December 6, 2024
ডেস্ক রিপোর্ট : পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুজনের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।
পাঁচ বছর আগের আলোচিত এ মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেছিলেন, তারা হাই কোর্টে খালাস পেয়েছেন।
পলাতক থাকা বাকি ১১ জনের বিষয়ে হাই কোর্টের রায়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আগের সাজাই বহাল থাকছে।
এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যৃদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের রায়ের শুনানি করে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এ রায় দেয়।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনার খবর ও ছবি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। আসামিরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মী হওয়ায় সরকারকে সে সময় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “বর্তমানে ছাত্রনেতারা হলের রুম পর্যন্ত ভাড়া দেয়। তারা দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।”
রায়ে বলা হয়, “এটা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড না হলেও আসামিদের সম্মিলিত হামলার ফলেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।”
কিন্তু সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ‘গাফিলতির’ কারণে নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা হাই কোর্টে এসে কমে গেছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে আঘাতের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আসামিদের জবানবন্দি ও সাক্ষীদের বর্ণনার মিল পায়নি আদালত।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুজ্জামান জানান বলেন, বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল করার ক্ষেত্রে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হকের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না- তা তদন্ত করে আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আর ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষক মাকসুদুর রহমানের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই কোর্ট।
এই আদেশ ঠিকমত বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না- সে বিষয়ে মানবাধিকার বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে সময়ে সময়ে আদালতে জানাতে বলা হয়েছে।
‘তা কী করে হয়!’
রায়ের পর বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত কুমার দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কী যে দুঃখ পেয়েছি, তা বলার মতো না।”
“আটজন মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামির মধ্যে দুজন খালাস পেল! তা কী করে হয়,” প্রশ্ন রেখেছেন তার ভাই উত্তম কুমার দাস।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত তারা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখার পর নেবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পলাতক যে ১১ আসামির বিষয়ে হাই কোর্ট রায়ে কোনো মন্তব্য করেনি, গ্রেপ্তার হলে বা আত্মসমর্পণ করলে তাদের বিষয়ে পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।
অন্যদিকে হাই কোর্টের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত সাইফুল, কাইয়ুম এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শাকিলের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন,সাক্ষ্য-প্রমাণে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি বলেই আদালত সাইফুল ও কাইয়ুমকে খালাস দিয়েছে।
“এ মামলায় চাক্ষুস কোনো সাক্ষী নেই। ভিডিও ফুটেজের উপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া হয়েছে। রফিকুল ইসলাম শাকিল সেদিন বিশ্বজিৎকে ধাওয়া করেছিলেন। তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।”
খালাস পাওয়া মোস্তফার আইনজীবী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম সবুজ সাংবাদিকদের বলেন, “বিচারিক আদালত অন্য এক অভিযুক্তের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে যাবজজ্জীবন দিয়েছিল। হাই কোর্টে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। ফলে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে, আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি।”
বিচার পরিক্রমা
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জালাল আহমেদ।
তিন মাসের মধ্যে তদন্ত করে ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক তাজুল ইসলাম।
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. জহুরুল হক ৬ ফেব্রুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে সরকারের সিদ্ধান্তে ওই বছরজুলাই মাসে মামলাটি পাঠানো হয় দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে।
২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক যে রায় দেন, তাতে ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া বেআইনি সমাবেশের আরেকটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই ১৩ জনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ
“সামগ্রিকভাবে অপরাধের মাত্রা ও গভীরতা বিবেচনা করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করলে ন্যায়বিচার সমুন্নত হবে বলে এ ট্রাইব্যুনাল মনে করে।”
বিচারক বলেন, “রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল অবরোধের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নামধারী এই ছাত্ররা বিশ্বজিৎকে রক্তাক্ত জখম করায় মিটফোর্ড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কাজেই এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল অবরোধের ক্ষেত্রে আহ্বানকারী পক্ষ ও বিরোধীপক্ষকে গণতন্ত্র রক্ষা ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার জন্য গভীর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়া আশঙ্কা, জন সাধারণের শান্তিভঙ্গ বা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন না হয়।”
ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয় গত ১৬ মে। শুনানি শেষে গত ৭ জুলাই রায়ের দিন ঠিক করে দেয় আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আর আসামিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহজাহান, লুতফর রহমান মণ্ডল, সৈয়দ আলী মোকাররম, সৈয়দ শাহ আলম, মো. আব্দুস সালাম, মো. ইসা, সৈয়দ মাহমুদুল আহসান।
পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মোমতাজ বেগম।
যেভাবে হত্যা
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেস্বর গ্রামের তরুণ বিশ্বজিৎ পুরান ঢাকার শাখারী বাজারে একটি দরজি দোকানে কাজ করতেন। ঘটনার দিন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছ দিয়ে তিনি কাজে যাচ্ছিলেন।
মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দিতে বলা হয়, অবরোধের ওই দিন বাহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল যাওয়ার সময় বোমা বিস্ফোরণ হলে সবাই যখন পালাচ্ছিল, তখন পলায়নরত বিশ্বজিৎকে মিছিল থেকে ধাওয়া করে তার ওপর হামলা চালানো হয়।
সাক্ষী রিকশাচালক রিপন রায় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় বলেন, “বোমার শব্দে এক ব্যক্তি (বিশ্বজিৎ) পার্কসংলগ্ন পেট্রল পাম্পের দিকে দৌড় দেয়। ওই মিছিল থেকে ধাওয়া করে কয়েকজন ওই ব্যক্তিকে মারতে থাকে।
“ওই ব্যক্তি মার খেতে খেতে পাশের ভবনে উঠে যান। লোকগুলো সেখানেও তাকে চাপাতিসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মারতে থাকে। এরপর তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে নিচে নেমে শাঁখারীবাজারের গলির মুখে গিয়ে পড়ে যান। তখন ওই ব্যক্তি পানি চাইলে পাশের এক দোকানি পানি খাওয়ান।”
এরপর রিপনের রিকশায় মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্বজিৎকে, সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনাস্থলে থাকা পরিবহনকর্মী ইউসুফ বেপারী ও আব্দুর রাজ্জাক আদালতে আসামি রফিকুল ইসলাম শাকিলকে সনাক্ত করে বলেন, তারা তাকে চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কোপাতে দেখেছেন।
সমালোচনা, অনুপ্রবেশকারী ও ‘অবহেলা’
মামলার তদন্ত চলাকালে আসামি শাকিল, শাওন ও নাহিদ আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়, ঘটনার সময় শাকিলের হাতে চাপাতি ও রাজনের হাতে ড্যাগার ছিল। অন্যদের হাতে ছিল রড ও লাঠি।
শাকিলের জবানবন্দিতে বলা হয়, অন্যরা রড দিয়ে মারতে থাকলে বিশ্বজিত তার নাম বলে না মারার অনুরোধ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে রাজন ড্যাগার দিয়ে আঘাত করেন এবং শাকিল চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিতের হাত-পা, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপাতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিশ্বজিৎ লুটিয়ে পড়েন।
কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজিতের পিঠে ‘হালকা ফোলা জখম’, ডান বগলের নিচে তিন ইঞ্চি কাটা জখম এবং বাঁ হাঁটুর নিচে ছেঁড়া জখম ছিল।
আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজিতের ডান বগলের নিচে সাড়ে তিন ইঞ্চি চওড়া দেড় ইঞ্চি গভীর একটি ছুরিকাঘাতের জখম এবং বাঁ হাঁটুর জোড়ায় থেঁতলানো জখম ছিল। বগলের নিচে একটি বড় ধমনি কাটা যাওয়ায় বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে। শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো স্বাভাবিক ও ফ্যাকাশে ছিল, হৃৎপিণ্ডের দুটি প্রকোষ্ঠই ছিল রক্তশূন্য।
এছাড়া মামলার সাক্ষীরা বিশ্বজিতের ওপর হামলার যে বিবরণ দিয়েছেন, তার সঙ্গেও সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের পার্থক্য পেয়েছে হাই কোর্ট। এ কারণেই পুলিশ ও চিকিৎসকের গাফিলতি ছিল কি না, তা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।
বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের পর জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ছবি ও ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমালোচনায় মুখর হন বিরোধী দলের নেতারা।
এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী।
পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেন, “বিশ্বজিৎকে যারা হত্যা করেছে, তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়, তারা ছিল ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী।”
এদিকে পুলিশের তদন্তের মধ্যেই গণমাধ্যমে যাদের নাম ও ছবি আসছিল, তাদের একে একে বহিষ্কার করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পেছাতে বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল আসামিপক্ষের। মামলার কার্যক্রম স্থগিতে ছয় আসামির পক্ষে আবেদন করা হলে হাই কোর্ট সে সময় তা খারিজ করে দেয়।
মামলার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করায় আসামি পক্ষের আইনজীবী সৈয়দ শাহ আলমকে এক হাজার টাকা জমা দিতেও নির্দেশ দেয়া হয়।বিডিনিউজ২৪।