April 24, 2024
আমাদের দেশের বিয়ের আসরগুলোর ধরণ পাল্টে গেছে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের বিয়ের অনুষ্ঠানের পুরোনো আবেগ ইদানিং হারিয়ে গেছে চাকচিক্যের ডামাডোলে। আপনি কল্পনা করুন তো, শেষ কবে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আপনার চোখে পড়েছে যেখানে জাকজমকপূর্ণ স্টেজ সাজানো নেই, হিন্দি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোমর দুলানো নেই, কিংবা সাধ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করার বিলাসিতা নেই? আর সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং সর্বাপেক্ষা প্রচলিত যে জিনিসটা, সেটা অবশ্যই শরীরভর্তি কৃত্রিম সাজসজ্জার বাহার। এই যুগে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, অথচ বর-কনে নামীদামী পার্লার বা বিউটিশিয়ানের শরণাপন্ন হয়নি, দামী দামী শাড়ী-গয়না-পাঞ্জাবী-শেরোয়ানী শরীরে জড়ায়নি- এমনটা ভাবতেও সাহস লাগে। কিন্ত আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এই কাজটা করে ফেলেছেন একজন, নাম তাঁর তাসনিম জারা।
মানুষটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং বিয়ের ছবিটাই শুধু দেখেছি। শরীরে কোনরকম কৃত্রিম সাজের ছোঁয়া না লাগিয়ে, সম্পূর্ণ নিরাভরণ অবস্থায় দাদীর সাদা কাতান শাড়ী পরেই বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। এর পেছনের যুক্তিটাও তিনি তুলে ধরেছেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে, লিখেছেন- “কয়েক পরত মেকাপ, ভারী পোষাক কিংবা বাহারি ডিজাইনের অলঙ্কার দিয়ে শরীরের ওজন বাড়ানোর পক্ষপাতী নই আমি। এই কৃত্রিমতাগুলো আমার সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান তুলে ধরবে না কখনও।” এই সিদ্ধান্ত নিতে তাসনিমকে নিজের পরিবারের অনেক সদস্যের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। অবশেষে সবাইকে রাজি করিয়েছেন। তার এই ভাবনায় সায় জুগিয়েছেন ভালোবাসার মানুষ খালেদ সাইফুল্লাহও।
তবে বিয়ের দিনটায় নিজেদের ইচ্ছেমতো সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে চাওয়ার বাসনাটায় কোন দোষও দেখেননি তিনি, তাঁর ভাবনাটা একটা জায়গাতেই, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আমাদের সমাজের বানিয়ে দেয়া বাজে কিছু অসামাজিক নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মেয়েরা নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে কিনা।
তাসনিম জারা’কে ধন্যবাদ। তিনি কোন বিপ্লব করেননি, সমাজ সংস্কারেও হাত দেননি, তিনি কোন মানদণ্ড বা আদর্শও নন। তবে স্রোতের উল্টোদিকে হাঁটার দুঃসাহসটা দেখিয়েছেন, এটা সবাই পারে না। খুব রূঢ় কিছু বাস্তবতার সঙ্গে বাস করি আমরা এই সমাজে। এখানে মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য নির্ধারণ করা হয় বিয়ের অনুষ্ঠানে সে কত বড় জাকজমক করতে পারলো সেটা দিয়ে। এখানে মানুষের মানসিকতা ছোট না বড় সেটা মাপা হয় শ্বশুরবাড়ীতে কি কি গিফট পাঠানো হলো সেসব দিয়ে। অদ্ভুত কিছু অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে এরমধ্যে বাস করছি আমরা, সেই জায়গায় তাসনিম জারা তো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম!
তাসনিম তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন কোনো বিয়ে আমি এটেন্ড করিনি যেখানে লোকজন ফিসফাস করছে, ”বউটা দেখতে কি যথেষ্ট সুন্দর… কয় ভরি স্বর্ণের গয়না পরেছে… তার জামাটা কতটা দামী হয়েছে?” আসলেও তো তাই! শুধু বিয়ের সময়ই যে এরকম আলোচনা তা না। কারো শ্বশুরবাড়ী থেকে বেশী কিছু আসেনি শুনলে শুরু হয়ে যায় তাদের লোকসঙ্গীত- “অমুক ভাবীর ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ী থেকে এটাসেটা এত কিছু দিল… আসলে ভাবী, সবার তো আর মন মানসিকতা একরকম হয় না, কি করবেন বলেন…”; এমনটাই থাকে তাদের কথার ধরণ। নারী-পুরুষ দুই দলেই এরকম মানুষের অভাব নেই আমাদের দেশে!
এই বাজারে একটা ছেলেমেয়ের মাস্টার্স শেষ করে মোটামুটি চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনের চাকুরী ম্যানেজ করতে করতে বয়স ত্রিশ ছুঁয়ে ফেলে। বিয়ে করতে গেলে দশ লাখ টাকা দেনমোহর দিয়ে, পাঁচ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, বাহারী সাজপোষাক আর হাজারখানেক মানুষের খাবারের টাকা যোগাড় করতে করতে তো মাথার চুল পড়ার বয়স হয়ে যাবার কথা। বিয়েটা কি তবে বাপ-দাদার জমি বিক্রি করে করতে হবে? কেন একটা মেয়েকে নিজের বাড়ী থেকে উপহার নামে যৌতুকের ডিজিটাল ভার্সন সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে? কেন উৎসবে পার্বণে দু’পক্ষ একে অন্যকে বাধ্যতামূলকভাবে উপহার দিয়ে খুশী করতে হবে? মানুষের মঙ্গলের জন্যেই নাকি সামাজিক রীতিনীতির সৃষ্টি, আমি তো এখানে কোথাও মঙ্গলটাই খুঁজে পাচ্ছি না। কারো যদি টাকাপয়সা বেশী থাকে, সে বাড়তি খরচ করবে, কারো সাজতে মন চাইলে সে পার্লারে গিয়ে সাজবে, কেউ ইচ্ছে করলে একশো ভরি স্বর্ণের গয়না দিয়ে শরীর মুড়িয়ে রাখবে। পুরোটাই ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ব্যাপার। কিন্তু এগুলো ‘নিয়ম’-এ পরিণত হলো কেন? এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কি এভাবেই চলতে থাকবে?
তাসনিম জারা পেশায় একজন ডাক্তার। ‘আরোগ্য’ নামক একটি সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও আছেন। এটি মূলত একটি ক্রাউডফান্ডিংয়ের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গরীব অসুস্থ রোগীদের জন্য ফাণ্ড রেইজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। গত বছর সংগঠনটি ইয়ুথ লিডারশিপ পুরস্কারও জিতেছে। প্রচলিত ধ্যানধারণার বিপক্ষে গিয়ে স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটার যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন তাসনিম জারা, একটা স্যালুট তো তার প্রাপ্যই!