November 6, 2025
সাভারে রানা প্লাজার টানা ২০ দিনের উদ্ধারকাজের শেষ মুহূর্তটি ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। নয়তলা ভবনটি নয়, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পার্কিংয়ে ভবনমালিকের অফিসকক্ষের পাশের স্টোররুমটি। ওই কামরাটিতে পাওয়া যায় দেশের ৪২ বছরের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির ইতিহাসের নির্যাস। ওই বিশ্ববিখ্যাত ভবন থেকে কয়েকজন মানবসন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা হলেও তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়—‘পার্কিং থেকে চারটি চাপাতি, তিনটি রামদা, ১৮ বোতল ফেনসিডিল, ১৫ ক্যান বিয়ার, একটি করাত ও একটি শিকল উদ্ধার করেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। র্যাব-৪-এর সাভার ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর কে এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সেনাবাহিনীর উদ্ধারকাজের সময় পার্কিংয়ে থাকা ভবনমালিক সোহেল রানার অফিসকক্ষের পাশের একটি স্টোররুম থেকে এগুলো উদ্ধার করা হয়েছে।’
[প্রথম আলো, ১৪ মে]
বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত, তেমনি এ দেশে আজ অনেক বস্তুরও রয়েছে রাজনৈতিক পরিচিতি। সেসবকে শুধু আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হিসেবে নয়, বিবেচনা করতে হবে রাজনৈতিক বস্তু হিসেবে। চাপাতি, রামদা, ফেনসিডিল, করাত, শিকল প্রভৃতি শুধু কোনো হাতিয়ার বা রাসায়নিক দ্রব্য নয়—বাংলাদেশে এসব নিত্যব্যবহূত রাজনৈতিক বস্তু। এসব ছাড়া বাংলার রাজনীতি আজ অচল ও প্রাণহীন।
রানা প্লাজায় শুধু স্বাধীন বাংলার অর্থনীতি নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সবকিছুই একাকার হয়ে গিয়েছিল। ওই ভবনের যিনি মালিক, সমকালীন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার পূর্ণ যোগ্যতা রয়েছে তাঁর। আমরা যখন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতির রহস্য অনুসন্ধান করব তখন ছুটে যাব তাঁর কাছে। আমরা যদি রাজনীতির চরিত্র জানতে চাই, তিনিই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমাদের যদি বর্তমান সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানার কিছুমাত্র আগ্রহ থাকে, তিনিই প্রধান অবলম্বন। গোটা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় তাঁর মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে যদি বিদেশের কোনো পত্রিকা ‘রানাদের দেশ’ বলে আখ্যায়িত করে থাকে—একেবারেই অন্যায় বা ভুল করেনি। আমরা আজ বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলাদেশে নয়—বাস করছি রানার দেশে।
সরলমনা কেউ বোকার মতো প্রশ্ন করতে পারেন, ও-বাড়ির স্টোররুমে রামদা কেন? এবং একখানা নয় চার-চারটি। বাড়ির মালিকের পেশা তো কসাইগিরি নয়। শুধু কি গরু-খাসি জবাই করে মাংস বিক্রি করলেই মানুষ কসাই হয়? যারা মানুষ বধ করে তারাও কসাই। কোনো বালক-বালিকা এ প্রশ্নও করতে পারে যে চাপাতি দিয়ে মালিক কী করতেন? বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। নিশ্চয়ই আম ছেলার জন্য চাপাতি রাখেননি স্টোররুমে। আমের খোসা ছাড়াতে তো চাপাতি নয়, চাকু বা ছুরিই যথেষ্ট। চাপাতি কেন রাখা হয়েছিল তা আজ আমরা বলতে পারব না, বলতে পারতাম যদি ওই দিন ভবনটি ধসে না পড়ত। আর এক ঘণ্টা পরে ভবনটি ধসে পড়লে সকাল ১০টায় যে হরতালবিরোধী মিছিল বেরোত, সেখানেই চকচক করত চাপাতি আর রামদা।
ওই ভবনের স্টোরে করাত কেন ছিল তা জানতে বোকাসোকা গোছের কোনো লোকের মধ্যে কৌতূহল দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। করাত দিয়ে তো কাঠ কাটে। বোকাদের অনেকেই জানেন না যে করাত দিয়ে রাতের অন্ধকারে মহাসড়কের গাছ শুধু নয়, প্রতিপক্ষের লোকদের হাত-পাও কাটা হয়। যে শত্রুর জন্য যে অস্ত্র প্রযোজ্য। কারও জন্য রামদা, কারও জন্য চাপাতি, কারও জন্য করাত। যে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনগুলো অনেক কক্ষ রামদা-চাপাতি-বন্দুকের গুদামে পরিণত হয়েছে, সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া ভবনমালিকের স্টোরে অত কম রামদা-চাপাতি পাওয়া গেছে—তা তাজ্জবের কথা বটে। তার তো আরও বেশি লোক নিয়ে কারবার!
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন শিকল নিয়ে। কার হাতে-পায়ে পরানো হবে তা? বিরোধী দলপন্থী কোনো পাগল যদি ভবনে ঢুকে পড়ে এবং মালিকের ওপর হামলা চালায়, তখন তাকে ধরে স্টোররুমের পাশের কোনো কামরায় বেঁধে রাখতেই শিকল। স্টোরে কোনো পিস্তল ও রিভলবার পাওয়া যায়নি। কারণ ও-জাতীয় অস্ত্র স্টোরে বা যেখানে সেখানে ফেলে রাখার জিনিস নয়। ওসব থাকে কোমরে। খাপের মধ্যে। প্রয়োজনের মুহূর্তেই তা শুধু বের করে ট্রিগার টিপতে হয়।
ভবনমালিক পৃথিবীর ভাগ্যবান মানুষদের একজন। অঢেল তাঁর সম্পদ, অসংখ্য তাঁর বন্ধু।
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রথম ১০ বছরে জামশেদজি টাটা, ঘনশ্যামদাস বিড়লা, আদমজী, ইস্পাহানীরাও অত টাকার মালিক হতে পারেননি। তৃতীয় আগা খান, হায়দরাবাদের নিজাম বা বিল গেটসও অত অল্প সময়ে অত বিত্ত অর্জন করেননি। তা করেননি তার কারণ তাঁরা কেউই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। টাকা যেটুকু কামাই করেছেন তা অতি পরিশ্রম করে। রানার কষ্ট করতে হয়নি—করতে হয়েছে রাজনীতি।
তাই ভবনধসের পরে রানাকে নিয়ে গোটা জাতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সঙ্গে সঙ্গে ছোঁ মেরে কোথায় তাঁকে সরিয়ে দেন—তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকদের কি জানা সম্ভব? তাঁর ভবনটির যা দাম, অনুমান করি, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা তাঁর খরচ হয়ে যায় ওই দিন দুপুরের মধ্যেই। সুতরাং তাঁকে খুঁজে না পাওয়াই স্বাভাবিক।
সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার যা তা হলো জাতিকে জানানো হলো: এ রানা সে রানা নয়।
যুবলীগের নেতা অন্য এক রানা। তবে তিনি কোথায়, কী অবস্থায় আছেন সে কথা গোপন রাখা হলো। বলা হলো, প্রথম আলোতে পোস্টারে চুম্বনধন্য রানার যে ছবি ছাপা হয়েছে তা ভুয়া। রাতে আমারও টিভি চ্যানেলে ডাক পড়ল। যুবলীগের নেতাও ছিলেন। তিনিও বললেন, এ রানা সে রানা নয়, এ ছবি ভুয়া। আসল এবং নকল কোনো রানা সম্পর্কেই আমার কোনো ধারণা ছিল না বলে প্রতিবাদ করলাম মিন মিন করে। ভবনধসের ফলে মানুষের যত সর্বনাশই হোক, বেঁচে গেছে আমিনবাজার-নয়ারহাট সড়কের আইল্যান্ড এবং সড়কের দুপাশের গাছপালা, বৈদ্যুতিক থাম্বা প্রভৃতি। গত চারটি বছর যাবৎ জং সাহেব ও রানাদের যেসব ডিজিটাল ব্যানার-পোস্টার বিরতিহীনভাবে শোভা পাচ্ছিল তা রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে। ভারমুক্ত হয়ে সড়কটি এখন কিঞ্চিৎ স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছে।
রানার যে বিপুল বিত্ত তা কি শুধু তাঁর নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য? গত পনেরো বছরে রানার উপার্জিত সম্পদ কি শুধু তাঁর মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তানেরাই ভোগ করেছেন?
এই রিপাবলিকের আমাদের মতো কেউ কি তাঁর অংশবিশেষ লাভ করে ধন্য হননি? কোনো মন্ত্রী নন, কোনো সাংসদ নন, কোনো নেতা নন, থানার দারোগা নন, পৌরসভার মেয়র নন, কর্মকর্তা নন, ইঞ্জিনিয়ার নন—কারও পকেটে তাঁর অর্থ কিছুই কি যায়নি? শুধু ছাত্রনেতা ও ক্যাডারদেরই বা দোষ কী? সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও এত দিন জানাননি তাঁর রূপকথার উত্থান সম্পর্কে। অনেকেই তাঁর অর্থের ভাগ পাওয়ায় তাঁর স্তম্ভ এতটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে তা সাধারণ মানুষ জোরে নাড়াচাড়া করেও নড়াতে পারেনি।
রানা হলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারক-বাহক এবং চেতনাপন্থী। তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমান সবাই সমান।
প্রবল চেতনা থেকে কোনো হিন্দুর জমিকেও তিনি নিজের জমি মনে করেন। আগে নয়, ভবনধসের পরেই আমরা কবিগুরুর নামে নাম একজনের কথা জানতে পারলাম। ‘দুই বিঘা জমি’র জমিদারবাবুর মতো যেদিন রানা বললেন, তাঁর ভবন নির্মাণের জায়গাটি দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান করতে ‘ওটা দিতে হবে’; সেদিন নিরুপায় হয়ে তিনি আরজি পেশ করতে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের বাসভবনে এসেছিলেন। গেটের কাছে তিন ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে গেটের প্রহরী তাঁকে বিদায় করে দেন: ‘দেখা হবে না, মাননীয় মন্ত্রী ব্যস্ত’। টিভির পর্দা থেকেই জানতে পারলাম, তিনি ভেবেছিলেন তিনি যেহেতু হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ হিন্দুদের নির্বাচনী রাজনীতিতে ব্যবহার করে, সুতরাং তাঁদের মন্ত্রী দেখা দেবেন এবং শুনবেন তাঁর আরজি। কিন্তু সে গুড়ে যে বালি সে ধারণা ছিল না তাঁর। ব্যাপারটা শ্রেণী চরিত্রের।
শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল; কিন্তু তাঁর দলের অন্য নেতাদের নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁদের বক্তৃতার বিষয়বস্তু আর ব্যক্তিগত বিশ্বাস দুই রকম।
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ দেখে একজন আমাকে বললেন, একটি মানুষ ও একটি ভবনের কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল। আমি তখন ভাবছিলাম ঠিক বিপরীত কথা। ভাবছিলাম, ভবনটি যদি সেদিন ধসে না পড়ত এবং আদৌ ধসে না পড়ত, তাহলে কী হতো?
পোশাক কারখানার মালিকদের নেতাদের কাছে হরতাল দুশমন। যেন তাঁরা জন্মের পর কোনো দিন হরতাল দেখেননি। এবং হরতাল ছাড়াই এত বড়লোক হয়েছেন। গত ২৪ এপ্রিল ছিল হরতাল। সকাল থেকেই হরতালবিরোধী মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল। জনপ্রতিনিধি জং সাহেবের নেতৃত্বে চার কারখানার মালিক ও সুযোগ্য ভবনমালিকের হরতাল প্রতিরোধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। টাকার অভাব ছিল না। লোক সমাগম হতো বেশ। মিছিলের পুরোভাগে জং সাহেব-রানা সাহেব হাতে হাত ধরে বীরদর্পে এগোচ্ছেন।
অন্যদের হাতে রামদা ও চাপাতি চকচক করছে। ওদিক থেকে আসছে হরতালঅলাদের পক্ষের গুটিকয় পিকেটার। ওদের সঙ্গে বেধে যেত সংঘর্ষ। ব্যবহূত হতো ওই রামদা, চাপাতি আর কারও কোমরের পিস্তল। টিভি থেকে দেশবাসী জানত হরতালের পক্ষ-বিপক্ষ সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও ১৭ জন আহত। ভবনধসে ১১শর বেশি মারা গেছে বটে, বেঁচে গেছে ওই তিনজন।
তিনটিকে ফেলে দেওয়ার পুরস্কারস্বরূপ ক্যাডার ও মিছিলকারীদের জন্য লাঞ্চে থাকত মোরগ পোলাও আর রাতে ডিনারে তেহারি। নেতাগোছের যাঁরা, সন্ধ্যায় তাঁদের জন্য মজুত ছিল বিয়ারের ক্যান। একেবারে নিচের পর্যায়ের কর্মীদের জন্য ফেনসিডিল। চাপাতির মতোই আজ বিয়ার ও ফেনসিডিলও দুটি রাজনৈতিক বস্তু। রাজনীতির প্রয়োজনে লাখ লাখ তরুণকে ফেনসিডিল শরাব পান করতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। তাদের হাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছে চাপাতি, রামদা, কাটা রাইফেল। এক বোতল ফেনসিডিলে কতটা শরাব থাকে এবং একবারে কয়জন পান করতে পারে, আমার ধারণা নেই। তবে এক বোতল যদি একজনই খায়, ২৪ এপ্রিল ভবনধস না হলে ১৮ তরুণ নেশায় বুঁদ হতো। পনেরো ক্যান বিয়ারে চোখে নেশা লাগত অন্তত ১৫ যুবকের। ভবনধসে ৩৩ তরুণের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে।
রাজনীতির কারণে সোনার বাংলায় কী না হয়! ছাত্রনেতা হতে গেলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ম্যাট্রিক পাস না করেই যদি বিশ্বকবি ও জাতীয় কবি হওয়া যায়, ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে ছাত্রনেতা হওয়া যাবে না কেন? ছাত্রনেতারাই তো প্রমোশন পেয়ে যুবনেতা হন। সবকিছু তাঁরা হন রাজনীতির স্বার্থে। তাঁদের নিজেদের স্বার্থ পরে।
রানা প্লাজা ধসের পরে পরিষ্কার হয়ে গেছে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, লুম্পেন অর্থনীতি ও ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা একাকার হয়ে গেছে। পোশাক কারখানার আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে হতদরিদ্র শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাসে। সেই দীর্ঘশ্বাস নিম্নচাপে পরিণত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। সেই ঝড়ে কখনো ধসে পড়ছে দু-একটি ভবন, কোথাও বা লাগছে আগুন। মরছে মানুষ কীটপতঙ্গের মতো। সাভারে ভবনধসের পরপরই মিরপুরে এক ভবনে মধ্যরাতে জ্বলে উঠল আগুন।
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলেন মালিক ও তাঁর ডিআইজি বন্ধু। দ্বিতীয় দুর্ঘটনাই বা কী বার্তা দিল দেশবাসীকে? বিশ্ববাসীকে?
রাজনীতি আর অর্থনীতি আজ সম্পূরক। একটি ছাড়া অন্যটি অচল। ছুটিছাটার দিনে বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে যাওয়াই স্বাভাবিক। নিশিরাতে সুনসান কারখানায় জম্পেশ আড্ডা শোভন নয়। পদমর্যাদা বলে একটা শব্দ আছে। সরকারি চাকরি করে সব পদের কর্মকর্তা সব জায়গায় সবার সঙ্গে আড্ডা দিতে বা পানাহার করতে পারেন না। আর যদি আড্ডার বিষয়বস্তু হয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ—তাহলে তো আরও পারেন না। আগামী নির্বাচনে শিল্প-মালিক প্রার্থী হচ্ছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল বন্ধুর সঙ্গে। সেখানে ১০ কোটি টাকাও পাওয়া গেছে বলে পত্রিকা লিখেছে। ধন্যবাদ আমাদের মিডিয়াকে। চক্ষুলজ্জাবশত হোক বা অন্য কারণে হোক, বিষয়টি নিয়ে তারা ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। তবে মানুষ যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে।
শুধু সোহেল রানার নয়, অন্য রানাদের ভবনের প্রতিটি ইটও আজ ক্ষুধার্ত। ক্ষুধার্ত ঠিকই, কিন্তু তাদের চেতনা নেই। তাই মুহূর্তে এক-দেড় হাজার নর-নারীকে জীবন্ত কবর দিতে তাদের কষ্ট হয় না। নয়তলা কবরে তাজা মানুষগুলোকে কাফনের কাপড় না পরিয়েই ঠেলে দিতে ভবনমালিক ও কারখানামালিকের বুক একটুও কাঁপে না।
রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর চারদিকে একজন পাগলা মেহের আলি ঘুরে বেড়াত আর বলত, ‘তফাত যাও, তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।’ (গার্মেন্টসের ‘ঝুট’ নয়। ঝুট ব্যবসা নিয়ে বিবাদে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ডজন কয়েক ব্যবসায়ী। মেহের আলির ‘ঝুট’ হলো মিথ্যা—একটি হিন্দি শব্দ)। মিথ্যার ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। বাংলাদেশে আজ একজন মেহের আলি নেই। থাকলে বনানী, উত্তরা, আশুলিয়া, মিরপুর, রামপুরা, সাভারের বহুতল ভবনগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতেন: তফাত যাও, তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।