December 13, 2025
অপপ্রচার বাজারে চলে বেশি, এর প্রতি সাধারণের আগ্রহ বেশি। সুকর্মের প্রচার এ দেশে তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মতো দেশে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থেকে এবং থেকে কিছু অপকর্ম করবেই। সরকারে থাকলে নিজেকে গরম মিয়া মনে হয়। এবং সব সময় গরম থাকলে নিজের ক্ষতি হবেই। কিন্তু মিডিয়াতে কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার ইতিবাচক কিছু করলে তা খবর হয় না। অপকর্ম করলে তো অবশ্যই হবে এবং হোক, সেটি আমরা চাই। কিন্তু ইতিবাচক বিষয় না তুললে পত্রিকা ভারসাম্য হারায়।
আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে অপকর্ম অনেক করেছে। সেগুলো ডিফেন্ড করে কোন লাভ নেই। আমাদের বিবেচনা করতে হয় বিএনপি-জামায়াতের তুলনায় কত কম অপকর্ম করেছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা তা করবেনই; কারণ, রাজনীতি এখন মূলত আদর্শের বদলে পেশা। গত কয়েক বছরের পত্র-পত্রিকা দেখুন, মনে হবে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে শুধু অপকর্ম করতেই। কিন্তু সত্য ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত অধ্যাপক এবিএম নাসিরের (১৪.৮.১৩) প্রবন্ধটি উলেøখ করব। সেখানে কিছু উপাত্ত দেয়া আছে।
নাসির লিখেছেন, ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে চারটি নির্বাচিত সরকার ও একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থেকেছে।
দীর্ঘ ২৫ বছরে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিএনপি আমলে। এর কারণ, জামায়াত চিরজীবন ভায়োলেন্সে বিশ্বাসীনÑ বিএনপির জন্ম ভায়োলেন্সের মাধ্যমে। বিএনপি-জামায়াতের সহযোগী হলো সব মৌলবাদী সংগঠন। খালেদা, নিজামী, তারেকের আমলে বাংলাদেশে সাবেক মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধিসহ নিহত হন ‘‘১৩৭ জন, আহত হন ১৪৫৮ জন।’’ গুলিতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন এএসএম কিবরিয়ার মতো অজাতশত্রু মানুষ, আহসানউলøাহ মাস্টারের মতো জনপ্রতিনিধি, আইভি রহমানের মতো রাজনৈতিক নেত্রী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস। আহত হন, এমন কি ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও। গত চার বছরে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে? বলতে পারেন চৌধুরী আলম বা ইলিয়াস আলীর কথা। কথিত আছে, মেয়র খোকার আমলে টোকাই আলম গুলিস্তানে নাকি বঙ্গবাজার পুড়িয়ে দেয়।
তারপর তা দখল করে এক দানে কোটি কোটিপতি হয়ে যায়। বিএনপির দাবি, র্যাব তাকে গুম করেছিল। এখন জানা গেছে, আলমের প্রতিদ্ব›দ্বী আরেক টোকাই থেকে কোটিপতি তাকে গুম করে। ইলিয়াস আলী কী উপায়ে অর্থ ও পেশিশক্তির মালিক হয়েছিলেন তা তার সমসাময়িক সবাই জানেন। বিএনপি সরকারই তাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছিল। তাকে গুম করে সরকারের লাভ কি? গুম করলে তো তাদের করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ফায়দা আছে। গু-াপা-া গুম করে রাজনৈতিক ফায়দাটা কী? এএসএম কিবরিয়া, আইভি রহমান বা আহসানউলøাহ মাস্টারের ব্যাকগ্রাউন্ড কি সেরকম? সরকারী প্রচেষ্টায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুনের চেষ্টা তো বিএনপি আমলেই ঘটেছে। যখন বর্তমান সরকারের অপকর্মের কথা ফলাও করে ছাপা হয় তখন সযতনে এসব কথা এড়িয়ে যাওয়া হয় এ বলে যে, পুরনো কথা থাক। পুরনো কথা বাদ দিলে বর্তমান বুঝব কিভাবে?
সাংবাদিক নির্যাতনের কথা আসে। বিএনপি আমলে সাংবাদিক হত্যা করা হয় ১৩ জন। এ আমলে ৭ জন। রাজনৈতিক ভায়োলেন্সে বিএনপি আমলে মৃত্যু ১২৬৫ জন, আর এ আমলে ৭৫৮ জন। [ক্রসফায়ারে আওয়ামী লীগ আমলে ৩৪৬ জন [এ পর্যন্ত], বিএনপি আমলে ৭৯৬ জন। ভায়োলেন্সেও আওয়ামী লীগ হার মানাতে পারেনি বিএনপিকে। তাহলে বুঝুন, দু’একটি ছাড়া অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থার ব্যবসাটি কি রকম!]
না, আমি কোন মৃত্যু, হত্যা, গুম কোন আমলেরই সমর্থন করি না। কিন্তু মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দল (বিএনপি-জামায়াত) কিভাবে অপপ্রচার চালায় তার একটি উদাহরণ দিলাম মাত্র। কারণ, পরিসংখ্যানের চেয়ে জোরালো সাক্ষী আর কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক ছোট একটি নিবন্ধে যা প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রী-উপদেষ্টা তার কিছুই পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস শাখা ও মন্ত্রণালয় [ইনুর আগে] যে কতটা অযোগ্য এটি তার ছোট একটি উদাহরণ। কিন্তু, মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, অযোগ্যদের এত যোগ্য ভাবেন কেন রাজনৈতিক নেতারা? তারা কি ভাবেন যোগ্য লোক এলে নেতার নেতৃত্ব খাটো হয়ে যাবে? পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা সোনিয়া গান্ধী কাদের পাশে রাখেন দেখুন।
গত চার বছরে আওয়ামী লীগ যা করেছে গত ২৫ বছরে কোন সরকার তা করেনি। বিলবোর্ডের প্রচার ঠিকই ছিল, কিন্তু মাথামোটা লোকজন পাশে থাকলে যা হয় তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভেবে অবাক হতে পারেন যে, কার জন্য এত করলাম? তিনি এত করেছেন ঠিকই আছে, কিন্তু সব মানুষ জানবে কিÑ কিভাবে যেখানে তার আশপাশে প্রচার অনভিজ্ঞদের দেয়া হয় প্রচারের দায়িত্বে?
আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনে ক্রমাগত হারছে তার কারণ কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। সরকার নীতি নির্ধারণ করে অগ্রাধিকার ঠিক করে তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। দেশের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় দলকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। দলের যে নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হয়েছে তার একটি উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু তা সফল হয়নি। এর একটি কারণ, সব কিছু দলীয় সভানেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত। সমষ্টিগত নেতৃত্ব নেই। যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিষ্ক্রিয় সে দল চলবে কিভাবে? এখন দলের সাংগঠনিক অবস্থা বিপর্যস্ত। এ মন্তব্যে দলের নেতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না। এ সব মতামত বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় নেতারাই আমাদের জানিয়েছেন। দলের কর্মীরা টাকা ছাড়া এক পা নড়তে নারাজ। এ অবস্থার জন্য দলীয় নেতারাই দায়ী।
বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করলেও বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ আদর্শ থেকে বর্তমান নেতৃত্ব সরে এসেছে। আদর্শের জায়গাটা অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। দলে ত্যাগীদের থেকে অর্থবানদের ইজ্জত বেড়েছে এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন জোরালো না হওয়ায় দলের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ কথাটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নেতৃত্ব যে, কোন শক্তি কোন দলকে ক্ষমতায় বসায় না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মানুষই দলকে ক্ষমতায় নেয়। সেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নেয় সংগঠন। গত চার বছরে সরকার হয়ত উপকৃত হয়েছে, কিন্তু দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা ভোট দেবেন স্থানীয় এমপি-নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই, রনি-বদিরা এর উদাহরণ। শহুরে সির্ভিল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ। এলিট সমর্থকরাও উপেক্ষিত। অর্থ ছাড়া সব কিছু যেন অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সমর্থক, এলিট ও অর্থবান এফবিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি যদি পুলিশের পিটুনি খায় তাহলে অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমেয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকায় এসেছেন। তিনি বলছিলেন, শেখ হাসিনা বলছেন জিতবেন। আর তার নেতারা নিজ দলকে ৩০/৪০টির বেশি সিট দিতে রাজি নয়, ব্যাপারটা কী? ব্যাপার কেউ জানে না। তবে এটা জানে যাদের নিয়ে শেখ হাসিনা লড়বেন বলে ঠিক করেছেন, ৪ সিটি কর্পোরেশনে হারার পর তারা মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দল, হয় লড়াইর জন্য চাঙ্গা হয় না হয় মিইয়ে পড়ে; কিন্তু আওয়ামী লীগ মিইয়ে পড়েছে। এর অন্যতম কারণ দলে এখন কোন দিকনির্দেশনা নেই। এক ঘেরাটোপে আটকে আছেন সভানেত্রী।
আওয়ামী লীগ কী করবে তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ঠিক করবে, সেখানে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা কোন পরামর্শ দিচ্ছি না। আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে মনে করে আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা আমাদের যা বলেন তার সারাংশ তুলে ধরলাম। আওয়ামী লীগ এত ইতিবাচক কাজ করেও যদি নেতৃত্বের অকারণ জেদ, অহমিকা ও ভুলের কারণে [ভুল দেখিয়ে দিলেও, ‘আমি যা বলছি তাই ঠিক’Ñ এটিই জেদ, ভুল স্বীকার না করায় কোন মাহাত্ম্য নেই] যদি ১৪ দল পরাজিত হয় তাতে তো আমরা আনন্দিত হব না। খানিকটা হতাশ হই এ ভেবে যে, এত অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো কোন ব্যক্তি বা দল নেত্রী সৃষ্টি করতে পারেননি। এ জন্য বলা হয়, মূর্খ যোগ্যতাহীন চামচা বন্ধু থেকে বুদ্ধিমান শত্রু শ্রেয়।
অপপ্রচারের কথা বলছি বারবার এ কারণে যে, তা জনমনে শুধু বিভ্রান্তি নয়, দলেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। যে প্রচারটি চালানো হয়েছে তাহলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণ জামায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা; যাতে তারা বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি আওয়ামী লীগের অনেকে তা বিশ্বাস করে।
তারা বিশ্বাস করে, মাদ্রাসা-মক্তবকে তোষণ করলে ভোট আসবে। যে কারণে, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো মানুষ শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরও মাধ্যমিক কারিকুলামে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়। মাদ্রাসাকে যে এত তোষণ করা হয়েছে তাতে কি ভোট বেড়েছে? নিতান্ত গবেট না হলে এ ধারণা কিভাবে হয়: যারা জামায়াত করে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? বিএনপির সঙ্গে জোট না থাকলেও দেবে না। পাকিস্তান তাদের ফাদার-মাদার। সেই পাকিস্তানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিদের অপমানের চূড়ান্ত করেছে; এটি একজন ট্রুু জামায়াতী, ট্রু বিএনপি মেনে নিতে পারে না। হেফাজত কখনও ভোট দেবে না আওয়ামী লীগকে। নারী দেখলে যে আহমদ শফীর লালা ঝরে তাকে তোয়াজে কি ফল হয়েছে? কিন্তু আওয়ামী লীগ তোয়াজ করতে চেয়েছে এবং ঝাঁপটা খেয়েছে। এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেছে। এবং এই বিশ্বাস আওয়ামী লীগের মূল আদর্শ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ম্লান করেছে। দলের নেতা শেখ হাসিনা বটে, কিন্তু দলের যে নেতৃত্ব তিনি সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই।
হেজাবিরা যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তখন শেখ হাসিনা [হঠাৎ সৈয়দ আশরাফ] বলেছিলেন, জামায়াত-হেফাজতকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। এই উক্তি দলের আদর্শের নড়বড়ে স্থানটা ঠিক করে দিয়েছিল। দলের তৃণমূল নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। তার মত অনুসরণ করে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন শুধু স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর অন্য কোন মন্ত্রী, কোন বড় বা পাতি নেতা, কোন উপদেষ্টা, কোন এমপি এ কথা বলেননি। এমনকি চার পরাজিত মেয়র হেফাজতী ও জামায়াতীদের তোয়াজ করেছেন এবং লাথি খেয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের পর এসেছে জামায়াত নিষিদ্ধকরণ ও গোলাম আযমের দ- বৃদ্ধি প্রসঙ্গ। আমরা জেনেছি, এ প্রশ্নেও ছাড় দিতে চেয়েছিল পার্টির কিছু ব্যক্তি [যাদের মিত্র মনে করা হবে আরেকটি ভুল]। কিন্তু এ দু’টি ক্ষেত্রেই সরকার আপীল করার পর এখন আর অপপ্রচারের কোন সুযোগ নেই। এবং এই কার্যক্রম শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া হয়েছে, এটি কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না। আদালতের রায় কী হবে জানি না। কিন্তু শেখ হাসিনা যে এই পথটি বেছে নিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জায়গাটায় পৌঁছাবার পদক্ষেপ নিয়েছেন, সে কারণেই অন্তত ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব।