October 1, 2025
শহীদ জিয়ার ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে, যাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। তার অপরাধ, তিনি দেশকে বুক উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন দেশের মাটি ও মানুষকে। অপরাধ, তিনি জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে নিশ্চিত করতে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জাতিকে একটি মর্যাদাবান ও গৌরবোজ্জ্বল সোপানে পেঁৗছে দিতে চেয়েছিলেন। ৩৩ বছর আগে ঠিক আজকের এই দিনে ঘাতকরা ঘৃণ্য এই সিংহমানবকে স্টেনের একঝাঁক বুলেটের গুলিতে স্তব্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য দুর্বল ও পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। তারা জাতির সম্মান ও গৌরবকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। জাতিকে এক নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল।
জিয়া সম্বন্ধে কোনো বলাই যথেষ্ট নয়। জিয়া একটি ইতিহাস। জিয়া একটি প্রতিষ্ঠান। জিয়া একটি বৈপ্লবিক চেতনা। জিয়া একটি রাজনৈতিক দর্শন। আজ জিয়া সম্বন্ধে দুটো কথা বলতে গিয়ে প্রথমে সৈনিক জিয়ার কথা বলতে চাই। আমরা দেখেছি, ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে লাহোর সীমান্তের খেমকারান সেক্টরে প্রচণ্ড যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফলের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ্য অনেকখানি নির্ভর করছে। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি যুদ্ধরত ডিভিশনের ইউনিট প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। এটি ছিল অধিকাংশ বাঙালি সৈনিক ও অফিসার নিয়ে গঠিত। এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়কও ছিলেন একজন বাঙালি। প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রচণ্ড সাহসিকতার সঙ্গে জীবন-মরণ সংকল্প নিয়ে চরম রণদক্ষতা প্রদর্শন করে সেই সেক্টরে ভারতের আগ্রাসনকে ঠেকিয়ে দেয়। গোটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে রেজিমেন্টের কৃতিত্ব কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন জিয়া এই রেজিমেন্টের (১ম ইস্টবেঙ্গল) ছিলেন কোম্পানি অধিনায়ক। তার কোম্পানি এই কৃতিত্বের এক বড় দাবিদার।
এর পর ১৯৭১। ক্যাপ্টেন জিয়া থেকে মেজর জিয়া। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের বাংলাদেশ। গোটা দেশে টানটান উত্তেজনা। চারদিকে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের আগুন। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্পৃৃহায় পাগলপারা। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী জ্বালাও-পোড়াও আর গণহত্যায় মত্ত। মানুষ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা। নেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা। নেই স্থির কোনো লক্ষ্য, বিশদ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা। এমনি এক চরম সংকটময় মুহূর্তে নেতৃত্বের এক মহাশূন্যতায় ইথারে ভেসে এলো, ‘… আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি…’। তিনি গোটা জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না; তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, ফোর্স সংগঠিত করলেন, যুদ্ধাস্ত্র ও রণসম্ভার সংগ্রহ করলেন এবং প্রচণ্ড সাহসিকতায় যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। দেশকে স্বাধীন করতে এক বড় ভূমিকা রাখলেন।
সৈনিক জিয়া মহান। বৃহত্তর ক্যানভাসে জাতীয় পরিসরে রাষ্ট্রনায়ক জিয়া আরও অনেক মহান। মহত্ত্বর। ১৯৭৫-এ এক মহাঅস্থিরতার মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। জাতির ভাগ্যাকাশে অনেক দুর্যোগ নেমে আসে। রাষ্ট্রব্যবস্থা চরম সংকটাপন্ন। জাতি হারায় মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘটনার ক্রমবিবর্তনে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি জাতীয় অঙ্গনে অনেক উদ্বিগ্নতা, অনিশ্চয়তা। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান ঘটে। আর এরই উত্তাল তরঙ্গমালার চূড়ায় আরোহণ করে জাতির সেই মহাশূন্যতায় জেনারেল জিয়া উঠে আসেন জাতির শীর্ষ নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে।
জিয়া গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তার ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন এক ভিশনারি, এক স্বপ্নদ্রষ্টা। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। নজরুলও সৈনিক ছিলেন। নজরুল লিখেছেন, উন্নত মম শির!/ শির নেহারি’ আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির। জিয়া বিশ্বাস করতেন, জাতীয় কবির এ মহান অভিব্যক্তি বাঙালি জাতির সব মানুষের জন্য, গোটা বাংলাদেশের জন্য। নিজের দুই শক্ত পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বসভায় হিমালয়ের উচ্চতায় দৃশ্যমান থাকবে বাংলাদেশের শির। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব; সেই মুক্তিযুদ্ধের ব্রাকেটবন্দি দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন আর ভিয়েতনামের মতো।
জিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতার সময়কাল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত_ মাত্র পাঁচ বছর বা তার একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব বড় কাজ করে গেছেন। তার সঙ্গে আমি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই পাঠান সম্রাট শের শাহ্র অনেক মিল খুঁজে পাই। শের শাহ্র শাসনকাল ছিল এমনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জনকল্যাণে সাধারণ মানুষের মঙ্গলে তার কীর্তিগুলো ছিল যেমন অভিনব তেমনি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা আজও তার দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে, প্রতিটি বিষয়ে একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয় সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা তখন জাতি। তিনি তাকে তার সত্যিকারের পরিচয়, তার লুপ্ত বিস্মৃত স্বকীয়তার মহান পরিচিতি উন্মোচন করে দিতে পেরেছিলেন। আর সে পরিচিতি বাংলাদেশের আবহমানকালের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি ঘটিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তার মন-মনন। তার চেতনা ও রাজনৈতিক দর্শন।
জিয়ার এক বড় অবদান তার রচিত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। নতজানু নয়, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বকে চিৎকার করে বলা_ আমি যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। আমি এক স্বাধীন জাতি। আমি শৃঙ্খল ভেঙেছি। আমি স্বাধীন হয়ে জন্মেছি। আমি শৃঙ্খলমুক্ত। আমি নতজানু হতে জানি না। জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তার দূরদৃষ্টি, তার বৈপ্লবিক চেতনা, বিশ্বাস ও স্বাধীনচেতা দৃঢ় চরিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মহান গণচীনসহ কয়েকটি বড় দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়া সস্ত্রীক গণচীন সফর করেন। আমি বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে মাত্র যোগদান করেছি। জেনারেল জিয়াকে চীনা সরকার, চীনা জনগণ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়। বিপুলভাবে সম্মানিত করে। তিনি যখন যেখানে গেছেন, সীমাহীন মানুষের ভিড়। রাস্তার দু’ধারে ফুল হাতে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মংচিয়ালা মংচিয়ালা (বাংলাদেশ বাংলাদেশ) বলে চিৎকার করছে আর হাত নাড়ছে। তখন এক গর্বভরা বিচিত্র অনুভূতি আমার। মাও সে তুংয়ের তিরোধানের পর তখন চীনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান হুয়া কুয় ফেং। আমার সুযোগ হয়েছিল শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত থাকার। আমি হুয়া কুয় ফেংকে উচ্ছ্বসিতভাবে জেনারেল জিয়ার প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের পূর্ণ সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস তিনি ব্যক্ত করেন। আমার মনে পড়ে একটি হৃদয়গ্রাহী সফল সফর শেষে বেইজিং পুরনো বিমানবন্দরে (নতুন বিমানবন্দর তখনও নির্মিত হয়নি) বাংলাদেশ বিমানের এয়ার ক্রাফটে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি যখন আরোহণ করতে যাচ্ছেন, সামরিক আনুষ্ঠানিক পোশাকসজ্জিত আমি, একটি চৌকস স্যালুট করি। তিনি হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য। আমার হাতে শক্ত করে চাপ দিলেন। বেইজিং বিমানবন্দরের টারম্যাকে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির সেই করমর্দনের স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ÔMahbub, I am leaving, you will be here. China is our friend. China is a great country. Develop our relations, promote the friendship. Remember this is the country to which we look forward, this is the country in which we can fully trust.’ কে জানত জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেই হবে আমার শেষ সাক্ষাৎ। তার বিদায়বেলার কথাগুলো এখনও আমি শুনতে পাই। আমার কানে অনুরণিত হয়।
তখনও আমি বেইজিংয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরবেলায় আমার বাসার টেলিফোনটি অনবরত বেজে চলছিল। এত ভোরে কখনও কেউ কল দেয় না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঢাকা থেকে হবে হয়তো কোনো দুঃসংবাদ। রিসিভার তুলতেই চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল সু চুইন ফিং-এর পরিচিত গলা। ‘আপনি কি জানেন আপনাদের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে আজ গভীর রাতে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়েছে? কারা করেছে? কেন করেছে? তিনি আমাদের একজন খাঁটি বন্ধু ছিলেন…।’ আমি স্তম্ভিত। আমি বাকরুদ্ধ। আমি তড়িতাহত। কর্নেল সু ওদিক থেকে বলে চলেছেন, ‘ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি আমাকে শুনছেন?’ আমি নিশ্চুপ। আমি হতবাক। আমি নিথর।