পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

কেড়ে নেওয়া হলো জনগণের দাঁড়ানোর জায়গা

Posted on May 21, 2013 | in নির্বাচিত কলাম | by

umor

বাংলাদেশে সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করে সরকারি মহল থেকে এক ফরমান জারি করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক না বলে সরকারি মহলের দ্বারা এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলার কারণ, এ নিয়ে কোনো সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়নি।

কোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি নির্দেশও জারি করা হয়নি। একাধিক মন্ত্রী সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের ঘোষণা এমনভাবে দিয়েছেন, যেভাবে এ কাজ করা যায় না। তাছাড়া দুই মন্ত্রী এ নিয়ে যা বলেছেন তার মধ্যেও কোনো মিল নেই। ১৯ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এক পুলিশ স্টেশন উদ্বোধন উপলক্ষে এক সভায় বলেছেন, পরবর্তী এক মাস কোনো সভা-সমাবেশ কাউকে করতে দেওয়া হবে না। সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয় শান্তিপূর্ণভাবে তার ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলগুলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ কারণে জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য আগামী এক মাস কোনো সভা-সমিতি করতে দেওয়া হবে না (ডেইলি স্টার, ২০.৫.২০১৩)। ওই দিনই সন্ধ্যায় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একই দিনে ঢাকায় তাদের দলের কার্যালয়ে বলেন, সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ত্রাণ কাজ ঠিকমতো পরিচালনার জন্য সারাদেশে সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডেইলি স্টারের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিনিয়র স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারি মোস্তাক আহমদ এবং পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খোন্দকারকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তারা উভয়েই বলেন, এ বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো অফিসারও এ বিষয়ে কিছু জানেন না! (ঐ)
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? এই সরকার কীভাবে চলছে? এদের অধীনে দেশ কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? দেশে সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে দুই সিনিয়র মন্ত্রীর বক্তব্য এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো সরকারি নির্দেশ না থাকার বিষয়টি ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, দেশের শাসন ব্যবস্থা আজ কী ধরনের বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তার পরিচয়ই এর মধ্যে আছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী থাইল্যান্ড সফরে যাওয়ার ঠিক আগে তার এই দুই মন্ত্রীর সামনে মৌখিকভাবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তার ফরমান ঘোষণা করে গেছেন।
মৌখিক নির্দেশের ক্ষেত্রে যা হওয়া সম্ভব তাই হয়েছে। এদের দু’জনের বোঝাবুঝির মধ্যে পার্থক্য হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তাদের বক্তব্যের মধ্যে গরমিল দেখা যাচ্ছে। সভা-সমাবেশ দেশে নিষিদ্ধ করা এক গুরুতর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত এভাবে হেলাফেলা করে যারা তাৎক্ষণিকভাবে নিতে পারে এবং সে বিষয়ে যথানিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা না করে মুখে হুকুম জারি করেই নিশ্চিত হতে পারে, তারা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কত বিপজ্জনক এটা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। স্বৈরতন্ত্রী রাজরাজড়াদের আমলে তাদের কথাই হতো আইন। কোনো শাসকের এ ধরনের কথার ভূমিকা ও কার্যকারিতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেই। অন্তত না থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এখন চলছে এক বেপরোয়া স্বৈরতন্ত্র। এ কথা বলার কারণ এই যে, দুই সিনিয়র মন্ত্রী যা বলেছেন এটা যে তাদের নিজেদের কথা বা নির্দেশ নয়, তা বলাই বাহুল্য। এই নির্দেশ তারা অবশ্যই পেয়েছেন শেখ হাসিনার কাছ থেকে এবং পেয়েছেন মৌখিকভাবে তার বিদেশ যাত্রার ঠিক আগে। কারণ শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া কোনো মন্ত্রীরই ক্ষমতা বা সাধ্য নেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তাছাড়া দু’জন যখন স্বতন্ত্রভাবে এই ঘোষণা দিয়েছেন, তখন এ বিষয়ে অন্য ধারণা পোষণের প্রশ্নই ওঠে না। এই গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়টি এভাবে সামনে আসায় প্রধানমন্ত্রী কী রাজকীয় পদ্ধতিতে সরকার পরিচালনা করে থাকেন, তার একটা স্পষ্ট চেহারা দেখা গেল। এর থেকে বোঝা যায়, শুধু এ ব্যাপারই নয়, প্রত্যেক বিষয়েই কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা কার্যকর করা হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকগুলো যে এই অবস্থায় যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যম নয় তা সহজেই বোঝা যায়। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর একতরফা কথাবার্তা ও বক্তব্য ভক্তিভরে শুনে তাকে বাহবা দেওয়া ছাড়া এই মন্ত্রিসভার অন্য কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী তার অস্থির ও ঘোলাটে বুদ্ধি নিয়ে যা বলেন ও করেন, তা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হওয়ার এটাও এক কারণ। তার ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ও তাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার কেউই তার দলে ও মন্ত্রিসভায় নেই। তারা সকলেই জানেন, তারা চাকরি করেন মাত্র এবং তাদের চাকরি শেখ হাসিনার খেয়ালখুশি ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। কাজেই দেশ এবং হতভাগা জনগণের স্বার্থে কথা বলতে গিয়ে চাকরি খোয়ানোর মতো হিম্মত এদের কারও নেই। দলীয় নেতৃত্ব ও মন্ত্রিসভার অবস্থা অন্য রকম হলে এ ক্ষেত্রে বিপদের মাত্রা হয়তো কিছু কম হতো।
যা হোক, একটি দেশে এভাবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার বিষয়টির মধ্যে যে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই এটা বলাই বাহুল্য। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের পূজারিণী হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান না, কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়! কিন্তু নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা নির্বাচিত হতে অথবা অনির্বাচিত ব্যক্তিকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের স্পিকার করতে তার অসুবিধা নেই! কারণ এ দুই সিদ্ধান্তের দ্বারা তার স্বার্থ সিদ্ধি হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে যখন তার নির্বাচন বিজয় অসম্ভব হয়, তখন তিনি মহাগণতন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত সরকারের অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তার নিজের নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো গণতান্ত্রিক বিকল্প দেখেন না! উপরন্তু অন্য কেউ সে কথা বললে তিনি তাদের গণতন্ত্রবিরোধী বলে নিজস্ব ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন, গণতন্ত্রবিরোধী আখ্যায় ভূষিত করেন।
ঢাকায় এমনিতেই সভা-সমাবেশের জায়গা এখন নেই বললেই চলে। এতদিন মুক্তাঙ্গনে যে সভা-সমাবেশ হতো সেটাও শেখ হাসিনার সরকার বন্ধ করেছে। সেখানে স্থায়ী ১৪৪ ধারা জারি আছে। এমতাবস্থায় প্রেস ক্লাবের সামনে এতদিন ছোট আকারে সভা-সমাবেশ করে আসা হচ্ছিল। এখন সেটাও বন্ধ করা হলো। এর ফলে ঢাকায় সভা-সমাবেশের জন্য দাঁড়াবার আর কোনো জায়গা রইল না। এ অবস্থা কোন ধরনের গণতন্ত্র? আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদক সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করার অজুহাত হিসেবে সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ কাজ পরিচালনার কথা বলেছেন! ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুরে সভা-সমাবেশ করলে নাকি দক্ষিণ বাংলায় ত্রাণকাজ বিঘিœত হতে পারে! শুধু তাই নয়, তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, জাতীয় দুর্যোগের সময় সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখা দরকার! এ সময় সে অধিকার জনগণকে দেওয়া যায় না! সরকারি লোকেরা, সরকারের মন্ত্রীরা এত বেশি উন্মাদতুল্য কথাবার্তা বললে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা থাকা সম্ভব নয়। দেশে এখন কোনো স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজও করছে না। যেভাবে দেশে সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারি মহল থেকে বলা হয়েছে তার মধ্যেই এর প্রমাণ আছে।
দেশে এখন জনগণের হাজারো সমস্যা। সমস্যা যখন এত বেশি হয় তখন তা নিয়ে জনগণের মধ্যে আলোড়ন হতে থাকে। জনগণ সভা-সমাবেশ, আলোচনার প্রয়োজন আরও বেশি অনুভব করে। রাজনৈতিক দল এবং নানা ধরনের পেশাজীবী সংগঠনও সভা-সমাবেশের প্রয়োজন বোধ করে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এখন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থা ও সমস্যার কথা জনগণের সামনে উপস্থিত ও পর্যালোচনা করা এবং এসব নিয়ে সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ থেকে নিয়ে আন্দোলনের জন্য দাঁড়ানোর তাগিদ তীব্রভাবে অনুভব করছে। এই অবস্থায় সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করার রাজনৈতিক পরিণতি দেশের জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, আওয়ামী লীগের নিজের জন্যও বিপজ্জনক। জনগণের কণ্ঠ রোধ করা এবং তাঁদের দাঁড়ানোর জায়গা কেড়ে নেওয়ার পরিণতি কী হয় সেটা স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমলে আমরা দেখেছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন আওয়ামী লীগ দল ও সরকার যে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা দেশে জারি করেছে তার থেকে মনে হয়, তাদের প্রথম সরকারের পরিণতি থেকে তারা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। সে শিক্ষা গ্রহণ করলে তারা যেভাবে এখন সেই একই পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা এমনভাবে ঘটত না। অন্তত তাদের নিজেদের লোকেরাও তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করে এ পথ পরিহার করার পরামর্শ দিতে পারত। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এ ব্যবস্থায় জনগণের কণ্ঠ রোধ করে ও দাঁড়ানোর জায়গা কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন দেশজুড়ে এক বিস্ফোরণোন্মুখী পরিস্থিতি সৃষ্টির শর্তই তৈরি করছে।
বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud