November 5, 2025
ইন্টারনেটের মূল্য কমাতে হবে : বাংলাদেশে টেলিকম খাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিটিআরসির হাতে। তারা প্রায় সকল খাতেই দাম ঠিক করে দেয়। অন্তত দামের সর্বোচ্চ মাত্রাটা তারা নির্ধারণ করে থাকে। এমনকি মোবাইল অপারেটররা ভয়েস কলের কোন প্যাকেজ ঘোষণার আগে এই সংস্থার অনুমোদন গ্রহণ করে। অথচ ইন্টারনেটের দাম লাগামহীন। বিটিআরসি কর্তৃক এক এমবিপিএস ব্যান্ডউইদথের দাম সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে ১ জিবি ডাটা ২১ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি এখন ব্যান্ডউইদথের দাম ৪৮০০ টাকায় নামিয়ে এনেছে। ব্যবহারকারী পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম সেই তুলনায় মোটেই কমেনি। বরং ব্যান্ডউইদথের দাম যতই কমানো হোক না কেন ইন্টারনেটের খুচরা দাম কমছে না। অন্যদিকে ইন্টারনেটের প্যাকেজের নামে প্রকৃত স্পিড না দিয়ে ইন্টারনেটের যেসব সেবা প্রদান করা হচ্ছে সেইসব বিষয়েও বিটিআরসি কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই অবস্থায় বিটিআরসি উটপাখির মতো চোখ বন্ধ করে রেখে চলতে পারে না। এই প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা দরকার। দেশের রাজধানী শহরের বাইরে যেখানেই ব্যান্ডউইদথ নেয়া হোক তার জন্য বাড়তি চার্জ গুনতে হয়। সরকার যদি ডিজিটাল ডিভাইড না রাখতে চায় তবে এই বাড়তি ব্যয় থেকে ইন্টারনেট সেবাদানকারীদেরকে রক্ষা করতে হবে। বিটিআরসি এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট রয়েছে। বিটিআরসির দায়িত্ব হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বার্থে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ইন্টারনেটের ওপর থেকে ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা। বিটিআরসি শিক্ষা খাতে বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্রদানের সুপারিশও করতে পারে।
ডিজিটাল অপরাধ : ডিজিটাল অপরাধ দমনে বিটিআরসির ভূমিকা নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। দেশের টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক এই সংস্থাটি একাধারে এর লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ অন্যদিকে এর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্বও তার। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহার যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু দুষ্কৃতকারী মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা ধরনের ডিজিটাল অপরাধ সংঘটিত করছে যা ব্যক্তি, সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিষয়টিকে জরুরিভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। এজন্য বিটিআরসি কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে।
ক. নিবন্ধন ছাড়া কোন সিম বা ইন্টারনেট সংযোগ বিক্রি করা যাবে না। বিদ্যমান অনিবন্ধিত সিম বা সংযোগ বাতিল করতে হবে। এ ধরনের বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত লোকদের বিরুদ্ধে চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই ব্যবস্থাটি বিটিআরসিকে অবৈধ ভিওআইপি দমনেও সহায়তা করবে। বিষয়টির বিদ্যমান অবস্থা দেখে মনে হয়, বিটিআরসি যেন এই ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। রাস্তাঘাটে অবাধে নিবন্ধনহীন সিম বিক্রি হয়-কিন্তু সেটি বে আইনী হলেও সেটি প্রতিরোধ করার কেউ নেই। বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে কথা বললেও এটি চূড়ান্তভাবে বন্ধ করার কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ডিজিটাল অপরাধ দমন করার জন্য বিটিআরসিকে ভিওআইপি বন্ধসহ আরও একটি জরুরী কাজ করতে হবে। এখন বাইরে থেকে ভিওআইপির নামে পরিচয়হীন নাম্বারের ফোন কল আসে। এসব কলের সহায়তায় ডিজিটাল অপরাধ, যেমন হুমকি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অপপ্রচার ইত্যাদি করা হয়। বিটিআরসিকে এসব কল আসা বন্ধ করতে হবে। এর ফলে পরিচয়হীনভাবে ডিজিটাল অপরাধ করা সীমিত হয়ে যাবে।
খ. বর্তমানে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনগুলোর সঙ্গে আইসিটি এ্যাক্ট ২০০৬ ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই আইনে ডিজিটাল অপরাধ দমন করার পর্যাপ্ত বিধান না থাকায় এর জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। বিটিআরসি নতুন আইনটির খসড়া তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সেটি সংসদে উপস্থাপন করতে বলতে পারে।
গ. দেশে এখন যত ধরনের ডিজিটাল অপরাধ ঘটছে তাতে বিটিআরসি কোন ভূমিকাই পালন করছেনা। যাদের হাতে মোবাইল ও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তারা এভাবে চুপ করে থাকতে পারেনা। আমরা বিটিআরসির হাতে ডিজিটাল অপরাধ দমনে দেশে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ চাই। বিটিআরসি এজন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে। বিটিআরসি পুলিশ-র্যাব ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এ বিষয়ে কারিগরি সহায়তাও দিতে পারে।
ঘ. বর্তমানে ডিজিটাল অপরাধ, মোবাইল সেবা ও ইন্টারনেট সেবা বিষয়ক অভিযোগ করার কোন সুযোগ নেই। ডিজিটাল অপরাধের প্রতিকার বা পরামর্শ চাইবার জায়গাও নেই। বলা হয়ে থাকে যে, বিটিআরসির এমন কেন্দ্র রয়েছে। হতে পারে যে বিটিআরসির অফিসে এমন কোন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সাধারণ ব্যবহারকারীরা সেই অভিযোগ কেন্দ্র খোজে পায় কিনা আমার তাতে সন্দেহ আছে। এজন্য বিটিআরসিকে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
ঙ. বাংলাদেশে ডিজিটাল সিস্টেমের নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা নেই। এখানে হ্যাকিং একটি অতি সাধারণ ঘটনা। সরকারি ওয়েবসাইট অহরহ হ্যাক হয়। হ্যাকাররা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হ্যাকিং করে। ইদানীং ডিজিটাল পদ্ধতিতে আর্থিক অপরাধের মাত্রাও বেড়েছে। এজন্য ডিজিটাল সিস্টেমের নিরাপত্তার বিষয়েও বিটিআরসিকে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য প্রচলিত আইনটিরও সংশোধন করতে হবে। বিটিআরসি সেই সংশোধনী তৈরি করে দিতে পারে। এ বিষয়ে বিটিআরসি টাস্কফোর্স গঠন করে কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে পারে।
চ. এটি একটি সাধারণ অভিযোগ যে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটররা পাইরেসির সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে সঙ্গীত পাইরেসির সঙ্গে তাদের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। বিটিআরসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাইরেসি বন্ধ করা না হলে দেশের সঙ্গীত শিল্প বলে আর কিছু থাকবে না।
কিছুদিন আগে বিটিআরসি ভ্যালু এডেড সেবা বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই নীতিমালাটি এখন কোল্ডস্টোরেজে রয়েছে। বিটিআরসি এ বিষয়ে কোন কথা বলছে না। সম্ভবত মোবাইল অপারেটরদের চাপে তারা নীরবতা পালন করছে। কিন্তু দেশের সফটওয়্যার খাতের বিকাশের জন্য এই নীতিমালাটি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা জরুরী।
নিবন্ধটি শেষ করার আগে দেশে থ্রি জি চালু করার ক্ষেত্রে বিটিআরসি ও টেলিকম মন্ত্রণালয়ের অমার্জনীয় ব্যর্থতার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। আমি স্মরণ করতে পারি, ২০০৮ সালে মঞ্জুর আলম সাহেব চেয়ারম্যান থাকাকালেই থ্রি জি চালু করার জন্য বিটিআরসি প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিটিআরসি শম্বুক গতিতে সেই কাজটি শুরু করে। এক সময়ে টেলিকম মন্ত্রণালয় বিটিআরসির ক্ষমতা খর্ব করে। তারপরও বছর খানেক আগে বিটিআরসি থ্রিজির গাইডলাইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরও বিটিআরসি থ্রিজির নিলাম বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে রাষ্ট্রের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার চাইতেও বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের অগ্রযাত্রার।
যাহোক, আমরা স্মরণ করতে পারি, বাংলাদেশ সরকারের টেলি যোগাযোগ বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু ২০১২ সালের মাঝেই থ্রিজির লাইসেন্স প্রদান সম্পন্ন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। গত ২৪ জুন ১২ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তিনি এই অঙ্গীকার করেন। ২৪ জুন রাতে প্রচারিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, সংসদে প্রদত্ত প্রশ্নোত্তর পর্বের জবাবে রাজিউদ্দিন রাজু জানান যে, এখন তার মন্ত্রণালয় বিটিআরসি প্রদত্ত গাইডলাইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। খুব শীঘ্রই এই গাইডলাইনটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্ট্যাক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং এরপর সেই গাইডলাইনটি বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এই গাইডলাইনটি অনুসরণ করে ২০১২ সালের মাঝেই থ্রিজি প্রযুক্তির লাইসেন্স প্রদানের কাজ সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি জাতীয় সংসদের স্পীকারের সামনে সদস্যদের কাছে প্রতিশ্র“তি প্রদান করেন।
এর আগে বিটিআরসি থ্রিজি লাইসেন্স প্রদানের গাইডলাইন প্রস্তুত করে সেটি অনুমোদনের জন্য টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেই পরিকল্পনা মতে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ৫টি মোবাইল অপারেটরকে থ্রিজি, ৪জি এবং এলটিই লাইসেন্স প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু টিএন্ডটি মন্ত্রণালয় যথাসময়ে উদ্যোগ না নেবার ফলে নভেম্বরে নিলামটি অনুষ্ঠিত হয়নি।
একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি টিএন্ডটি মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। তারা ২০১৩ সালে যে কাজটি করতে চাচ্ছে সেটি যদি ২০০৯ সালে করত তবে ৫টি অপারেটর থেকে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা লাইসেন্স ফিস এবং অন্তত ৫ কোটি টাকা করে বছরে ২৫ কোটি হিসেবে তিন বছরে আরও ৭৫ কোটি টাকার বাড়তি লাইসেন্স নবায়ন ফিস পেত। এই খাতে সহজ হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার রাজস্ব আসত। একই সঙ্গে সরকার রেভিনিউ শেয়ারিং পেত ৩ বছরের। এই অঙ্কের পরিমাণটা আমি জানি না। তবে এতে হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারত। এছাড়াও দেশের জনগণ শতকরা ১ ভাগ সামাজিক দায়বদ্ধতার টাকায় প্রযুক্তির উৎকর্ষতা দেখতে পেত। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের কাছে জানতে চাওয়া যায় না যে, থ্রিজি লাইসেন্স দিতে বিলম্ব করার ফলে জাতির প্রযুক্তিগত ক্ষতির পাশাপাশি যে আর্থিক ক্ষতি হলো তার দায় কার?
আমরা জানি এসব বিষয়ে জবাবদিহিতা বলতে কিছু আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে নেই। ৯৪ সালে সাবমেরিন সংযোগ না পাবার ফলে যে ক্ষতি হলো সে প্রশ্ন আমরা কাউকে করতে পারি না। এমনি করে জুলাইতেও যদি আমরা থ্রিজির লাইসেন্স না পাই তবে কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না। চার বছরের ব্যর্থতার জন্য দায়ী রাজিউদ্দিন রাজু তার মন্ত্রণালয় থেকে দূরে সরে গেছেন। বিটিআরসির চেয়ারম্যান জিয়া আহমেদ আজ দুনিয়াতেই নেই। দুই জায়গায় আগত নতুন দুজন অবলীলায় বলতে পারবেন-এই দায় তো আমাদের নয়। বরং জাতিকেই বলতে হবে এই দায় আমাদের।
আমি মনে করি, থ্রিজি বিষয়ে বিটিআরসি ও মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার জন্য জাতি কমপক্ষে ৪ বছর পিছিয়েছে। কামনা করি, সকল ব্যর্থতা অতিক্রম করে বিটিআরসি সামনের দিনে সফলতার সঙ্গে টেলিকম খাত তথা আইসিটি খাতকে সামনে নিয়ে যাবে।