পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

চুমুর স্বাদ কেমন?

Posted on November 16, 2014 | in নির্বাচিত কলাম | by

CHUMUওপার বাংলার প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতা। ১৯৯৮ সালের দিকে একটি গানের জন্য তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি। গানটির একটি লাইনে ছিল ‘প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ, ঘুষ খাওয়া কখনোই নয়’। পশ্চিবঙ্গ সরকার তখন শিল্পী নচিকেতার কণ্ঠরোধ করে দিলেও আজ ১৪ বছর পর ঠিক ভারতেই কয়েক হাজার তরুন তরুনী প্রকাশ্যে চুমু দিয়ে সকল প্রকার মৌলবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার অবস্থান জানান দিলো। পাঠক হয়তো ভাবছেন, এ ঘোর কলিকাল। কিন্তু পাঠক একটু খেয়াল করে দেখুন, কলিকাল বলেই অপরাধের বিচারটাও মর্তের মানুষ দেখে যেতে পারছে, মানুষকে এখন আর প্রতিবাদের জন্য সরকার বাহাদুরের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে না।
ভারতের গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত পাঠ করলে কিছু সংবাদ বারবার দেখা যায়। আর এই বারবার দেখা সংবাদের মধ্যে আছে ‘নিকো পার্ক থেকে প্রেমিক-প্রেমিকাকে চুম্বনরত অবস্থায় গ্রেপ্তার’ কিংবা ‘প্রেমিকার শরীরের কাছাকাছি বসায় প্রেমিককে গ্রেপ্তার’। আমার স্মৃতি যদি দুর্বল না হয়ে থাকে, তাহলে ভারতের প্রথম যে নারী আইপিএস অফিসার, তিনিও দিল্লিতে এরকমই এক পুলিশি নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু কেন? চুমু দেওয়া বা খাওয়া কি সত্যিই তাহলে অপরাধ! যদি এটা অপরাধই হয়ে থাকে, তাহলে সংবিধানের কোন ধারা মোতাবেক এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?। এরকম অনেক প্রশ্নই ইচ্ছে করলে করা যায়। কিন্তু অগুনতি প্রশ্ন করে মূল বিষয় থেকে সরে আসার মোটেও ইচ্ছে আমার নেই। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে যতদিন যাচ্ছে ততই হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনের লম্ফঝম্ফ বাড়ছে। আর এখন তো যদিও তাদের পৌষমাস। কারণ খোদ রাষ্ট্রই এখন মৌলবাদী বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাইতো আমরা শিবসেনাকে বলতে শুনি, ‘বিজেপি যাকে প্রধানমন্ত্রী করবে, তাকেই আমরা মেনে নিব’। এই যখন অবস্থা তখন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দায়িত্বটা এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর কাধেই বর্তায়। যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন সময় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীও উপর চড়াও হয়েছে এবং হচ্ছে। বিজেপি-শিবসেনা এখনও পাজি দেখে জীবনযাপন করলেও ভারতের আপামর জনগোষ্ঠিতো আর এখন পাজি দেখে জীবনযাপন করে না, তাদের জীবনযাপনের অনুষঙ্গে এখন আমূল পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন বর্হিজগত এবং নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন এবং হুশিয়ার। যে কারণে এই সচেতনতার অংশ হিসেবেই গত রোববার কেরালা রাজ্যের কয়েক হাজার তরুন তরুনী প্রকাশ্যে চুমু দিয়ে প্রমাণ করে দিলো যে তারা এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যোগ্য নাগরিক এবং তাদের পরিশ্রমেই স্বচ্ছ ভারত নির্মানের স্বপ্ন দেখেন নীতিনির্ধারকেরা।
কেরালার প্রতিবাদকারীরা তাদের একাট্টা হওয়ার প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে ফেসবুককে। তারা বলতে চেয়েছে, প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া মোটেও ভারতীয় সংস্কৃতি বিরোধী কাজ নয়। বরংচ এই ভারতমাতার বুকে শত শত বছর ধরে মানুষ বসন-ব্যসনের তথাকথিত নৈতিকতা ছাড়াই জীবনযাপন করেছে। ভারতীয় হিন্দুদের যে মহাগুরু শঙ্করাচার্য, তার আমলেও এই অঞ্চলের নারীরা শরীরের উপরের বসন হিসেবে স্রেফ কাপড় জড়িয়ে রাখতো এবং নারী-পুরুষ একসঙ্গে চলাফেরা করতো। অথচ সেই শঙ্করাচার্যের চ্যালারা এখন চ্যালাকাঠ হাতে আধুনিককালের রাধ-কৃষ্ণদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আরও যদি পেছনের দিকে যাওয়া যায় তাহলে আমরা ভারতের কালীঘাটের পটচিত্রগুলোর দিকেও তাকাতে পারি, সেখানকার অনেক মন্দিরে চুম্বনরত নর-নারীর চিত্র আছে। যে অঞ্চলে রাধা-কৃষ্ণের লীলা আখ্যান আকারে ঘরে ঘরে শোভা পায়, সেখানে চুমু দেয়ার অপরাধে প্রহারের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকারান্তে স্ববিরোধীই বটে। আর এই ঘটনা যে শুধু ভারতে তা কিন্তু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই চুমু বা নর-নারীর প্রেমের সম্পর্কের উপর সমাজ খড়গহস্ত আচরণ করছে।
মাস দুয়েক আগের কথা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টিএসসি নামক জায়গায় দুটি ঘটনা আমার নজর কেড়ে নেয়। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বেদম হট্টগোল শুনতে পাই। একটু পরে জানতে পারি, পাশাপাশি বসে দুই তরুন-তরুনী একে অপরকে চুমু দেয়ার অপরাধে একদল ছাত্র (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সদস্য) তাদের বেধরক প্রহার করে এবং তরুনীটির শ্লীলতাহানি করে। অপরদিকে, গত ৫ কিংবা ৬ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পুকুরের সামনে দুই নারী সমেত একজন নর আলোকচিত্রীকে শারিরীকভাবে নির্যাতন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র(এরাও ছাত্রলীগেরই সদস্য)। এরকম নানান ঘটনা আমাদের আশেপাশেই ঘটছে প্রতিদিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরকম কোনো ঘটনারই কোনো আইনি সমাধান হচ্ছে না। ২০০০ সালে টিএসসিতে বাধন নামের এক মেয়েকে চরমভাবে হেনস্তা করার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বিজ্ঞ আদালত। এধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন থেকে শুরু করে আমাদের সমাজ ভয়াবহ রকমের নিশ্চুপ আচরণ করে।
কেন সমাজ এবং সমাজের মানুষ এরকম আচরণ করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে আমরা দীর্ঘ সমস্যার লাইন দেখতে পাই। আমাদের দেশে বাল্যশিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই ছেলে এবং মেয়ের প্রভেদ করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাতেই এমন একটা ভাব বিরাজ করে যেন ছেলের সঙ্গে মেয়ে কথা বলতে পারবে না, কিংবা মেয়ের সঙ্গে ছেলে কথা বলতে পারবে না। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ স্কুলে একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে এরকম অসংখ্য ঘটনার কথা, যেগুলো আদতে কোনো ঘটনাই নয়। উল্টো স্কুল শিক্ষকদের এহেন আচরণের কারণে ওই শিশু বাচ্চারাই ভবিষ্যতে বড় হয়ে সমাজের অন্যদের উপর চড়াও হয়। এতো গেল একদিককার কথা। অন্যদিকে, আমাদের এই অঞ্চল নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলীয় হওয়ার কারণে এখানকার মানুষের শারিরীক এবং মানসিক বিকাশ অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি হয়। বর্তমানে এমনও জানা যায় যে, ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পিরিয়ড হয়ে গেছে। ঘটনা খুব বেশি দূরের নয়, আমাদের এই সমাজেই কোনো মেয়ের একটু আগে পিরিয়ড হলে সামাজিক ভাবে ওই মেয়েকে এবং মেয়ের পিতা-মাতাকে কিছুটা হেয় হতে হতো। তেমনি ছেলেদের ক্ষেত্রেও, একটা ছেলে যখন অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হয় ততদিনে তার ভেতর একপ্রকার যৌনচেতনা গড়ে উঠে। কিন্তু পিতা-মাতা থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেকটি জায়গায় এই অবধারিত বিষয়টিকে দেখানো হয় অনকেটা পাপবোধের দৃষ্টি দিয়ে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে নর-নারীর স্বাভাবিক শারিরীক সম্পর্কও হয়ে যায় অনেকটা পাপাচারের মতো। এরকম অজস্র মনস্তাত্ত্বিক স্খলনের কারণে সমাজের একেবারে গভীরে এই নেতিবাচক যৌনচেতনা স্বাভাবিক যৌনচেতনার সঙ্গে বিরোধীতা করছে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন স্থানে আরএসএস বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ বেধে যাচ্ছে ‘কিস অব লাভ’ কর্মীদের সঙ্গে। গত ৮ নভেম্বর দিল্লিস্থ আরএসএস কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ করে ‘কিস অব লাভ’ কর্মীরা। এসময় আরএসএস কর্মীদের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে প্রতিবাদী কর্মীদের লাঠিপেটা করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রায় সত্তর জন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আর এর মধ্য দিয়ে বৃহত গণতান্ত্রিক দেশ ভারত আরও একবার প্রমাণ করলো যে এই দেশে সত্যিই চুমু খাওয়া অপরাধ। কিন্তু কথা হলো, যারা এই কাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছেন তারা কী আদৌ ভালোবাসা কিংবা প্রেমময় চুমু সম্পর্কে জানেন। ভারতে-বাংলাদেশে কিংবা বিশ্বের যেকোনো স্থানে যখন কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হয় তখন এই ধর্ষন কারা করে? নাকি, মানুষের সঙ্গে মানুষের এই ভালোবাসাকেই ভয় পায় শসক গোষ্ঠি। কারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনহীন ভালোবসার সম্পর্ক রচিত হলে একে একে নষ্ট হয়ে যাবে সীমান্ত ব্যবস্থা, দুর্নীতির শেকলসহ সামাজিক নানান ব্যধি। আর সামাজিক এই প্রতিবন্ধকতাগুলো না থাকলে শাসকগোষ্ঠি শাসন করবে কাকে বা কাদের। যারা কোনোদিন জানলো না ভালোবাসার অনুভূতি কেমন ও চুমুর স্বাদই বা কেমন, তারাই আজ লাঠি হাতে তর্জন গর্জন করছে। হয়তো বেশিদিন লাগবে না দুর্দান্ত চুমুর তোড়ে সকল সামাজিক অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।

Comments are closed.

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud