পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

‘এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ’

Posted on June 15, 2017 | in নির্বাচিত কলাম | by
প্রভাষ আমিন :
মঙ্গলবার রাতে একজন জানতে চাইলেন, আচ্ছা, পাহাড় ধসের কি কোনও পূর্বাভাস দেওয়া যায়? দিনভর লাশ গুনতে গুনতে মন খারাপ ছিল। তাই কিছুটা রেগে গেলাম। বললাম, অবশ্যই যায়। আমি আপনাকে বলছি, আগামী বছর জুন মাসে আবার পাহাড় ধস হবে, আবার মানুষ মারা যাবে। কিন্তু এটা আসলে আমার রাগের কথা নয়। এটাই বাস্তবতা। এবারের আগে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। সে ঘটনায় প্রাণ দিয়েছিলেন ১২৭ জন। এরপর ২০০৮, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালে- মানে প্রায় নিয়মিত পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছেই এবং মানুষও মারা যাচ্ছে। তাই আমি নিশ্চিত জানি, আগামী বছর আবারও পাহাড় ধস হবে এবং মানুষ মারা যাবে।
অনেকেই পাহাড় ধসকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দায় এড়াতে চাইছেন। কিন্তু পাহাড় ধসকে আমি মোটেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখতে রাজি নই। আমি বরং একে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে দেখতে চাই। আচ্ছা, পাহাড় ধস না হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিন্তু পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এ নিছকই হত্যাকাণ্ড; উদাসীনতায়, খামখেয়ালিতে আমরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছি। বুনো হাতি ধরার কৌশল জানেন, প্রথমে একটা খেদা বানানো হয়, যার একদিক খোলা রাখা হয়। তারপর বনে আগুন জ্বালিয়ে বা তীব্র আওয়াজ দিয়ে হাতিদের ভয় দেখিয়ে খেদার দিকে তাড়িয়ে আনা হয়। হাতির পাল খেদার ভেতর ঢুকলে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এটা একটা ফাঁদ। পাহাড়ও তেমনি ফাঁদ। মানুষগুলো বাধ্য হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে, আসলে মৃত্যু উপত্যকায় আশ্রয় নেয়। তারপর পাহাড় ধস হলে মরে একেবারে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। ধরুন, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় একই রকম পাহাড় ধস হলো, কিন্তু একজন মানুষও মারা গেলো না; তাহলে কিন্তু সেই ধস নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যথা থাকতো না। সেটা তখন ভূ-তাত্ত্বিক, পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতো। আমাদের অবহেলায় একজন মানুষের মৃত্যুও আমাকে বেদনার্ত করে। আর ১৩৫ জনের মৃত্যু আমাকে ক্ষুব্ধ করে, ক্রদ্ধ করে, সবকিছু তছনছ করে দিতে মন চায়। পারি না, অসহায় আক্রোশে কাঁদি, লিখে মনের ঝাল মেটাই। মঙ্গলবার সকালে ঘুম ভাঙে ৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়ে। বুধবার সকালে পত্রিকার শিরোনাম, ১৩৫ জনের মৃত্যুর খবর। বুধবার আবার উদ্ধারকাজ শুরু হলে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। পেশাদার লাশ গুনকের মতো অফিসে বসে বসে লাশ গুনতে একদম ভালো লাগে না। আমাদের কাছে, মানুষগুলো যেন মানুষ নয়, নিছকই কিছু সংখ্যা। কথায় কথায় আমরা বলি, স্মরণকালের বৃহত্তম।
এতদিন পাহাড় ধসের কথা এলে আমরা ২০০৭ সালের উদাহরণ দিতাম। এখন থেকে ২০০৭ সালের ১২৭ জন চিরদিনের জন্য অতীত হয়ে যাবে। আমাদের স্মৃতি মনে রাখবে ২০১৭ সালের ধসের কথা। তবে আমার শঙ্কা প্রতিবছর না নতুন নতুন সংখ্যা জমা হয় আমাদের স্মৃতিতে।
পাহাড় ধসকে আমিও প্রাকৃতিক দুর্যোগই বলছি। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ত্বরান্বিত করার দায় আমাদের। প্রকৃতির একটা নিজস্ব সারভাইভাল সিস্টেম আছে। যেমন সিডরে ধ্বংসপ্রায় সুন্দরবনকে কিভাবে বাঁচানো হবে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সবাই মিলে ঠিক করলেন, সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, সুন্দরবনকে বিরক্ত না করা। সুন্দরবনকে নিজের মতো বেঁচে ওঠার সুযোগ দেওয়া। তাই হয়েছে। কিন্তু সমস্যা আমরা বারবার প্রকৃতির সেই সিস্টেমে আঘাত করি। প্রকৃতি কখনও কখনও পাল্টা আঘাত হানে। পাহাড়েরও বেঁচে থাকার, টিকে থাকার নিজস্ব সিস্টেম আছে। আমরা পাহাড় কেটে ঘর বানিয়ে, গাছ কেটে ন্যাড়া করে, রাস্তা বানিয়ে, নিজেদের মতো চাষবাস করে পাহাড়কে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করি। প্রকৃতি শৃঙ্খলিত হতে চায় না। প্রতিবাদ করে। পাহাড় কাটার কারণ বিশ্লেষণ করার মতো জ্ঞান আমার নেই। আমজনতার মতো সাদা চোখে দেখা কয়েকটা ছোট ছোট কারণ বলতে পারি। পাহাড়ে যদি প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর গাছ থাকতো, তাহলে বৃষ্টির পানির প্রথম আঘাতটা লাগতো গাছের পাতায়, তারপর সেটা দুর্বল হয়ে মাটিতে পড়তো। আর প্রাকৃতিক নিয়মে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে নেমে যেতো। আর গাছের শিকড় আকড়ে রাখতো পাহাড়ের মাটি। কিন্তু গাছ না থাকায় এবং নানাভাবে পাহাড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করায়, ফাঁক-ফোকর তৈরি করায় বৃষ্টির পানি প্রবল বেগে পাহাড়ের গায়ে আঘাত হানে এবং ফাঁক ফোকর দিয়ে পাহাড়ের  ভেতরে ঢুকে যায়। পানি ঢুকে ঢুকে আমাদের বালু আর মাটির পাহাড় ভেতরে ভেতরে ঝুরঝুরা হয়ে যায় এবং এরপর আরেকদফা প্রবল বর্ষণ হলেই ধসে পড়ে। ধস ঠেকাতে, পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে সবার আগে।
জরুরি প্রয়োজনে করলেও সেটা নিয়ম মেনে করতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাওয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম যেন বিঘ্নিত না হয়। বুয়েটের একজন বিশেষজ্ঞ, পাহাড়ে বিশেষ ধরনের ঘাস লাগাতে বলেছেন, যার শেকড় অনেক গভীর পর্যন্ত যায় এবং পাহাড়ের মাটিকে আকড়ে ধরে রাখতে পারে। তবে আমি যেহেতু পরিবেশবিদ নই, তাই পাহাড় বাঁচানোর সবগুলো নিয়ম আমি জানি না। নিশ্চয়ই আরও অনেক উপায় আছে। পাহাড় বাঁচানো নয়, আমার খালি ভাবনা মানুষ বাঁচানো। আমাদের দেশে মানুষ বেশি, তাই বলে মানুষের জীবনের দাম তো কম নয়। প্রত্যেকটি মানুষের জীবন অমূল্য। বিজ্ঞান অনেককিছু দিতে পারে, প্রাণ নয়।
তাই যে জীবন আমি দিতে পারবো না, সে জীবন আমাদের অবহেলায় কেড়ে নেওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। যদি দেশের বিভিন্নস্থান থেকে অসহায় মানুষদের নিয়ে পাহাড়ে জড়ো না করতাম, যদি পাহাড় কেটে বসতি না বানাতাম, যদি খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে বস্তি না বানাতাম তাহলেই অন্তত মানুষগুলো মারা যেতো না। আর এই মানুষগুলো তো সবার চোখের সামনেই বছরের পর বছর সেই মৃত্যু উপত্যকায় ঘর বানিয়ে থাকছে। শুধু দুর্গম পাহাড়ে নয়, চট্টগ্রামের শহরেও এমন অনেক মৃত্যু ফাঁদ আছে। প্রশাসন তাদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করে, মাইকিং করে দায়িত্ব শেষ করে। আর যে প্রভাবশালীরা  পাহাড় কেটে, পাহাড়ের পাদদেশে বস্তি বানিয়ে ভাড়া দেয়; প্রশাসনের নাকের ডগায় তারাই অসহায় মানুষগুলোকে সেখানে রাখে। শুধু মাইকিং করলে হবে না। প্রয়োজনে জোর করে, বিকল্প বাসস্থান ও বিকল্প কর্মসংস্থান করে এই মানুষগুলোকে সরিয়ে নিতে হবে।
পাহাড় ধসে যখন মানুষ মরছে, অনেকে যখন আটকে আছেন পাহাড়ের নানা কোনায়; এই ঘোর দুর্যোগে যখন অনেকের মাথায় ছাদ নেই; তখন ঢাকায় নিরাপদ অফিসে বসে বড় বড় কথা বলতে, লিখতে লজ্জা লাগছে, গ্লানি হচ্ছে। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ বলে দায় এড়াতে ঘৃণা হচ্ছে। এই মৃত্যু উপত্যকাই আমাদের দেশ। আমাদের সবার, বিশেষ করে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের দায়িত্ব সবার, প্রতিটি মানুষের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা। পাহাড়ের সাথে আগুন, সন্ত্রাস, মৃত্যু, ধস- এই শব্দগুলো আর শুনতে ভালো লাগে না। মৃত্যু নয়, পাহাড় হোক শান্তির উপত্যকা।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud