পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

ভাসছে মানুষ সাগরে, কাঁদছে মানুষ বিশ্বময়

Posted on June 12, 2015 | in আইন-আদালত, জাতীয় | by

BOATবিশ্বাবাসীর চোখ কিছুদিন আগেও আমাদের চারপাশের সাগরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেকেরই চোখ ভিজে গেছে নোনা জলে। যারা ‘মানুষ’ তারা এসব দেখে কাঁদে। সাগর আর এই মানুষগুলোর মধ্যে কি অদ্ভুত মিল। সাগরের পানি লবণাক্ত, মানুষের চোখের জলও তাই।
আবার অনেকেই আছেন, তাঁরা অর্থের লোভে মানুষকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। বিপন্ন মানুষগুলোকে জিম্মি করে কেউ কেউ টাকা আদায় করে। এরাও মানুষ বা মানুষের মতো। এদের মূল্যাবোধের সংকট এতটাই তীব্র যে, এরা বোঝে না, মানুষ মরে গেলে লাশ ভিন্ন অন্য কোনো পরিচয় তার থাকে না। একইভাবে যারা বিপন্ন, তাদেরও ‘মানুষ’ ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় খোঁজা উচিত নয়। কিন্তু সম্প্রতি দেখলাম, সাগরে ভাসছে মানুষ। অথচ মানবতা সেখানে নিরব।
কিছু মানুষ নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দিয়েছে উন্নত জীবনের সন্ধানে। এদের বেশির ভাগই পাশের দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। অনেকেই আমাদের বাঙালি। দুটি দেশের কেউই এই অসহায় মানুষগুলোর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এমন কি সরকারও। মিয়ানমার তো রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকারই করে না। ইতিহাসকে অস্বীকার করার রাজনীতি যে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, এমন দৃষ্টান্ত নিকট অতীতে কমই দেখা গেছে। এর মধ্যে আমাদের সরকার কেন যে জাতিগত সমস্যা আর ধর্মীয় অপপ্রচারকে গুরুত্ব দিয়েছে, তা বোধগম্য নয়। বিপন্ন মানুষের ধর্মীয় পরিচয় অনুসন্ধান করতে যাওয়াটা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে?
জাতিগত প্রশ্নে একই ভূখণ্ডের অধিবাসী হয়েও যেখানে আমরা ‘বাঙালি’ আর ‘বাংলাদেশির’ তর্কের সমাধান করতে পারিনি, সেখানে কীভাবে ভিন্ন একটি দেশের সঙ্গে আমরা এ সমস্যার সমাধান করবো। কয়েক বছর আগে জাপানে ইমিগ্র্যান্ট সমসা নিয়ে এক সভায় অংশগ্রহণ করে একটি খুব সুন্দর যুক্তি আমি খুঁজে পেয়েছি, যা কোথাও বলার সুযোগ হয়নি। জাপানের ৬৪টি জেলা কিন্তু সমানভাবে উন্নত না। সমানভাবে কর্মসংস্থানও নেই। যে কারণে এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় যায় কাজের সন্ধানে। একইভাবে এক দেশের মানুষ যায় অন্য দেশে উন্নত জীবন ধারণের আশায়। এতে অন্যায় বা দোষের কিছু নেই।
জাপানীরা এখন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যায় বেশি টাকা আয়ের উদ্দেশে কাজ করার জন্য। কিন্তু এক সময় তারাও নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেত কাজের সন্ধানে। তারাও অভিবাসী হিসেবে বসবাস করেছে ভিন্ন দেশে। ভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এখন অনেকেই এখানে আসে কাজের সন্ধানে। শুরুতে জাপানে অভিবাসীদের ভিসা ব্যবস্থা নিয়ে এতটা কড়াকড়ি নিয়ম ছিল না। এখন যতটা কড়াকড়ি। এর জন্য অভিবাসীরাই দায়ী। তারপরও মানুষ আসছে জাপানে। জাপানে আসার জন্য দেশে মানুষ লাখ লাখ টাকা ধার-দেনাও করে। কারণ সবার ধারণা, জাপানে আসলে লাখ লাখ টাকা রোজগার করতে পারবে খুব সহজে। আর তাদের মনে স্বপ্নের জাল বুনে দেয় মানবপাচারকারী দালালচক্র।
কয়েক বছর আগে বাংলাভিশনে আমার ছোট একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, আমাদের দেশের মানুষ খুব সরল প্রকৃতির। তাদের খুব সহজে বোকা বানানো যায়। প্রতারকদের কথায় বিশ্বাস করে জমিজমা বিক্রি করে তারা দেশান্তরি হয়। তাও কি না, কাঠের তৈরি নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে। উন্নত জীবনের হাতছানি মানুষকে এতটা দুঃসাহসী করতে, এ যেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। এমন চিত্রনাট্য রচনার ক্ষেত্র বন্ধ হওয়া উচিত। সেজন্য দরকার দেশের অভ্যন্তরে কাজের ক্ষেত্র বাড়ানো। তা না হলে মানুষ যে কোনো উপায়ে দেশ থেকে বের হবার পথ খুঁজতেই থাকবে। সেটা আকাশ বা সাগর, যে পথই হোক।
সাগর পথে একসময় পাশের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও অনেক বাঙালি জাপানে এসেছে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বা বসে। ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তাঁরা ঝুঁকি নিতে কার্পণ্য করেনি। এখনো যে যেভাবে পারছে, জাপানে আসছে। এখনো মানুষ মনে করে, জাপান বুঝি টাকার খনি। কিছুদিন আগেই দেখেছি, জাপানে একটি সংঘবদ্ধ চক্র মিউজিক কনসার্ট আয়োজনের কথা বলে ১৭২ জনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার কিছুদিন পরে জাপানের পত্রিকায় একটি সংবাদ চোখে পড়লো, অন্য একটি চক্র জাহাজে চাকরি দেবার কথা বলে বাংলাদেশ থেকে ২৪ জনকে জাপানে নিয়ে এসেছে মোটা টাকার বিনিময়ে। আসার পরেরদিন সবাই এক সঙ্গে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ইমিগ্রেশনে তাদের কাগজপত্র জমা দিতে গেলে পুলিশ তাদের সবাইকে আটক করে ফাটকে পুরে দিয়েছে। এসব ঘটনা অহরহ এখানে ঘটছে, যা আমাদের মোটেও কাম্য না।
আর যারা জাপান আসার যোগ্যতা বা সামর্থ্য রাখে না, তারাই কেবল নৌকায় করে মালয়েশিয়া বা সিংগাপুরে পাড়ি জমায়। এরা যে কোন উপায়ে গেলে সমস্যা হবার কথা নয়। গিয়ে যদি কোন ধরনের বিপদে না পড়ে। বিপদের পরলে জাত-মান-কূল সবই যাবে। আর যদি যাবার পর যথাযথ কাজ করার সুযোগ পায়, তাহলে এরা হয়ে যায় মানবসম্পদ। এদের উপার্জনকেই সরকার গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে বিদেশি রেমিট্যান্স বলে। সুতরাং এই মানবসম্পদ যেন কোনো দেশে ভুল পথে গিয়ে কোনো ধরনের বিপদে না পড়ে এবং দেশের যাতে কোন বদনাম না হয়, সে জন্য সরকারকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের দেশের সহজ-সরল মানুষগুলো যেভাবে দালালের খপ্পরে পরে বিপদে পড়ছে, সেটা দেখে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আর কী করার আছে? শুধু বলতে পারি, মানুষের এমন ভুল ভাঙানোর জন্য আমাদের দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা রাখা জরুরি। সচেতন করতে হবে, মানুষ যেন দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাড়ি না জমায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সম্প্রতি দেশে প্রচার হয়েছ বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে লোক আনা হবে জাপান। কোনো একটি পত্রিকাতেও পড়েছি এমন একটি সংবাদ। এই সংবাদ পড়ে অনেকেই জাপান আসার সেই সুযোগ খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির দালালও সক্রিয় হয়ে গেছে। তারা তাদের কৌশল যথারীতি প্রয়োগ করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
জাপানের বেলায় এমন ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। লোকদের কাছ থেকে দশ পনেরো লাখ টাকার বিনিময়ে লোক আনছে। এদের আনার পর কি হচ্ছে? সবাই কি আর সোনার হরিণ ধরতে পারছে?
জাপান উন্নত দেশ আর এখানকার উপার্জনও তুলনা মূলক ভাবে বেশি। তাই এই দেশে আসার জন্য দালালদের চাহিদাও বেশি। যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি আর মোটা অংকের টাকা পরিশোধের সামর্থ আছে তারাই কেবল জাপান আসার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যাদের দ্বারা এই ডিমান্ড পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই তারা স্বপ্ন দেখে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড কিম্বা সিংগাপুর আর ইন্দোনেশিয়া যাবার। এতে বিদেশ যেতে আগ্রহীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। যে জন্য সহজে অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে সক্ষম এই দালালেরা। কিস্তু এর কোন নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের বালাই নেই। নেই এসব তদারক করার সৎ লোকও। টাকার গন্ধ যেখানে আছে এবং সহজে টাকা রোজগারের পথ যেখানে খোলা, সেখানে সবই বদলে যায় ধর্ম আর আদর্শের কাছে। এই ক্ষেত্রে বলা যায়, যে যায় লংকায় সেই হয় রাবন।
সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখলাম সাগরে ভেসে বিদেশ পাড়ি দেবার বেশ কিছু করুণ চিত্রের ছবি। ছবির মানুষ গুলো তাদের পরিশ্রমের ফলে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাগ্য পরিবর্তনের চিন্তা করেই অন্ধের মতন ঝাপ দিয়েছিল এই পথে বিদেশ পাড়ি দেবার জন্য। আর তাদের এই চিন্তা সফল হলে দেশ পেতো রেমিটেন্স আর দেশই হতো বেশি লাভবান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লোক গুলো বিপদে পরে গেল। অথচ তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে না আমাদের দেশ বা সরকার।
এখানে কে রোহিঙ্গা আর কে বাংগালি সে বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে সাগরে ভাসমান বিপদের পরা ওরা মানুষ। ওদেরকে প্রথম মানবতার কারণেই উদ্ধার করতে হবে তারপরে না হয় জাতি ধর্ম বিচার করা। বিষয়টি অতি সম্প্রতি আলোচনায় কম আসলেও এর স্থায়ী কোন সমাধান এখন পর্যন্ত হয়নি। সাময়িকভাবে কিছু কিছু দেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত দেখালেও সময় সীমা তারা বেধে দিয়ে বলেছে, তাদের ফিরিয়ে আনার কথা। যেহেতু জাহাজে বাংলাদেশিও সংখ্যায় কম ছিল না সুতরাং আমাদের দেশকেই এগিয়ে আসা উচিৎ ছিল আগে। তাহলে আমাদের বর্তমান সরকারের অনেক ভালো কাজের মধ্যে এটিও যোগ হতো মানবিক দিক থেকে।
সম্প্রতি এই ধরনের সমস্যা আমাদের বাংলাদেশিদের নয় শুধু, পুরো মানবজাতির উপরই যেন বইছে এমন কোন না কোন ঘটনার প্রতিফলন। তবে অতি সম্প্রতি যে করুণ চিত্র আমরা দেখতে পেলাম, এর সুষ্ঠু তদন্ত করে এর সাথে জড়িত মূলহোতাদের যথাযথ শাস্তি দিয়ে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। দেশ থেকে যেন এই ভাবে আর কোন লোক বাইরে যেতে না পারে এবং বিদেশেও গিয়েও যেন সহজ সরল লোক গুলো কোন ধরনের বিপদে না পরে।
দেশ থেকে বাইরে যাবার এই হিরিক দেখে বাইরের দেশের মানুষ হাসতে পারে। পারে দেশের আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দুর্বলতার কথা অনুমান করতেও। সুতরাং আমাদের যত অর্জন তা যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল করতে হবে অবশ্যই। তা না হলে এভাবেই যেন ভাসবে মানুষ সাগরে আর হাসবে মানুষ এসব দেখে বিশ্বময়।

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud