November 6, 2025
ঢাকা: বাঙালির চিরপথের সঙ্গী, চিরকালের প্রেরণা ও বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ তার ১৫২তম জন্মজয়ন্তি।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (১৮৬১ সালের ৭ই মে) কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রাত আড়াইটায় পৃথিবীর আলো বাজাতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের আশির্বাদ নিয়ে আগমণ করেন তিনি। তার ছদ্মনাম ভানুসিংহ ঠাকুর। কবিগুরুর আগমনে বাংলা সহিত্য ও বাংলা ভাষায় ফিরে আসে এক প্রাণচাঞ্চল্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দিকপালসহ জীবন-সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় তার আলো পড়েছে। তিনিই বাংলা সাহিত্যের গদ্য কবিতার জনক। কবিগুরু তার লেখনিতে স্থান দেননি এমন কোনো বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার ছিল সমানতালে অগাধ বিচরণ।
রবীন্দ্রনাথ তার বিস্ময়কর প্রতিভায় নিজেকে কবিগুরু থেকে বিশ্বকবিতে পরিণত করেছিলেন। বাঙালির চিন্তা-ধারা, জাত-অনুভূতি, কৃষ্টি ও কালচারসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া পড়েনি। অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজও বাঙালিকে সঠিক পথের নিশানা দেখায়। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে কবিগুরুর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তিনিই দেখিয়েছিলেন সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে নিজ বাড়ির পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল বিশ্বকবির। বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছেই তিনি বেশিরভাগ শিক্ষাগ্রহণ করেন। কবিগুরু মাত্র ৮ বছর বয়েসে কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তার প্রথম ‘অভিলাষ’ কবিতা প্রকাশিত হয়।
১৮৮৩ সালে খুলানার দক্ষিণ ডিহির মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৮৮০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদার এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯০২ সালে তার স্ত্রী মৃনালিনী মারা যান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য কবিগুরু শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।
রবিন্দ্রনাথ শুধু একজন কবিই ছিলেন না, তিনি একজন আদর্শ সম্পাদকও ছিলেন। তার সম্পাদনায় ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, ‘বঙ্গদর্শন’ প্রভৃতি পত্রিকা বের হয়েছিল। ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘মানসী’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘সোনার তরী’, ‘বলাকা’, ‘গীতবিতান’, ‘নৈবেদ্য’, ‘গীতাঞ্জলি’ ইত্যাদি কাব্য রচনা করেন তিনি। ‘শেষের কবিতা’, ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’, ‘চতুরঙ্গ’ তার রচিত উপন্যাস। ‘ছিন্নপত্র’ তার অবিস্মরণীয় পত্রসাহিত্য।
৫২ বছর বয়সে ১৯১৩ সালে কবিগুরুর জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তার সাহিত্যে তার অক্লান্ত সাধণা ও অর্জনের স্বকৃতিস্বরূপ তার গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য ও সাংস্কৃতির পাশাপাশি ছিলেন একনজ শিক্ষাপ্রেমী। তাই তিন ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৫ জন ছাত্র নিয়ে বোলপুরে ‘শান্তি নিকেতন’ নামে একটি শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন।
রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস এবং ৩৬টি প্রবন্ধ রয়েছে। আর অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও ৪টি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তিনি প্রায় ২ হাজার ছবি এঁকেছিলেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবিন্দ্রনাথ থাকুর ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। বাবা মায়ের অট্টালিকা সম্পদের মধ্যে বেড়ে ওঠলেও তিনি ব্যক্তিজীবনে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ব্রাহ্মণের সন্তান। কিন্তু তিনি সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে। জীবন পরিক্রমায় অনেক ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে। অকালে স্ত্রী-সন্তান বিয়োগের মতো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও তিনি নিজেকে ধরে রেখেছিলেন এক পাহাড় সমান ধৈর্যের প্রতীক রূপে।
কবিসম্রাট রবি ঠাকুর তার গোটা জীবন মানুষের কল্যাণেই উৎসর্গই করে গেছেন। ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।’ মানবজাতির পাশে থাকতে কবিগুরুর এমন আকুতি থাকলেও অবশেষে দুনিয়ার সকল মায়জাল ছিন্ন করে ৮০ বছর বয়সে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট) কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবিগুরু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিশ্বকবির ১৫২তম জন্মজয়ন্তি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে।