May 3, 2024
ঢাকা: কিছু দিন পরপর ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলেছে টার্গেট কিলিং। এর সর্বশেষ শিকার বিদুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা খিজির খান। পুলিশ খুনের অনুমান ছাড়া গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এর আগে ব্লগার অভিজিৎ রায়, সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রি, গোপীবাগের ভিন্নমতের নেতা লুৎফর রহমানসহ তার ৬ অনুসারী, চ্যানেল আইয়ের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন। গোয়েন্দারা বলছেন, এসব হত্যাকা- একইসূত্রে গাঁথা। ভিন্ন মতালম্বী লুৎফর রহমান হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত সেই গ্রুপই এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে।
বাড্ডা থানার ওসি এমএ জলিল বলেন, ‘ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা পরিকল্পিত হত্যাকা-। নিহত খিজির খান পীর-দরবেশ ভক্ত। তিনি নিজেও বাংলাদেশ খানকা শরিফের প্রধান। সেহেতু এই অনুসারীদের যারা দেখতে পারে না বা ইসলামের শত্রু মনে করে সেই গোষ্ঠীই পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় এখনও মামলা দায়ের হয়নি। তারপরও খুনিদের গ্রেপ্তারে আমরা অভিযান চালাচ্ছি।’
খিরিজ খানের বাড়ির কাজের বুয়া আমেনা বেগম বলেন, ‘সন্ধ্যার পর পরই ৪/৫ জন লোক খানকা শরিফের ভেতরে প্রবেশ করে স্যারকে ধরে ফেলে। এ সময় আমি বাথরুম পরিষ্কার করছিলাম। আমি সেটি দেখে বের হয়ে ভাবি গো বলে চিৎকার দিই। এরপর তারা আমার হাত, মুখ ও চোখ বেঁধে ওয়াশরুমের একটু সামনে শুইয়ে রাখে। দীর্ঘক্ষণ আমেনা বেগম দোতলা থেকে তিন তলা না যাওয়ায় সন্দেহ হয় খিজির খানের স্ত্রী রুবি বেগমের। এসময় তিনি ও আরেক কাজের মেয়ে কিশোরী সাফিয়াকে সঙ্গে করে তিন তলা থেকে দুই তলায় খানকা শরিফে নেমে আসেন। এসময় ঘাতকরা সালাম দিয়ে তাদেরও হাত, মুখ চোখ বেঁধে ফেলে। এক পর্যায়ে স্যারকে তারা আমার গায়ের ওপর দিয়েই ওযু খানার জায়গা নিয়ে গিয়ে জবাই করে।’ আমেনা বেগম আরও বলেন, ‘ঘটনার সময় আমার চোখ বাঁধা অবস্থায় শুয়ে থাকলেও মনে হলো আমার গায়ের ওপর দিয়েই স্যারকে নিয়ে যাওয়া হলো।’ কিশোরী সাফিয়াও বলেন, ‘আমরা যখন স্যারের খানকায় প্রবেশ করি তখন তারা সালাম দেয় এবং আমাকে ও আন্টিকে বেঁধে ফেলে।’
পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ৮/১০ জনের একটি দল নিচের গোডাউন ভাড়ার কথা বলে তারা প্রথমে বাসায় প্রবেশ করে। এর আগে তারা সোমবার বাসায় এসে গোডাউন ভাড়ার জন্য ৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে যায়। বাসায় প্রবেশের পর তারা কয়েকটি গ্রুপ ভাগ হয়ে যায়। একটি গ্রুপ খানকা শরিফে প্রবেশ করে অন্য একটি গ্রুপ তিনতলায় পরিবারের অন্য সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এরপর তারা ঠা-া মাথায় জবাই করে হত্যা করে। হত্যার পর গ্রুপটি সময় নিয়ে দু’একজন করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।
নিহত খিরিজ খানের ছোট ছেলে আশরাফুল আলম আহমদ বলেন, ‘সন্ধ্যার পর যখন লোকগুলো আসছিল সেই সময় আমার সঙ্গে তাদের দেখাও হয়। ওই সময় তারা বলে হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। সুতরাং আমি আর তাদের সঙ্গে কোনও কথা না বলে বাইরে চলে যাই।’ তিনি বলেন, ‘বাবার কাছে অনেক লোকই আসতো। বাইরে দারোয়ানকে হুজুরের সঙ্গে দেখা করার কথা বললে কেউ আটকাতো না।’ তিনি আরও বলেন, তার কোনও শত্রু ছিল না। এছাড়া পীর আওয়ালিয়াদের মাজারে যেতেন মাহফিল করতেন।
এদিকে, গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কাজের দুই বুয়াসহ বাকিরা সবাই বলেছেন, আল্লাহু আকবর বলে তারা জবাই করেছে। পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবাই পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে যে, জবাইয়ের সময় তারা সবাই আল্লাহু আকবর শব্দ শুনতে পেয়েছেন। এছাড়া ঘাতকদের মধ্যে ২/৩ জনের বয়স ২৫ এর নিচে আর ৪/৫ জনের বয়স ৩০ এর উপরে। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, প্যান্ট ও টি শার্ট ছিল। হত্যাকা-ের পর থেকে খিরিজ খানের আত্মীয় স্বজন সহকর্মী থেকে শুরু করে এলাকার বাসিন্দারা সেখানে আসেন। নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনায় শোকে বিবহব্বল হয়ে পড়েন সবাই। মঙ্গলবার নিহত খিজির খানের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে বাসায় পৌঁছালে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়। আত্মীয় স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। মহানগর আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কালোব্যাজ ধারণ করে নির্মম হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন।