December 13, 2025
মেজর জেনারেল (অব,) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ৪ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্ভুক্ত এবং হালদা নদীর তীরে অবস্থিত ‘উত্তর বুড়িশ্চর’ গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা সংক্ষেপে সেকেন্ড বেঙ্গল-এর সঙ্গে এবং ৩ নম্বর সেক্টরের ভৌগলিক এলাকায় তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পূর্ণ ৯ মাস অংশগ্রহণ করেন। সফিউল্লাহ ‘এস ফোর্স’ নামের ব্রিগেড সমতুল্য সংগঠনের কমান্ডার হন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যুদ্ধকালে সাহসিকতাপূর্ণ কর্ম ও নেতৃত্বের জন্য তিনি ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পান। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তিনি কোম্পানি কমান্ডার, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার, ব্রিগেড কমান্ডার এবং ডিভিশন কমান্ডার তথা ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বা জিওসি-এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৮ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজন জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) দেশের চলমান রাজনীতি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ, হেফাজতে ইসলাম, মতিঝিলের কথিত অভিযান নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন পরিবর্তন ডটকমের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন? নতুন শক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। এ রকম কোনো শক্তির কি আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) : দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গতকাল বিকেল (২ সেপ্টেম্বর) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড় নিয়েছে। অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে দেশ। অসমঝোতার পক্ষে চলে গেছে। সংঘাতময় পরিস্থিতির কথা সবাই মুখে বলাবলি করছিলো। সেই ইঙ্গিতটাই এখন প্রকটভাবে বাস্তবরূপে দেখা দিয়েছে। যদি বলেন কেনো? যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তবে সেটা আমি বলতে পারি। আর অন্য কোন শক্তির যে ব্যাপারটি বলছেন সে সম্পর্কে আমি বলবো সেই শক্তি কি রাজনৈতিক বা রাজপথের শক্তি হবে, সেই শক্তি কি কূটনৈতিক শক্তি হবে, সেই শক্তি কি আন্তর্জাতিক শক্তি হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমার পক্ষে শতভাগ সঠিক উত্তর দেওয়া মুশকিল। যে কারো পক্ষেই দেওয়া মুশকিল।
কারণটা হলো- এটি আমি একটি উপমা দিয়ে বলতে চাই। আপনারা উত্তরে আমার উপমাটি তুলে ধরবেন। যে কোনো সমস্যার একটি নির্যাস থাকে। ইংরেজিতে এটিকে বলে cracks of the problem, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল হয়েছিলো। সেই পদ্ধতি মোতাবেক সদ্য সাবেক হওয়া প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন। মানুষ রচিত যে কোনো আইনেই ভুল থাকা স্বাভাবিক। মানুষ ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বের কোনো যন্ত্র নয়। এটা আমরা মেনে নিয়েই দুনিয়াতে বাস করছি, করতে হবে। ২০০৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে অক্টোবরের কথা যদি ধরি, সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারপতি কেএম হাসানকে আওয়ামী লীগ মানতে রাজি হলো না। অভিযোগ আওয়ামী লীগ দিলো- ওনার গায়ে বিএনপির গন্ধ আছে। আপনি তরুণ হলেও এইটুকু অন্তত মনে আছে যে, এই অভিযোগটাই একমাত্র অভিযোগ ছিলো। আর কী রকম সেই গন্ধ? তারা বলল যে, ২৫-৩০ বছর আগে তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক দপ্তরের সম্পাদক ছিলেন। অথচ ২৫-৩০ বছর পরে সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। অ্যাডভোকেট হয়েছেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হয়েছেন। অতপর আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়েছেন। উনার কাপড়-চোপড় কতোবার লন্ড্রিতে গিয়েছে। উনি কতোবার গোসল করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতে উনার গায়ে থেকে বিএনপির ‘গন্ধ’ নাকি যায়নি।
সেই গন্ধের কারণে তারা উনাকে মানতে রাজি হল না। এখন দেশবাসির সামনে আপনাদের অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে আমার আবেদন, এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন- আমার নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবেন। আমার গায়ে কোনো গন্ধ নেই। আমি লীগের প্রধান।
আমার গায়ে কোন গন্ধ নাই। কারণ আমি লীগের উৎস। সকল গন্ধের উৎসই আমি। আমার গায়ের গন্ধকে সুঘ্রাণ বলতে হবে। এটি কি বাংলাদেশে প্রযোজ্য? সমগ্র বিশ্ববাসীকে আমি এর বিচার করার ভার ছেড়ে দিচ্ছি মিডিয়ার মাধ্যমে। তারপরেও আমি বলবো। মাননীয় দেশনেত্রী, জোট ১৮ দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে মিটিং করে আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেবেন। সেটি কোনদিকে যায় তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। যেহেতু আমরা শান্তি কামনা করি। তবে এই প্রতিক্রিয়া একান্তই ব্যক্তিগত মূল্যায়ন।
স্বাধীনতার এতো বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে কথা হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা লক্ষ্য করছি যে, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেই দাবি করা হয় তারাই স্বাধীনতার পক্ষের একমাত্র শক্তি। এভাবে দুই পক্ষে তুমুল বিতর্ক-বিতণ্ডা চলছে আজো। বিতর্কের কি কোনো অবসান নেই? এ বিষয়ে কিছু বলেন।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম : আমি নিজে কিছু বলার আগে আপনাকে দিয়েই শুরু করি। আপনি হচ্ছেন যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ। আপনার জন্ম বাংলাদেশ জন্মের ২০ বছর পর। আপনাকে এখন স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বলা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত! নিজেই উত্তর দেবেন। আপনি কী আজকে বলবেন, বাংলাদেশের বিপক্ষের লোক? নাকি বলবেন পক্ষের লোক? আপনার জন্মলগ্নে মায়ের পেট থেকে বের হয়ে আপনি জানেন আপনি বাংলাদেশি। আপনি বাঙালি। আপনি মুসলমান। আমি বলবো এটি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অত্যন্ত একটি অকাম্য গর্হিত কাজ। দেশ জাতিকে এবং বিভক্ত করার কাজ। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ স্বাধীন থাকুক এমন কামনা যাদের মধ্যে নেই তারা ১৯৪৭ সালের বাংলাদেশকে- পূর্ব পাকিস্তানকে বাঙালী জাতি স্বাধীন হোক এটা মেনে নিতে পারে নাই। তারাই অখণ্ড ভারতকে এখন পর্যন্ত মনে প্রাণে কামনা করে বলেই এই ধরণের একটি বক্তব্য দেয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছি। আমার জীবনটা বাজি রেখেছিলাম। মুখের ফুলঝুড়ি দিয়ে যুদ্ধ করি নাই। আমার মতো লক্ষ লক্ষ যুবক অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলো। সেই সময় আনুমানিক ২ থেকে তিন ভাগ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। আমরা যদি তাদেরকে তখন পেতাম- হত্যা করতাম। আর তারা যদি আমাদের পেতো-হত্যা করতো। এটাই নিরেট বাস্তবতা। এর মধ্যে এক ফোটা সন্দেহের কোনো কারণ নাই। কিন্তু আজ ২০১৩ সালে তাদের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ হাজার। আমাদের সংখ্যা এক থেকে দেড় লাখ। বাকি সমগ্র বাংলাদেশকে বিভক্ত করা হয়েছে- ওই খোড়া অজুহাতে; আমি এটা কোনোমতেই কামনা করি না।
আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ‘স্বপক্ষের শক্তি’ দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলো। আপনার দৃষ্টিতে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার ব্যাপারে কিছু বলুন।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম : একটি সরকার যেমন অনেক ভালো কাজ করে তেমনি অনেক মন্দ কাজও করে। আওয়ামী লীগ সরকারও এর উর্দ্ধে নয়। কিন্তু আজ তাদের প্রচার প্রচারণায় সর্বকিছুতেই ভালো কাজ গুলোর কথাই বলতে চেষ্টা করে, মন্দগুলো এড়িয়ে যায়। এমন কি গতকাল (২ সেপ্টেম্বর রাত ১০.৩০ মিনিটি) টিভিতে আলোচনায় ছিলাম। একজন সম্মানিত আওয়ামী লীগের এমপি সাহেব আমার সাথে আলোচক ছিলেন। আমি শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির কথা তুলতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন এবং বললেন জনগণ ওগুলো জুয়া খেলেছে, জুয়ায় তারা হেরে গেছে। এতে সরকারের কী করার আছে? আমি বলেছি- ঠিক আছে আপনি যেহেতু জনগণকে জুয়াড়ি বলেছেন, তারা জুয়া খেলেছে, আওয়ামী লীগের কি সেখানে কোনো কিছু করার নাই? দেশতো তারা পরিচালনা করছে। তবে হলফ করে বলতে পারি, নির্বাচনে তার উত্তর তারা পাবেন। আমার বক্তব্য এটাই, সরকার যদি নিজেদের ভুলগুলো মানতে চেষ্টা না করে, তাহলে তার উত্তর জনগণ নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবে। এই সরকারের অনেকগুলো বড় বড় ভুল হয়েছে। সরকারের যোগ সাজশে অনেক অনেক বড় দূর্নীতি হয়েছে। সরকার ভারতকে অনেক বেশি ছাড় দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে আজ পর্যন্ত কিছুই আনতে পারে নাই। এতে বাংলাদেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভারতের প্রতি যারপর নাই কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার দেশের জন্য কিছু যদি আমি আনতে না পরি, তাহলে সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বাতুলতা।
হেফাজতে ইসলাম নিয়ে তুমুল আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। হেফাজত দাবি করছে, তাদের কর্মসূচীতে প্রায় দুই হাজারের উপর লোক মারা গেছেন। আর সরকার বলছে যে, দশ-বারো জন মারা গেছেন। কখনো বলা হচ্ছে সেখানে গুলিই চালানো হয়নি। কখনো বলা হচ্ছে, একজনও মারা যায়নি। এ ব্যাপারটা নিয়ে সরকার কার্যকর কোনো তদন্তও করল না। আসলে আমরা দ্বন্দের মধ্যে আছি…।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, যার ফলে তাদের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম : দেশবাসীর সামনে আপনাদের পাঠকপ্রিয় অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে রেকর্ড করে রেখে বলতে চাই, আমার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারি থানায়। কেউ যেনো ভুল না বুঝেন। আমার জন্ম হাটহাজারিতে। হেফাজতের জন্মের ষাট বছর আগে আমার জন্ম। তা না হলে আবার বর্তমান সরকারের আমলে একটা আতঙ্ক থেকে যাবে যে, আমি বুঝি হেফাজত কানেকশনেই বড় হয়েছি। দাঁড়ি এবং টুপি থাকলেই এরা কাউকে না কাউকে রাজাকার বানিয়ে দেয়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকিকে রাজাকার বানাতে এই সরকারের মন্ত্রীদের কোনো সংশয়-সন্দেহ জাগে না। এটা বলার পেছনের কারণ হেফাজত ইসলামির কর্মীরা যখন মতিঝিলে আল্লাহর জিকিরে ব্যস্ত, নামাজে ব্যস্ত ছিলো, কেউ ঘুমাচ্ছিলো তখন তাদের উপর গরম পানি ঢালা হয়েছে। তাদের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে। তাদের উপরে গুলি বর্ষণ করেছে। সেটা রাবার গুলি হোক বা মারণাত্মক গুলি হোক। মানুষ মারা গেছে এটাই সত্য। কতো জন মারা গেছে? আমি যেহেতু নিজের চোখে দেখি নাই, সেজন্য বলতে পরছি না। হেফাজতের নেতাদের সাথে কথা বলে একটা আনুমানিক ফিগার আমি পেয়েছি। আগামী নির্বাচনের সময় যখনই এই সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিবে। তখন হেফাজতে ইসলাম তাদের স্বপক্ষের তথ্যগুলো নিয়ে আসবে। আর সংখ্যাটা এগারো-বারো না, এতোটুকু আপনাকে বললাম। সংখ্যাটা রিজনেবল এবং আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এই জন্য বলছি যে, প্রচুর সংখ্যক লোক গায়েবি অবস্থায় আছে, এখনো তারা যদি আসলেই লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকে, তাহলে মারা যায় নাই। আর যদি চূড়ান্তভাবে দুনিয়া থেকে লুকিয়ে থাকে, তাহলে নিহত হয়েছে। নিহত হলে কারণটা একমাত্র পুলিশি অ্যাকশন।
হেফাজতে সমাবেশে যদি বিপুল সংখ্যক মানুষ মারাই যায় তাহলে তাদের আত্মীয় স্বজনরা গেলো কোথায়? তারা তো কোনো অভিযোগ বা দাবি দাওয়া করছে না?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম : বাংলাদেশের লোকজনের দু তিনটি অভ্যাস আছে। আমি আপনাকে একটা কথাই বলবো, পুলিশের ফ্যামিলিকে ঘরে ধরে মেরে ফেলতেছে। কোনো বিচার পাচ্ছে না তারা। দুজন পুলিশ তো আমাদের সামনেই মারা গেলো, কে কার জন্য মায়া কান্না করে? আর গ্রামের ফ্যামিলি একটা হুজুর, আমি গিয়েছি তাদের একজনের বাড়িতে কবর জিয়ারত করতে। তারা বলে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি। আল্লাহ দেখবে। কার কাছে কে কার বিচারের জন্য দৌঁড়াবে। অধিকার সম্মাদককে ধরে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমার দেশের সম্পাদককে মেরে দাঁত ভাঙা হচ্ছে, নখ তুলে ফেলা হচ্ছে। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা এ পৃথিবীতে আছে, এইটা নিয়ে হইচই করবেন?
বিগত কয়েক বছরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বিরোধী দল হিসেবে কি মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে? কঠোর আন্দোলন করার মতো অনেক ইস্যু এসেছে, বিরোধীদল কী সেগুলোতে আন্দোলন করে সফল করতে পেরেছে?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: এই মুহুর্তে বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট যে কৌশল নিয়েছে আমি মনে করি তা অত্যন্ত সময় উপযোগী। অর্থাৎ বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোটের সামনে একটি যুগসন্ধিক্ষণ। হরতাল দিলে তার অবশ্যম্ভাবী কম্পেনিয়ন বা সঙ্গী হচ্ছে জ্বালাও পোড়াও। সময় বদলে গেছে, মহাত্মা গান্ধীর হরতাল আর এখন নাই। সত্তর বছর আগেকার ধর্মঘট, সত্যাগ্রহ, শান্তিপূর্ণ অবস্থান এখন নাই। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের সময় এখন আর নাই। সুতরাং আপনি এখন হরতাল দিলে জ্বালাও পোড়াও হবে, গাড়ি পোড়ানো হবে, মানুষ মারা যাবে। পুলিশ মানুষের গলা টিপে ধরবে। মানুষ পুলিশের গলা টিপে ধরবে। তখন আপনি বলবেন, এ হরতাল আমরা চাই না। তাহলে আপনারা কোন হরতাল চান? এর থেকে বেঁচে থাকার, এই আক্রমণাত্মক পরিবেশ থেকে বেঁচে থাকার একটাই রাস্তা- শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করা। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটা হলো, আবেদনের পর আবেদন করে জনমত সৃষ্টি। ১৮ দল এই রাস্তাই বেছে নিয়েছে এবং এর মাধ্যমেই দেখা যাচ্ছে অন্তত পক্ষে রমজানের ঈদের পর থেকে মানুষের জনমত প্রবলভাবে তাদের দিকে ছুটে আসছে। ৮ই সেপ্টেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়া যে জনসংযোগে নামছেন, তার পূর্বে ১৮ দলীয় নেতৃবৃন্দ যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই প্রচুর জনসমর্থন পাচ্ছেন। আমি তো চট্টগ্রাম জেলায় বিভিন্ন জায়গায় যাই, খাগড়াছড়ি জেলায় যাই। আমার থানায় যাই। সেখানে মানুষ চাচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে জনমত সংগ্রহ করা হোক। আর আপনি একটি কথা বলেছেন- ১৮ দল সফল হয় নাই। কথাটা ঠিক না। সফল না হলে পাঁচটা সিটি কর্পোরেশনে এরকম একতরফাভাবে জয়ী হতো না। জনগণ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করছে না, তার সঙ্গে আবার ১৮ দলকে পছন্দ করছে। এভাবেই দুই দুই যোগে চার হয়। শুধু অপছন্দের কারণেও না, শুধু পছন্দের কারণেও না।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম : যাদের বয়স ৫৫ বা এর বেশি এবং যারা শাহবাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদের নিকট প্রশ্ন, আগামীতে ১৮ দল ক্ষমতায় এলে এটা অফিসিয়ালি জিজ্ঞেস করবো, ১৯৭১ সালে আপনারা কে কোথায় ছিলেন? চানপুরে ছিলেন, নকলায় ছিলেন, হালুয়াঘাটে ছিলেন, কিশোরগঞ্জে ছিলেন, জীবন নগরে ছিলেন, কারো পেট ব্যথা ছিলো, কেউ বোনের বিয়ে খেতে গিয়েছিলো, কারো মাথা ব্যথা ছিলো, কারো হাঁটু ভাঙা ছিলো, মুক্তিযুদ্ধে কেন যান নাই? এখন আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় বড় নেতা হয়ে গেছেন। এই সমস্ত চাপাবাজি ধমকা-ধমকি বন্ধ করতে হবে। আমাদের আমলে আমরা যা করার করেছি। বঙ্গবীর যা করেছেন। আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠি তা করতে পারে নাই। বঙ্গবীরকে যারা অপমান করবে, তাদেরকে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। সময়ের অপেক্ষায় আছি। সাক্ষাতকর – পরিবর্তন.কম থেকে সংগৃহীত
একবার ভাবুন, ঐশীরা বিপথে গেল কেন। কোনো শিশুই তো পাপ নিয়ে বা অপকর্মের ব্রেইন নিয়ে জন্মায় না। কিন্তু ওই শিশু যখন পরে বড় হতে থাকে, তখন সে চিন্তা করতে শেখে, অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে শেখে, নিজের ভাব বোঝাতে শেখে এবং নিজে নিজে চলার একটি পথ খুঁজতে শেখে।
কিন্তু এই পরিবর্তনের সময় কিছু পরিবেশ তাকে শুদ্ধ চিন্তা করতে যেমন শেখায়, তেমনি অশুদ্ধ চিন্তা করতেও শেখাতে পারে। অল্প বয়সে যে যেটা চোখের সামনে দেখবে, সেটার দ্বারাই প্রভাবিত হবে। সেই অনুযায়ী তার চালচলন গড়ে উঠবে। আমরা তো আমাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছি এই ভেবে যে তথায় তারা শৃঙ্খলা আর মূল্যবোধ শিখবে। কিন্তু আমাদের স্কুলগুলো এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রমাণ হচ্ছে না। স্কুল ব্যস্ত পাঠ্যসূচিতে যা আছে তা শেখাতে।
মূল্যবোধ আর নৈতিকতার সংজ্ঞা স্কুলের কাছে পরিষ্কার নয় এবং তা নিয়ে স্কুল মাথাও ঘামায় না। তারা মাথা ঘামায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে। কিন্তু ভালো রেজাল্ট আর ভালো মূল্যবোধ সব সময় একসঙ্গে যায় না। আমাদের সন্তানদের অভিভাবকরা বেশি চিন্তিত সন্তানের শিক্ষাগত ভালো রেজাল্টের দিকে। সন্তানের স্বভাব-চরিত্র কেমন হচ্ছে কিংবা সন্তানের স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না- এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে অত চিন্তা দেখা যায় না। তাঁরা তাঁদের সন্তানকে এক টিউটর থেকে আরেক টিউটরের কাছে পাঠিয়ে যেন তৃপ্তি পাচ্ছেন। কিন্তু এতে যে তাঁদের সন্তানরা ভালো রেজাল্ট করছে তাও না।
অনেক সময় সন্তানদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন বিষয় পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, যেটা পড়তে গিয়ে পরে সে একাডেমিক ফলই খারাপ করে ফেলছে। আমি অনুরোধ করব, আপনারা অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুল-কলেজের শিক্ষাগত ফল নিয়ে এত বেশি চিন্তিত না হয়ে তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি, তাদের চরিত্র গঠনের প্রতি একটু বেশি যতœবান হোন। একটি ভালো স্বাস্থ্যের আর ভালো স্বভাবের ছেলে সত্যিকার অর্থে আপনার জন্য বড় সম্পদ এবং সে সন্তান সমাজের জন্যও মূল্যবান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভালো স্বাস্থ্য তো স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও ভালো খাবার থেকে এলো; কিন্তু ভালো চরিত্র কোথা থেকে আসবে? আমাদের প্রাইমারি শিক্ষার সময়ে- সে এখন থেকে ৫০-৫৫ বছর আগে আমাদের শিক্ষকরা ছাত্রটি চরিত্রবান হচ্ছে কি না এ নিয়ে অনেক উদ্গ্রীব থাকতেন।
তাঁরা দেখতে চাইতেন, ছাত্রটি বড়দের সালাম-আদাব দেয় কি না, মিথ্যা কথা বলে কি না, স্কুলে সঠিক সময়ে আসে কি না, সহপাঠীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে কি না, ঘরে ফিরে রাতের প্রথম দুই ঘণ্টা পড়ালেখা করে কি না ইত্যাদি। তখন গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক ধর্ম শিক্ষার জন্য মক্তব ছিল। আমরা স্কুলে যাওয়ার আগে দুই ঘণ্টার জন্য সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মক্তবে যেতাম। আজকে যতটুকু কোরআন পাঠ জানি, যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ- তার প্রায়টাই এসেছে সেই মক্তবের শিক্ষা থেকে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা ছিল অবৈতনিক।
শুধু বই ও কাগজ-কলমের জন্য সামান্য অর্থ ব্যয় করতে হতো। মক্তবের শিক্ষায় তাও লাগত না। কোরআন শরিফটাও অন্য কেউ দিয়ে দিত। স্কুলের শিক্ষকরা ছিলেন নিষ্ঠাবান। তাঁরা ছাত্রদের কাছে আদর্শ মানুষ হিসেবে ধরা দিতেন। কিন্তু এখন যেন সব কিছু বদলে গেছে। একটা স্বার্থপরতা আর আর্থিক লেনদেন সব পুরনো ও পরীক্ষিত মূল্যবোধকে যেন তছনছ করে ফেলছে। সবাই যেন এক ধরনের ধান্দাবাজিতে লিপ্ত। এই যে আমরা আমাদের সন্তানদের সামনে কোনো রকম আদর্শ স্থাপনে ব্যর্থ হচ্ছি, তারই ফল হচ্ছে ঐশীদের কর্তৃক তাদের পিতা-মাতাকে খুন। অথবা বাবার অঢেল অর্থ দুই হাতে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা।
যারা ছোটকাল থেকেই আদর্শ শিক্ষা ও আদর্শ দেখা থেকে বঞ্চিত, তারা কিভাবে একটা শ্রদ্ধাবোধসম্পন্ন জীবনের মধ্যে আসবে? এ জন্য বেশি দায়ী সন্তানদের পিতা-মাতারা, আংশিক দায়ী স্কুল ও চারদিকের পরিবেশ। আপনি যদি নিজেই আদর্শ পিতা না হন, তাহলে আপনার সন্তানরাও আদর্শবান হবে না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। আদর্শ পিতার লক্ষণ হলো সৎ ও পরিশ্রমী পিতা। অর্থকড়ি বেশি থাকল না কম থাকল, এটা বড় কথা নয়। অর্থ অনেক সময়ই বিপদ ডেকে আনে। অর্থই তো আপনার সন্তানকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ছেলেমেয়েরা তো জানে, বাপের অর্থের উৎস কী। আর অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থ আপনার সন্তানের হাতে পড়লে সেই অর্থের কোনো মূল্যই থাকবে না তার কাছে।
তাই অনুরোধ করব নিজেদের জীবনকে সংশোধন করে নিতে। দেখবেন, আপনি শুদ্ধ হয়ে গেলে আপনার সন্তানরা ভালো হয়ে যাচ্ছে। অর্থ কোনো দিন মানুষকে প্রকৃত সুখ দিতে পারেনি। বরং ধর্মবোধ-ধর্মকে মানা মানুষকে অনেক বেশি সুখ দিয়েছে বলে প্রমাণিত। এই যে আজকে আমরা ইয়াবার দংশন বলে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছি, এই দংশন থেকে দূরে থাকারও অন্যতম উপায় হলো ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখা। আর সেই পার্থক্য করার শিক্ষাটারও আসল উপাদান আসে সন্তানরা যদি ন্যূনতম ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো শিখতে পারে। আসলে তো মানুষ কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না। সব কিছুর নিয়ন্ত্রকই হলেন আমাদের স্রষ্টা।
সে জন্য আমরা পিতা-মাতারা যদি স্রষ্টার দেওয়া জীবনের মধ্যে আমাদের জীবনটাকে চালাতে পারি, তাহলে আশা করা যায় সেই জীবন আমাদের সন্তানদের ভালো চিন্তা করতে ও উচ্চতর নৈতিকতাসম্পন্ন জীবনের দিকে নিতে উৎসাহ জোগাবে। সন্তান যদি দেখে তার বাবা ঘুষখোর ব্যক্তি, তাহলে সন্তান ওই বাবার কাছ থেকে কী শিখবে? আপনার-আমার চোখের সামনেই তো দেখা যাচ্ছে, একজন দরিদ্র লোকের সন্তান অতি ভালো রেজাল্ট করে নিজ পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেক ওপরে উঠে গেছে। অন্যদিকে একজন ধনকুবের-ধনাঢ্য ব্যক্তির সন্তান গোলøায় গেছে। অনেক অর্থকড়ি এই ব্যক্তি সন্তানের পেছনে ব্যয় করেছে, কিন্তু ছেলেটি না হয়েছে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, না হয়েছে পরিশ্রমী। ঐশীদের সামনে যদি কোনো আদর্শ স্থাপন না করা যায়, তাহলে তো তারা মাদকাসক্ত হবেই। আর আদর্শের সূত্রপাত হয় ঘর থেকেই। তাই ঘর ঠিক আছে কি না সেটা আগে দেখুন। আপনার ছেলে বড় হয়েছে, সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে- এসব বিষয়ে খবর নিন। তাকে সঙ্গে করে কি আপনি প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে যেতে পারেন না?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
অর্থনীতি বিশেøষক
আমার সঙ্গে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক স্যারের ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কথা নয়। তিনি প্রকৌশলী, আমি আইনের শিক্ষক। কিন্তু তার সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সেটি তার বিশালত্বের কারণে। তিনি প্রথম আলোতে আন্তর্জাতিক নদী আইনের ওপর একটি লেখা দেখে আমাকে ফোন করেন।
তিনি সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু যারা বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো সম্পর্কে খবর রাখত তারা জানত কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। এলজিইডির প্রকৌশল উপদেষ্টা এবং পরে এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ হিসেবে শুধু নয়, তা বাস্তবায়নে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ও নিরলস আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়। তিনি আমাকে ফোন করাতে অবাক হয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক নদী আইন সম্পর্কে তার আগ্রহ আমাকে আরও অবাক করে। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনায় তিনি বহুদিন ধরেই কাজ করছেন।
তিনি গ্লোব ওয়াটার পার্টনারশিপের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আন্তর্জাতিক নদী আইন বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে ভারতের পানি আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি ছিল। তিনি এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। পরিচয়ের পর থেকেই তিনি নদী সম্পর্কে আমাকে যেভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন তা ছিল তার নিখাদ দেশপ্রেমের কারণে। তিনি স্টকহোমে বিশ্ব পানি সম্মেলনে আমাকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় নিয়ে যান। আন্তর্জাতিক নদী আইনসম্পর্কিত বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশিøষ্ট বিষয়ে তিনি যে কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো বক্তব্য রাখতেন, আমাদেরও সর্বাৎদকভাবে উৎসাহিত করতেন। তার গভীর পাণ্ডিত্য এবং নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতার কারণে আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞরা তাকে যে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখত তা উপলব্ধি করে আমরা নিজেরা সম্মানিতবোধ করতাম।
নানা মত ও পথের মানুষকে তিনি একত্রিত করতে পারতেন। বাংলাদেশের বহু স্বনামধন্য মানুষ, যাদের কেউ কেউ ছিলেন তার চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ, তারা তার সঙ্গে কাজ করতে গেলে স্বচ্ছন্দে তার নেতৃত্ব মেনে নিতেন। তিনি ২০০৩-২০০৪ মেয়াদে গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রথম চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ভারত ও পাকিস্তানের বাঘা বাঘা পানি বিশেষজ্ঞ থাকার পরও তিনি এ প্রভাবশালী পদে আসতে পেরেছিলেন তার যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের কারণে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশিপ এবং ন্যাশনাল ফোরাম ফর রুর্যাল ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের প্রেসিডেন্টের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেন।
তার তত্ত¡াবধানে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। সময়ের অভাবে তিনি সেই মহান কাজটি নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করতে পারেননি। তবে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে অল্পদিনেই তিনি ঢাকা শহরের বিধ্বস্ত আইল্যান্ড, জীর্ণ ফুটপাত, অবৈজ্ঞানিক ট্রাক, দুর্বল সিগন্যাল ব্যবস্থা, অপ্রয়োজনীয় গোলচক্কর, নিয়ন বাতির স্বল্পতাথ এসব সমস্যা সমাধানে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ছিলেন উদ্ভাবনী ক্ষমতাধর একজন কর্মবীর। তিনি কৃষি ক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করে ইরি চাষের মাধ্যমে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার ধারণা জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি বাংলাদেশে রাবার ড্যাম স্থাপন এবং এ প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করেন।
জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নগুলোর বেস ম্যাপ প্রস্তুতির জন্য জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম চালু করে তথ্য মাধ্যমে বিপ্লব সাধন করেন। আদর্শ গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পসহ গ্রামীণ রাস্তা, সেতু, সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, সমাজ উন্নয়ন ও সমবায় ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, জরুরি দুর্যোগ প্রশমন কর্মসূচির আওতায় প্রয়োজনীয় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার বহু কীর্তি সারা দেশের গ্রামে ও শহরে রয়েছে এবং তা বহুযুগ ধরে থাকবে। বর্তমানে নানা আন্তর্জাতিক আগ্রাসনের মুখে তার মতো করে দেশের স্বার্থে কথা বলার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সংগঠিত করার বিরল ক্ষমতার অধিকারী লোকের অভাব আজ আমরা খুবই অনুভব করি। ৬৩ বছর বয়সে এমন কর্মবীর মানুষের মৃত্যু আমাদের কাছে অকালমৃত্যুই। অনেক কিছু দিয়েছেন তিনি দেশকে। আরও অনেক কিছু দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। তার সম্পর্কে ভাবলে এটি মনে পড়ে। মনে পড়ে তার স্নেহময় পিতৃসুলভ হাসিমাখা মুখ। তার মৃত্যু শুধু দেশের জন্য নয়, আমার মতো তার বহু ভাবশিষ্যের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবসে মাদারীপুর শহরের পুরান বাজারের যৌনপলিøতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। যৌনকর্মীদের সম্পর্কে নজরুল লিখেছেন, ‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?/ হয়ত তোমার স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।/ না-ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি।’ [বারাঙ্গনা]
আমাদের কথিত ভদ্র সমাজের মানুষেরা যৌনকর্মীদের তাদের মা-বোনদের জাতি মনে করে না। তাঁদের দ্বারা তারা শুধু তাদের পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। মাদারীপুরের যৌনপলিøর বাসিন্দাদের ওপর হামলা ও সেখান থেকে তাঁদের বিতাড়নের যে দৃশ্য টিভি-সংবাদে দেখা গেছে, তাতে মনে হয় না আমরা কোনো সভ্য সমাজের মানুষ। আদিম বর্বরতার বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যেও পুরো মাত্রায় উপস্থিত।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় যৌনকর্মীরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত মানুষ। যে সমাজ সাধারণ নারীকে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত, সেখানে যৌনপলিøর মেয়েরা যে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত হবে—তাতে সন্দেহ কী? তাঁদের প্রতি ধর্মীয় মৌলবাদীদের আক্রোশ ও নির্মমতা আরও বেশি। দিনদুুপুরে ইসলাহে কওম পরিষদ নামের একটি সংগঠন উচ্ছেদ ও হামলায় নেতৃত্ব দিলেও তাদের পাশে ছিল প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সমাজের ‘গণ্যমান্যরা’।
লুটপাটে অংশ নিয়েছে স্থানীয় লোকজন। আক্রমণে আহত হয়েছেন ৩০-৪০ নারী। বিপন্ন নারীদের পাশে দাঁড়াতে কাউকে দেখা যায়নি।
বিস্ময়কর ব্যাপার যে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল যৌনকর্মীদের হয়রানি না করতে এবং তাঁদের পেশা চালিয়ে যেতে প্রশাসন
যেন কোনো বিঘœ সৃষ্টি না করে। কিন্তু সমাজপতিরা এতই প্রভাবশালী যে, আদালতের নির্দেশও অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং সে জন্য অভিযুক্ত সংগঠনের কোনো নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আড়াই শ বছর ধরে যৌনকর্মীরা সন্তানসন্ততি নিয়ে ওই জায়গায় বাস করছেন। বর্তমানে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে এমন বর্বরোচিতভাবে উচ্ছেদ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু নয়, ফৌজদারি অপরাধ। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা হতে পারে না।
সমাজের প্রতিটি দুর্বল শ্রেণীই আজ চরম অসহায়। অসহায় আদিবাসী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী, শিশু প্রভৃতি। যেভাবে যৌনকর্মীদের তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তা শুধু সাধারণ দাঙ্গাহাঙ্গামা নয়, নির্মম নারী নির্যাতন। মূল উদ্দেশ্য ভূমি দখল। নির্যাতিতদের পাশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই, সমাজপতি নেই, প্রশাসন নেই। এই ঘটনার পর দেশের অন্যান্য জায়গার যৌনকর্মীরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে দুর্বৃত্তদের কঠোর শাস্তি না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সমাজহিতৈষী মানুষদের তাই শুধু মৌখিক প্রতিবাদ নয়, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ।
আমাদের দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত যৌনকর্মীদের তাঁদের জায়গায় অবিলম্বে করা হোক পুনর্বাসন। তাঁদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে প্রশাসনকে দিতে হবে তাঁদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে পূর্ণ নিরাপত্তা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
শামীম ওসমান পুরোদস্তুর রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা এক আলোচিত চরিত্র, বহুল আলোচিত এই রাজনীতিককে দেখা গেছে বিরোধীপক্ষের সর্বোচ্চ আন্দোলন ‘লংমার্চ’ প্রতিহত করতে, বোমার আঘাতে অলৌকিকভাবে বেচে যেতে, নারায়নগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম আলোচিত এই রাজনীতিককে নানা বিশেøষণে বিশেষায়িত করলেও জননেতা.কম একজন শামীম ওসমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্নতাকে সমীহের চোখে দেখা বশত একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিল আমাদের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মাসুদ রানা। যেখানে সম-সাময়িক রাজনীতি ছিল আলোচ্য উপজীব্য বিষয়। সাক্ষাতকারটির চুম্বক অংশ আমাদেরসময় ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল :
জননেতা.কম : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু দেখছেন?
শামীম ওসমান : আওয়ামী লীগ-বিএনপি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল যদি সংলাপের বিষয়ে নিজেদের দাবিতে অটল থেকে দুই মেরুতে অবস্থান করে তবে নির্বাচন হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাদেরকে অবশ্যই সমঝোতায় আসতে হবে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যদিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে। তবে আপাত দৃষ্টিতে বর্তমান পরিস্থিতি হতে উন্নতি না হলে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে প্রতীয়মান হয়।
জননেতা.কম : চলমান শাসন ব্যবস্থাকে অর্থবহ করতে কী কী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন?
শামীম ওসমান : অতীত আর বর্তমান কালের মধ্যে অনেক তফাত। সময়ের সাথে দূরত্ব বেড়ে গেছে। অতীতে নির্বাচনে মূলত ফ্যাক্টর ছিল তিনটি ‘এম’। (১) মিলিটারি (২) মানি (৩) মাশল। বর্তমানে যা দাড়িয়েছে পাঁচটি ‘এম’ এ। (১) মিডিয়া (২) মিলিটারি (৩) মানি (৪) মুসলিম ফ্রন্ট (৫) মাশল। বর্তমানে দেশে সাড়ে চার কোটির বেশি সাংবাদিক আছেন। কোন দল কী করছে না করছে জনগণ খুব সহজেই তা জেনে যাচ্ছে। যুক্তিযুক্ত কারণেই তারা বেছে নিবে তাদের নেতা, তাদের সরকার।
জননেতা.কম : ধর্ম ভিত্তিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
শামীম ওসমান : নামে ইসলামী হলেও প্রকৃতপক্ষে জামায়াত ইসলামী দলে ইসলামের ন্যূনতম প্রতিফলন নেই। তারা আজ ধর্মের মুখোশ পরে সাধারণ মানুষের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তাদের মূল পৃষ্ঠ পোষক পশ্চিমা বিশ্ব। কওমী মাদরাসার প্রতিটি ছাত্রের পিছনে ১০০ ডলার খরচ করে মূলত এদেশে একটি জঙ্গি ঘাটি তৈরি করতে চায়। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের সুবিধা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় তারা। আজ ধর্মের নামে যেভাবে কুরআন পোড়ানো হয়েছে, মসজিদে হামলা চালানো হয়েছে, জাতীয় পাতাকার অবমাননা করা হয়েছে তা সত্যিই নেক্কারজনক। জামায়াত ইসলাম স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি। কাজেই দেশের আপামর জনগণের উচিত এই বিরুদ্ধ শক্তিকে বর্জন করা।
জননেতা.কম : জামায়াত-বিএনপি একসাথে রাজনীতি করছে, তাদের রয়েছে ১৮ দলীয় জোট। তবে কী আপনি বলতে চাইছেন বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধের বিরূদ্ধ শক্তি?
শামীম ওসমান : অবশ্যই তারা এক অপরের সহযোগী। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন তারেক রহমান শিবিরের সভায় বলেছেন, “ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুল।” বিএনপি যদি আগামীতে ক্ষমতায় আসে তবে দেশে ব্যাপক হত্যাকান্ড হবে। দেশ পুরোপুরি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সারা বিশ্বের সামনে দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাবে।
জননেতা.কম : আপনি কি মনে করেন আমাদের বর্তমান তরুণ রাজনীতিবিদদের মাঝে কেউ একজন মাহথীর মোহাম্মদ হয়ে উঠবে, দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাবে?
শামীম ওসমান : আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থাতে তেমন নিবেদিত প্রাণ কাউকে দেখি না। আমাদের বর্তমান রাজনীতি নোংরা রাজনীতি। সবাই রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেয়, তারা দেশ সেবার নিমিত্তে তো আর রাজনীতি করে না। সেই শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান আজ ইতিহাস। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই তাদের মূল আদর্শ হতে যোজন যোজন দূরে সরে পড়ছে। সবই এখন ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তেই ব্যস্ত।
জননেতা.কম : বর্তমান পরিস্থিতিতে এক তরুণ সজীব ওয়াজেদ জয়ের আগমন, আরেক তরুণ তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
শামীম ওসমান : অবশ্যই বিশাল প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। দুজনই দলকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, তবে আমি মনে করি “একজন ফুলদানির ফুল আরেকজন বাগানের ফুল। মৌমাছি ঠিকই সত্যিকারের ফুলকে বেছে নিবে।” জয় একটি বিশাল রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন পরিবার থেকে এসেছে, সুশিক্ষিত মেধাবী। সে অবশ্যই দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়ে দেশকে যোগ্য অবস্থানে অধিষ্ঠিত করবে বলে আমার পূর্ণ বিশ্বাস।
পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী মর্মান্তিকভাবে খুন হয়েছেন। খুনের অভিযোগে তাদের মেয়ে ঐশীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে বেরিয়ে আসছে নানারকম তথ্য। খুনের মোটিভ নিয়েও চলছে বিতর্ক এবং প্রশ্ন উঠছে তারুণ্যের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে। আমরা এ বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাতকারটি উপস্থাপন করা হলো।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এই মুহুর্তে অন্তত দু’টি বিষয় আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। তার মধ্যে এস বি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যার ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে মাদকাসক্তি ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে বাধা দেয়ার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবা মাকে হত্যা করেছে পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে ঐশী ও তার বন্ধুরা।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের নৈতিক অধঃপতনের একটি চরম উদাহরণ প্রকাশ পেয়েছে। এই নৈতিক অধঃপতনের জন্য আপনি কোন্ কোন্ বিষয়কে দায়ী করবেন?
নাঈমুল ইসলাম খান: এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন আমরা সকলেই পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রীর নৃশংস ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি। আমরা শুধু হতবিহবল না; আমরা ভাবতেই পারছি না যে একজন সন্তান তার বাবা-মাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করতে পারে।
তবে বিষয়টি নিয়ে আমি সাইড লাইনের দু’একটি কথা বলে নেব। ঐশী নামক মেয়েটির মাদকাসক্তি বা অন্যান্য দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ এই ঘটনাটিকে উস্কে দিল কিনা, এখানে কোনো ভূমিকা রাখল কিনা এগুলো কিন্তু আলাদা করে তদন্ত করতেই হবে। দেখতে হবে এই ঘটনার সাথে আরো কেউ জড়িত ছিল কিনা। তাছাড়া আরো অন্যান্য বিষয়ও জড়িত ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
তো having said that আমি বলব যে, উঠতি বয়সের তরুণ তরুণীদের বিশেষ করে adolescence লেভেলের ছেলে মেয়েদেরকে অনেক ক্ষেত্রে তাদের বাবা-মায়েরা বুঝতে পারেন না। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় বাবা-মায়ের বা পরিবারের ভূমিকার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা অযোগ্যতার কারণে এমনটি হয়েছে। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের ঘনিষ্ঠতার অভাবে তারা বুঝতেও পারলেন না সন্তানের মানিসক অবস্থা কি, তার ঘোরাফেরা কোথায়, তার বন্ধুরা কি করে, কোথায় যায় কোথায় সময় কাটায় এবং কিভাবে তারা টাকা পয়সা খরচ করে আর সে টাকা পয়সা কোথায় পায়!
কিভাবে বাবা-মা একটি সন্তান থেকে এতোটা দূরে থাকবেন, এতটা তাদের মানসিক এবং যোগাযোগের দূরত্ব হবে যে তাদেরকে হত্যার পরিকল্পনা করবে সন্তান এবং বাবা-মা ঘূর্ণাক্ষরে তা বুঝতে পারবেন না ! আমার মনে হয় এটা প্রাথমিকভাবে পরিবারের ব্যর্থতা। আমাদের পারিবারিক বন্ধনের অক্ষমতার ব্যর্থতা। বাবা-মা হিসেবে সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চরম ব্যর্থতার প্রতিফল হচ্ছে এই পুলিশ কর্মকর্তা দম্পতির নিহত হওয়ার ঘটনা।
তারপরেও আমি বলব যে আমাদের সামগ্রিক সমাজেও মাদকাসক্তি, স্কুল কলেজের লেখা পড়ার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিক শিক্ষা চর্চার ঘাটতি আছে। আমাদের সামাজিক বন্ধন; আমাদের যোগাযোগ যেটা প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারত, প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারত সেই সম্পর্কগুলোও সম্ভবত এখানে খুবই শিথিল ছিল যার জন্য এই চরম উদারহণ আমাদেরকে মেনে নিতে হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এ ঘটনায় ঐশীর পিতা-মাতাসহ পরিবার, স্কুল, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। বিষয়টিকে আমি এভাবেই ঘটনা পরম্পরায় দেখি। আমি এও দেখি এটা কাভার করতে গিয়ে টেলিভিশনগুলোও-এই বয়সী একটা মেয়ের জীবন নিয়ে কিভাবে কাভারেজ করছে।
আপনারা জানেন যে, তাকে রিমাণ্ডে নেয়ার ক্ষেত্রেও কিছু নৈতিকতা এবং আইনী প্রশ্ন উঠেছে। আমি বলব যে, আইনী প্রশ্নের বাইরেও তার প্রতি যেন কোনো নিপীড়ন এবং অবিচার করা না হয় –এ বিষয়টির প্রতি যেন সবাই লক্ষ্য রাখেন।
আমি আশা করব যত খারাপ চিন্তা করেই ঐশী তার বাবা-মাকে হত্যায় জড়িত হন না কেন এখন নিশ্চয়ই তার মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এ সময় তার প্রতি আমাদের কি আচরণ করা উচিত, তাকে আমরা কিভাবে সুস্থ করে তুলব; ভবিষ্যতে সে যেন একজন সুনাগরিক হয় সে জন্য আমরা কি করব – এগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার।
প্রশ্ন : জ্বি জনাব নাঈমুল ইসলাম, আপনি যুব সমাজের মধ্যে নেশার কথাটি বললেন। এ প্রসঙ্গ ধরেই আপনার কাছে জানতে চাইব- দেশের কিশোর–কিশোরীদের একটা বড় অংশ নেশার ছোবলে পড়েছে যার ফলে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বা তার স্ত্রীর মতো অনেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। কেন কিশোর কিশোরীরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তারা কেন মাদক ও বিভিন্ন নেশাদ্রব্য গ্রহণ করছে?
নাঈমুল ইসলাম খান: প্রথম কথা হচ্ছে- আমরা সবাই জানি এই ‘adolescence’ এর একটা বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে- তারা নিজেদেরকে বড় ভাবে কিন্তু পরিবার বা সমাজ তাদেরকে তখন বড় হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তারা সেটার প্রতিশোধ নেয় নানাভাবে। তারা বড় হিসেবে জাহির করার নানারকমের পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশ হিসেবে যেগুলো এতদিন তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল সেই নিষিদ্ধ জগতে আনাগোনা করার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর এভাবেই আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা বিশেষ করে ছেলেরা সিগারেটে আসক্ত হয়। সিগারেট থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন খারাপ সংস্পর্শে গিয়ে তারা নেশার অন্যান্য উপকরণের দিকে যায়। প্রথমে হয়তো নির্দোষ অভিজ্ঞতার জন্য কোনো একটি নেশার চেষ্টা করে তারপর সেটাতে সে আসক্ত হয়ে ওঠে এবং আটকে যায়। পরিবারের ভেতরে যে বন্ধন থাকলে তাকে অঙ্কুরেই মুক্ত করা যেত- সেই বন্ধন, সেই সম্পর্ক বা সেই যোগাযোগ না থাকাতে বিষয়টি যখন আমরা জানতে পারি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। ফলে তখন ঐ অবস্থা থেকে আসক্ত ঐ সন্তানকে ফিরিয়ে আনা দুরুহ হয়ে পড়ে; অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার মনে হয় নেশার এই চিত্র সমগ্র দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কেবলমাত্র রাজধানী ঢাকা বা বড় বড় শহরগুলোতে নয় আমি দেখছি গ্রাম্য জনপদেও এখন এই নেশার মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন : দেশের যুব সমাজকে নেশার হাত থেকে রক্ষার জন্য করণীয় কি বলে মনে করেন।
নাঈমুল ইসলাম খান: যে কাউকে নেশার কাছ থেকে সরানোর একমাত্র পথই হচ্ছে অন্য যে কোনো ইন্টারেস্টিং কাজে সম্পৃক্ত করা। সেটা খেলাধুলা হোক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হোক, সোশ্যাল সার্ভিস হোক, এলাকার মানুষের সেবা করা হোক- ইত্যাদি কাজে সম্পৃক্ত করা। আর এগুলো আমাদের সবার প্রায় জানা বিষয় অথচ আমরা এগুলোর চর্চা করি না এবং জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব দেই না। এসব বিষয়ে আমরা উদাসীনতা দেখাই বলেই ছেলে মেয়েদের খেলাধুলার জায়গা থাকে না, মাঠ থাকে না- যে কারণে ছেলে মেয়েরা ঘরে বন্দি হয়ে পড়ে। আর এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাদের অনেকে নিজের অজান্তেই নেশার জগতে পা দেয় এবং এমনভাবে আটকে যায় যে তাদেরকে আর মুক্ত করার উপায় থাকে না।
প্রশ্ন : জনাব খান, আপনি পুলিশ কর্মকর্তা দম্পতি হত্যার ঘটনায় পরিবারের ব্যর্থতাকে দায়ি করেছেন। তো একই সাথে আমরা বলব একটি পরিবারের সন্তান যখন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায় তখন তার দায় কি সমাজ এড়িয়ে যেতে পারে। অর্থাত ঐশী বা ঐশীর মতো যারা উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করছে এর দায় এ সমাজ এড়াতে পারে কি না?
নাঈমুল ইসলাম খান: দেখুন আমি কিন্তু এ ব্যাপারে সমাজের বা রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা এড়িয়ে যাইনি বা না করিনি। তবে আমি বলেছি প্রাথমিকভাবে এ দায়িত্ব পরিবারের।পরিবারের বন্ধনের মধ্যে থাকলে অঙ্কুরেই জিনিষটার সংশোধনে পদক্ষেপ নেয়া যেত। পারিবারিক বন্ধন যখন শিথিল হয়ে যায়, বাবা-মার সাথে যখন সন্তানের সম্পর্ক দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখন বিষয়টা দুরূহ হয়ে পড়ে। তখন আমরা বলি সমাজেরও অবশ্যই উদাসীনতা আছে। সমাজের এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যর্থতা আছে। আর সেই ব্যর্থতার যাতাকলে পড়ে আর কিছুই করা সম্ভব হয় না। তবে আমি আবারও বলছি যে, এক্ষেত্রে পারিবারিক দিকটাই হচ্ছে হচ্ছে প্রথম। এ ধরনের ঘটনায় সন্তানের যদি প্রতিষেধক বা প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ নিতে হয় তাহলে প্রথম যে জায়গাটাতে সংস্কার করতে হবে, সতর্কতা আনতে হবে সেটি হচ্ছে পরিবার। পরিবারের ভাই-বোন, বাবা-মা সকলে যদি আমরা একে অন্যের কাছাকাছি থাকি এবং ওপেন থাকি তাহলে আমার ধারনা এই সমস্যাগুলো দেখা দিলেও তা কম স্থায়ী হবে।
প্রশ্ন : আমরা সবশেষে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব সেটি হচ্ছে- নৈতিকতা। আর নৈতিকতা শেখানোর পেছনে ধর্মীয় শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান সেক্যুলার সরকার স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যবাধকতাহীন করে দিয়েছে। এর সুদূরপ্রসারি কুফলগুলোর একটি কি আমরা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ খুনের ঘটনায় দেখতে পেলাম?
নাঈমুল ইসলাম খান: আমি মূলত জোর দেব নৈতিকতার চর্চার ওপর। আর নৈতিকতা চর্চার বিস্তারিত সুযোগ আমরা পাই ধর্ম চর্চার মাধ্যমে -এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের ধর্ম চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের বাইরেও নৈতিকতার বিষয়টিকে একটা সামগ্রিক বিষয়ে পরিণত করতে হবে। আমাদের কারিকুলামের মধ্যেও নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব নিশ্চয়ই বাড়াতে হবে। একটা সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে নৈতিকতার শিক্ষা লুপ্ত হয়ে যায় কি না এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে তবে আমরা যদি আপাতত বিতর্কে না যাই সেক্ষেত্রে আমি অন্তত এটুকু নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে, ধর্মীয় শিক্ষা এবং ধর্মানুরাগী পরিবার এবং ধর্মনুরাগী মানুষ নিশ্চয়ই অধিকতর নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন হবে এবং তাদের স্খলনের পরিমাণ নিঃসন্দেহে কম হবে। তারপরও আমি বলব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যেও নৈতিকতার অবক্ষয় বা দুষ্টামি দেখা যায়। তো আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে ইন জেনারেল নৈতিকতার শিক্ষা এবং তার চর্চার ক্ষেত্র ও সুযোগ আরো প্রসারিত করতে হবে। পাড়ায় মহল্লায় চিত্ত বিনোদনের জন্য ক্রীড়ানুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিম্বা বৃদ্ধদের জন্য সাহায্য সহযোগিতা করা এভাবে নানারকম সমাজ হিতৈষী কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের নানারকম অস্থিরতাকে প্রশমন করা সম্ভব।
সূত্র: রেডিও তেহরান
গণতন্ত্র নয়, সামরিক স্বৈরতন্ত্রের গণহত্যার নিষ্ঠুর রূপ এখন দেখছে মিসরের জনগণ। শুধু মিসর নয়, টেলিভিশনের কল্যাণে নির্মমতার লাইভ দৃশ্য বিশ্ববাসীও দেখছে। আরব বসন্ত এখন রক্তিম রূপ নিয়েছে। ইসলামপন্থী নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে সেকুলার রাজনীতিকÑ সেনা আঁতাত মিসরকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে মোবারক জামানায়। মিসর ও মুসলিম ব্রাদারহুডের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নানা বিশেøষণ চলছে। রক্তাক্ত এ আন্দোলনের শেষ পরিণতিই কী? বেসামরিক শাসনের মুখোশ পরা অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আইনগত প্রক্রিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হবে। যদিও জন্মের পর থেকে চার দশকের বেশি নিষিদ্ধ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড; কিন্তু অতীত ও বর্তমানের ব্রাদারহুডের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে।
মাত্র কয়েক দিন আগে দলটি ক্ষমতায় ছিল। পরিহাস হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থানে বে আইনিভাবে ক্ষমতাসীন সরকার এখন বিপুল ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলকে ‘আইনিপ্রক্রিয়ায়’ নিষিদ্ধ করতে চাইছে। যদিও ব্রাদারহুড একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক বাহু হচ্ছে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। মিসরের সংবিধান অনুযায়ী ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে ব্রাদারহুড নিষিদ্ধে সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে কোনো প্রভাব পড়বে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং এ নিষিদ্ধের সুযোগে মোবারক আমলের মতো জরুরি অবস্থা দীর্ঘায়িত হবে। গোয়েন্দা সংস্থা ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে জরুরি অবস্থাকে জায়েজ করা হবে। অতীতে মোবারক এ কৌশল নিয়েছিলেন। সংাবিধান স্থগিত ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে আটক করে সেনাপ্রধান জেনারেল আবুল ফাত্তাহ আল সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি মোবারককে দ্রুত ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক দিকে মুক্ত মানুষ হিসেবে মোবারক বেরিয়ে আসছেন। অন্য দিকে মিসরের মানুষের মুক্তি ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আন্দোলন ও আত্মত্যাগ তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে এক নজির স্থাপন করেছে মিসরের জনগণ। মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ৩ জুলাই। এরপর তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে ৪ জুলাই আন্দোলন শুরু হয়। ১৪ আগস্ট গণহত্যার আগ পর্যন্ত নাসের সিটির রাবা আল উদইয়া মসজিদ ও নাহদা স্কোয়ারে টানা অবস্থান করেন প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থকেরা।
তাহরির স্কোয়ারে ১৭ দিনের টানা আন্দোলনে মোবারকের পতন হয়েছিল। আর মুসলিম ব্রাদারহুড নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ফিরিয়ে আনতে টানা ৪১ দিন রাজপথে অবস্থান করেছে। এরপর মিসরের রাজপথ প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে। সহিংস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার পরও মুসলিম ব্রাদারহুড বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে সরে আসেনি। বরং এসব বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি আরো বাড়ছে। আন্দোলনে শুধু ব্রাদারহুডের সমর্থকেরা নন, অ্যান্টি ক্যু অ্যালায়েন্সে দেশের অপর প্রধান রাজনৈতিক শক্তি সালাফি গ্রুপগুলোও ব্রাদারহুডের সাথে যোগ দিয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি ও কারফিউ ঘোষণার পরও এ আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেনাবিরোধী এ আন্দোলনে দলটির কারাবন্দী আধ্যাত্মিক নেতা মোহাম্মদ বদিইর ছেলে আম্মার বদি মারা গেছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে মোহাম্মদ বদিইকে। অপর নেতা মুসলিম ব্রাদারহুডের সেক্রেটারি মুহাম্মদ বেলতাগির ১৭ বছরের মেয়ে আসমা বেলতাগি এবং কারাবন্দী ভাইস প্রেসিডেন্ট খাইরাত আল সাতিরের মেয়ে ও জামাই সেনা অভিযানে নিহত হয়েছেন। সরাসরি রাজপথের আন্দোলনে দলটির মধ্যম সারির আরো অনেক নেতা মারা গেছেন। স্বাভাবিকভাবে দলটির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর এ ধরনের আত্মত্যাগের বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। আন্দোলনকে আরো বেশি নৈতিক শক্তি জোগাচ্ছে। মুরসির পুনর্বহাল আন্দোলন আসলে সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে; কিন্তু এর পরও সেনাবাহিনী পিছু হটবে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই; বরং আরো কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। গৃহযুদ্ধ না ব্যর্থরাষ্ট্র এ ধরনের পরিস্থিতিতে মিসরে সেনাবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যেমনটি ১৯৯২ সালে আলজেরিয়ায় শুরু হয়েছিল। ইসলামিক সলভেশন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও সেনাবাহিনী ফল মেনে নিতে অস্বীকার করে।
এ গৃহযুদ্ধে প্রায় দুই লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল; কিন্তু আলজেরিয়ার মতো মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সশস্ত্র পথে যাবে এমনটি মনে করেন না অনেক বিশেøষক। কারণ মুসলিম ব্রাদারহুড মূলত সামাজিক শক্তি হিসেবে মিসরের জনসমর্থন পেয়েছে। আনোয়ার সাদাত ও মোবারকের দমনাভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে দলটির ক্ষুদ্র একটি অংশ সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা শক্তি অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম ব্রাদারহুডের মূল নেতৃত্বের সাথে তাদের আর সর্ম্পক ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে রক্তস্নাত আন্দোলনের মধ্যেও দলটির নেতারা বারবার বলছেন তারা গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সেনাশাসনের অবসান ঘটাতে চান। যদিও সেনাশাসক ব্রাদারহুডের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও সেকুলার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম একই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সশস্ত্র পথে না গিয়ে রক্ত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যদি এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে, তা হলে সেনাবাহিনীর জন্য সঙ্কট বাড়তে থাকবে; কারণ সেনাসমর্থিত অন্তর্র্বতী এই সরকারের কোনো আইনগত বৈধতা নেই। সেকুলার রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের পাশে দাঁড়াবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গণহত্যার পর সেকুলারদের জোটে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আল বারাদি অন্তর্র্বতী সরকার থেকে পদত্যাগের পর দেশ ত্যাগ করেছেন। আমর মুসা, আহমদ শফিকসহ অন্যান্য সেকুলার নেতা মোবারক সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণীর অংশ, সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই; যা বিগত নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। এ অবস্থায় অব্যাহত আন্দোলনে মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে গৃহযুদ্ধ না হলেও সেনাশাসনের কারণে মিসর একটি ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং দায়দায়িত্ব সেনা নেতৃত্বের ওপর বর্তাবে। প্রকৃতপক্ষে মিসরের সেনাবাহিনী এখন জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে।
জনগণের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী কখনোই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। বাদশাহ-আমির ও আমেরিকা মুরসি সরকারকে উৎখাতে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশ ছিল। শুরু থেকে মুরসিকে একজন ব্যর্থ শাসক হিসেবে তুলে ধরার নানা কৌশল নেয়া হয়। মুরসির এক বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা। মিসর বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর দেশ। দেশটির বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে পর্যটন। মোবারকবিরোধী আন্দোলনের পর থেকে মিসরে পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। এ পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি উপসাগরীয় দেশগুলো মুরসি সরকারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে বারবার অস্বীকার করেছে। এমনকি আইএমএফের ঋণ পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। অথচ মুরসিকে অপসারণ করে সেনাশাসকেরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ১২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয়। মুরসিকে উৎখাতের সেনা তৎপরতা সম্পর্কে আগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জানত। মুরসি সরকারের পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী আমর দারাগ নিউ ইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে বলছেন, সামরিক বাহিনী যে অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে এ কথা প্রথম জানিয়েছিলেন আমেরিকান একজন কর্মকর্তা। তিনি আরো জানানÑ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতাপ্রক্রিয়া শেষ মুহূর্তে জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসি বাতিল করেছিলেন।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের জন্য ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী দুই কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো মানবিক পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসানীয়। তবুও এ ঘটনা কেন যেন বুকের ভেতর কুঠার আঘাত হানছে। দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িতদের অন্যতম জননেতা আবদুর রাজ্জাক কি নিদারুণ অর্থকষ্টে-অনাদরে লন্ডনের হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় চিরতরে বিদায় নিলেন। তার জন্য কই, কোটি কেন লাখ টাকাও জোটেনি। আওয়ামী লীগের আরেক প্রবীণ নেতা জনাব আবদুল জলিল সিঙ্গাপুরে মারা গেলেন। তার তেমন আর্থিক কষ্ট না থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো খোঁজ নেননি। আলøাহ না করুন আমি অথবা আমার পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো কানাকড়ি খরচ করবেন? গত তিন বছরে আমার স্ত্রী দুইবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে মাসাধিক হাসপাতালে কাটিয়েছে। আমিও গুরুতর অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মাস ছিলাম। কেউ কোনো খোঁজখবর নেননি। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, ইচ্ছা করলেই যা খুশি তা করতে পারেনথ এটা ঠিক না। আজ না হোক কাল এসবের জবাব অবশ্যই তাকে দিতে হবে।
ফেলানী হত্যার বিচার নিয়ে ক’দিন হলো খুব আলোচনা হচ্ছে। আমাদের যে কি হয়েছে? বিএসএফের বিচার হচ্ছে বিএসএফের আদালতে। সেখানে কি বিচার হবে? লোকদেখানো কেউ দোষী হলেও বড়জোর দু-এক বছরের কোর্ট মার্শাল? শৃঙ্খলা বাহিনীর শাস্তি রাত-দিনে বছর। দুই বছর জেল হলে এক বছর খেটেই খালাস। তা ছাড়া ভালো ব্যবহারের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ মাফ। ফেলানীর বাপ-মা যত সাক্ষ্যই দিন আদালতের তো বেশি সাজা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকায় দুই কলম লিখেছিলাম। সেই থেকে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে দাওয়াত বন্ধ। যদিও ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি খবর দিয়ে পুরো পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। মাননীয় মন্ত্রী এলে বাড়ি এসে খেয়ে যান। কিন্তু দূতাবাসের দাওয়াত পাই না। না পেলাম, আমার কথা আমি বলেই যাব। তাতে দাওয়াত পেলে পেলাম, না পেলে না পেলাম।
নেশা করে ছোট্ট মেয়ে তার মা-বাবাকে যখন অমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তখন আইনশৃঙ্খলা থাকে কোথায়? সেও যদি পুলিশের লোক হয় সেক্ষেত্রে সরকারের দেশ চালানোর আর কি অধিকার থাকে? বোধশক্তি থাকলে কচুগাছের সঙ্গে গুটি সুতোয় ফাঁস নিয়ে মরা উচিত। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার দুই বছরেও কূলকিনারা হলো না। পুলিশ বাবা-মা হত্যার কূলকিনারা হতে আবার কত যুগ লাগবে কে জানে।
বজ্রকথনে ‘১৫ই আগস্ট এক মহাবিপর্যয়ের দিন’ নামে নিয়মিত কলাম লিখেছিলাম। সেখানে প্রতিরোধ সংগ্রামীদের কথা বলতে গিয়ে কোম্পানি কমান্ডার সুকুমার, জিতেন ভৌমিক, কবির বেগ, দেলোয়ার হোসেন, শাহাদৎ হোসেন সুজা, হুমায়ুনের নাম লিখিনি। প্রাসঙ্গিকও ছিল না। কিন্তু কি করে যে সখিপুরের আবদুল হালিম, লুৎফর রহমান, ফুফাতো ভাই শাহালম, বিশেষ করে নওশের আলী নসুর নাম বাদ পড়েছিল ভেবে পাই না। ধামরাইর শরিফ, সাভারের ফিরোজ কবির, ডা. শরিফুল, আলী আজম আলমগীর (আলম), দুলাল দে বিপ্লব এদের চেয়ে শেষ মুহূর্তে নসুর ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রেফতার হয়ে চান্দভূই ক্যাম্প ছাড়তে গিয়ে ভারতীয় জিপে ওঠার সময়ও নওশের আলী নসু নোটবই হাতে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রতি মুহূর্তের কাজ রেকর্ড করছিল। গাড়িতে উঠলে শেষ নোটখাতাটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিলথ ‘সর্বাধিনায়ক এইমাত্র গ্রেফতার হয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের গাড়িতে আমাদের ক্যাম্প ত্যাগ করলেন।’ সেই নসুর কথা লেখা হয়নি। এটা একটা মারাৎদক ভুল। বয়সের কারণেই এমন বড় বড় ভুল হচ্ছে কিনা, নাকি বাসা ঠিকঠাক করার জন্য কাগজপত্র এলোমেলো থাকায় হচ্ছে বুঝতে পারছি না। শেষবার হেডকোয়ার্টারের অস্ত্রাগারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গাইবান্ধার ছোট্ট রফিক এটেনশন হয়ে এক অসাধারণ স্যালুট দিয়েছিল। যোদ্ধা দলে সুন্দর স্যালুট দেওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সারা দিন একজন আরেকজনকে স্যালুট দিতে হয়। যে কোনো সামরিক ছাউনিতে স্যালুট বাঙালির ডাল-ভাতের মতো। জীবনে কত হাজার লাখ স্যালুট পেয়েছি, এখনো পাই তার লেখাজোখা নেই। কিন্তু সেদিনের সেই স্যালুট আজো আমার চোখে ভাসে, হৃদয়ে গেঁথে আছে। লেখাটির অবতারণা করেছিলাম সম্প্রতি বোন রেহানার এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা ওটা বলেন কিছু মনে করি না। সরকারপ্রধান হিসেবে তার অনেক বাধ্যবাধকতা। তেমন সৎ সাহস না থাকলে সত্য বলা কঠিন। কিন্তু বোন রেহানার তেমন বাধ্যবাধকতা কই? প্রাক্তন স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে ফেরেস্তার সঙ্গে তুলনা করে, আমাদের কোনো পর্যায়েই না ফেলায় খুবই বিরক্ত লেগেছে। ফেরেস্তাতুল্য জনাব হুমায়ুন রশিদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের চাকরি করেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন। একে খন্দকার বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের চাকরি করেছেন, এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, এখন মহাজোটের মন্ত্রী। আবুল মাল আবদুল মুহিত জিয়া-এরশাদকে ভেজে খেয়ে এখন মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর চামড়া তুলে নিতে চেয়ে মতিয়া চৌধুরী মন্ত্রী। জাতির পিতাকে জুতার ফিতা বলে হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী। কতজনের কথা বলব? বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রেহানা, জয়-পুতুলই করেনি, আরও অনেকেই করেছে, যারা তাদের অমূল্য প্রাণ দিয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রতারণার প্রকৃতিই একদিন বিচার করবে। আমি শুধু মনে করিয়ে দিলাম মাত্র। জানি সত্য সব সময় গায়ে জ্বালা ধরায়। কিন্তু বড় হলে সত্য হজমের ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। ববি-টিউলিপ অথবা জয়-পুতুলের ছেলেমেয়েদের বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ভূমিকা রাখার কথা বললাম না কারণ তখনো তারা জন্মায়নি। বলেছে জয়-পুতুলই ছিল তখন তার সময় কাটানোর প্রধান অবলম্বন। হতে পারে, ৬-৮ মাস রেহানা জয়-পুতুলের কাছে ছিল। কিন্তু তারপর জয়-পুতুলের চায়না ক্লে নিয়ে খেলায় যতক্ষণ সময় দিয়েছি তার শতভাগের এক ভাগও দিতে পারেনি। পান্ডারা রোডের বাড়ির নিচে বিকালে পুতুল যখন ছোটাছুটি করত, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলত, আমি গেলে নড়তে দিত না। চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা কি করি? তার মন ভাঙতে পারতাম না। যতক্ষণ খেলত শত কাজ থাকলেও অপেক্ষা করতে হতো। খেলা শেষে ছুটে এসে মামা বলে যখন জড়িয়ে ধরত তখন ছোট্ট বাচ্চার স্পর্শে প্রবাসের শত দুঃখেও বুক জুড়িয়ে যেত। যেমনটা এখন কুশিমণি করে। সারা বাড়ি একদিকে কুশিমণি একাই একদিকে। সে যা বলবে তা-ই হবে। গাড়ির ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, গেটের দারোয়ান, কাজের ছেলে, কাজের মেয়ে, বাড়িঘর মেরামতের রড মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, জোগালি কারও রক্ষা নেই। কেউ কথা না শুনলেই চিৎকার, আব্বুৃ হোসেন কথা শুনে না, ফরিদ চাচ্চু কেমন করে, তুহিন দুষ্টামি করছে, আবদুলøাহ চাচ্চু খেলে নাথ এ রকম হাজারো অভিযোগ। অমন অভিযোগই জয়-পুতুলও দিলিøতে করত। তখন রেহানা ধারেকাছেও ছিলেন না, ছিলেন লন্ডনে। তবে ভাগিনা-ভাগনিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, এখনো বাসেন। মা-বাবার মধ্যে তর্ক হলে আমি গেলেই দুজন জড়িয়ে ধরে বলত, দেখ মামা, মা-বাবা অমন করলে, মন খারাপ করে থাকলে আমরা কি করব? যে কারণে দিলিø গেলে যত বেশি পারতাম ওদের সময় দিতাম। আমাকে পেলে প্রধানমন্ত্রী কি যে খুশি হতেন তা শুধু আলøাহই জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোটা কাচের চশমা পরতেন। চশমা খুলে কিছুই দেখতেন না। একটু দূরে চশমা থাকলে খুঁজে পেতেন না। তাকে ২৪ ঘণ্টাই চোখে চশমা রাখতে হতো। মানে ঘুম ছাড়া সব সময় চশমা পরা। ঘুমের সময় হঠাৎ চশমা হাতছাড়া হলে নিজে খুঁজে পেতেন না। অনেক সময় অন্যকে খুঁজে দিতে হতো। এখনো দিতে হয় কিনা জানি না। রান্না করতে গিয়ে অনেক সময় অসুবিধায় পড়তেন। একজন মানুষ হিসেবে দিলিøর কষ্টের জীবন ছিল বাঙালি মা হিসেবে, বাঙালি বোন হিসেবে তার শ্রেষ্ঠ সময়। কামাল, জামাল, রাসেলকে হারিয়ে ভাই হিসেবে আমাকে অসম্ভব যতœ করেছেন। মা-পাগল মানুষ ছিলাম আমি। তিনি আমার ছোট না হলেও বয়সে মোটেই বেশি বড় হবেন না। তবুও তাকে মায়ের মতো দেখেছি। আমি দিলিøর যে দিনগুলোর কথা বলছি তখন আমাদের বড় দুর্দিন ছিল। তাই কোনো কলুষতা, মলিনতা ছিল না। অর্থবিত্ত ছিল না তাই কোনো অভাবও ছিল না। চিত্ত ছিল শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা ও আন্তরিকতার ধনে ভরা। যখনই পান্ডারা রোডে গেছি একবারও না খেয়ে ফিরিনি।
১৫ আগস্ট বেলা ১টায় সহধর্মিণী নাসরীন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকার দিকে পাড়ি জমিয়েছিল। নিজে যখন গাড়িতে থাকি তখন তেমন চিন্তা হয় না। কিন্তু পরিবার-পরিজন যখনই গাড়িতে উঠে স্বস্তি পাই না। গাড়ির চালক হোসেন, যীশু, মান্নান সবাই অভিজ্ঞ, ধীরস্থির। কেউ প্রায় ৪০ বছর ধরে আছে। কিন্তু তবু রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখে একটা অস্বস্তি লেগেই থাকে। ঔরসজাত দীপ-কুঁড়ি বড় হয়েছে। কিন্তু আলøাহর দান কুশিমণি বেশ ছোট। বাইরে গেলে ওর কথা মন থেকে আড়াল করতে পারি না। আলøাহর রহমতে ওরা সহিসালামতেই দুই-সোয়া দুই ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছেছিল। কিন্তু ওর কয়েক ঘণ্টা পরেই শুরু হয়েছিল সেই মহাজটথ যা চলেছিল ৬০ থেকে ৭০ ঘণ্টা। মানুষের সে যে কি কষ্ট!
১৯৭১-এর ১৬ আগস্ট হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। বাঁচার তেমন আশাই ছিল না। আলøাহর দয়ায় কেন বেঁচে আছি তা তিনিই জানেন। প্রতি বছরই মাকরাই যাই। কয়েক বছর আগে বিকল্প ধারার সভাপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আ. স. ম. আবদুর রব, বিকল্প ধারা মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান গিয়েছিলেন। কয়েক লাখ লোক সমাগম হয়েছিল সেবার কিন্তু এবার যেতে পারিনি। কারণ পরম সুহৃদ মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মেয়ের আংটি বদল। অন্তরের টানে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মানুষের আন্তরিকতার যে কত শক্তি সেটি দুই-চারজন গরিব এবং দুই-একজন ধনবানের মধ্যে দেখেছি। তাদের মধ্যে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান অন্যতম। এমনিতে ধনবানদের অনেককেই আমার ভালো লাগে না। কিন্তু কি করে যেন মেজর মান্নান সেই বেরিয়ারটা অতিক্রম করেছেন। যতবার তার কাছে গেছি কখনো ছাড়তে চাননি। সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে উঠতে চাইলে উঠতে দেননি। প্রথম প্রথম মনে হতো লৌকিকতা করছেন। কিন্তু অনেক দিন দেখে দেখে সে ধারণা বদলে গেছে। এখন মনে হয় আমাকে পেলে সত্যিই তিনি বড় বেশি খুশি হন। ব্যবসার ঝামেলা থেকে কিছু সময় অন্য চিন্তা করার সুযোগ পান। আমি আদার বেপারি জাহাজের খবর কিই-বা জানি। তারপরও মাঝে-মধ্যে নিজের কষ্টের কথা বলে হালকা হতে চেষ্টা করেন, সেটা সব ধরনের কথাই। আমারও বেশ ভালো লাগে। জীবনে কত কষ্ট করেছি, এখনো কত শঙ্কা, কত জ্বালায় থাকি। কেউ হাত পাতলে ভরে দিতে পারি না, সে এক জ্বালা। যারা এক সময় হাত পেতে থাকত তারা এখন তাদের সম্পদের নিচে আমাদের কবর দিতে চায়। সে আরেক জ্বালা। ক্ষমতাবান কেউ কেউ এমন ব্যস্ততা দেখায় ফোন করলে ধরে না। আবার কখনো প্রয়োজন হলে ঘণ্টায় সাতবার ফোন করে বিরক্ত করে। এসবের বাইরের মানুষ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। আগেই বলেছি ১৬ তারিখ আমার মরণদিন। তারপরও মেজর মান্নানের মেয়ের বিয়ের আংটি বদলে যোগ দিতে বেলা ২টায় টাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়েছিলাম। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি জমে থাকায় গোড়াই হয়ে না গিয়ে ভাতকুড়া, বাসাইল, সখিপুর, ভালুকা সিডস্টোরের রাস্তা ধরেছিলাম। গ্রামে প্রবাদ আছে, ‘তাড়াতাড়ি যেতে চাও তো ঘুরে যাও’। সেদিন সেই ঘুরা পথই ধরেছিলাম। কিন্তু তাতে তাড়াতাড়ি হয়েছিল কিনা বলতে পারব না। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় সে কি ভিড়, দেড়-দুই কিলোমিটারে দুই ঘণ্টা লেগেছে। ৮টার দাওয়াতে ৯টা ৪০ মিনিটে সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে গিয়েছিলাম। খুব মার্জিত চমৎকার ব্যবস্থাপনা ছিল। গেটে জাহাঙ্গীর, হলের দরজায় মেজর মান্নান দাঁড়িয়েছিলেন। বহুদিন পর তাকে বড় বেশি হাসি-খুশি মনে হচ্ছিল। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। ১৬ তারিখই প্রথম মনে হলো, আমার মেয়ের বিয়ের দিন আমারও কি অমন হবে? হলে দেখলাম ১ নম্বর টেবিলে জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাশের টেবিলে ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী ও প্রাক্তন জ্বালানিমন্ত্রী জেনারেল নুরউদ্দিন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাশে আমাদের বসানো হয়। ডানে কুশিমণি, তারপর তার মা নাসরীন। এরশাদ সাহেবের বামে এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি ফরিদপুরের একে আজাদ। যার ফরিদপুরের সংবর্ধনা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিয়াই মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিরোধের কারণে জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর চেয়ে বড় বড় ছবি ছাপায় বেশ আলোচিত। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস এসেছিলেন। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে এই প্রথম দেখলাম। হয়তো আরও অনেক অনুষ্ঠানে যান কিন্তু আমি দেখিনি। ড. কামাল হোসেন এবং জেনারেল নুরউদ্দিনের মাঝে বসেছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে আমরা আগেই চলে এসেছিলাম। আমাদেরও আগে জনাব এরশাদ চলে গিয়েছিলেন।
সেদিন আমার এক প্রিয় সাংবাদিক সাগর আনোয়ারের প্রশ্ন ছিল, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বা ষড়যন্ত্র সফল করতে অধ্যাপক ইউনূসকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন কিনা? আমার বরাত দিয়ে সে উলেøখ করেছে, ‘যদি বিদেশি কোনো রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র করে, তবে ড. ইউনূসকে দিয়ে লাভবান হবে না। অধ্যাপক ইউনূস ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হওয়ার উপযুক্ত নন। এমনটাই মনে করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।’ আসলে অধ্যাপক ইউনূসকে আগে কখনো ঝেঁকে দেখিনি, অধ্যয়ন করিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের ঘটনায় তাকে পরতে পরতে উল্টে-পাল্টে দেখার চেষ্টা করেছি। আমারও এক সময় মনে হয়েছিল ঘুষ টুষ দিয়ে নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু নাড়াচাড়া করে উপলব্ধি হয়েছে, কেউ তাকে দয়া করে নোবেল দেয়নি। তার যোগ্যতাকে সম্মান জানাতে নোবেল কমিটি বাধ্য হয়েছে। আর বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো এজেন্ডার বাহন হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার নেই। সাদাসিধা, খোলামেলা নিরহংকার একজন খাঁটি বাঙালি তিনি। তার মধ্যে দেশপ্রেমের যে স্ফুরণ আমি দেখেছি অমন মানুষ অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের বাহন হতে পারে না। তাই ওকথা বলেছি, অধ্যাপক ইউনূসকে জাতীয়ভাবেই আমাদের আরও সম্মান করা উচিত। তাকে আর বিব্রত করা উচিত নয়। তার মেধাকে কাজে লাগালে জাতি উপকৃত হবে। জাতীয় এই কল্যাণব্রতী মানুষটাকে নাজেহাল করতে গিয়ে আমরাই বড় বেশি নাজেহাল ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ক্ষমতাসীনদের কবে উপলব্ধি হবে? তবে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই দেশের কল্যাণ বা মঙ্গল।
মহাজোট সরকারের এটাই ছিল সরকারিভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেষ শোক পালন। তারা আর সরকারিভাবে শোক পালন করতে পারবে কিনা ভবিতব্যই জানে। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় শোক পালনে দলাদলির কোনো মানে হয় না। যারা অমন করবেন তাদের মহাকালের কলঙ্ক অবশ্যই গ্রাস করবে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালোত্তীর্ণ বাংলার জনগণ তথা বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার অগ্রদূত। নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের বন্ধু। আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু বললেও তিনি তার আপন মহিমায় মানবতার বন্ধু, বিশ্ব বন্ধু। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠন ছাড়া ১৫ আগস্টে মহাজোটের অন্য শরিকদের কোনো উচ্চবাচ্য দেখা গেল না। কেমন যেন কোছ কাটা ছুরির মতো সবাই লুকিয়েছিল।
বছর আড়াই আগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দুই ঘণ্টার একটু কম একান্তে আলোচনা হয়েছিল। চারদলীয় জোটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাদের আমাকে দরকার। ওরকম আওয়ামীদেরও আমাকে চাই। আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছিলাম, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত সঙ্গে থাকলে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া যৌবনে প্রেম করিনি, বঙ্গবন্ধুকে ভালো বেসেছিলাম, না চাইতেই তার সঙ্গে একটা প্রেমের অনুভূতির মিশ্রণ ঘটেছে। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব বেশি হৃদয়জুড়ে আছে। বিধবার সাজ না ধরলেও আমার অন্তরাৎদাজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আপনার জোটের নেতারা তাকে নিয়ে যখন তখন যা খুশি তা বললে আমার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ১৫ আগস্ট শোকে আমরা যখন মুহ্যমান, জাতির মহারক্তক্ষরণের ক্ষণে আপনার শুভ জন্মদিন, বড় নিষ্ঠুরভাবে হৃদয়ে বাজে। তাই ওটা থেকে বিরত হতে হবে। তিনি বলেছিলেন, অমন একজন মহান নেতার নির্মম মৃত্যুদিনে ঘটা করে জন্মদিন পালনে আমিও উৎসাহী নই। কিন্তু কি করব, দশের চক্রে ভগবান ভূতের মতো অবস্থা। দলীয় নেতা-কর্মীরা করে, দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা তাদের ফিরাই কি করে? তবে আপনার কথা মনে রাখব। জানি না কতটা মনে রেখেছেন। কিন্তু পরের বছর তিনি জন্মদিন পালন করেননি। জন্মদিনে সৌদি আরব ছিলেন। গত বছর ছিল মাহে রমজান। এ বছরও নিজে কেক কাটেননি, দলের নেতারা কেটেছেন। জানি না তার নিজের কেক না কাটা বা তাতে অংশ না নেওয়া শ্রদ্ধা নাকি কৌশল। তবে আওয়ামী লীগের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তারা বলেছে, যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে, আনন্দ-ফুর্তি করে তাদের সঙ্গে আবার সমঝোতা কিসের। তাহলে কোনো আওয়ামী নেতার ১৫ আগস্ট বাচ্চাকাচ্চা হলে গলা টিপে মেরে ফেলবে না তো? শুধু ছোটখাটো নেতারা বলেননি, স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। দেখাই যাক কত ধানে কত চাল। এসবে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ করেছে, বেগম জিয়া জন্মদিনে নিজে কেক কাটেননি, এতে কি তাদের সঙ্গে আমাদের মিশে যাওয়ার পথ খুলে যাচ্ছে? আবার আওয়ামীরা স্বাধীনতার পক্ষ বলে রাতে যোগাযোগ করছে। সময় বড় নিয়ামক।
সময়ের এক ঘা অসময়ের শত ঘা সমান। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র সংসদে বলেছেন, তিনি আর নির্বাচন করবেন না। না করলে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের তবু একটু সম্মান পেয়ে যাবেন। আর নেত্রীর কথায় যদি নির্বাচন করেন লোকজন বলবে, মদখোরের ‘রাত কি বাত, বাত কি বাত’। মানে নেশার ঘোরে রাতের কথা কথার কথা, কোনো মূল্য নেই। আওয়ামী নেতাদেরও কথার কোনো মূল্য নেই। বেগম খালেদা জিয়া নিজে কেক কাটেননি, তাই এমন চিৎকার। কোনো সমঝোতা করবেন না। নিজে কেক কেটে ঘটা করে জন্মদিন পালন করলে মনে হয় সব নেতা আৎদহত্যা করতেন। কোনো সমঝোতা না হলে কার ক্ষতি? সব থেকে বেশি দেশের। তারপরই তো আওয়ামীপন্থিদের। কথাটা একটু হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করবেন। আর জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার দিনে আওয়ামীদেরও কি এবং কেমন করা উচিত সেটাও ভাবার মনে হয় সময় এসেছেৃ।
লেখক : রাজনীতিক।
অপপ্রচার বাজারে চলে বেশি, এর প্রতি সাধারণের আগ্রহ বেশি। সুকর্মের প্রচার এ দেশে তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মতো দেশে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থেকে এবং থেকে কিছু অপকর্ম করবেই। সরকারে থাকলে নিজেকে গরম মিয়া মনে হয়। এবং সব সময় গরম থাকলে নিজের ক্ষতি হবেই। কিন্তু মিডিয়াতে কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার ইতিবাচক কিছু করলে তা খবর হয় না। অপকর্ম করলে তো অবশ্যই হবে এবং হোক, সেটি আমরা চাই। কিন্তু ইতিবাচক বিষয় না তুললে পত্রিকা ভারসাম্য হারায়।
আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে অপকর্ম অনেক করেছে। সেগুলো ডিফেন্ড করে কোন লাভ নেই। আমাদের বিবেচনা করতে হয় বিএনপি-জামায়াতের তুলনায় কত কম অপকর্ম করেছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা তা করবেনই; কারণ, রাজনীতি এখন মূলত আদর্শের বদলে পেশা। গত কয়েক বছরের পত্র-পত্রিকা দেখুন, মনে হবে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে শুধু অপকর্ম করতেই। কিন্তু সত্য ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত অধ্যাপক এবিএম নাসিরের (১৪.৮.১৩) প্রবন্ধটি উলেøখ করব। সেখানে কিছু উপাত্ত দেয়া আছে।
নাসির লিখেছেন, ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে চারটি নির্বাচিত সরকার ও একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থেকেছে।
দীর্ঘ ২৫ বছরে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিএনপি আমলে। এর কারণ, জামায়াত চিরজীবন ভায়োলেন্সে বিশ্বাসীনÑ বিএনপির জন্ম ভায়োলেন্সের মাধ্যমে। বিএনপি-জামায়াতের সহযোগী হলো সব মৌলবাদী সংগঠন। খালেদা, নিজামী, তারেকের আমলে বাংলাদেশে সাবেক মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধিসহ নিহত হন ‘‘১৩৭ জন, আহত হন ১৪৫৮ জন।’’ গুলিতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন এএসএম কিবরিয়ার মতো অজাতশত্রু মানুষ, আহসানউলøাহ মাস্টারের মতো জনপ্রতিনিধি, আইভি রহমানের মতো রাজনৈতিক নেত্রী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস। আহত হন, এমন কি ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও। গত চার বছরে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে? বলতে পারেন চৌধুরী আলম বা ইলিয়াস আলীর কথা। কথিত আছে, মেয়র খোকার আমলে টোকাই আলম গুলিস্তানে নাকি বঙ্গবাজার পুড়িয়ে দেয়।
তারপর তা দখল করে এক দানে কোটি কোটিপতি হয়ে যায়। বিএনপির দাবি, র্যাব তাকে গুম করেছিল। এখন জানা গেছে, আলমের প্রতিদ্ব›দ্বী আরেক টোকাই থেকে কোটিপতি তাকে গুম করে। ইলিয়াস আলী কী উপায়ে অর্থ ও পেশিশক্তির মালিক হয়েছিলেন তা তার সমসাময়িক সবাই জানেন। বিএনপি সরকারই তাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছিল। তাকে গুম করে সরকারের লাভ কি? গুম করলে তো তাদের করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ফায়দা আছে। গু-াপা-া গুম করে রাজনৈতিক ফায়দাটা কী? এএসএম কিবরিয়া, আইভি রহমান বা আহসানউলøাহ মাস্টারের ব্যাকগ্রাউন্ড কি সেরকম? সরকারী প্রচেষ্টায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুনের চেষ্টা তো বিএনপি আমলেই ঘটেছে। যখন বর্তমান সরকারের অপকর্মের কথা ফলাও করে ছাপা হয় তখন সযতনে এসব কথা এড়িয়ে যাওয়া হয় এ বলে যে, পুরনো কথা থাক। পুরনো কথা বাদ দিলে বর্তমান বুঝব কিভাবে?
সাংবাদিক নির্যাতনের কথা আসে। বিএনপি আমলে সাংবাদিক হত্যা করা হয় ১৩ জন। এ আমলে ৭ জন। রাজনৈতিক ভায়োলেন্সে বিএনপি আমলে মৃত্যু ১২৬৫ জন, আর এ আমলে ৭৫৮ জন। [ক্রসফায়ারে আওয়ামী লীগ আমলে ৩৪৬ জন [এ পর্যন্ত], বিএনপি আমলে ৭৯৬ জন। ভায়োলেন্সেও আওয়ামী লীগ হার মানাতে পারেনি বিএনপিকে। তাহলে বুঝুন, দু’একটি ছাড়া অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থার ব্যবসাটি কি রকম!]
না, আমি কোন মৃত্যু, হত্যা, গুম কোন আমলেরই সমর্থন করি না। কিন্তু মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দল (বিএনপি-জামায়াত) কিভাবে অপপ্রচার চালায় তার একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। কারণ, পরিসংখ্যানের চেয়ে জোরালো সাক্ষী আর কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক ছোট একটি নিবন্ধে যা প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রী-উপদেষ্টা তার কিছুই পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস শাখা ও মন্ত্রণালয় [ইনুর আগে] যে কতটা অযোগ্য এটি তার ছোট একটি উদাহরণ। কিন্তু, মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, অযোগ্যদের এত যোগ্য ভাবেন কেন রাজনৈতিক নেতারা? তারা কি ভাবেন যোগ্য লোক এলে নেতার নেতৃত্ব খাটো হয়ে যাবে? পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা সোনিয়া গান্ধী কাদের পাশে রাখেন দেখুন।
গত চার বছরে আওয়ামী লীগ যা করেছে গত ২৫ বছরে কোন সরকার তা করেনি। বিলবোর্ডের প্রচার ঠিকই ছিল, কিন্তু মাথামোটা লোকজন পাশে থাকলে যা হয় তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভেবে অবাক হতে পারেন যে, কার জন্য এত করলাম? তিনি এত করেছেন ঠিকই আছে, কিন্তু সব মানুষ জানবে কিÑ কিভাবে যেখানে তার আশপাশে প্রচার অনভিজ্ঞদের দেয়া হয় প্রচারের দায়িত্বে?
আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনে ক্রমাগত হারছে তার কারণ কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। সরকার নীতি নির্ধারণ করে অগ্রাধিকার ঠিক করে তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। দেশের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দলকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। দলের যে নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হয়েছে তার একটি উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু তা সফল হয়নি। এর একটি কারণ, সব কিছু দলীয় সভানেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত। সমষ্টিগত নেতৃত্ব নেই। যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিষ্ক্রিয় সে দল চলবে কিভাবে? এখন দলের সাংগঠনিক অবস্থা বিপর্যস্ত। এ মন্তব্যে দলের নেতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না। এ সব মতামত বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় নেতারাই আমাদের জানিয়েছেন। দলের কর্মীরা টাকা ছাড়া এক পা নড়তে নারাজ। এ অবস্থার জন্য দলীয় নেতারাই দায়ী।
বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করলেও বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ আদর্শ থেকে বর্তমান নেতৃত্ব সরে এসেছে। আদর্শের জায়গাটা অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। দলে ত্যাগীদের থেকে অর্থবানদের ইজ্জত বেড়েছে এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন জোরালো না হওয়ায় দলের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ কথাটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নেতৃত্ব যে, কোন শক্তি কোন দলকে ক্ষমতায় বসায় না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মানুষই দলকে ক্ষমতায় নেয়। সেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নেয় সংগঠন। গত চার বছরে সরকার হয়ত উপকৃত হয়েছে, কিন্তু দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা ভোট দেবেন স্থানীয় এমপি-নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই, রনি-বদিরা এর উদাহরণ। শহুরে সির্ভিল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ। এলিট সমর্থকরাও উপেক্ষিত। অর্থ ছাড়া সব কিছু যেন অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সমর্থক, এলিট ও অর্থবান এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি যদি পুলিশের পিটুনি খায় তাহলে অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমেয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকায় এসেছেন। তিনি বলছিলেন, শেখ হাসিনা বলছেন জিতবেন। আর তার নেতারা নিজ দলকে ৩০/৪০টির বেশি সিট দিতে রাজি নয়, ব্যাপারটা কী? ব্যাপার কেউ জানে না। তবে এটা জানে যাদের নিয়ে শেখ হাসিনা লড়বেন বলে ঠিক করেছেন, ৪ সিটি কর্পোরেশনে হারার পর তারা মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দল, হয় লড়াইর জন্য চাঙ্গা হয় না হয় মিইয়ে পড়ে; কিন্তু আওয়ামী লীগ মিইয়ে পড়েছে। এর অন্যতম কারণ দলে এখন কোন দিকনির্দেশনা নেই। এক ঘেরাটোপে আটকে আছেন সভানেত্রী।
আওয়ামী লীগ কী করবে তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ঠিক করবে, সেখানে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা কোন পরামর্শ দিচ্ছি না। আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে মনে করে আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা আমাদের যা বলেন তার সারাংশ তুলে ধরলাম। আওয়ামী লীগ এত ইতিবাচক কাজ করেও যদি নেতৃত্বের অকারণ জেদ, অহমিকা ও ভুলের কারণে [ভুল দেখিয়ে দিলেও, ‘আমি যা বলছি তাই ঠিক’Ñ এটিই জেদ, ভুল স্বীকার না করায় কোন মাহাত্ম্য নেই] যদি ১৪ দল পরাজিত হয় তাতে তো আমরা আনন্দিত হব না। খানিকটা হতাশ হই এ ভেবে যে, এত অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো কোন ব্যক্তি বা দল নেত্রী সৃষ্টি করতে পারেননি। এ জন্য বলা হয়, মূর্খ যোগ্যতাহীন চামচা বন্ধু থেকে বুদ্ধিমান শত্রু শ্রেয়।
অপপ্রচারের কথা বলছি বারবার এ কারণে যে, তা জনমনে শুধু বিভ্রান্তি নয়, দলেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যে প্রচারটি চালানো হয়েছে তাহলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণ জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা; যাতে তারা বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি আওয়ামী লীগের অনেকে তা বিশ্বাস করে।
তারা বিশ্বাস করে, মাদ্রাসা-মক্তবকে তোষণ করলে ভোট আসবে। যে কারণে, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো মানুষ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরও মাধ্যমিক কারিকুলামে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়। মাদ্রাসাকে যে এত তোষণ করা হয়েছে তাতে কি ভোট বেড়েছে? নিতান্ত গবেট না হলে এ ধারণা কিভাবে হয়: যারা জামায়াত করে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? বিএনপির সঙ্গে জোট না থাকলেও দেবে না। পাকিস্তান তাদের ফাদার-মাদার। সেই পাকিস্তানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিদের অপমানের চূড়ান্ত করেছে; এটি একজন ট্রুু জামায়াতী, ট্রু বিএনপি মেনে নিতে পারে না। হেফাজত কখনও ভোট দেবে না আওয়ামী লীগকে। নারী দেখলে যে আহমদ শফীর লালা ঝরে তাকে তোয়াজে কি ফল হয়েছে? কিন্তু আওয়ামী লীগ তোয়াজ করতে চেয়েছে এবং ঝাঁপটা খেয়েছে। এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেছে। এবং এই বিশ্বাস আওয়ামী লীগের মূল আদর্শ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ম্লান করেছে। দলের নেতা শেখ হাসিনা বটে, কিন্তু দলের যে নেতৃত্ব তিনি সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই।
হেজাবিরা যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তখন শেখ হাসিনা [হঠাৎ সৈয়দ আশরাফ] বলেছিলেন, জামায়াত-হেফাজতকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। এই উক্তি দলের আদর্শের নড়বড়ে স্থানটা ঠিক করে দিয়েছিল। দলের তৃণমূল নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। তার মত অনুসরণ করে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন শুধু স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর অন্য কোন মন্ত্রী, কোন বড় বা পাতি নেতা, কোন উপদেষ্টা, কোন এমপি এ কথা বলেননি। এমনকি চার পরাজিত মেয়র হেফাজতী ও জামায়াতীদের তোয়াজ করেছেন এবং লাথি খেয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর এসেছে জামায়াত নিষিদ্ধকরণ ও গোলাম আযমের দ- বৃদ্ধি প্রসঙ্গ। আমরা জেনেছি, এ প্রশ্নেও ছাড় দিতে চেয়েছিল পার্টির কিছু ব্যক্তি [যাদের মিত্র মনে করা হবে আরেকটি ভুল]। কিন্তু এ দু’টি ক্ষেত্রেই সরকার আপীল করার পর এখন আর অপপ্রচারের কোন সুযোগ নেই। এবং এই কার্যক্রম শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া হয়েছে, এটি কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না। আদালতের রায় কী হবে জানি না। কিন্তু শেখ হাসিনা যে এই পথটি বেছে নিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জায়গাটায় পৌঁছাবার পদক্ষেপ নিয়েছেন, সে কারণেই অন্তত ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব।