয়ে নয়। তাঁদের সম্পর্কে অতীতে বহু লেখা হয়েছে। সচেতন মানুষ তাদের সম্পর্কে মোটেও বিভ্রান্ত নয়। আমার লেখার বিষয়: শিক্ষিত ও সচেতন মানুষদের ভূমিকা সম্পর্কে, যাঁরা এই দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নন এবং নির্বাচনে তাঁদেরই ভোট দেন। সাধারণ মানুষসহ শিক্ষিত জনগণের ভোটেই এসব দল নির্বাচিত হয় ও সরকার গঠন করে। এসব দল বন্দুকের জোরে ক্ষমতা লাভ করে না। তারা ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় গিয়ে যত অনাচার করে।
এখানে শিক্ষিত ও সচেতন জনগণকে আমরা দুভাবে দেখতে চাই। ক. রাজনৈতিক দলের প্রতি মোহহীন শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ, খ. রাজনৈতিক দলের প্রতি মোহগ্রস্ত, দলের প্রতি অন্ধ, দলের প্রতি অনুগত শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ। দ্বিতীয় গ্রুপের (খ) ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই না। কারণ, তাঁদের অনেকেই ব্যক্তিত্বহীন, নিজের বিবেক বা বিবেচনাবোধ নেই, দলকানা ও দলদাস। আশার কথা, পুরো শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তুলনায় এদের সংখ্যা খুবই কম। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী স্বাধীন চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতে পারেন। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁরা অনুগত নন। হয়তো অনেকে একটি দল সমর্থন করেন।

সেই দলকে ভোটও দেন। কিন্তু দলের সমালোচনা করতে কুণ্ঠা বোধ করেন না। নিজের পদোন্নতি বা বৈষয়িক কোনো লাভের জন্য তাঁরা দল সমর্থন করেন না বা ভোট দেন না। দেন নীতিগত কারণে, মনের তাগিদে।
আমাদের বড় দু-তিনটি দল নানা অগণতান্ত্রিক কাজে ব্যাপৃত, নানা সন্ত্রাসী কাজে ম“ দেয়। দলীয় নেতারা (মন্ত্রী) দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আরও নানা অপকর্ম করেন। প্রায় দেখা যায়, তার প্রতিবাদে শিক্ষিত-সচেতন জনগোষ্ঠী তেমন সোচ্চার নন। তাঁরা নেতাদের এই অপকর্মগুলো দেখেন, বুঝতেও পারেন। কিন্তু নিজেদের পরিমণ্ডলে বা প্রকাশ্য সভায় অপকর্মের প্রতিবাদ করেন না। জোরালো ভাষায় নিন্দা করেন না।

সুযোগ থাকলেও রুখে দাঁড়ান না। এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতায় তাঁরা আক্রান্ত। শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ অপরাজনীতির প্রতিবাদ বা সমালোচনা করে লেখালেখি করেন বা কথা বলেন। বাকিরা যে অপরাজনীতিতে ক্ষুব্ধ হন না, তা নয়। তাঁরাও ক্ষুব্ধ। কারণ, তাঁদের আশপাশে প্রতিদিন অপরাজনীতির নানা প্রকাশ তাঁরা দেখতে পান। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে তাঁরা নীরব থাকেন।
আমরা এখানে বারবার ‘শিক্ষিত’ শব্দটি ব্যবহার করছি। আসলে বাংলাদেশে শিক্ষিত লোকের সংজ্ঞা খুব স্পষ্ট নয়। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ডিগ্রি নিলেই সমাজ তাঁকে শিক্ষিত বলে বিবেচনা করে। কিন্তু ডিগ্রি অর্জন করলেই তাঁকে কি প্রকৃত শিক্ষিত বলা যায়? তিনি কি দেশ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকার, প্রশাসন ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন? ডিগ্রিধারীদের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ দেশ নিয়ে ভাবেন। আমরা এই নিবন্ধে যাঁদের শিক্ষিত বলছি, তাঁদের মনে হয় ‘সুশিক্ষিত’ বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। বাংলাদেশে শিক্ষিত শব্দটির খুব অপপ্রয়োগ দেখা যায়।
যার যার অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা একজন সুশিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তির কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। সেই প্রতিবাদ রাজনৈতিক দলের মতো সহিংস প্রতিবাদ হবে না। সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, লেখালেখি, টিভি টক শো, বিবৃতি ইত্যাদি ভঙ্গিতে হবে। কিন্তু ব্যাপকভাবে হবে। সোচ্চারভাবে হবে। এটা আমাদের আশা। কিন্তু বাস্তবে আমরা তা দেখি না।
দেশে পেশাজীবীদের নানা ফোরাম রয়েছে। দুঃখের বিষয় বেশির ভাগ ফোরামই (সব নয়) বড় দুটি দল দ্বারা প্রভাবিত এবং কোনো কোনোটি রীতিমতো নিয়ন্ত্রিত। ‘পেশাজীবী ফোরাম’ যদি রাজনৈতিক দলের প্রভাবে বা নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়, তাহলে তা আর পেশাজীবী ফোরাম থাকতে পারে না। পেশাজীবী ফোরামগুলো তাদের পেশাসংশিøষ্ট সরকারের ভুল নীতির প্রতিবাদ, অপরাজনীতির কারণে তাদের পেশা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এগুলো নিয়ে সোচ্চার হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। এখানেও বিভিন্ন পেশার নির্দল ব্যক্তিরা অপরাজনীতির ও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁদের নীরবতা দিয়ে।
আজ যদি সচেতন ও সুশিক্ষিত নির্দল নাগরিক সমাজ সরকারের ভ্রান্তনীতি ও দেশের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সোচ্চার থাকত এবং সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে (দলের স্বার্থে নয়) নানা দাবি তুলত, তাহলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। আজ দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দলীয়করণ, নানা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন না দেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার, সংসদ বর্জন, রাজপথে প্রতিবাদের নামে সন্ত্রাস, হরতালের নামে সন্ত্রাস, সরকারি ব্যাংক ও নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও চরম অব্যবস্থাপনা, ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, বড় দুটি দলে একনায়কত্ব, পরিবারতন্ত্র, দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা না হওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য, কিছু মিডিয়ার তথ্য-সন্ত্রাস—এ রকম ১০০টি বিষয় লিপিবদ্ধ করা যায়, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো প্রতিটি সুশিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।
আমাদের অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক দুর্নীতি ও সামগ্রিক অপরাজনীতির বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেন না। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলেন। প্রবন্ধ লেখেন। নিঃসন্দেহে এগুলো খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু দেশের রাজনীতি যদি সুস্থ না হয়, গণতান্ত্রিক না হয়, বিচারব্যবস্থা যদি পক্ষপাতমুক্ত না হয়, জাতীয় সংসদ যদি কার্যকর না হয়, সরকারি প্রশাসন, সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি নিয়ম-নীতি বাদ দিয়ে দলীয়করণের নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে বুদ্ধিজীবীদের দাবি ও প্রত্যাশা কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে?
আমরা প্রায় দূষিত রাজনীতির জন্য রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করি। নিন্দা করি। দূষিত রাজনীতি ও দুর্বৃত্ত নেতাদের যারা প্রশ্রয় দেয়, আমরা তাদেরও সমালোচনা করি। কিন্তু নির্দল নাগরিকও কি এ জন্য কম দায়ী? সবাই ভোট দিয়েই তো তাঁদের নেতা বানিয়েছি। আমাদের ভোটে জয়লাভ করেই তারা সরকার গঠন করে। আমরা তো তাদের ভোট না দিয়ে প্রত্যাখ্যান করিনি। অযোগ্য লোকদের নেতা ও সাংসদ করার জন্য আমরা কি কম দায়ী? আজ যদি দেশের সব সুশিক্ষিত ও সচেতন মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন, নিয়মিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতেন, তাহলে দুর্নীতি ও অপরাজনীতি এতটা বিস্তার লাভ করত না।

নাগরিক সমাজ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আজ সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত ব্যক্তিরা দেশের নেতা হতে পেরেছে। অযোগ্য ব্যক্তিরা দেশের কর্ণধার হয়ে উঠেছে। রাজনীতি আর লুটপাট আজ সমার্থক হয়ে গেছে। এই রুগ্ণ পরিবেশে সৎ, সজ্জন, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সেবা থেকে দেশ আজ বঞ্চিত।
আবার নির্বাচন আসছে। আবার একটি দল বা জোট সরকার গঠন করবে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্দল নাগরিক সমাজের উচিত এখন তাদের কর্তব্য কী, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনা এবং সরকারের কর্তব্য

image29

ঘটনাটি ঘটেছে গত পরশু রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সিলেটে বিকেলের দিকে। সে রাতেই খবরটি লন্ডনে পৌঁছে যায় এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির অধিকাংশই জেনে যায় যে সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাসদ যখন যুক্তভাবে জনসভা করছিল, তখন ছাত্রলীগ ওই জনসভার ওপর হামলা চালায়। এ হামলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অন্যূন ২৫ জন আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক খবরে জানা গেছে।

খবরটি জানার পর এ আকস্মিক হামলার কারণ কী, এটি কি পরিকল্পিত, না অপরিকল্পিত হামলা, তা জানার জন্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর ঘেঁটেছি, সিলেট ও ঢাকার বন্ধু-বান্ধবের কাছেও জানতে চেয়েছি। তাঁরা কেউ কারণটি আমাকে জানাতে পারেননি। কিন্তু দলমত-নির্বিশেষে দেশের সব মহল এই গুণ্ডামি ও হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এই নিন্দায় আমিও নিজের কণ্ঠ মেলাতে চাই।
এটি যে ছাত্রলীগ নামধারীদের হামলা নয়; বরং সিলেটের ছাত্রলীগেরই হামলা- এটা এখন বিতর্কিত ব্যাপার নয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এই দুষ্কর্মের জন্য সিলেটের ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করেছে এবং সিলেট জেলা ও সিটি আওয়ামী লীগের নেতারা গিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জনসভায় অন্যান্য নেতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সারা দেশেও এর প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সিলেটে এই গুণ্ডামির প্রতিবাদে পরের দিন সোমবার যে অর্ধদিবস হরতাল ডাকা হয়েছিল, তাতে বিএনপিসহ অনেকেই সমর্থন জানিয়েছে এবং হরতালটি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন দলের নেতারাও স্বাভাবিকভাবেই এই সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তপনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
আমি অনেক ভেবেও বুঝতে পারছি না, বেছে বেছে কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদের জনসভায় ছাত্রলীগের এই হামলা কেন? এ দুটি দলই আওয়ামী লীগের মহাজোটে না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের শিবিরের দল। কমিউনিস্ট পার্টি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিজে একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তা ছাড়া আজ পর্যন্ত সিপিবি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে যোগ দেয়নি, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করেছে। তাদের মিটিং-মিছিলও সব সময় শান্তিপূর্ণ। জানা যায় সিলেটের জনসভাটিও ছিল শান্তিপূর্ণ।
বক্তারা হয়তো সরকারের কোনো কোনো কাজের কঠোর সমালোচনা করে থাকতে পারেন, কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মতো উসকানিমূলক কথাবার্তাও বলেননি। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম শুধু একজন নিষ্ঠ বাম রাজনীতিকই নন, বর্তমানে একজন রাজনৈতিক কলামিস্টও। তাঁর লেখা আমি নিয়মিত পড়ি। তিনি বাম রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেন। তাতেও আওয়ামীবিদ্বেষী নেই এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোনো মিথ্যা প্রচারণাও নেই।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সমমনা দুটি বাম রাজনৈতিক দলের সভায় সিলেট ছাত্রলীগের এই হিংস্র আক্রমণ কেন? খবরে পড়েছি, সিলেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাবেন, তাঁকে সংবর্ধনাদানের প্রস্তুতি হিসেবে সিলেট ছাত্রলীগ ওই রবিবারই (১৫ সেপ্টেম্বর) শহরে একটি শোভাযাত্রা বের করেছিল এবং কমরেড সেলিমদের জনসভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। জনসভাটিও চলছিল শান্তিপূর্ণভাবে। তাহলে সিলেট ছাত্রলীগের মিছিলটির মধ্যে উত্তেজনা ও হিংস্রতা কেন দেখা দিল এবং তারা সমমনা গণতান্ত্রিক দুটি দলের সভা ভাঙতে গেল কেন, তার কোনো কারণ আমি এখনো জানতে পারিনি।
দেশের গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক দলগুলো, বিশেষ করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী জামায়াত, হেফাজত, ছাত্রশিবির প্রভৃতি সংগঠন যখন হরতাল, শোভাযাত্রার নামে গাড়ি পোড়ায়, দোকানপাটে ভাঙচুর করে, আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী শক্তি দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দেয়, তখন ছাত্রলীগের একশ্রেণীর বীরপুঙ্গবের বীরত্ব কোথায় থাকে তা জানতে ইচ্ছে করে।
এটি একটি রহস্য কি না আমি জানি না। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মীকে দেখা যায়, দেশের প্রকৃত সন্ত্রাসী দলগুলোর বিরুদ্ধে নয়, গণতন্ত্রমনা, শান্তিপ্রিয় দল-বিশেষের ওপর হামলা চালিয়ে তারা বীরত্ব দেখাতে বেশি পছন্দ করে। প্রথম হাসিনা সরকারের আমলেও দেখা গেছে কমিউনিস্ট পার্টির একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর আওয়ামী লীগের তৎকালীন মায়া বাহিনীকে অকারণে হামলা চালাতে। সেবারও ওই কমিউনিস্ট শোভাযাত্রার এক নেতা (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমই কি না আমার মনে পড়ছে না) আক্রান্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত পুলিশ দিয়ে তাঁদের লাঠিপেটা করারও চেষ্টা হয়েছিল।
সেবারও কমিউনিস্ট নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগ দুঃখ প্রকাশ করেছিল, এবার ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এই ক্ষমা চাওয়া এবং সিলেটের ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার মধ্যেই এরূপ একটি হিংস্র ও দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক ঘটনার সমাপ্তি টানা উচিত বলে সিলেট আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারা কি মনে করেন? নাকি এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার আর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য দলের বা সহযোগী সংগঠনের দোষী প্রমাণিত নেতা ও কর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের পদক্ষেপ তাঁরা নেবেন? আওয়ামী লীগ সরকারেরও কি উচিত নয়, তারা যখন দেশ থেকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি উচ্ছেদের কথা বলে, তখন এই মহৎ কাজটি নিজেদের দলের ভেতর থেকেই শুরু করা?
আমি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম। এ জন্য বর্তমান ছাত্রলীগের অবস্থা দেখে আমার লজ্জা হয়। এ অবস্থার জন্য ছাত্রলীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের দোষ দিই না। তাঁদের অনেকের মধ্যেই অতীত ছাত্রলীগের আদর্শবাদ মরে যায়নি, তার প্রমাণ পাই। কিন্তু ছাত্রলীগের ওপরের স্তরের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী, যাঁরা সরকার ও ক্ষমতার কাছাকাছি, তাঁরা অনেকেই চরিত্রে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মতো দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লাইসেন্সবাজি, খুনোখুনিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন যে এর প্রতিকারের উপায় কী তা কেউ বলতে পারছেন না।
আমাকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের এক প্রভাবশালী সদস্য বলেছেন, ছাত্রলীগ থেকে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই বের করে দেওয়া যায়। মুশকিল হয়েছে, তাহলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। আমাদের দেশের রাজনীতি এখনো ছাত্র ও যুবশক্তির ওপর নির্ভরশীল। ইউরোপে বৃহৎ শক্তির মধ্যে একতরফা নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলন সফল করা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি আমাদের দেশেও একতরফা অহিংস ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাস ও গুণ্ডামির মুখে ছাত্রলীগ যদি শুধু ভদ্রলোকের ছাত্র সংগঠন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আওয়ামী লীগ এক দিনও মাঠের রাজনীতিতে থাকতে পারবে না। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে কী ঘটল দেখলেন না? ছাত্রলীগ সরে আসতেই মঞ্চ দুর্বল হয়ে পড়ল, হেফাজতিদের উত্থান ঘটল।
আমি এই সরকারি নেতাকে বলেছি, ঠিক আছে, ছাত্রলীগেরও মাসল পাওয়ারের দরকার আছে এবং আওয়ামী রাজনীতির জন্য ডিফেন্স লীগ হিসেবে কাজ করার আবশ্যকতা আছে, তা মানছি। কিন্তু ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী যখন অফেন্সে যায় এবং তা গণবিরোধী চক্র ও শক্তিগুলোকে প্রতিহত করার জন্য নয়; বরং গণতান্ত্রিক শিবিরের সমমনা দলগুলোর বিরুদ্ধে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের একই কায়দায় গুণ্ডামি করে, তখনই আপত্তি করতে হয়। ছাত্রলীগ যখন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কায়দায় হল দখল, চাঁদাবাজি, লাইসেন্সবাজি ও রক্তাক্ত আত্মদ্ব›েদ্ব লিপ্ত হয়, তখন তা কি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যই দুর্নাম ও কলঙ্ক বয়ে আনে না? যে ছাত্রলীগ ছিল এককালে গণজাগরণের অগ্রদূত, আওয়ামী লীগের শক্তি ও সুনামের উৎস, তা আজ আওয়ামী দল ও সরকারের জন্য দুর্নামের উৎস ও লায়াবিলিটি- এ অবস্থা কি মেনে নেওয়া যায়? ছাত্রলীগের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস আগামী সাধারণ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জন্য এক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
সিলেটের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সিলেটের ছাত্রলীগের কমিটিকে বাতিল করেছে এবং ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করছে। এখানেই তাদের দায়িত্ব পালনে ইতি টানলে ভুল করা হবে। এ ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং সারা দেশে ছাত্রলীগের ভেতরে চিরুনি অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে জড়িত দুর্বৃত্তদের বহিষ্কার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ একবার বলেছিলেন, ‘২০০৮ সালে ক্ষমতার হাত বদলের পর ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির থেকে বহু দুর্বৃত্ত ছাত্রলীগে এসে অনুপ্রবেশ করেছে।’ সৈয়দ আশরাফের এ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে সরকার ও আওয়ামী লীগ কেন যৌথভাবে ছাত্রলীগের সৎ ও নিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের সহায়তায় এই অনুপ্রবেশকারী দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অগ্রসর হয়নি?
দেশে ছাত্ররাজনীতি ও সংগঠনে যেহেতু সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ঢুকেছে, সেহেতু ছাত্ররাজনীতি কিছুকালের জন্য নিষিদ্ধ করার কথাও কেউ কেউ বলেন। এটি মাথাব্যথা দূর করার জন্য মাথা কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়ার মতো। দেশে শুধু বড় ছাত্র সংগঠনগুলোতেই সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ঢোকেনি, বড় রাজনৈতিক দলগুলোতেও এর প্রাবল্য ঘটেছে। বস্তুত রাজনীতির বৃহৎ অঙ্গনের সন্ত্রাস ও দুর্নীতিই আজ ছাত্ররাজনীতিতেও গিয়ে ঢুকেছে। উৎসের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বন্ধ না করলে দেশের ছাত্ররাজনীতিকেও এই রোগ থেকে মুক্ত করা যাবে না।
দেশে সামাজিক অবস্থার দ্রুত অবক্ষয়, শিক্ষিত বেকারের দ্রুত হার বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাত্ররাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। যে ছাত্রলীগ ছিল দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নিরাপত্তার লেঠেল, সেই দল কেন আজ সমমনা গণতান্ত্রিক দলের সভায় হামলা চালিয়ে গণতন্ত্র নিধনের লেঠেল হতে চায়, সরকারকে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং এর প্রতিকারপন্থা উদ্ভাবন করতে হবে। ছাত্রলীগ থেকে দুর্বৃত্ত বিতাড়নের ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সরকারের উচিত, গোটা ছাত্ররাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন রোধ করার জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় কিছু আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
ইউরোপের কোনো কোনো দেশে ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য কিছু গাইডলাইন তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বর্তমানে দেশে ছাত্ররাজনীতির নামে যা ঘটছে- ভিসিকে ঘেরাও, শিক্ষক প্রহার, শিক্ষাঙ্গন লণ্ডভণ্ড করা, শিক্ষাঙ্গনে গোলাগুলি চালানো ইত্যাদি অত্যন্ত লজ্জাকর। এর প্রতিকারপন্থা উদ্ভাবনের জন্য সরকার সব দলমতের মানুষ, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বৈঠকে বসতে পারে, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে দেশে গঠনমূলক ছাত্ররাজনীতির একটি গাইডলাইন তৈরি করে তাকে আইনে রূপান্তর ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে পারে। তাতে রাতারাতি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির সব সমস্যা দূর হবে তা নয়, কিন্তু ছাত্ররাজনীতিকে বর্তমানের অসহনীয় দুর্বৃত্তপনা থেকে মুক্ত করার একটি উদ্যোগের সূচনা হবে।

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

সমঝোতার দরজা খুলছে না সরকার

image10

সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার দুয়ার খুলতে কূটনীতিকরা পর্দার অন্তরালে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। সরকার ও বিরোধী দলের নেতা ছাড়াও সিভিল সোসাইটির সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসতে এক পায়ে খাড়াই নয়, রীতিমতো দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু সরকার সংলাপ-সমঝোতার দরজা খুলছেই না। দূতিয়ালদের বিশ্বাস সংলাপ-সমঝোতার দরজা খোলার চাবি এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। বল এখন প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে। কূটনীতিকরা বিরোধী দলকে যেমন সহিংসতার পথ ছেড়ে নির্বাচনে যেতে চাপ দিচ্ছেন, তেমনি সরকারকেও সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছতে বলছেন। বিরোধী দল বিএনপি কূটনীতিক ও দাতাদের কারণেই জনমত পক্ষে টানতে জনসভা কর্মসূচি দিয়েছে। এখনই সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছে না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে জনসভা করে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে নির্বাচনের ঢেউ তুলতে চাচ্ছেন।

আর বিএনপি মনে করছে, সরকারের বাইরে যারাই কথা বলছেন তা তাদের পক্ষেই জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও তাদের দাবির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। আন্দোলন শেষ অস্ত্র হিসেবেই রাখছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়ায়, পরিণতি কী এই ভেবে।শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপের প্রস্তাব গ্রহণ না করে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে দাবি মানতে ৪৮ ঘণ্টার যে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন তার অজুহাত দিয়ে সরকার এখন সংলাপে বসতে নারাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, বিরোধী দলের নেতা ট্রেন মিস করেছেন। সংবিধান থেকে তার সরকার একচুলও নড়বে না। সংবিধানে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই নির্বাচন হবে। এমনকি তিনি সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, বিরোধী দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সরকার সংবিধান থেকে একচুলও নড়তে নারাজ। এদিকে বিরোধী দল সংবিধানের আওতায় সমঝোতার জন্য সংলাপে বসতে চায়। তাদের সর্বশেষ অবস্থান সরকার সংবিধান সংশোধন করতে না চাইলে উভয়পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে দুই দিক থেকে সংসদের ১১ জন সদস্যকে পদত্যাগ করিয়ে শূন্য আসনে গ্রহণযোগ্য ১১ জন নির্দলীয় ব্যক্তিকে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় বিজয়ী করে আনা। তারাই অন্তর্র্বতী সরকার হিসেবে নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করবেন। সরকার এই ফর্মূলাও মানতে নারাজ।
তাদের ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হবেন। আর নির্বাচনকালীন তার অধীনে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দল থেকে আনুপাতিক হারে সদস্য নিয়ে গঠন করবেন ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভা। এতে বিএনপির ভাগ্যে ক’জন পড়বে সেই প্রশ্নও রয়েছে। তবুও সরকার এর বাইরে কোনো ছাড় দিতে নারাজ।তবে সরকার সংবিধানের আওতায় নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি সংলাপে এলে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সুযোগটি হাতে রেখেছে। বিএনপি মনে করে, নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ছাড়াও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনী বিধিবিধান, আচরণবিধি, সেনা মোতায়েন ও প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি সংলাপে প্রাধান্য পাবে।কূটনীতিকদের কাছে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে- তাদেরকে বাইরে রেখে সরকার নির্বাচন করতে চায় বলেই এমনটি বলছে এবং সংলাপ-সমঝোতার দুয়ার বন্ধ করে রেখেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বাসভবনে নৈশভোজ আড্ডায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বলেছিলেন, অনেকেই বলছেন আপনারা বিজয়ী হবেন, তাহলে নির্বাচনে যাচ্ছেন না কেন? নির্বাচনে যান। উত্তরে মির্জা ফখরুল বলেছেন, আমরা তো ক্ষমতার কথা বলছি না। আমরা ব্যবস্থার কথা বলছি। যে ব্যবস্থা ছিল সাংবিধানিক। পরস্পরের আস্থা ও বিশ্বাসের। সেটি নিয়ে সরকার সমাধানে না এলে যাই কি করে? ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের সঙ্গেও বিএনপি ক্ষমতায় এলে কূটনৈতিক সম্পর্ক কতটা ভালো থাকবে সেই প্রসঙ্গ স্থান পায়। পঙ্কজ শরণ নাকি বলেছেন, আমরা তো আপনাদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চাই। মির্জা ফখরুল বলেছেন, বিএনপি তো সব সময় বলে আসছে সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বের। তিনি বলেন, জনগণের মতামত নিয়ে উভয় দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়। তিনি বলেন, বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে অতীতে যাই হোক না কেন সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেবে না। দমননীতি হবে কঠোর। তিনি বলেন, অতীতে জঙ্গিবাদ দমনে তাদের ভূমিকাও খাটো করে দেখার মতো নয়। তিনি আলাপে আলাপে বলেন, ভারতকে তিস্তার পানিসহ পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে জনগণের সামনে আন্তরিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কোনো সরকারের পক্ষেই জনগণকে ক্ষুব্ধ করে কিছু করা যায় না। বৈঠকে নাকি পঙ্কজ শরণ বলেছেন কম, শুনেছেন বেশি।
সূত্র আরও জানায়, নৈশভোজ আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রসঙ্গই এসেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় জাতীয় নির্বাচন ও সরকার-বিরোধী দলের সমঝোতা। অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে মির্জা ফখরুল বললেন, আপনারা বিশিষ্ট নাগরিকরাও একটা উদ্যোগ নিতে পারেন। রেহমান সোবহান কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চান না বলে এ নিয়ে আগ্রহ দেখাতে নারাজ বলে জানান। সূত্র জানায়, বৈঠকে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল একজন ব্যক্তি আছেন কিনা যাকে সবাই গ্রহণ করবেন এবং তিনি হবেন নির্বাচনকালীন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধানমন্ত্রী- এ নিয়েও কথা ওঠে। কিন্তু তেমন কাউকেই নৈশভোজ আড্ডার অংশগ্রহণকারীরা খুঁজে পাননি এই সংসদে। বিএনপির ধারণা, তাদের মতো কূটনীতিকদের কেউ কেউ মনে করেন সরকারের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় একটি অংশ প্রধানমন্ত্রীকে তার অবস্থান থেকে সরতে দিচ্ছে না। তারা চায় বিএনপিকে বাইরে রেখেই নির্বাচন। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর দু-একজন সদস্য ছাড়াও দল ও সরকারের কেউ কেউ বলেছেন, এই মুহূর্তে তারা যদি সংবিধান থেকে সরে এসে বিরোধী দলের দাবির খানিকটা মেনে নেন, বিশেষ করে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা না থাকেন তাহলে এই সমঝোতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দল এতটাই শক্তি নিয়ে মাঠে-ময়দানে নামতে পারবে যে, তার সামনে মানসিক শক্তি হারিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা দাঁড়াতেই পারবে না। অনেকে এলাকাছাড়া হবে, অনেকে মানসিক শক্তি হারিয়ে ভোটের আগেই পরাজিত হয়ে পড়বেন। তাই বিরোধী দলের দাবি না মানার পরামর্শই দিয়ে যাচ্ছেন। আর সরকার ও দলের সব স্তরের মন্ত্রী-নেতাদের কণ্ঠে সংবিধান সংবিধান জিকির উঠেছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, সংবিধান যেখানে নিয়ে যাবে তারা সেখানেই যাবেন। এদিকে বিএনপির হাইকমান্ড কোনোভাবেই শেখ হাসিনার বা আওয়ামী লীগের অন্তর্র্বতী সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে নারাজ।
তাদের ভাষায়, এভাবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ামাত্রই আওয়ামী লীগ জোট ও তাদের প্রশাসন নতুন শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে। অন্যদিকে বিএনপি নেতা-কর্মী ও প্রার্থীরা স্নায়ুচাপে ভুগতে ভুগতে ভোটের লড়াইয়ে শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।সূত্র জানায়, কূটনীতিকরা বিএনপির ড. মঈন খান, শমসের মবিন চৌধুরী, ড. ওসমান ফারুক ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, কাজী জাফরউলøাহ এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।সূত্র জানায়, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কারামুক্তির পর প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দুই দফা টেলিফোন করে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মির্জা ফখরুল সেই প্রস্তাব তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ নেতাদের অবহিত করেন। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও দৃশ্যমান হয়ে সংলাপের কথা বলেছিলেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অনানুষ্ঠানিক আলোচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ড. মঈন খানকে। সময় নির্ধারণ করে বৈঠক চূড়ান্ত হয়েছিল। বিএনপির দুই নেতা অপেক্ষা করছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের জন্য। আশরাফ রওনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু একটি টেলিফোনে তার পা থেমে যায়। সামনে অগ্রসর না হয়ে ফিরে যান তিনি। সেই বৈঠক আর হয়নি। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা অবিরাম দুই পক্ষকে সংলাপে সমাধান খোঁজার তাগিদ অব্যাহত রাখেন। অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে সবার সঙ্গে যোগাযোগ-আলোচনা চালিয়ে যান। সর্বশেষ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে সংলাপে বসে দুই পক্ষকে সমঝোতায় আসার আহ্বানই জানাননি, সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেরও প্রত্যাশা করেন। দুই নেত্রী সংলাপে বসার আগ্রহ প্রকাশ করে যার যার অনড় অবস্থান জানাতে ভুলেননি। জাতিসংঘ মহাসচিবের দূতও সামনে ঢাকা আসছেন। সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপ-সমঝোতার দুয়ার তবুও খুলছে না। কিন্তু হাল ছাড়ছেন না কূটনীতিক ও দাতারা। শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গতকাল নরসিংদীর জনসভায় বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার আলোচনা চাইলে তারা প্রস্তুত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি বরাবর সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করতে আগ্রহী। সরকার সংলাপ করছে না। এখানে আন্তরিকতার ঘাটতি সরকারের। তাদের নয়। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউলøাহ বলেছেন, সংলাপে তারা আগ্রহী নন এটি ঠিক নয়। প্রধানমন্ত্রী সংলাপের আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন বিরোধী দলের নেতা তাতে সাড়া না দিয়ে উল্টো সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে হেফাজতের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশের অর্থনীতি, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে।

Posted in নির্বাচিত কলাম | Leave a comment

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud