October 2, 2025
‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’Ñ এই প্রবাদ-প্রবচনটি মানুষের অভিজ্ঞতার ফসল। মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ‘ঐশ্বরিক’ ক্ষমতা বুঝাতে আর দম্ভ ও অহমিকাসর্বস্ব ক্ষমতাদর্পী মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে এটি ব্যবহৃত হয়। ধর্ম সব যুগেই প্রভাবক থেকেছে। একসময় ধর্মের বাইরে কিছুই হতো না। সেটা বিকৃত ধর্ম হলেও। ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করার লক্ষ্যে পনের শতকের চিন্তাটিও অভিজ্ঞতা থেকেই এসেছিল। ‘পোপেরটুকু পোপকে দাও সিজার বা রাজারটা রাজাকে দাও’Ñ এটাই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের গোড়ার কথা। এর আগে রাষ্ট্র সরকার রাজ্য সাম্রাজ্য সবকিছু ধর্মাশ্রয়ী ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ ধরনের চিন্তায় ধর্মবিদ্বেষের চেয়েও ধর্মকে রাজনীতির পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করার বাসনা অধিকতর সক্রিয় ছিল। মাও, লেনিন, মার্কস-এঙ্গেলসকে সাম্যবাদের পুরোহিত ভেবে যারা তাদের ধর্মের প্রতিপক্ষে দাঁড় করার চেষ্টা করেন Ñ তারা অর্ধ সত্য বলেন।
ধর্মীয় পরিচয়ে অনাচার যে হয়নি বা হচ্ছে না তা কেউ দিব্যি দিয়ে বলতে পারবেন না। তাছাড়া ফেরাউন-নমরুদরাও নিজ নিজ ধর্ম মানত। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং ধর্ম ব্যবসা এখনো চলছে। কোনো কোনো সরকার এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করে। বর্তমানে সরকার মূল ধারার ইসলাম ঠেকাতে ধর্মব্যবসায়ী ও মাজারি-বাজারিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এর দায় ধর্ম ও ধার্মিকের নয়। গির্জায় রক্ষিতা, যিশুর নামে কাষ্ঠফলক, মিথ্যা বেহেশতের সনদ বা ইনডালজেন্স ও ধর্মের নামে টোল আদায়ের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথার প্রতিবাদ করেছেন। এটাই প্রোটেস্টান্টদের আদি ইতিহাস। ধর্মের নামে অনাচার ধর্ম নয়। একটা বহুল প্রচলিত মত হচ্ছে, মানুষের মনের ভেতর আনুগত্যের বীজ রয়েছে। সঠিক সৃষ্টিকর্তার সন্ধান না পেলে মানুষ সৃষ্টির পূজা বা আনুগত্য করবেই। পৃথিবীর কোনো ধর্মই মূর্তিপূজা দিয়ে শুরু হয়নি। এক নিরাকার সৃষ্টিকর্তা বা একত্ববাদ দিয়েই শুরু হয়েছে। ভক্তিবাদ ও বিকৃতির পথে মিথ-মিথোলোজিও ধর্মের মর্যাদা পেয়ে গেছে। যেমন রামায়ণ-মহাভারত কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়, যেমন ধর্মগ্রন্থ নয় বিষাদসিন্ধু। কিন্তু ভারত-বাংলার ঘরে ঘরে এসব বই ঐশীগ্রন্থের মতো মর্যাদা পেয়ে গেছে। সব ধর্মেই এমন কিছু লোক আছেন, যাদের অনেকেই ধর্ম মানতে পারেন না কিন্তু এ জন্য তার অনুতাপ আছে। কিন্তু তিনি ধর্মদ্রোহী হন না, কিংবা বিদ্বেষও ছড়ান না। তবে কিছু লোক ধর্ম না মানাকে প্রগতিশীলতা ভাবেন এবং ধর্মবিদ্বেষী হতে পছন্দ করেন Ñ এরা যে ধর্মেরই হোক ভয়ঙ্কর, এরা ধর্ম ও মানবতার দুশমন। এরাই সমাজকে কলুষিত করে চলছে। নৈতিকতাকে ধসিয়ে দিচ্ছে। সব যুগেই কিছু ধর্মদ্রোহী ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
প্রকৃত সৃষ্টিকর্তাকে পেতে শক্তি ও মূর্তিপূজা বিপথগামী মানুষের আদি প্রবণতা। যারা আসমানি কিতাবের খোঁজ রাখেন, অন্তত সংস্করণের পর সংস্করণ বানিয়ে যে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট প্রচার করা হয়Ñ তাতেও একত্ববাদের মূল সুরটা যে ধরা পড়ে তা বুঝতে সক্ষম হবেন। হজরত আদম আ: থেকে সর্বশেষ নবী একত্ববাদের অভিন্ন বক্তব্য শুনিয়েছেন। এ বক্তব্য কুরআনও সত্যায়িত করেছে। নবী-রাসূলের অনুপস্থিতিতে মানুষ আদি স্বভাব বা প্রবণতায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাই নিষ্ঠার সাথে যারা ধর্মের নামে অনাচার, বিকৃতি, বকধার্মিকতা, অধর্ম ও ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন Ñ তারা সবাই মূলত ধর্মকে আক্রমণ করতে চান না। তারা ধর্মের নামে কুসংস্কার ও অনাচার রুখে দিতে চান। যদিও কেউ কেউ এসবের বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মের প্রতিপক্ষে দাঁড়ান। একজন সংস্কারক ধর্মের নামে কুসংস্কারকে সংস্কার করে মূলে প্রত্যাবর্তন করতে আহ্বান জানান। কিন্তু ধর্মের প্রতিপক্ষে দাঁড়ান না। এটাই সংস্কারক ও বিদ্বেষীর মধ্যে গুণগত একটি ফারাক।
আমরা জানি, ুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, প্রীতিলতা, সূর্যসেন, সুবাস বোস কেউ অধার্মিক ছিলেন না। তেমনি তীতুমির, সিরাজি, দুদু মিয়া, রজব আলী, মেহেরুল্লাহ এবং পুনর্জাগরণবাদী কোনো নেতা ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। শ্রী চৈতন্য, মজনু শাহ, লালন ফকিরসহ ভাববাদী আন্দোলনও ছিল মানবিক ও ধর্মাশ্রয়ী। নজরুল-রবীন্দ্রনাথরা ছিলেন ধর্মের ও মানবতাবাদের তূর্যবাদক। পারস্যের বিখ্যাত কবিরা, ইংরেজ মণীষীরা, আরব বিজ্ঞানীরা, গ্রিক দার্শনিকরা, ইউরোপীয় শাসকরা কেউ অধার্মিক ছিলেন না। তাই ধার্মিক মানুষের উত্থান কোনোভাবেই ভীতিকর নয়, প্রীতিময়। পৃথিবীর কোনো মহান শাসক, মহাকবি, মহাবীর, মহৎপ্রাণ মানুষ ও দার্শনিক নেই যিনি বা যারা যার যার ধর্মকে পরম শ্রদ্ধাভরে অনুসরণ করতে সচেষ্ট ছিলেন না। যারা অল্প জানেন, তারা ধর্মের বিপক্ষে ম্যাকিয়াভেলি ও কাল মার্কস, লেনিন ও মাওকে দাঁড় করান। সময় ও বাস্তবতা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মানুষ তার সীমাবদ্ধতা জানে। জন্ম-মৃত্যুর বাগডোর তার হাতে নেই সেটাও বিশ্বাস করে। দুর্বিনীত হয়ে আকাশ ফুঁড়ে নিঃসীম নীলিমায় হারিয়ে যাওয়া কিংবা মাটি ভেদ করে পালিয়ে যাওয়া মানুষের সাধ্যাতীত এটাও স্বীকার করে। মানুষ নিজের রিজিক ও মান-মর্যাদার নিশ্চয়তা নিজে দিতে পারে না। পর মুহূর্তে কি ঘটবে তা জানে না। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী মানুষ হাতে অস্ত্র পেলে, অর্থ পেলে, ক্ষমতা পেলে, রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহারের সুযোগ মিললে কতটা ভয়ঙ্কর ও দাপুটে হয়ে মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক সেজে যায়, তার প্রমাণ এখন দেশজুড়ে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল বর্তমান সরকারের গায়ে অমোচনীয় কালির একটি অবৈধতার সিল লাগানো ছাড়া হয়তো অনেক বেশি কিছুই করতে পারেননি। তারপরও খালেদাভীতি শাসকদের কতই না বিগড়ে দিয়েছেন। সরকার খালেদা জিয়াকে মিটিং করতে দেয় না। কোণঠাসা করতে করতে তাকে ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেও শান্তি পাচ্ছে না। অথচ এই দাপুটে সরকার বর্তমান সময়ের কাছে কত অসহায়। কুরআন বলেছে, এত দুর্বিনীত সেজো না, সময় হলে তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হাত-পা তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফুলগাজী, গাজীপুর থেকে সাতক্ষীরা, কক্সবাজার থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আর কত উপমা টানলে এই বাস্তবতা মাথায় নেবেন, ধর্মের কল কি বাতাসে নড়ছে না!
দুই.
ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট এবং কুরআন পড়লে অসংখ্য নবী-রাসূলের কথা জানা যায়। বাইবেলে অসংখ্য নবীর নাম হিব্রু ও এরামাইক ভাষায় উচ্চারণ করে বলে অনেকেই বুঝতে পারেন না। সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ে মানুষ যে চিরায়ত ধর্মের অনুসারী তার প্রমাণও খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মের বাইরেও মানুষ নীতি-নৈতিকতার জন্যও যুগ যুগ ধরে নীতিনিষ্ঠদের কাছে ধরনা দিয়ে আসছে Ñ যেমন ইশপের গল্প পড়ে নীতি-নৈতিকতা জানা যায়। সক্রেটিস পড়লে নৈতিকতা জেগে ওঠে। বৌদ্ধ স্মরণে সংযমের পরাকাষ্ঠা কাকে বলে জানা সম্ভব। তলস্তয় পড়ে জানা যায় ধর্মের মাহাত্ম্য ও মানবতার জয়গান সম্পর্কে। এখনো ইহুদি-খ্রিষ্টান, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক মিলিয়ে পৃথিবীর নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ মানুষ ধর্মের অনুসারি। যে ধর্মেরই হোক ধর্মীয় তীর্থগুলো এখনো প্রশান্তির পীঠস্থান। তাই ধর্মীয় পুনর্জাগরণ ও উত্থানে এখনো আশা জাগে, মানবসভ্যতা ধ্বংস হওয়ার আগে সম্ভবত আরো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। মূল ধারার ইহুদিরা বিশ্বাস করে সত্যযুগ আবার ফিরে আসবেই। খ্রিষ্টানদের ধারণা হজরত ঈশা বা যিশুর নেতৃত্বে পুনর্জারণ অবশ্যম্ভাবী, মুসলমান বিশ্বাস করে হজরত ঈশাও আসবেন, ইমাম মেহেদিও একটি পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেবেন। তাই যেকোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের উত্থানে স্বপ্ন জাগে ভালো কিছু প্রত্যাশার। এ কারণেই প্রশ্ন তুলেছিলাম ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ধর্মপ্রাণ নরেন্দ্র মোদির উত্থান অভিশাপ না আশীর্বাদ। একই নিবন্ধে জবাব দিয়েছিলাম, মোদি প্রকৃত ধার্মিক হলে আশীর্বাদ। নইলে সমস্যার বিস্তৃতি ঘটবে ভারতে।
তিন.
নরেন্দ্র মোদি এখন দিল্লির মসনদে। নমো এখন অন্তত আগের মতো কারো কাছে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত শব্দ নয়। ভারতের মানুষের কাছে ভোটের মাধ্যমে অর্জিত একটি আদুরে নাম, একই সাথে প্রত্যাশার মাত্রায় ভালো লাগা ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি। এখনো নমোকে অনেকেই পছন্দ করেন না, কিন্তু তার কাছে প্রত্যাশা করেন প্রচুর। আবার কেউ কেউ বেশি পছন্দ করেন, তারা ভাবেন ভারত তো বটেই পড়শি গণমানুষ ও ধার্মিক মানুষের যোগ্য প্রতিনিধি হবেন তিনি। মোদি এখন ভারতবাসীর কথা বলেন, এক সময় শুধু হিন্দুত্ববাদের কথা বলতেন। এই একটি মাত্র কারণে মোদিকে যারা অপছন্দ করেন তাদের সাথে একমত পোষণ করা জরুরি নয়। একজন হিন্দু যদি আপন ধর্মে অনুরাগ দেখায় এবং হিন্দুত্ববাদ নিয়ে উৎসাহবোধ করেন, তাতে আমাদের বিরক্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ক’দিন আগের এক লেখায়ও উল্লেখ করেছি, আমাদের বিবেচনায় যেকোনো ধর্মেরই হোক ধার্মিক মাত্রই মানবিক, নীতিজ্ঞানসমৃদ্ধ এবং অন্য ধর্মের প্রতিও সমান আচরণে বিশ্বাসী মানুষ। কোনো যুগেই প্রকৃত ধার্মিক মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য উপকারী ছাড়া ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়নি। সাম্প্রদায়িকবিদ্বেষের বিকারগ্রস্ততা, ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, বকধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতা কোনো ধার্মিকের কাজ নয়। ধর্ম ব্যবসায় ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি আপনি আমি কেন, কেউ পছন্দ করেন না। এটা পছন্দ করার কোনো কারণও নেই। একজন ধার্মিক মানুষের কথা ভাবলে নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের কথা ভাবতে হয়। বাস্তবে মোদি কী পরিমাণ ধার্মিক, কতটা ধর্মান্ধ সেটা প্রমাণ করার দিন গণনা শুরু হলো মাত্র। সেই প্রমাণের পরীক্ষায় নরেন্দ্র মোদি কতটা উত্তীর্ণ হবেন তার ওপর নির্ভর করবে তার ক্ষমতার ভবিষ্যৎ। তার ধর্মপ্রীতির আসল রূপটাও এখন প্রতিফলিত হবে। আগেও মন্তব্য করেছি, অতীত তার অনুকূলে নেই। ভবিষ্যতের পথ রচনা করতে হবে তাকেই।
মোদির হার-জিত নিয়ে জরিপগুলোই বেশি বাস্তবতা পেয়েছে। এখন বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে যোগ-বিয়োগ করে দেখার প্রহর গোনা শুরু হলো মাত্র। কেউ ভাবছেন মোদি ধর্মীয় নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার কারণেই উতরে যাবেন। কারো ভাবনায় তিনি মডারেট হতে বাধ্য হবেন। আরেকটা বিশ্লেষণ হচ্ছে, মোদির ধর্মীয় ক্রেজ নয়, অপশাসন ও দুঃশাসনের কারণে কংগ্রেস আর ক্ষমতায় আসা উচিত নয় ভেবেই মোদির প্রতি ভারতীয় জনগণের ঐতিহাসিক রায় এসেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের মুক্তবুদ্ধির লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ মনে করেন, কংগ্রেস সরকারের বাংলাদেশ নীতি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা আরো মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা-গণতন্ত্রকামী ও ধার্মিক মানুষদের অভিশাপ রয়েছে কংগ্রেস সরকারের দ্বৈত ও বৈষম্যমূলক নীতির প্রতি। তাই মোদির উত্থান কতটা কাম্য ছিল, তারচেয়ে বড় কথা ছিল কংগ্রেস নিপাত যাক। বিষয়টি যে মোটেও ভারত বিরোধিতা বা বিদ্বেষ ছিল না তাও বিবেচনায় রাখার মতো বিষয়।
নরেন্দ্র মোদি, আদভানি, বাজপেয়িরা অখ্যাত কোনো মানুষ নন, আবার সর্বজনগ্রহণযোগ্য ধর্মাবতারও কেউ নন, কিন্তু তারা রাজনীতিবিদ কিন্তু নিজের ধর্ম বিশ্বাসে অকপট। এটা অনেক মানুষ বিবেচনায় নিয়েছে। তারওপর রাহুল-সোনিয়ার স্ববিরোধী ও অর্বাচীন রাজনীতি ও দ্বিমুখী আচরণের পুরোটা ক্যাশ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। যতটা উত্তরাধিকার রাজনীতির বর্ণাঢ্য অতীত নিয়ে রাহুল গান্ধী রাজনীতি করছেন, তারচেয়ে সাধারণ দোকানির ঘরে জন্ম নেয়া হাজার গুণ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মোদি ভারতীয় রাজনীতির দিকপাল হয়ে উঠতে জনগণকে আস্বস্ত করতে পেরেছেন বেশি।
সনাতন ধর্মে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান দেয়নি। তবে জীবনকে সাংস্কৃতিক অবয়বে ধর্মাশ্রয়ী করেছে। তাই ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলা সম্ভব। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে সঙ্ঘ পরিবার এ কারণেই কখনো একেবারে অপাঙ্ক্তেয় ছিল না। এখনো নয়। তেমনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে হিন্দি হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদ কখনো অনুপস্থিত ছিল না। এখনো নেই। কংগ্রেস যা লুকিয়ে বলে ও করে, বিজেপি সেটা প্রকাশ্যে বলে এবং বাস্তবায়ন করতে চায়। ভারতীয় জনগণ বর্ণচোরাদের চেয়ে প্রকাশ্য ধার্মিকদের অকপট ভেবেছে। তাই মোদি জোয়ার বা হাওয়ায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও বিজেপিকে উতরে দিয়েছে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভারত আপন অস্তিত্বের স্বার্থেই আঁকড়ে ধরতে চায়, কারণ হিন্দি ও হিন্দুত্ববাদ হিন্দুস্তানকে এক রাখার একমাত্র উপায়। বর্ণবাদ, আর্য-দাক্ষিণাত্য ব্যবধান ও জাতপাত ঘুচিয়ে এক ভারত ইউনিয়ন অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশকে গণতন্ত্রশূন্য করা হয়েছে। ধার্মিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি উপড়ে ফেলার চেষ্টা চলেছে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। নির্বাচন অর্থহীন। সংবিধান অকার্যকর। আইন-আদালত প্রশ্নবিদ্ধ। তাই বাংলাদেশের মানুষ এবার অনেক বেশি মাত্রায় ভারতের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে নিজেদের শূন্যতা ঘুচাতে। বাংলাদেশের মানুষ দেখল, কংগ্রেস শাসনে সীমান্ত হত্যা কমেনি, বেড়েছে; পানির ন্যায্য হিস্যা মেলেনি উপরন্তু বাংলাদেশ প্রতারিত হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় হয়নি। কংগ্রেস দৃঢ়তা দেখায়নি বলে সব সমস্যা ঝুলে আছে। তা ছাড়া কোনো ন্যায্য হিস্যা না দিয়েই ভারত করিডোর-ট্রানজিট, বন্দর সুযোগ পেতে বারবার চাপ সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস শাসনে ভারতীয় অহমিকার কারণে সীমান্ত বিরোধ মেটেনি বরং ঢাকার ওপর আধিপত্য বেড়েছে। ঢাকা থেকে আইএসআইয়ের সাথে জড়িত অভিযোগ তুলে ভারতীয় গোয়েন্দারা লোক তুলে নিয়ে গেছে। এভাবে আমাদের সরকার, জনগণ ও রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য বিস্তারের পরও সার্বভৌমত্ব কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি! তার ওপর অসম বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। নানাভাবে ভারতীয়রা বাংলাদেশে নিয়ম না মেনেই চাকরি করছে, বাণিজ্য করছে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেতন-ভাতার নামে পাচার করছে। বাংলাদেশ এখন সোনা, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ভারতের স্বার্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব ব্যাপারে কংগ্রেস সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ তারা প্রতিশ্রুতি পূরণে কোনো নজির রাখেনি। অধিকন্তু ঢাকায় ভারতীয় দূতরা ভাইসরয়ের মতো আচরণ করতে চেয়েছে, যা জনগণ পছন্দ করেনি। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশীদের কাছে কংগ্রেস যেমন নমস্য নয়, তেমনি বিজেপিও ঘৃণিত নয়!
১৯৮০-তে জন্ম নেয়া বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক শাখা এ কথাটি কারো অজানা নেই। আরএসএসকে প্রেরণার উৎস ধরেই বিজেপির জন্ম। এসব ইতিহাসের সাথে কংগ্রেসের সম্পর্কও প্রত্যক্ষ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাজনীতিতে কংগ্রেস ও বিজেপির অবস্থান দৃশ্যত বিপরীতধর্মী, কার্যত গুণগত তফাত কম। যারা ভাবছেন বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বলে ভারত পাল্টে যাবে, তারা ভারতীয় রাজনীতির মূল সূত্রটা মাথায় না নিয়েই ভাবছেন। এবারো ভোট ব্যাংকের রাজনীতিতে ও ধর্ম ব্যবসায় কংগ্রেস বিজেপির চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। অন্তত ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কাছে বিজেপি এখনো আনকোরা। তবে ভোটের জন্য বিজেপি যে অনেক ছাড় দিয়েছে তাতো মিথ্যে নয়। বিজেপি ইন্ডিয়ান ডকট্রিনের সাথে হিন্দুত্ববাদের মেলবন্ধনের নামে এক ধরনের ভারতীয় রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে ইন্ডিয়ান ডকট্রিনের ককটেল বানিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের একটা আবহ সৃষ্টি করে রাজনীতি ও ক্ষমতা চর্চা করে আসছে। পূর্বাপর ভারত বর্ণপ্রথার জাত, পাত ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রজনন কেন্দ্র। এটা হিন্দুত্ববাদ ও দেশ বিভাগের ফসল কি না জানি না, তবে এটা যে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের নোংরা রাজনীতির উদর থেকে জন্ম নেয়া সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তা নিশ্চিত। এর সাথে আসল ধার্মিক ও ধর্মের সম্পর্ক গৌণ। মুসলমান, শিখ, নমঃশূদ্র বা হরিজনেরা সব যুগেই বঞ্চিত। কাশ্মির প্রশ্নে কংগ্রেস কখনো ধোয়া তুলসী নয়। বেশি রক্ত কংগ্রেসের হাতেই লেপ্টে আছে। এখন সবাই দেখতে চাইবে কাশ্মির, সাতবোন, শিখ সম্প্রদায়, মাওবাদী, মুসলিম ও হরিজন প্রশ্নে কংগ্রেস ও বিজেপির অবস্থান একই সমতলে কি না।
ভারতীয় রাজনীতি ভালো-মন্দ সবটুকু ভারতীয়দের। তবে আমরা অভিন্ন অনেক ইতিহাসের উত্তরাধিকার। তদুপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় জীবনকে ও ভারতীয় বান্ধবনীতির বাস্তবতাকে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে শিখিয়েছে। সেই সাথে আমাদের জনগণকে অনেক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখিও করেছে ভারতের শাসকেরা।
দিল্লির মসনদে রদবদল বাস্তবে দিল্লির রাজনীতি, সাউথ ব্লকের কূটনীতি, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাববলয় বৃদ্ধির নীতিতে তেমন কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটছে না। তবে মোদির সরকারকে পাক-ভারত উত্তেজনা প্রশমন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জমাট বাঁধা বরফ গলানো ও পড়শি নীতিতে ভারসাম্য আনতেই হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত হয়তো অন্যভাবে প্রভাবক হতে চাইবে। এর মুখ্য কারণ ভারতের বিদেশ নীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা প্রতিবেশীদের বেলায় রয়েছে সেটা রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। অর্থনৈতিক কূটনীতি ও বিশ্বজুড়ে প্রভাব বলয় বাড়ানোর জন্য বিজেপি ও কংগ্রেস একই সমতলে অবস্থান নিচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব কমানো, বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতির দিকে বেশি নজর দিলেও সেখানে বাহ্যত গুণগত তফাত বেশি চোখে পড়বে না। আমাদের বিদেশীনীতি ভারসাম্যহীন করেছে আওয়ামী লীগ, এটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেই শুধু পরিস্থিতি পাল্টাবে। কারণ ভারতীয় কংগ্রেস সরকার জনগণের সাথে নয়, কংগ্রেস পরিবারের সাথে আওয়ামী লীগ পরিবারের দেশ ভাবনার ঊর্ধ্বে যে সখ্য, ভারত সেটাকে অপব্যবহার করেছে। ক্ষমতার স্বার্থে দলকানা কূটনীতি জনগণের ওপর ভীষণ রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ কারণেই আমাদের জনগণের ক্ষোভটা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের ক্ষোভ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্বেষে রূপ নিয়েছে। এটা ভারতীয় জনগণকে দুষবার বিষয় নয়, শাসকদের বিবেচনায় নেয়ার বিষয়।
বাংলাদেশের জনগণ দেখল, ভারত নিজ দেশে গণতন্ত্র চর্চা করল। বাংলাদেশের জন্য অনুমোদন দিলো স্বৈরতন্ত্র। কংগ্রেস নিজ দেশের জন্য অবারিত বিদেশনীতি অনুসরণ করল, বাংলাদেশকে প্রেসক্রিপশন দিলো একঘরে থাকার। নিজেরা মুক্তবাজার অর্থনীতি চর্চা করতে মরিয়া ওয়ে উঠল, আমাদের জন্য আরোপ করল ভারতনির্ভরতার একচেটিয়া আধিপত্য নীতি। ভারত নিজ দেশের সংবিধানচর্চা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা, নির্বাচন কমিশনের স্বাতন্ত্র্য ও প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষায় নিষ্ঠা প্রদর্শন করল, আর বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক শাসন-শোষণে নৈরাজ্যের উসকানি দিয়ে পঙ্কজ শরণরা তাল-বেতাল কত কথাই না শোনাল। সুজাতা সিংরা আমাদের কী মন্ত্র শোনাল তা কি বিস্মৃত হওয়ার মতো! বিজেপি সরকার হয়তো এসব মাথায় রেখেই পথ চলবে। সে কারণেই পরিস্থিতির পরিবর্তন কিছুটা হলেও সম্ভব হবে বলে মনে করা যায়।
বিজেপি এখন ক্ষমতায়, তারা ধার্মিক না ধর্মান্ধ সেটি ভারতের জনগণ দেখবে। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো এলার্জি নেই; বরং সব ধর্মের ধার্মিক মানুষের প্রতি মমত্ববোধ রয়েছে। ধর্মপন্থী দল হিসেবে বিজেপি ক্ষমতায় বসার কারণে ভারত ও বাংলাদেশের ধর্মবিদ্বেষী অশুদ্ধ ও অচ্যুত সুবিধাবাদী বাম রাজনীতিবিদদের বিকারগ্রস্ততার কারণ ঘটলেও জনগণের কোনো মতিভ্রম ঘটেনি।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর যাদের যত সব ঘৃণা তারাই বিগড়ে গেছে। কংগ্রেস-বিজেপি ভারতীয় রাজনৈতিক দল, তারতম্য করার এখতিয়ারও ভারতীয় জনগণের। আমরা নিরাপদ পড়শি ও বন্ধুভাবাপন্ন স্থিতিশীল ভারত দেখতে চাইব। আমাদের সব ধরনের বিশ্বাস যেমন আমাদের নিজস্ব। সেটি পাল্টানো-না-পাল্টানোর এখতিয়ারও আমাদের জনগণের। জোর দিয়ে বলব মানুষ বিশ্বাস পাল্টাতে পারে, কিন্তু ইচ্ছা করলেই কোনো দেশ প্রতিবেশী পাল্টাতে পারে না। ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বুঝাপড়ায় ভারতবাসীর শুভকামনা ও একটি নিরাপদ সংবেদনশীল প্রতিবেশী পাওয়ার প্রত্যাশা ছাড়া দিল্লির নতুন সরকারের কাছে আমাদের বড় কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকার কথা নয়।
[email protected]