May 19, 2024
ঢাকা: বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় নারীদের যৌন হেনস্তার ঘটনার পর থেকেই জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠেছে সারা দেশে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন ঢাবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক, নারী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও। তবে এসব প্রতিবাদে এখনো দেখা যায়নি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কেবল একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ জানান, পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ শেষ হলেই কর্মসূচি দেওয়া হবে। তবে ঘটনার ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও ‘পর্যবেক্ষণ’ শেষ হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিদিনই প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ চলছে। এদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত টানা কর্মসূচি দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়া, অপরাজেয় বাংলা থেকে কার্জন হল পর্যন্ত মানববন্ধন পালন ছাড়াও প্রক্টরের পদত্যাগ ও সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কয়েক দফা সংবাদ সম্মেলন করেছে তারা। কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার ছাত্র ইউনিয়ন, প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও সাম্রাজ্যবিরোধী ছাত্র ঐক্যের নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের অপসারণ দাবি করে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এ সময় করা এক সমাবেশে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশনসহ ১১টি বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
একই দিন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সামনে মানববন্ধন করেন অনুষদটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান জানানো হয় মানববন্ধন থেকে।
এ ছাড়া ২০ এপ্রিল, সোমবার ছাত্র ইউনিয়নের আয়োজিত মানববন্ধনে আলাদা ব্যানারে অন্তত ১০টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। একই দিন এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং দোষীদের দ্রুত বিচারের দাবিতে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধনের আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন থেকে শিক্ষক সমিতির নেতারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানান। এ ছাড়া চারুকলার পক্ষ থেকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। ওই দিনই নারী হেনস্তার প্রতিবাদে এবং দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় প্রক্টরের অপসারণ চেয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পরদিন ২১ এপ্রিল, মঙ্গলবার একই দাবিতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। একই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে।
এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি এবং প্রশাসনের নীরবতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে তারা ক্যাম্পাস এলাকায় বেশ কয়েকটি মিছিল করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি সমর্থিত শিক্ষকদের সাদা দল এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতি দেয়।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নয়, বাইরেও প্রতিদিন প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন। অনেক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনই এ বিষয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন পালন করেছে। অন্যদিকে, বষর্বরণের অনুষ্ঠানে যৌন হেনস্তাকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বর্ষবরণের দিন বিকেলে জবি বাসে ফেরার সময় ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করেন ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল। এ সময় নাজমুল গণধোলাইয়ের শিকার হন। ঘটনার পর এ অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাজমুলকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ ছাড়া উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের আদিবাসী ছাত্রী লাঞ্ছিতের ঘটনায় ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে জাবি শাখা ছাত্রলীগ।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে বহিষ্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট করা মতো কাজ করবে, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
এদিকে, গত শুক্রবার ঢাবির বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগ নেত্রীরা মানববন্ধন করতে চাইলেও কোনো এক অজানা কারণে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন তাঁরা। কর্মসূচিবিহীন থাকার বিষয়টি নিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের এক প্রভাবশালী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি যতক্ষণ না কর্মসূচির ডাক দিচ্ছেন, আমাদের ইচ্ছা থাকলেও আমরা নিজেরা কোনো কর্মসূচি ডাকতে পারি না।’ এ বিষয়ে আক্ষেপ করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের একজন বলেন, ‘আমি বুঝি না, নেতাকর্মীদের বিবেক বলতে কিছু নেই নাকি। বিবেক কি মারা গেছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় একটা ঘটনা ঘটল অথচ কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই।’
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজন হলে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’ এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ব্যস্ততাও এর অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন এই ছাত্রলীগ নেতা। এদিকে, এ ঘটনার পর ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও দোষীদের এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন। আর এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সচেতন মহলের সবাই।
সৌজন্য….এন টিভি