November 6, 2025
সিলেট থেকে: মেয়র হিসেবে আর কামরানকে দেখতে চান না সিলেট আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা। নানা কারণেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী গ্রুপ কামরানের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। সিসিক নির্বাচনে কামরানের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও মনে প্রাণে তারা কামরানের পক্ষে কাজ করবেন না, সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্রই পাওয়া গেল।
সিলেট আওয়ামী লীগ এবং দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে এমন মনোভাবই ব্যক্ত করেন।
কামরানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেন, কামরান গত ২০ বছর ধরে মেয়র পদে আছেন। কিন্তু নগরীর বাহ্যিক কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি তিনি। সরকারি অর্থ লুটপাট করেছেন। লুটপাটের টাকায় তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। পক্ষান্তরে দলীয় নেতাকর্মীদের দিকে তিনি ফিরেও তাকাননি। পাশাপাশি নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতায় মহানগর আওয়ামী লীগকে তিনি কার্যত বিকল করে রেখেছেন। নতুন নেতৃত্বও সৃষ্টি করেননি। দলীয় নেতাকর্মীদের কোন পৃষ্ঠপোষকতা না করে নগরীর উন্নয়নকাজ তার পছন্দের লোক দিয়ে করিয়েছেন। দল ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোন লাভ হয়নি। তার কারণেই মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
মূলত এসব কারণেই সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা কামরানের ওপর দারুণ ক্ষুব্ধ। এই অবস্থায় বিরোধী দল বিএনপি একক প্রার্থী ঘোষণা করায় মহাবিপদে পড়েছেন কামরান। তার অবস্থা হয়েছে এখন ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ এমন।
নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে তাকে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হবে বলে জানালেন সিলেটের রাজনীতি সচেতন মহল।
আওয়ামী লীগের ভেতরের এক সূত্র জানায়, জেলা ও মহানগর কমিটির একটি শক্তিশালী গ্রুপ কামরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও নেপথ্যে তার বিরুদ্ধে কাজ করছেন তারা। যে কোনো মূল্যেই কামরানকে তারা আর সিলেটের মেয়র হিসেবে দেখতে চান না।
জানা গেছে, সিলেট আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদের ক্ষমতায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদের গ্রুপ করতেন। পরবর্তীতে সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর এ গ্রুপের হাল ধরেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ইফতেখার হোসেন শামীম। তার মৃত্যুর পর এ গ্রুপের হাল ধরেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র বদর উদ্দিন কামরান।
পাশাপাশি নগর আওয়ামী লীগ নেতা ও বিদায়ী সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও সাবেক ছাত্রনেতা রঞ্জিত সরকারের গ্রুপকে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন।
আজাদ ও রঞ্জিত গ্রুপের বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই বারবার এমসি কলেজে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় বলে অভিযোগ আছে। অস্ত্রের মহড়ায় প্রায়ই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এমসি কলেজ। এই গ্রুপটিই এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসটি পুড়িয়েছে বলে জানা গেছে। আর তাদের এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পরোক্ষভাবে মদদ দেন মেয়র কামরান।
অথচ সিলেট আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মীই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থন করে না। তাই আজাদ-রণজিৎ গ্রুপকে প্রশ্রয় দিয়ে কামরান বারবার সমালোচিত হচ্ছেন।
সূত্র জানায়, মেয়র কামরান আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কৌশলে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তার উদ্দেশ্য সিলেট আওয়ামী লীগে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা। তার সমান্তরালে কোন নেতা সৃষ্টি হোক, তা তিনি চান না। এ কারণেই আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই বিকল করে রেখেছেন তিনি। দলকে সুসংগঠিত করতে কখনই তিনি কোন উদ্যোগ নেননি। গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়া সিলেটে আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি পালিত হয়নি।
এদিকে কামরানের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, দলীয় নেতাদের সঙ্গে কামরানের দূরত্ব তৈরি হওয়ার অন্তরালের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বিগত জোট সরকার ও পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সমাধান বা মীমাংসার কোন উদ্যোগ নেননি তিনি।
এ পরিস্থিতিতে আগামীতে সরকার পরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এলাকায় থাকতে পারবেন না মনে করে অনেক নেতাকর্মীই আতঙ্কে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা মামলাগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে দফায় দফায় কামরানকে অনুরোধ জানালেও তিনি এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেননি। এ কারণে জেলা ও মহানগর কমিটির নেতারা তার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ।
সূত্র জানায়, সাবেক মেয়র কামরান একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সঙ্গে চলাফেরা করেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এটি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রয়েছে কামরানের নিবিড় সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে কামরানের ব্যবসা-বাণিজ্যও রয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে তিনি এমনকি হেফাজতে ইসলামের সমাবেশেও কলা ও পাউরুটি পাঠিয়েছেন। তার এসব কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।
এদিকে সিলেট নগরবাসীরা আড়ালে বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানকে ‘মিস্টার থ্রি পার্সেন্ট’ বলে অভিহিত করে। যে কোনও কাজ পাওয়ার আগেই কামরানকে পুরো কাজের শতকরা তিনভাগ টাকা অগ্রিম দিতে হয় বলেই তার এমন নামকরণ বলে জানা গেছে। তবে এভাবেই বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন তিনি। এ নিয়ে জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিনিয়তই বিব্রত হতে হয়।
আওয়ামী লীগের অপর এক নেতা জানান, ৮০’র দশকের প্রারম্ভে ভাগ্যান্বেষণে মধ্যপ্রাচ্য যান বদর উদ্দিন কামরান। মাত্র দু’লাখ টাকা নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। এরপর পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার পদে নির্বাচন করেন তিনি। ধাপে ধাপে তিনি সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে সিলেট সিটি করপোরেশনের ঘোষণা হলে ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনেও তিনি কারাবন্দী অবস্থায় বিপুল ভোটে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন।
জানা গেছে, পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কামরানের জীবন পাল্টে যেতে থাকে। অর্থ বিত্ত আর প্রাচুর্যের নাগাল পান। এভাবেই বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান এখন সিলেটের অন্যতম শীর্ষ ধনী। তার কি পরিমাণ সহায়-সম্পত্তি ও অর্থ আছে তা তিনি নিজেও জানেন না বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সম্পত্তির মধ্যে কিছু নিজের নামে থাকলেও বেশিরভাগই রাখা আছে স্ত্রী ও সন্তানের নামে।
অথচ গত ২০ বছরে অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়লেও দলীয় নেতাকর্মীদের দিকে ফিরেও তাকাননি তিনি। একসময় যারা তার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করেছে মেয়র হওয়ার পর তিনি তাদেরই প্রথম দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।
কিন্তু মেয়র কামরান মনে করেন, দলীয় নেতাকর্মীরা তার সঙ্গেই আছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান বলেন, “আওয়ামী লীগে কোন বিভাজন নেই। দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীই তাকে জয়ী করার জন্যে মনে প্রাণে কাজ করছেন।” তিনি আরও দাবি করেন,‘‘বিএনপিতে বিরোধ থাকলেও আওয়ামী লীগে কোন বিরোধ নেই।’’
কিন্তু সরেজমিনে সিলেট নগরীর ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষোভের কারণে তিনি এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ মিটে গেলে কামরানকে বিজয়ী হওয়ার জন্যে কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। সেই লড়াইয়ে কে জিতবেন তা দেখার জন্যে এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সিলেট নগরবাসী।
……………………..বাংলানিউজ