March 29, 2024
রাজধানীর উত্তরায় আগুনে পুড়ে যাওয়া তিনটি ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের সতর্ক করেছিল বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। সেই সতর্কতা আমলে নেননি, এমনকি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কোনও উন্নতি করেননি ভবন তিনটির মালিকেরা। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন।
সোমবার ভোর ৫ টা ২ মিনিটে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের প্রধান সড়কের পাশে ‘সি শেল চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টারে’ আগুনের সূত্রপাত হয়। চারতলা এই ভবন পুরোটাই রেস্টুরেন্ট। ভবনটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমানউল্লাহ নামে এক ব্যক্তি এই রেস্টুরেন্ট ও ভবনের মালিক। এর পাশের পরী মনি ম্যানসন ও একে টাওয়ার নামে ছয়তলা ভবন দুটিতেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরী মনি ম্যানসনের তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ‘সি শেল হোটেল ও রেসিডেন্স।’ আবাসিক হোটেলের ৩০২ নম্বর কক্ষ থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি একে টাওয়ার ভবনটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনার ছয় ঘণ্টা পর বেলা ১১ টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে ফেলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ আগুন নেভানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে চলে আসি। আমাদের ১৫ টি ইউনিট চেষ্টা করে আগুন প্রথমে নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর বেলা ১০ টা নাগাদ আগুন পুরোপুরি নিভেয়ে ফেলে। আমরা আবাসিক হোটেলের তিনটি ফ্লোরের সব কক্ষগুলোর দরজা খুলে তল্লাশি করেছি। কেবল ৩০২ নম্বর কক্ষ থেকে দুজনকে উদ্ধার করেছি। পরবর্তীতে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেছে বলে আমি শুনেছি। এছাড়া সকালে ছাদের ওপর থেকে দুজনকে উদ্ধার করেছি, তারা সুস্থ রয়েছেন। আমরা হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও বলেছে ভেতরে আর কেউ নেই।’
মেজর শাকিল বলেন, ‘ভবনগুলোর ভেতরে হাইলি ইন্টেরিয়রের ডিজাইন রয়েছে, ফোম রয়েছে, ফার্নিচার রয়েছে, এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের বেগ পেতে হয়েছে। তারপরও দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। আগুনে প্রচুর সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। তাদের আগুন নেভানোর কোনও যন্ত্রপাতি ছিল না, তাদের টিমও ছিল না।’
সতর্ক করা হয়েছিল ৫/৬ মাস আগে
উত্তরা ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিনটি ভবনই আগুনের ঝুঁকিতে ছিল। ভবনের মালিকদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। তারা চিঠি রিসিভও করেছেন। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নতি করেননি। তাদের আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তাই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।’
তবে সি শেল রেস্টুরেন্টের মার্কেটিং ম্যানেজার মো. সোহেল এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরীমনি ম্যানসনের মালিক ইসমিয়ারা হানিফও ফায়ার সার্ভিসের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন, ‘আমাদের আগুন নিয়ন্ত্রণের সকল ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেগুলো
কেউ ব্যবহার করেনি।’
কোন ভবনে কী ছিল, কে মালিক?
পরীমনি ম্যানসনের মালিক ইসমিয়ারা হানিফ নামে একজন নারী। তার স্বামী অ্যাডভোকেট হানিফ। ছয়তলা এই ভবনের নীচতলায় রয়েছে ‘ফার্ম কথা’ নামের ওষুধের দোকান, এনজেল ড্রাই ক্লিনার্স, সেফ ওয়ে ইলেক্ট্রিক দোকান, নিউ রাজিয়া মোটরস ২ নামে গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান এবং সি শেলের একুশ সুইটস ও বেকারি নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় তলায় আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখা। ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক বাচ্চু শেখ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগুনের খবর পেয়েই তারা ঘটনাস্থলে আসেন। এখানে ভোল্ট রয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহযোগিতায় আগুন ভেতরে ঢুকতে পারেনি। ব্যাংকের ক্ষতি হয়নি। সব ঠিক রয়েছে।’
ভবনটির তৃতীয় তলা থেকে পঞ্চম তলায় সি শেল আবাসিক হোটেল। তৃতীয় তলায় ৯ টি, চতুর্থ তলায় ৯ টি এবং পঞ্চম তলায় ১১ টি কক্ষ রয়েছে। ষষ্ঠ তলায় সি শেল রেস্টুরেন্ট। আবাসিক হোটেলের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আগুনে বেশি পুড়েছে। ৩০২ নম্বর কক্ষ থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি কক্ষের দরজা ভেঙে তল্লাশি চালানো হলেও কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। এই আবাসিক হোটেলের মালিকও সি শেল রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টারের মালিক ব্যবসায়ী আমানউল্লাহ।
সি শেল ভবন
চার তলা ভবনের প্রথম তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টার। এই ভবনটিতেই আগুনের সূত্রপাত। পুরো ভবনটিই পুড়ে গেছে। কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই।
সি শেল ভবনের পাশেই একে ভবন। ভবনটিতে দোকান, ইনসুরেন্স কোম্পানির অফিস ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের উত্তরা ব্র্যাঞ্চ রয়েছে। আগুনে ভবনটির উত্তর পাশে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবন তিনটিতে উচ্চমানের ইন্টেরিয়র ডিজাইন ছিল। এসব ডিজাইনের বিষয়ে সবাইকে আরও সচেতন হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
নিহত দু’জনের পরিচয়
রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের সি শেল আবাসিক হোটেলের এক কক্ষ থেকে আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত একজনের পরিচয় মিলেছে। তার নাম রাসেল মিয়া (৩৫)। বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচর। সোমবার সকালে হোটেলের একটি কক্ষ থেকে দুজনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। লাশ দুটি উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
রাসেল মিয়া ঢাকার পল্লবীর ব্লক ডি, রোড ২৩, সেকশন ১২ -এ থাকতেন। তিনি প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তবে তিনি হোটেলে কেন অবস্থান করছিলেন, তা জানা যায়নি। হোটেলের রেজিস্টারে তার নাম-ঠিকানাও নিবন্ধন করা নেই। নিহত নারীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘সি শেলের গার্ড ও কর্মচারীরা আগুনের পর পালিয়েছেন। তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা যদি আগে থেকে চেষ্টা করতেন তাহলে আগুনটা এতো বাড়তো না।
ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের কমিটি গঠন
আগুনের কারণ অনুসন্ধানে এবং ত্রুটি- বিচ্যুতি জানার জন্য ফায়ার সার্ভিস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ বিষয়ে মেজর শাকিল বলেন, ‘এই ঘটনা তদন্তে উপপরিচালক (ডিডি) দেবাশিষ বর্ধনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা ১৫ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তদন্তে যেটা বেরিয়ে আসবে সেটাই চূড়ান্ত। আমাদের অনেক তথ্য নিতে হবে, তারপর উপসংহারে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আগুন বিভিন্ন কারণে লাগতে পারে। প্রথমত, প্রাকৃতিক বজ্রপাতের কারণে হতে পারে। দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনাজনিত আগুন হতে পারে। তৃতীয়ত, শত্রুতাপূর্বক অগ্নিকাণ্ডও হতে পারে। তাই তদন্তে সময় লাগবে। এরপর আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত পাবো।’
আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে জানানোর অনুরোধ অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে জানানোর অনুরোধ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক নিজেরা চেষ্টা করুণ এবং আমাদের ফায়ার সার্ভিসের ০২৯৫৫৫৫৫ নম্বরে ফোন দিয়ে দ্রুত জানান।’