পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

মিসর : গণতন্ত্র থেকে গণহত্যা

Posted on August 22, 2013 | in নির্বাচিত কলাম | by

alfaz-anam

গণতন্ত্র নয়, সামরিক স্বৈরতন্ত্রের গণহত্যার নিষ্ঠুর রূপ এখন দেখছে মিসরের জনগণ। শুধু মিসর নয়, টেলিভিশনের কল্যাণে নির্মমতার লাইভ দৃশ্য বিশ্ববাসীও দেখছে। আরব বসন্ত এখন রক্তিম রূপ নিয়েছে। ইসলামপন্থী নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে সেকুলার রাজনীতিকÑ সেনা আঁতাত মিসরকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে মোবারক জামানায়। মিসর ও মুসলিম ব্রাদারহুডের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নানা বিশেøষণ চলছে। রক্তাক্ত এ আন্দোলনের শেষ পরিণতিই কী? বেসামরিক শাসনের মুখোশ পরা অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আইনগত প্রক্রিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হবে। যদিও জন্মের পর থেকে চার দশকের বেশি নিষিদ্ধ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড; কিন্তু অতীত ও বর্তমানের ব্রাদারহুডের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে।

মাত্র কয়েক দিন আগে দলটি ক্ষমতায় ছিল। পরিহাস হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থানে বে আইনিভাবে ক্ষমতাসীন সরকার এখন বিপুল ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলকে ‘আইনিপ্রক্রিয়ায়’ নিষিদ্ধ করতে চাইছে। যদিও ব্রাদারহুড একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক বাহু হচ্ছে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। মিসরের সংবিধান অনুযায়ী ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে ব্রাদারহুড নিষিদ্ধে সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে কোনো প্রভাব পড়বে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং এ নিষিদ্ধের সুযোগে মোবারক আমলের মতো জরুরি অবস্থা দীর্ঘায়িত হবে। গোয়েন্দা সংস্থা ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে জরুরি অবস্থাকে জায়েজ করা হবে। অতীতে মোবারক এ কৌশল নিয়েছিলেন। সংাবিধান স্থগিত ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে আটক করে সেনাপ্রধান জেনারেল আবুল ফাত্তাহ আল সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি মোবারককে দ্রুত ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক দিকে মুক্ত মানুষ হিসেবে মোবারক বেরিয়ে আসছেন। অন্য দিকে মিসরের মানুষের মুক্তি ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আন্দোলন ও আত্মত্যাগ তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে এক নজির স্থাপন করেছে মিসরের জনগণ। মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ৩ জুলাই। এরপর তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে ৪ জুলাই আন্দোলন শুরু হয়। ১৪ আগস্ট গণহত্যার আগ পর্যন্ত নাসের সিটির রাবা আল উদইয়া মসজিদ ও নাহদা স্কোয়ারে টানা অবস্থান করেন প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থকেরা।
তাহরির স্কোয়ারে ১৭ দিনের টানা আন্দোলনে মোবারকের পতন হয়েছিল। আর মুসলিম ব্রাদারহুড নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ফিরিয়ে আনতে টানা ৪১ দিন রাজপথে অবস্থান করেছে। এরপর মিসরের রাজপথ প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে। সহিংস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার পরও মুসলিম ব্রাদারহুড বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে সরে আসেনি। বরং এসব বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি আরো বাড়ছে। আন্দোলনে শুধু ব্রাদারহুডের সমর্থকেরা নন, অ্যান্টি ক্যু অ্যালায়েন্সে দেশের অপর প্রধান রাজনৈতিক শক্তি সালাফি গ্রুপগুলোও ব্রাদারহুডের সাথে যোগ দিয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি ও কারফিউ ঘোষণার পরও এ আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেনাবিরোধী এ আন্দোলনে দলটির কারাবন্দী আধ্যাত্মিক নেতা মোহাম্মদ বদিইর ছেলে আম্মার বদি মারা গেছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে মোহাম্মদ বদিইকে। অপর নেতা মুসলিম ব্রাদারহুডের সেক্রেটারি মুহাম্মদ বেলতাগির ১৭ বছরের মেয়ে আসমা বেলতাগি এবং কারাবন্দী ভাইস প্রেসিডেন্ট খাইরাত আল সাতিরের মেয়ে ও জামাই সেনা অভিযানে নিহত হয়েছেন। সরাসরি রাজপথের আন্দোলনে দলটির মধ্যম সারির আরো অনেক নেতা মারা গেছেন। স্বাভাবিকভাবে দলটির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর এ ধরনের আত্মত্যাগের বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। আন্দোলনকে আরো বেশি নৈতিক শক্তি জোগাচ্ছে। মুরসির পুনর্বহাল আন্দোলন আসলে সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে; কিন্তু এর পরও সেনাবাহিনী পিছু হটবে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই; বরং আরো কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। গৃহযুদ্ধ না ব্যর্থরাষ্ট্র এ ধরনের পরিস্থিতিতে মিসরে সেনাবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যেমনটি ১৯৯২ সালে আলজেরিয়ায় শুরু হয়েছিল। ইসলামিক সলভেশন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও সেনাবাহিনী ফল মেনে নিতে অস্বীকার করে।
এ গৃহযুদ্ধে প্রায় দুই লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল; কিন্তু আলজেরিয়ার মতো মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সশস্ত্র পথে যাবে এমনটি মনে করেন না অনেক বিশেøষক। কারণ মুসলিম ব্রাদারহুড মূলত সামাজিক শক্তি হিসেবে মিসরের জনসমর্থন পেয়েছে। আনোয়ার সাদাত ও মোবারকের দমনাভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে দলটির ক্ষুদ্র একটি অংশ সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা শক্তি অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম ব্রাদারহুডের মূল নেতৃত্বের সাথে তাদের আর সর্ম্পক ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে রক্তস্নাত আন্দোলনের মধ্যেও দলটির নেতারা বারবার বলছেন তারা গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সেনাশাসনের অবসান ঘটাতে চান। যদিও সেনাশাসক ব্রাদারহুডের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও সেকুলার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম একই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সশস্ত্র পথে না গিয়ে রক্ত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যদি এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে, তা হলে সেনাবাহিনীর জন্য সঙ্কট বাড়তে থাকবে; কারণ সেনাসমর্থিত অন্তর্র্বতী এই সরকারের কোনো আইনগত বৈধতা নেই। সেকুলার রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের পাশে দাঁড়াবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গণহত্যার পর সেকুলারদের জোটে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আল বারাদি অন্তর্র্বতী সরকার থেকে পদত্যাগের পর দেশ ত্যাগ করেছেন। আমর মুসা, আহমদ শফিকসহ অন্যান্য সেকুলার নেতা মোবারক সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণীর অংশ, সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই; যা বিগত নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। এ অবস্থায় অব্যাহত আন্দোলনে মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে গৃহযুদ্ধ না হলেও সেনাশাসনের কারণে মিসর একটি ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং দায়দায়িত্ব সেনা নেতৃত্বের ওপর বর্তাবে। প্রকৃতপক্ষে মিসরের সেনাবাহিনী এখন জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে।
জনগণের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী কখনোই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। বাদশাহ-আমির ও আমেরিকা মুরসি সরকারকে উৎখাতে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশ ছিল। শুরু থেকে মুরসিকে একজন ব্যর্থ শাসক হিসেবে তুলে ধরার নানা কৌশল নেয়া হয়। মুরসির এক বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা। মিসর বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর দেশ। দেশটির বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে পর্যটন। মোবারকবিরোধী আন্দোলনের পর থেকে মিসরে পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। এ পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি উপসাগরীয় দেশগুলো মুরসি সরকারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে বারবার অস্বীকার করেছে। এমনকি আইএমএফের ঋণ পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। অথচ মুরসিকে অপসারণ করে সেনাশাসকেরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ১২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয়। মুরসিকে উৎখাতের সেনা তৎপরতা সম্পর্কে আগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জানত। মুরসি সরকারের পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী আমর দারাগ নিউ ইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে বলছেন, সামরিক বাহিনী যে অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে এ কথা প্রথম জানিয়েছিলেন আমেরিকান একজন কর্মকর্তা। তিনি আরো জানানÑ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতাপ্রক্রিয়া শেষ মুহূর্তে জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসি বাতিল করেছিলেন।

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud