পৃথিবীকে জেনে নিন আপনার ভাষায়….24 Hrs Online Newspaper

নূর হোসেন এখন কোথায়?

Posted on May 31, 2014 | in রাজনীতি | by

untitled-63_56263_0ঢাকা : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত অপহরণ ও হত্যার প্রধান আসামি নূর হোসেনের অবস্থান নিয়ে প্রতিদিনই নানা ধরনের গুজব রটছে। ‘ডেঞ্জার ম্যান’ খ্যাত নূর হোসেন এখন কোথায়, সবারই প্রশ্ন। কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট জবাব বা তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ কারো কাছেই নেই। ঘটনার পর থেকেই পলাতক তিনি। খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দারা। ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, এডভোকেট চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। এর তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উল্লেখ্য সাত খুনের ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে নূর হোসেনকে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড-এর এই ক্ষমতাধর কাউন্সিলরকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানারকম গল্প। দেশের প্রতিটি মানুষের জিজ্ঞাসা নূর হোসেন এখন কোথায়? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় এক মাস অতিক্রম হতে চললেও নূর হোসেনের কোন হদিস করতে পারেনি, তাহলে কি আইন-শ্ঙ্খৃলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে নূর হোসেন?

কোথায় আছে নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের ঘটনার পর পরই নূর হোসেন পলাতক রয়েছে। শুরুতে না হলেও কিছু পরে তাকে খুঁজতে মাঠে নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার খোঁজ মিলাতে পারেনি তারা। অনেকেই দাবি করছে নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গেছে। এমনকি নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, নূর হোসেনকে কলকাতায় পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহা-পরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান। র‌্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, আলোচিত সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। ঘটনার তিনদিন পর তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সব রহস্য উন্মোচিত হবে। এছাড়া নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরপরই শহিদুল ইসলাম র‌্যাবকে জড়িয়ে এই বক্তব্য দেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, র‌্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানই নূর হোসেনকে কলকাতায় পার করে দিয়েছেন। সেখানে তার ‘রাধা’ নামে এক স্ত্রী রয়েছে। ভারতে গিয়ে সে তার নাম পরিবর্তন করে ‘গোপাল’ রেখেছে। ‘গোপাল’ নাম ব্যবহার করে সে একটি পাসপোর্টও নিয়েছে। ভারতে তার নিজস্ব বাড়িও রয়েছে বলে নারায়ণগঞ্জে গুঞ্জন রয়েছে। নূর হোসেনকে গ্রেফতারের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন শীর্ষ কাগজকে জানান, তাকে গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। সে যেখানেই থাকুক তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। তার অবস্থান নিয়ে কোন তথ্য পুলিশের কাছে আছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ বিভিন্ন কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা আশা করি, শিগগিরই তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হব।

নূর হোসেনের ৬ স্ত্রী নূর হোসেনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার নেতিবাচক চারিত্রিক পরিচয়ও প্রকাশ পেয়েছে। একাধিক নারীর সঙ্গে তার বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় রয়েছে মুখরোচক গল্প। এলাকাবাসীর ভাষ্য মতে, নূর হোসেন এ পর্যন্ত ছয়টি বিয়ে করেছে। এর মধ্যে প্রথম স্ত্রী লিলির বাড়ি ঢাকার মিল ব্যারাক এলাকায়। সে এখন নূরের সংসারে নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী লিপির বাড়ি নারায়ণগঞ্জের খানপুরে। তার সংসারে বিপ্লব নামের এক ছেলে ছিল। কলেজপড়ুয়া এ ছেলে বাবার (নূর হোসেনের) স্থাপিত মদের দোকান থেকে অত্যাধিক মদ পান করায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়েও তাকে ফেরানো সম্ভব হয়নি। মদ পান করতে করতেই কয়েক দিন আগে করুণভাবে তার মৃত্যু হয়। তৃতীয় স্ত্রী পারুলের বাড়ি ডেমরার সারুলিয়ায়। সেও এখন নূরের সংসারে নেই। চতুর্থ স্ত্রী কাঁচপুরের রুমা। তার সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। রুমার সঙ্গেই সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে বসবাস করতো নূর। সাত অপহরণ ও খুনের মামলার পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পলাতক আছে নূর হোসেন। পঞ্চম স্ত্রী রাধার বাড়ি ভারতের কলকাতার সদর স্ট্রিটে। ২০০১ থেকে প্রায় ছয় বছর ভারতে পালিয়ে থাকার সময় গোপাল নাম ধারণ করে রাধাকে বিয়ে করে নূর হোসেন। অভিযোগ রয়েছে, সর্বশেষ সিটি করপোরেশনের অনিন্দ সুন্দরী ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদাউস নীলাকে জোর করে বিয়ে করেছিলো নূর হোসেন। যদিও নীলা বিয়ের কথা স্বীকার করেননি। ইতিমধ্যে নীলাকে আটক করে আবার ছেড়েও দেয় পুলিশ।

নূর হোসেনের রাজনৈতিক উত্থান

নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রাকের সহকারী (হেলপার) হিসেবে জীবন শুরু করা নূর হোসেন পরে চালক হয়। ১৯৯২ সালের পর সে কৃষক লীগের সাবেক নেতা ও পরে বিএনপি’র সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যোগ দেয় বিএনপিতে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করে। এরপর সে সিদ্ধিরগঞ্জে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ ১৩টি মামলা হয়। বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন কাঁচপুর শাখার সভাপতিও হয়। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সে এলাকায় ছিলো না। ওই সময় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলো। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিসও পাঠানো হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের পর নূর হোসেন এলাকায় ফিরে আসে। গত বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়।

নূর হোসেনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

১৯৯১ থেকে ২০০০ পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে নূর হোসেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তার পরিচয় হয় হোসেন চেয়ারম্যান হিসেবে। ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালে এলাকার স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি, রাস্তায় ইট বিছানোর নামে পরিষদের তহবিল তসরুপ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য বরাদ্দ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতসহ নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এজন্য অন্তত অর্ধশতবার তদন্ত হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিতও হয়। তাতে অবশ্য কিছুই হয়নি নূর হোসেনের। সে সময় ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে তার অপসারণ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশও করেছে তদন্ত টিম। কিন্তু তাতেও ফলাফল শূন্য।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরই গা-ঢাকা দেয় হোসেন চেয়ারম্যান। দীর্ঘ চার বছর অনুপস্থিত থাকায় ২০০৫ সালে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ’র একটি সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে নূর হোসেনদের গড়ে তোলা বালু ও পাথরের ব্যবসা উচ্ছেদ করা হলেও নবম সংসদ নির্বাচনের পর আবারও নদী দখল করে এ ব্যবসা চালু করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যার তীর অবৈধভাবে দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা গড়ে তোলার অভিযোগে নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ২০১০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেছিলেন। বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের পোর্ট কর্মকর্তা। মামলায় সরকারি কাজে বাধাদান, কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়া এবং নদী তীরের প্রায় ৮০০ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগ আনা হয়। বিগত কয়েক বছরে ওই দখল উচ্ছেদে আট-দশবার অভিযান চালানো হয়। মামলার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ২২টি চিঠি দেওয়া হয়।

এছাড়‍াও অভিযোগ রয়েছে, সিদ্ধিরগঞ্জে সিটি করপোরেশনের ট্রাক টার্মিনালে এক বছরের বেশি সময় ধরে মেলার নামে চলেছে অশ্লীল নৃত্য ও জুয়ার আসর। মেলায় অবাধে মাদকও বিক্রি হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর নূর হোসেনকে এ মেলা বন্ধ করতে গত ১৬ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল মজুমদার চিঠি দিলেও মেলা বন্ধ হয়নি।
এদিকে নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কি করেনি নূর হোসেন? পুরো সিটি করপোরেশনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, বালির ব্যবসা, পরিবহনে চাঁদাবাজি সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এগুলো অবশ্য নূর হোসেন একা করেনি, তার পেছনে ছিল সিনিয়র কয়েকজন নেতার আশীর্বাদ ও প্রশাসনের পরোক্ষ সহায়তা।

তিনি বলেন, তার হাত থেকে রেহাই পাননি তার নিজ দলের নেতারাও। তার কথার বাইরে যে কেউ কাজ করতে গেছেন তাকেই বিপদে পড়তে হয়েছে। পরে নূর হোসেনের সঙ্গে আপোষ করেই সেই কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। তিনি আরো বলেন, নারায়ণগঞ্জে চুনের ফ্যাক্টরি রয়েছে ২২টি। এ ২২টি ফ্যাক্টরি থেকে প্রতিমাসে দুই লাখ টাকা এবং নদীর পাড়ে ৫০/৬০টি পাথরের বালির টেক থেকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকা করে চাঁদা নিত নূর হোসেন।

আওয়ামী লীগের ‘ত্যাগী নেতা’

২০০৯ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের স্বাক্ষরিত ‘অতি জরুরি’ লেখা একটি চিঠি দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। আর চিঠির অনুলিপি বিতরণ করা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে।

ওই চিঠিতে নূর হোসেন চেয়ারম্যানকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক ত্যাগী নেতা হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে, সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাকে চেয়ারম্যানের পদ  থেকে অপসারণ করে। সে যাতে আইনের আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়। এ চিঠিটির পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় নূর হোসেন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের গ্রেফতারি পরোয়ানা। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য কায়সার হাসনাতের জোর আপত্তিতে এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের বাধায় শেষ পর্যন্ত তাকে পৌর প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর

আজকের ছবি

www.facebook.com

Tag Cloud