পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

মোদির বার্লিন ওয়াল ও মমতার ‘এক বাংলা’

Posted on June 7, 2015 | in নির্বাচন কমিশন | by

19869_1

 

রেজোয়ান সিদ্দিকী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির বাংলাদেশ সফরের আগেই এক বার্তায় বলেছেন, রাজ্যসভা ও লোকসভায় বাংলাদেশের সাথে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ভারতের যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, সে দেশের সংবাদপত্রগুলো তার মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে। তার এ চুক্তি স্বাক্ষর বার্লিন প্রাচীরের পতনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা মনে করি না যে, জনাব মোদি এটা অবহিত নন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার বিভক্তিরেখা হিসেবে বার্লিন ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৬১ সালে। বার্লিন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির রাজধানী। আর তার অপর প্রান্তেই ছিল যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম জার্মানি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে জার্মানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী যুদ্ধ করেছিল, সে জার্মানি পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ ছিল না। সে জার্মানির নেতা ছিলেন এডলফ হিটলার। তার সাথে প্রধানত যোগ দিয়েছিল ইতালি ও জাপান। সে যুদ্ধে জার্মানির অনিবার্য পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ভাগ-বাটোয়ারার অংশ হিসেবে বার্লিনসহ জার্মানির পূর্বাংশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং সেখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু করে। এভাবে ইউরোপের অনেক দেশই কার্যত দুই পরাশক্তির অধীনে চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। আর যুক্তরাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশগুলোতে চালু করে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
আর তখন থেকেই পৃথিবী দুই পরাশক্তির অধীনে চলে যায়। এই দুই পরাশক্তি দেশে দেশে তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আর সেই প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই পৃথিবীতে শীতল যুদ্ধের যুগ শুরু হয়। উভয় পরাশক্তিই প্রভাববলয় বিস্তারের ক্ষেত্রে কোনো নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না। প্রয়োজনে তারা সামরিক অভ্যুত্থানের পথ বেছে নিতেও পিছপা হয় না।
তবে বার্লিন ওয়াল জার্মান জাতির বিভক্তি কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থে মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন যত দ্রুত হচ্ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফ থেকে সে ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ক্ষতি হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের তা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। ফলে দ্রুত অন্যদের চিন্তা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেটুকু শক্তি তার ছিল, তার বেশির ভাগই তারা ব্যয় করছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঠাণ্ডাযুদ্ধ মোকাবেলায় সমরাস্ত্র নির্মাণের কাজে। ফলে অর্থনীতি গুছিয়ে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তখন বিভক্ত জার্মানির পূর্বাংশের কাছে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম জার্মানি হয়ে ওঠে ঈর্ষনীয় দেশ। ফলে পূর্ব জার্মানির লোকেরা সুযোগ পেলেই পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে যেত। আর সে জনস্রোত রোধ করতেই ১৯৬১ সালে এই দেয়াল নির্মাণ করা হয়। এক বার্লিন ওয়াল জার্মানির দুই অংশের মধ্যে যাতায়াতের পথ রুদ্ধ করেছিল বটে, তবে পশ্চিম জার্মানির উন্নয়নের খবর তাদের কাছে অজ্ঞাত থাকেনি। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের শত কর্তৃত্ব সত্তে¡ও পূর্ব জার্মানির সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতি হিসেবে একীভূত হওয়ার আকাক্সক্ষা ক্রমেই প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে। জার্মানরা জাতি হিসেবে কখনো আলাদা ছিল না। কেবল জবরদস্তিমূলকভাবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দিয়ে তাদের পৃথক করার চিন্তা বাতুলতা ছিল মাত্র। জার্মানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, ধর্ম কোনো কিছুই কখনো আলাদা ছিল না। এরকম একটি যূথবদ্ধ জাতিকে শুধু দেয়াল দিয়ে আলাদা করা যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নও তা পারেনি। ফলে জার্মানদের এক রাষ্ট্রভুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা দিনকে দিন প্রবলতরই হয়েছে। উপরন্তু পূর্ব জার্মানির লোকেরাও মনে করেছে যে, পশ্চিম জার্মানির সাথে একীভূত হলে তাদের জীবন-মানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
এক দিকে জার্মানদের এই আকাক্সক্ষা, অপর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ায় পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জবরদস্তিমূলকভাবে যেসব রাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তাদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের আকাক্সক্ষা আবার প্রবলতর হয়ে ওঠে এবং তারা আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে চায়। ভাঙন শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। লাটভিয়া-লিথুয়ানিয়া দিয়ে শুরু হয়েছিল সে ভাঙন। তার ধাক্কা এসে লাগে জার্মানিতেও।
এরই মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি উভয় এলাকায়ই একীভূত হওয়ার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। এ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা তত দিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে বার্লিন প্রাচীরের দুই পাশেই এই দেয়ালবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। আর তত দিনে প্রায় ৩৫ লাখ লোক পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে আসে। ফলে পূর্ব জার্মানি সরকার ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর ঘোষণা করে যে, পূর্ব জার্মানির নাগরিকেরা অবাধে পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণ করতে পারবে। আর তখনই শুরু হয়ে যায় বার্লিন প্রাচীর ভাঙনের প্রক্রিয়া। কৃত্রিমভাবে বিভক্ত জার্মানির লোকেরা উভয়প্রান্ত থেকে ভাঙতে শুরু করে বার্লিন প্রাচীর। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে দুই বার্লিন আবার একত্র হয়ে যায়। জার্মান জাতি পুনরায় এক জার্মানিতে পরিণত হয়।
ভারতের সাথে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনাকে বার্লিন প্রাচীরের পতনের সাথে তুলনা করে বসেছেন। এই স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে, এটি ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামে অধিক পরিচিত। এই চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় সাথে সাথেই বাংলাদেশ তা অনুমোদন করে। হস্তান্তর করে ছিটমহল কিন্তু নানা অজুহাতে ভারত ৪১ বছর ধরে এ চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করতে থাকে। জনাব মোদিকে ধন্যবাদ, তিনি ভারতের সংসদে তা অনুমোদন করিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এ চুক্তি অনুমোদনের ফলে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণই লাভবান হয়নি, ভারতীয় জনগণও সমানভাবে লাভবান হয়েছে। কিন্তু মোদি কথাটা এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যে, মনে হলো, জোর করে বিভক্ত করা ভারত ও বাংলাদেশ আবার একীভূত হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে মোদির ধারণায় ঘাটতি আছে বলেই মনে হয়।
নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসার আগেই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অনেক কাণ্ডই ঘটে গেছে। ভারত ব্যবহার করতে শুরু করেছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর। চালু হয়ে গেছে কলকাতা-ঢাকা-শিলং-আগরতলা বাস সার্ভিস। রেলপথ যাবে কলতাকা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা ও ত্রিপুরা। শিলং, আগরতলা বা ত্রিপুরায় বাংলাদেশীদের কোনো কাজ নেই। চিকিৎসা করাতে বা বেড়াতে যারা ভারত যান তারা যান কলকাতা হয়ে কিংবা বিমানে দিল্লি হয়ে অন্যত্র। আগরতলা, শিলং বা ত্রিপুরায় বেড়াতেও যান না কোনো বাংলাদেশী। সে পরিবেশও সেখানে নেই। ফলে এই রুট বাংলাদেশের জন্য অর্থহীন এক পথ। কিন্তু ভারতের জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্যত ভারত এই রুট ব্যবহার করবে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য। আর যা করবে, তা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে। ভারতের সাত রাজ্যে স্বাধীনতাকামীরা গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সেখানে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এসব পথে অস্ত্র ও সেনা পরিবহনের সুযোগ দিলে অকারণেই বাংলাদেশ ভারতের স্বাধীনতাকামীদের রোষানলে পড়বে। আর আমরা ওই সাত রাজ্যে যেটুকু পণ্য রফতানি করি, তাও বন্ধ হয়ে যাবে।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে গত ৪ জুন কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, রাজনীতি যাই থাকুক দুই দেশের মাটি এক, ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তাই দুই বাংলাকে আর আলাদা করা যাবে না। ঐক্যবদ্ধভাবে দুই বাংলা আরো নতুন নতুন রাস্তার পথ দেখাবে। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী ও রংপুর দিয়ে মালদহ ও শিলিগুড়ির পথে আরো দুটি বাস রুট চূড়ান্ত হওয়ার পথে রয়েছে। দুই বাংলার মধ্যে যাতায়াতের জন্য আরো দু’টি চেকপোস্টও চালু হচ্ছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, কয়েক হাজার ভারতবাসী আমাদের কাছে ফিরে আসবেন, এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এ ক্ষেত্রে মোদির কথার সাথে মমতার কথার কোনো ভেদ নেই। মমতার ভুলটা সম্ভবত এখানেই যে, দুই বাংলার পৃথক হওয়ার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে তিনি সম্ভবত পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল নন। পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) কেন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ভোট দিলো, কেন বাংলাদেশ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করল, এর পুরো ইতিহাস জানলে মমতা বা মোদি এমন কথা বলতেন কি-না, সন্দেহ। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা পাকিস্তান না ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা নিয়ে ১৯৪৭ সালে ভোটাভুটি হয়েছিল। তাতে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে পূর্ব বাংলায় ভোট দিয়েছিলেন ১৬৬ জন আর ভারতে থাকার জন্য ভোট দিয়েছিলেনমাত্র ৩৫ জন। আর পশ্চিম বাংলায় ভারতের পক্ষে থাকার জন্য ভোট দিয়েছিলেন ৫৮ জন, বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ২১ জন।
১৯৩৫ সালে ব্রিটেন ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করলে ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের শাসন চালু ছিল। তাদের প্রমাদ গুনেছিল ভারতীয় সাম্প্রদায়িক নেতারা। তারা ধরে নিয়েছিল যে, বাংলা যদি এক থাকে, তাহলে কোনো দিনই হিন্দুরা বাংলার রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারবে না। কারণ, তখনো বাংলায় ৬৭ শতাংশ লোক ছিল মুসলমান। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রধান ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলেছিলেন, গোটা ভারত যদি একটি রাষ্ট্র হিসেবেও স্বাধীন হয়, তাহলেও বাংলা ভাগ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাস্তায় মিছিল করেছেন, ব্রিটিশের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন যে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে এক লোক এক ভোট নীতি চলবে না (পড়–ন, জয়া চ্যাটার্জির বই ‘বাংলা ভাগ হলো’)। বাংলা ভাগ হয়েছে। আমরা পূর্ব বাংলার মানুষেরা যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আর পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় যূপকাষ্ঠে কেবলই খাবি খাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ও মমতা ব্যানার্জি উভয়েই যেন বিষয়টি তলিয়ে দেখেন।

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud